Tuesday, September 4, 2018

প্রেম, বিয়ে, ভালোবাসা - মাহফুজ আলামিন

আজকাল আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা অনুযায়ী ছেলে মেয়েদের বিয়ে করার আনুমানিক গড় বয়স কত হতে পারে বলে আপনার মনে হয়? আধুনিক এই সমাজে ধরে নেয়া যায়- ছেলেদের ৩০ আর মেয়েদের ক্ষেত্রে ২৩/২৫। তাইতো? ব্যাতিক্রম থাকবেই, সেই হিসেব পরে।
.
আচ্ছা, এখন একটা ছেলে প্রাপ্ত বয়স্ক হয় ঠিক কত বছর বয়সে? ১৩/১৪? আর একটা মেয়ে? বয়ঃসন্ধিকাল হিসেবে ধরে নিলাম ১২/১৩ তেই। এখন যেহেতু, সমাজে ছেলেমেয়েরা উভয়ই পড়াশোনা করছে, সেই অনুযায়ী তাদের পড়াশোনা শেষ করতে করতে প্রায় কেটে যায় জীবনের ২৫/২৬ বছর বয়স পর্যন্ত। মেয়েদের পড়াশোনা শেষে তারা না হয় বিয়ে করে ফেলতে পারে, নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হিসেবে না প্রমাণ করলেও চলে।
.
কিন্তু, একটা ছেলের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তা নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত না সে পড়াশোনা শেষে একটি ভালো চাকরি পেয়ে সব কিছু গুছিয়ে নিচ্ছে, তার আগে তার পরিবার বিয়ের কথা ভাবেনা। উন্নয়নশীল এই দেশে অধিকাংশ পরিবারের অবস্থা অনেকটা এমন ই। নিতান্তই দরিদ্র এবং ধনী পরিবারগুলোর ব্যাপার কিছুটা ভিন্ন। কিন্তু চিন্তাভাবনা সেই একইরকম।
.
তাহলে সমস্যার শুরু কোথা থেকে? সেই প্রসঙ্গেই আসা যাক। একটা ছেলে অথবা মেয়ে বয়স্বন্ধিকাল পেড়িয়ে প্রাপ্ত বয়স্ক হচ্ছে। সেই সাথে স্বাভাবিকভাবেই দেহের চাহিদা অনুভব শুরু করছে। যদিও সে তা প্রকাশ করছে না। কিন্তু নিজের অজান্তেই এই বিষয়গুলো তার কাছে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। তো একটা ছেলে যেখানে ১৩/১৪ বছরে প্রাপ্তবয়স্ক হচ্ছে আর তার পড়াশোনা শেষ করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা পর্যন্ত ৩০ বছর পার হয়ে যাচ্ছে সেই ক্ষেত্রে গ্যাপ পড়ছে কত বছর? (৩০-১৪)= ১৬ বছর। আর একটা মেয়ের ক্ষেত্রে (২৫-১২)=১৩ বছর।
.
এই ১৬ অথবা ১৩ বছর পর্যন্ত সে নিজেকে সংযত রেখে তার মতই একজন ভালো শুদ্ধ মানুষ পাবে বিয়ের জন্য তার গ্যারান্টি কোথায়? আর তা কি আসলেই সম্ভব? স্কুল কলেজ, ইউনিভার্সিটি তে ছেলেমেয়েরা একইসাথে পড়াশোনা করছে, অবাধেই স্বাভাবিক হোক আর অস্বাভাবিক হোক মেলামেশার সুযোগ পাচ্ছে। সমাজে ধীরে ধীরে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব, ধর্মীয় জ্ঞান আর নৈতিকতার অভাব সব মিলিয়ে তারা দেহের আকর্ষণ, চোখের আকর্ষণকে মনের আকর্ষণে রূপান্তরিত হবার নাম দিয়ে ভালোবাসা নামক না বুঝে উঠা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে।
.
কারণ, তার কাছে সুযোগ আছে, সমাজের নিশ্চুপ অনুমোদন আছে, সবাই তো করছে, আমি করতে দোষ কোথায়? ঠিক এইসব চিন্তাভাবনার উপর ভিত্তি করে যখন এক একটা সম্পর্ক নামক জটিল খেলায় তারা জড়িয়ে যাচ্ছে, তখন কিন্তু চাইলেও তারা পরিবারের অনুমোদন নিয়ে বিয়ে করার মতো অবস্থান এ যাওয়ার মত সামাজিক ব্যাবস্থা তারা পাচ্ছেনা। ফলে প্রেম নামক ব্যাপারটা সাময়িক টাইম পাস, দুই মনের মিলিত খেলা, ঘুরাফেরা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ না থেকে অবশেষে দৈহিক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এরপর কত বছর পর্যন্ত সেইসকল সম্পর্ক টিকে থাকে তা সবার ই কমবেশি জানা।
.
এভাবে, একটা দুইটা তিনটা করে সম্পর্ক নামের খেলা চলতে থাকে। এখন কথা হলো সবাই তো এক না। তা অবশ্যই ঠিক, সবার কাছে সুযোগ সমান থাকেনা, আবার অনেকেই ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে যান। কিন্তু এদের সংখ্যা এই আধুনিক সমাজে খুব ই কম। তাহলে বিয়ের বয়স হবার আগ পর্যন্ত অধিকাংশ ছেলেমেয়ে এক বা একাধিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে, একটা ভাঙছে, তো আরেকটা গড়ে উঠছে, কারো বা বিয়ে হয়ে যাওয়ায় অন্যজন হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ছে, প্রেমের অবস্থা এইরকম সস্তা পণ্যের মত হয়ে যাওয়ার কারণে নারী-পুরুষ একে অপরকে দোষারোপ করে জীবন পার করে দিচ্ছে।
তাহলে কি পাওয়া গেলো? এই যে প্রাপ্তবয়স্ক ( দেহের চাহিদার ভিত্তিতে) হওয়া থেকে শুরু করে গড় বিয়ের বয়স হবার আগ পর্যন্ত ১৬/১৩ বছর কিন্তু তারা প্রেম এর নাম করে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে, ফলে সমাজে ঘটছে অনাকাঙ্খিত সব ঘটনা। আর প্রযুক্তির উৎকর্ষতা, সহজলভ্যতার ফলে তরুণ/কিশোররা ঝুকে পড়ছে পর্ণোগ্রাফির দিকে। সেই দিক টার প্রভাব যে কত ভয়াবহ তা আপনারা ভালো করেই জানেন। মানুষের সুস্থ চিন্তাভাবনার জায়গায় যতরকম অসুস্থ মানসিকতার, বিকারগ্রস্থ করে দেয়ার মত এক মাধ্যম এটি। এর ফলে সমাজে ইভটিজিং থেকে শুরু করে ধর্ষণ পর্যন্ত কত বর্বর আচরণে তরুণরা জড়িয়ে পড়ছে তার উদ্রেকদাতা কিন্তু সেই পর্ণোগ্রাফি। এই প্রসঙ্গ না হয় আরেকদিন আলোচনা করা যাবে।
.
প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক, দিন শেষে যখন অবশেষে একজন ছেলে বা মেয়ে বিয়ে করছে তার প্রয়োজনীয় সময়ের অনেক বছর পর, তখন তার পিছনে থেকে যাচ্ছে অনেক অনেক না বলা, কালো ইতিহাস। আধুনিক এই সমাজে প্রত্যেকের ই বন্ধুর নামে প্রেমিক প্রেমিকা বিয়ের পরেও থেকে যাচ্ছে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে পরকীয়া নামক ব্যাপারটা ঢুকে যাচ্ছে মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ফলে একে অপরকে স্বামী স্ত্রী হবার পরেও সন্দেহ থেকে যাচ্ছে, একে অন্যের প্রাক্তন কালো ইতিহাস জানা হয়ে গেলে পরিণতি মিলছে শেষ পর্যন্ত ডিভোর্স এ গিয়ে। ডিভোর্স এর ফলে তাদের সন্তানদের উপর কি প্রভাব পড়ছে তা আপনারা ভালো করেই জানেন।
.
তাহলে এতোসব সমস্যার শেষ কোথায়? এর থেকে উত্তরণের উপায় কি? সমাধান কি?
এর একমাত্র উপায় হচ্ছে সময়মত প্রাপ্ত বয়স্ক হবার পর ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেয়া। সেটা কিভাবে সম্ভব তাইতো? একটা ছেলে যখন জানতে বুঝতে পারবে তার বয়স ১৮-২১ হবার পর পরই তার বিয়ে করার সুযোগ আছে, একটা মেয়ে ও যখন জানতে পারবে তার বয়স ১৫-১৬ হবার সাথে সাথেই বিয়ে করার পারিবারিক অনুমোদন আছে, তখন সে অবৈধ সম্পর্কে না জড়িয়ে অপেক্ষা করবে বৈধ বিয়ের জন্য। এই ক্ষেত্রে পরিবারগুলোকে ভুমিকা পালন করতে হবে। এখন আপনি বলতে পারেন বিয়ের পর খাবে কি? চলবে কিভাবে? কিছুই তো করছেনা কেউ যে পরিবার চালাতে পারবে তারা! তাইতো?
.
তাহলে এবার শুনুন, যেই পরিবার এতো এতো টাকা পয়সা দিয়ে একটা ছেলেকে পড়াশোনা করাতে পারে, তারা আরেকটা মানুষের দেখাশনার দায়িত্ব নিতে পারবেনা? বিয়েতে লাখ লাখ টাকা লোক দেখানোর নামে খরচ না করে, সেই টাকা দিয়ে দুই পরিবার মিলে তাদের জন্য উপার্জনের একটা সুন্দর রাস্তা তৈরি করে দিতে পারেনা বলুন? অবশ্যই পারে। আর যারা, নিজেদের এক প্রেম নিয়েই সারাজীবন সুখে থাকতে পারবেন বলে গর্ব করছেন তাদের বলবো, বিয়ে করে ফেললেই হয়। কাওকে যদি নিতান্ত অনেক ভালো লেগেই থাকে( চেহারার বা দেহের নয়, তার ব্যাবহার আচার আচরণ, দ্বীন এর প্রতি ভালোবাসা) তবে তাকে বিয়ে করে ফেলুন।
কথা হচ্ছে, দিন শেষে আপনি কি চান? বৈধ বৈবাহিক শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক? নাকি অবৈধ প্রেম ভালোবাসার নামে চরিত্র কে কলুষিত করার মত ব্যবস্থা? তারপর একটা থেকে আরেকটা, তারপর বিরহ, হতাশা, অনাকাঙ্খিত বিয়ে, মনের অমিল অতঃপর ডিভোর্স? বেশিনা, আপনাদের পূর্বপুরুষদের কথা চিন্তা করুন। ঠিক কতজন প্রেম করে বিয়ে করেছেন? তারা কিন্তু একে অপরকে একদম জানতো না, চিনতো না, তবুও তাদের মাঝে কি মধুর বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান। আর আজকালকার প্রেমের বিয়ে, অথবা প্রেম অতঃপর অন্যের সাথে বিয়ের সম্পর্কগুলো লক্ষ্য করুন তাহলেই বুঝতে পারবেন।
.
শেষ কথা হলো, মানুষ ই সমাজ তৈরি করে, এর তথাকথিত নিয়মগুলো ও তারাই করে। সমাজ সবসময় পরিবর্তনশীল। আর সমাজের এই সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের সবাইকে ভূমিকা পালন করতে হবে। আপনার কাছে যদি আপনার চরিত্র রক্ষার চেয়ে, ধর্মীয় আদেশ রক্ষার চেয়ে ক্যারিয়ার, তথাকথিত প্রেম এইসব বড় হয়ে থাকে তবে এই সমাজব্যাবস্থায় আপনি স্বাগতম। আর যদি সত্যিই নিজের চরিত্রকে কলুষিত করতে না চান, ধর্মের আইন লঙ্ঘন করতে না চান তবে সমাজের এই সমস্যাগুলো বুঝে আপনাকেই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পরিবারের মানুষদের বুঝাতে হবে কেনো সময় অনুযায়ী বৈধ বিয়ে হাজারো অনিয়ম, নীতিবিবর্জিত কাজ থেকে উত্তম।
.
আর এই ক্ষেত্রে ইসলাম ই একমাত্র আপনাকে শান্তির পথ দেখাতে পারে। ক্যারিয়ার, টাকা পয়সা এইসব দিয়ে কি করবেন, যদি কাল বিয়ের পর দেখেন আপনার স্ত্রী/স্বামী অন্যের সাথে পরকিয়ায় ব্যাস্ত, বিয়ের আগে তার অনেক অবৈধ সম্পর্ক ছিল? আর হ্যা, পড়াশোনা- বিয়ের পর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া মেয়েদের পক্ষে কষ্টকর হলেও অসম্ভব নয়। এমন অসংখ্য উদাহরণ আপনার চারপাশেই বিদ্যমান। তাই দিন শেষে, চিন্তা করুন, বুঝার চেষ্টা করুন, অনুধাবন করুন, যেই ফ্যান্টাসি লাইফের পিছনে আপনি ছুটছেন তার দিনশেষে পরিণতি কি? বৈধ বিয়ে উত্তম, চরিত্র রক্ষা বেশি প্রয়োজন নাকি অবৈধ প্রেম-পরকীয়া! পরিবর্তন আপনাকেই আনতে হবে, আনতে হবে সবাই মিলে। আপনি যদি আজ এই কথাগুলো বুঝতে পারেন, অনুধাবন করতে পারেন, তবে কাল ঠিক ই আপনি আপনার ছেলেমেয়েকে প্রাপ্তবয়স্ক হলে বিয়ে দেবার ব্যবস্থা করবেন। সেখানেই এর স্বার্থকতা।

No comments:

Post a Comment