Sunday, September 2, 2018

স্বামী-স্ত্রী হচ্ছে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের নিউক্লিয়াস - মুহাম্মাদ যুবায়ের



"আমি তো অমুকের চেয়ে বেশি কোয়ালাইফাইড, তাহলে কেন তার আনুগত্য করব"–এই চিন্তা একটা সর্বনেশে চিন্তা। ক্লাসের সেরা ছাত্রটিকেই সবসময় ক্যাপ্টেন বানানো হয় না। তখন তাকেও নিজের চেয়ে "কম ভালো" ছাত্রটির নির্দেশ মানতে হয়। এটাই ডিসিপ্লিন। আমরা জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নানা কমিউনিটি এবং প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পূর্ণতা লাভ করি। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ডিসিপ্লিন আছে, ডেকোরাম আছে। সেগুলো রক্ষা তখনই সম্ভব হবে যখন যাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সে সেটাকেই ফোকাস করে। আর এগুলোর মূলে থাকে নেতার আনুগত্য। আনুগত্য মানে দাসত্ব নয়। দাসত্ব হলো নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে নির্দেশ মানা, তা ঠিক হোক আর ভুলই হোক। আনুগত্য মানে ডিসিপ্লিনের স্বার্থে নিজের অহংবোধকে চাপা দেওয়া।
.
আমাদের দেশের মানুষ ক্রিকেট ভালো বোঝে, তাই ক্রিকেট দিয়েই উদাহরণ দিই। ক্রিকেট খেলায় এগারো জনের দলে একজনকে অধিনায়ক বানানো হয়। অধিনায়ক ম্যাচের সময় নানা ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নেয়। অধিনায়কের চেয়ে ভালো খেলোয়াড় ঐ দলে থাকতে পারে। কিন্তু তারপরও সে কয় নম্বরে ব্যাট করবে, কখন বল করবে, কোথায় ফিল্ডিং করবে–এসব ব্যাপারে অধিনায়কের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। সে যেটা পারে, সেটা হলো অধিনায়ককে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করা, অথবা সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করা। কিন্তু "সিদ্ধান্ত মানবো না"–এই গোঁ রেখে খেললে দলের স্বার্থেই তাকে বাদ দেওয়া হবে, যত বড় খেলোয়াড়ই সে হোক না কেন।
.
প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্রতম রূপ হলো পরিবার। ক্ষুদ্রতম হলেও এটাই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মানুষের জীবনে। পরিবারে একটাসময় পর্যন্ত মা-বাবার আনুগত্য করতে হয়। আসলে একটাসময় পর্যন্ত না, সবসময়ই এটা বিদ্যমান থাকে, অন্তত থাকা উচিত; তবু ছেলেমেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের সক্ষমতার সাথে সাথে সাধারণত এর প্রভাব ও রূপ বদলে যেতে থাকে। কোন ছেলে যদি বলে "আমি এসএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ, আর বাবা ম্যাট্রিকে সেকেন্ড ডিভিশন, বাবার কথা কেন শুনব", তাহলে সেই পরিবার ভাঙ্গা কেবল সময়ের ব্যাপার। পশ্চিমে ছেলেমেয়ের বয়স আঠারো হলে বাবা-মায়ের আর আইনত ক্ষমতা থাকে না সন্তানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। সেজন্য সেখানে ঐ বয়সের পর সন্তানেরা বাবা-মায়ের থাকে থাকতে চায় না। এটাই অবশ্যম্ভাবী। আনুগত্য না থাকলে প্রতিষ্ঠান থাকে না, থাকতে পারে না। যে প্রতিষ্ঠানে সবার সমান মর্যাদা, সবার সিদ্ধান্তের গুরুত্ব সমান, সে প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হতে ততটুকুই সময় লাগে যতটুকু সময় অসম্পৃক্ত লবণের দ্রবণে দ্রবের গলতে দরকার হয়।
.
স্বামী-স্ত্রী হচ্ছে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের নিউক্লিয়াস। এখানেও পার্লামেন্টের মতো আপার হাউস, লোয়ার হাউসের প্রয়োজন আছে। আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা স্বামীকে এখানে কর্তৃত্বের আসনটা দিয়েছেন। এই কর্তৃত্ব হচ্ছে অধিনায়কের মতো, মালিকের মতো না। স্ত্রী স্বামীর আনুগত্য করবে; এই আনুগত্য দাসত্ব না, দাসত্ব কেবল আল্লাহ্‌র জন্য। স্ত্রী তার বুদ্ধি দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে স্বামীকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে, প্রয়োজনে প্রভাবিত করবে। কিন্তু বিদ্রোহ করবে না। এখানে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কে বেশি কোয়ালিফাইড, সেটা বিবেচ্য না। কারণ কর্তৃত্বের সিদ্ধান্তটা আল্লাহ্‌ ঠিক করে দিয়েছেন। একজন মুসলিম নারীর পক্ষে শোভা পায় না এটাকে বৈষম্য মনে করার।
.
আল্লাহ্‌ কেন স্বামীকেই এই আসনটা দিলেন? এটা আল্লাহ্‌র হিকমাহ। তিনি মানুষের সাইকোলজি সবচেয়ে ভালো জানেন, তিনি জানেন এই কাজটা পুরুষের জন্য উপযুক্ত। কেন উপযুক্ত তা ভিন্ন আলোচনা, এই লেখার বিষয়বস্তু না।
.
পাশাপাশি এটাও মনে রাখা দরকার, কর্তৃত্ব জিনিসটা জোর করে আদায় করার জিনিস না, এটা নিজের যোগ্যতা দিয়ে আদায় করে নিতে হয়। বর্তমানে সমাজের ছেলেদের ইমোশনাল ম্যাচিউরিটি থেকে শুরু করে অন্যান্য দিক নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সংসার জীবনে অনেকক্ষেত্রেই তারা নিজেদের বুদ্ধি, জ্ঞান, বিচক্ষণতা ও অন্যান্য গুণ দ্বারা কর্তৃত্বের জায়গাটা নিতে পারছে না, গায়ের জোরটাই অবলম্বন হয়ে দাঁড়াচ্ছে, এবং শেষ পর্যন্ত সংসারে একটা যুদ্ধংদেহী পরিবেশ বিরাজ করছে।
.
সেক্যুলারিজম-নারীবাদসহ বিভিন্ন তথাকথিত আদর্শের মনভুলানো বুলি থেকে মেয়েরা বিশ্বাস করা শুরু করেছে সংসারে আনুগত্য জিনিসটা একটা ব্যাকডেটেড কনসেপ্ট। যোগ্যতায় স্বামীর চেয়ে কম না হলে তার আনুগত্য করবে কেন? এটা একটা বিধ্বংসী চিন্তা। এই চিন্তা পরিবার তো বটেই, জীবনের সব সুখ নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট।
.
মনে রাখতে হবে, ইবলিস আদমকে (আলাইহিস সালাম) সিজদাহ করতে চায় নি কারণ সে নিজেকে আদম থেকে শ্রেয় মনে করেছে। সুপিরিওর কেন ইনফিরিওরের কাছে মাথা নোয়াবে? যৌক্তিক প্রশ্ন। কিন্তু ইবলিস ভুলে গিয়েছিল সুপিরিওর তো সে-ই যে আল্লাহ্‌র হুকুম মানে। আর সে হুকুম ছিল আদমকে সিজদাহ করা। সেটাই সে করে নি, ইগোর কারণে। ইবলিসের জ্ঞান, যোগ্যতাকে এখন আর কেউ ঈর্ষা করে না, ঘৃণা করে।
.
[পুনশ্চ: অবিবাহিত মানুষের পক্ষে স্বামী-স্ত্রী প্রসঙ্গে কথা বলা অনেকক্ষেত্রেই শোভনীয় না। এখানে আমি আনুগত্য-কর্তৃত্বের ব্যাপারে আমার নিজের কিছু চিন্তাভাবনা শেয়ার করলাম। চিন্তায় ভুল থাকতেই পারে। অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ ব্যক্তিবর্গ ভুল ধরিয়ে দিতে চাইলে সাদরে গৃহীত হবে]


No comments:

Post a Comment