Tuesday, September 4, 2018

'প্রত্যাবর্তন' বই রিভিউ - মিরাজ মাহমুদ



জীবনের ফেলে আসা সময়গুলো নিয়ে খানিকক্ষণ ভাবতে বসলাম। কি করেছি সময়গুলোতে? যতোদূর হাতড়ে বেড়াই, সবখানে কেবল অন্ধকার। পাপের অন্ধকার। আমার চারপাশে যেন মহীরুহ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাপের এক সুবিশাল বৃক্ষ, যার পাতা, ডাল, গুল্ম আর শিকড় জুড়ে কেবল পাপের বিষবাষ্প। এই বিষের স্তুপে বসবাসে আমি যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছি আপনাতেই। আমি নিঃশ্বাসে বিষ নিই, কিন্তু বিষের প্রতিক্রিয়া আমি বুঝতে পারিনা। বিষ খেতে খেতে আমি বেদনায় নীল হয়ে হয়ে পড়ি। কিন্তু কি অদ্ভুত! আমি চিৎকার করিনা যাতনায়। এই বিষের দংশনে আমি আহত হই, মরে যাই, বারবার মরে যাই.. তবুও আমি চিৎকার করিনা... চিৎকার করে বলিনা বাঁচাও.....বাঁচাও......বাঁচাও.....

এরপর, একদিন হঠাৎ এক মৃত্যু আমাকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিলো। এরকম একটি মৃত্যুর জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলোনা। আসলে, মৃত্যুর তো কোন সময়জ্ঞান নেই। হয়তোবা আছে, কিন্তু আমরা তা জানতে পারিনা।

মৃত্যুটা আমাকে ভাবালো, - এটাই কি জীবনের পরিণতি? একদিন এরকম আমিও কি লাশ হয়ে যাবো? অনড়? নিশ্চল? নিশ্চুপ?

একদিন কি আমার পা দুটোও এরকম জড়িয়ে যাবে? নিঃশ্বাস থেমে যাবে? হৃদকম্পন নিয়ে নিবে তার অন্তিম বিরতি?

আমি আমার চারপাশের মানুষগুলোর দিকে তাকালাম। আজ যে মানুষটি খুব ভালোবাসা আর স্নেহমাখা চাহনিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমার মৃত্যুর পর সেই মানুষটিই আমাকে সংকীর্ণ একটা কবরে শুইয়ে দিয়ে আসার বন্দোবস্ত করবে। আমার অন্তিম যাত্রার পসরা সাজিয়ে সে আমাকে রেখে আসবে অন্ধকার এক জগতে। সে জগতে আমি একা। বড্ড একা।

আমার ভাবনার দুয়ারগুলো খুলে গেলো। চোখের সামনে থেকে সরে গেলো একটি মায়াবী পর্দা। আমি দেখতে পেলাম মৃত্যু আমাকে গ্রাস করার জন্য ছুটে আসছে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমার পরিণতি। তখন আমার কাছে মৃত্যুই যেন নির্জলা সত্য। এর বাইরের সবকিছু মিথ্যা, স............ব। আমি বসে পড়লাম। মুখ থুবড়ে পড়ে রইলাম এক ভীষণ গ্লানিবোধে। কি করেছি আমি তাহলে? যে দীর্ঘ, অনন্ত পথ আমাকে একা পাড়ি দিতে হবে, সে পথের সম্বল কোথায় আমার?

ভবোদয় ঘটলো। জীবনের যা কিছু ভুল, পাপ আর অনর্থক কালক্ষেপণ- সবকিছু মুছে নতুন করে শুরু করার এক উদ্যমতা আমার মাঝে চেপে বসলো। শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়। নতুন জীবনের গল্প।
'প্রত্যাবর্তন' বইটিতেও এরকম কিছু আত্মার গল্প আছে, যারা তাদের চারপাশে পরম যত্নে বড় করে তুলেছিলো একটি পাপের বৃক্ষকে। সেটি মহীরুহ হতে হতে যখন তাদের অস্তিত্ব বিলীন হবার পথে, ঠিক সেসময় একটি দমকা হাওয়া এসে সেই মহীরুহটাকে উপড়ে ফেলে দিলো। সেখানে জায়গা করে নিলো একটি শান্তির জানালা। সেই জানালা দিয়ে কেবল শান্ত-শীতল বাতাস প্রবেশ করে।
বইয়ের একজন যখন এক ক্লিকে সব গানের ফোল্ডার ডিলেট করে দিলো, মনে হলো- আমার অতীত যেন আমার সামনে উঠে এলো।

ইউনিভার্সিটির র‍্যাগ ডে, পহেলা বৈশাখ, ভালোবাসা দিবস- এসবকিছুকে যখন ছুঁড়ে ফেলেছিলাম, সেদিন মনে হলো আমি কোন এক খাদের কিনারায়, খাদে পড়তে পড়তে বেঁচে ফিরেছি।
যখন কেউ স্রষ্টাকে খুঁজতে খুঁজতে মাড়িয়ে বেড়ায় পথ, বিশ্বাসের অলিতে-গলিতে যখন সে সন্ধান করে বেড়ায় এক চিরন্তন সত্যের, মনে হয় এ যেন আমারই পাদচারণা।

এরকম বেশকিছু পাপে নিমজ্জিত আত্মার বিশুদ্ধকরণের গল্প দিয়ে রচিত এই বইটি। বইটি সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো বলা আছে বইটির ফ্ল্যাপেঃ

'মোহ আর মিথ্যের মধ্য দিয়ে পথ চলতে চলতে একটা সময় আত্মাগুলো নিমজ্জিত হয় অন্ধকারের অতল গহ্বরে। সেই ভয়ার্ত অন্ধকার কূপ থেকে কেউ আলোর দেখা পায়, কেউ পায় না। কেউ নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে নেওয়ার সুযোগ লুফে নেয়, কেউ নিজেকে হারিয়ে ফেলে অতল থেকে অতলে। যারা ফিরে আসে, কেমন হয় তাদের গল্পগুলো? সেরকম একঝাঁক পরিশুদ্ধ আত্মার গল্প নিয়েই 'প্রত্যাবর্তন'।
শেষ করতে চাই সেই মৃত্যুর ঘটনাটি দিয়ে। মৃত্যু হয়তো একজন মানুষের দুনিয়াবি জীবনের পরিসমাপ্তি। কমা বা সেমিকোলন নয়, একটা ফুলস্টপ। কিন্তু, কিছু কিছু মৃত্যু অন্য কারো জন্য নতুন করে জীবন শুরু করার পেছনের অনুঘটক। নতুন এক প্রয়াসের জন্য অনুপ্রেরণা।

পৃথিবীর সকল পরিশুদ্ধ আত্মার জন্যে ভালোবাসা। ভালোবাসা 'প্রত্যাবর্তন' এর সেই সকল 'ফিরে আসা' আত্মাগুলোর জন্যও, যারা তাদের জীবনকে সেই মহামহিম সত্ত্বার কাছে সোপর্দ করে দিয়েছে, যার কাছে ফিরে যেতে হবে আমাদের সকলকে। প্রত্যাবর্তন করতে হবে সবাইকে। দুনিয়ার প্রত্যাবর্তনের মতো আমাদের আখিরাতে প্রত্যাবর্তনও এরকম বিশুদ্ধ হোক, এই কামনায়।

বই - প্রত্যাবর্তন
প্রকাশনায়- সমকালীন প্রকাশন
সম্পাদনায় - আরিফ আজাদ



রিভিউ লেখক - মিরাজ মাহমুদ
মূল পোস্টের লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/groups/326459141145760/permalink/543828409408831/


No comments:

Post a Comment