Monday, September 3, 2018

জ্ঞানপিপাসা - আরিফুল ইসলাম



ইমাম আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ)'র ঘরভর্তি বই ছিলো। ঘরের একটা কোণায় বসে তিনি পড়তেন। কেউ আসলে বসতে দেবার মতো জায়গা ছিলো না।

ইবনে জামা'আ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, "আমি যখন ইমাম নববী (রা.) কে দেখতে গেলাম তখন তার ঘরে বসার মতো কোনো জায়গা ছিলো না। তারপর তিনি চারপাশের কিছু বই সড়িয়ে বসার জন্য কিছু জায়গা করে দিলেন। আর যখন আমি বসলাম তখনও তিনি বইয়ের মধ্যে ডুবে ছিলেন।"

ইমাম আন-নববী (রাহি.) বলেন, তিনি এমন দুটো বছর কাটিয়েছেন যখন তাঁর পিঠ বিছানা বা মাটিতে স্পর্শ করেনি। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, তিনি ঘুমাতেন কিভাবে? তখন তিনি বললেন, তাঁর ঘুম আসলে তিনি বইয়ের উপর ঘুমিয়ে পড়তেন।

ইমাম মুহাম্মদ ইবন হাসান শায়বানী (রাহিমাহুল্লাহ) রাতে খুব অল্প সময় ঘুমাতেন। রাতে একটার পর একটা বই পড়ে যেতেন। ঘুম আসলে চোখে পানি ছিটিয়ে ঘুম দূর করতেন এবং বলতেন, "ঘুম তো উষ্ণতা থেকেই আসে তাই শীতলতার মাধ্যমেই তাকে প্রতিহত করতে হয়।"

ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) রাতে ঘুমাতেন, ঘুম ভেঙ্গে যাবার পর কোনো হাদীস মনে পড়লে তা লিখে রাখতেন। আবার ঘুমাতেন, আবার ঘুম ভাঙ্গার পর যা মনে পড়তো তা লিখে রাখতেন। ইবনে কাসির (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ইমাম বুখারী (রাহি.) রাতে গড়ে বিশবার ঘুম থেকে উঠতেন।

আবু বকর ইবনুল খাইয়্যাত (রাহিমাহুল্লাহ) ছিলেন আরবী ব্যাকরণ শাস্ত্রের ইমাম। রাস্তায় হাটার সময়ও তিনি বই পড়তেন। অনেক সময় এমন হতো, তিনি পড়তে পড়তে রাস্তার গর্তে পড়ে যেতেন। আবার কোনো কোনো সময় জন্তুর বাহনের সাথে ধাক্কা খেয়ে আহত হতেন।

লিসান আদ-দ্বীন ইবনুল খাতিব (রাহিমাহুল্লাহ) ছিলেন স্পেনের গ্রানাডার একজন আলেম। তাকে 'যুল উমরাইন' বা দুই জীবনের অধিকারী নামে ডাকা হতো। কারণ তিনি দিনের বেলা মামলা-মোকাদ্দমা নিয়ে থাকতেন, আর রাত কাটাতেন বই পড়ে।

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) পড়ালেখা করতেন অনেক এবং বিশ্রাম করতেন কম। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, (এতো পড়ালেখা করছেন) বিশ্রাম নিবেন কখন?
তিনি বলতেন, কবরে। কবরে গিয়ে তিনি বিশ্রাম নিবেন।

মাহমুদ আল আলূসী (রাহিমাহুল্লাহ) ছিলেন বাগদাদের গ্রান্ড মুফতি। তাঁর দিন অতিবাহিত হতো ফতওয়া ও দারস প্রদানে আর রাতের শেষাংশে তিনি তাফসীর সংকলন করতেন। এই অল্প সময়ে তিনি যা লিখতেন পরদিন সকালে তাঁর নিয়োগকৃত অনুলিপিকারিককে দিয়ে তা লিখাতেন। রাতের শেষাংশে লিখা তাঁর তাফসীরের অনুলিপি লিখতে অনুলিপিকারকের দশ ঘন্টারও বেশি সময় লাগতো।

খলিফা হারুন-আর-রশীদের দুই ছেলেকে পড়ানোর জন্য নিয়োগ করা হয় আল কিসাই (রাহিমাহুল্লাহ) কে। আল কিসাই (রাহি.) খলিফার ছেলেদ্বয়কে পড়াতে গেলে দরজার সামনে গিয়ে জুতা খুলতেন। তখন খলিফার দুই ছেলে দৌড়ে গিয়ে আল কিসাই'র (রাহি.) জুতা বহন করে নিয়ে আসতেন।
খলিফার নজরে বিষয়টা ধরা পড়ে। একদিন খলিফা আল কিসাইকে জিজ্ঞেস করলেন, এই সময়ে কে সর্বোত্তম?
আল কিসাই বললেন, খলিফা আপনি।
খলিফা হারুন-আর-রশিদ বললেন, "না! বরং ঐ ব্যক্তিই সর্বোত্তম যার জন্য খিলাফতের উত্তরাধিকারী ছুটে যায় তাঁর জুতা বহন করার জন্য (অর্থাৎ তিনি তাঁর নিজের ছেলেদের কথা বললেন, যারা আল কিসাই'র জুতা বহন করার জন্য ছুটে যায়)।"
ইমাম আশ-শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ) কে ইলম অর্জনের পেছনে কিভাবে ছুটতেন জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, "আমি ইলমের পেছনে এমনভাবে ছুটেছি যেরকমভাবে মা তার হারানো সন্তানকে খুঁজার জন্য ছুটে।"

সালাফদের জীবনী পড়লে তাদের ইলম অর্জনের আগ্রহ দেখলে মাঝেমাঝে বেশ অবাক হই। সময়কে তারা যেভাবে মূল্যায়ন করতেন সেটা ভাবার বিষয়।
ইসলাম জ্ঞানার্জনকে উৎসাহিত করেছে। একজন জ্ঞানী ব্যক্তি এবং একজন অজ্ঞ ব্যক্তি কখনো সমান হতে পারেনা।

একজন জ্ঞানী ব্যক্তির মর্যাদা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
"যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের জন্য কোন পথ অবলম্বন করে, আল্লাহ্‌ তার পরিবর্তে তাকে জান্নাতের পথসমূহের মধ্যে কোন একটি পথে পৌঁছে দেন। ফেরেশতারা জ্ঞান অন্বেষণকারীর সন্তুষ্টির জন্য নিজেদের ডানা বিছিয়ে দেন। জ্ঞানীর জন্য আসমান ও যমীনের যারা আছে তারা আল্লাহর নিকট ক্ষমা ও দু‘আ প্রার্থনা করে, এমনকি পানির গভীরে বসবাসকারী মাছও। আবেদ (সাধারণ ইবাদাতগুজারী) ব্যক্তির উপর ‘আলিমের ফাযীলাত হলো যেমন সমস্ত তারকার উপর পূর্ণিমার চাঁদের মর্যাদা। জ্ঞানীরা হলেন নাবীদের উত্তরসূরি। নাবীগণ কোন দীনার বা দিরহাম মীরাসরূপে রেখে যান না; তারা উত্তরাধিকার সূত্রে রেখে যান শুধু ইল্‌ম। সুতরাং যে ইল্‌ম অর্জন করেছে সে পূর্ণ অংশ গ্রহণ করেছে।"

সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৩৬৪১


No comments:

Post a Comment