Tuesday, September 4, 2018

বই প্রকাশের আগে প্রকাশকের যেসব বিষয় মাথায় রাখা উচিৎ - আরিফ আজাদ


আমি মনে করি একটা বই অনুবাদ করার ক্ষেত্রে একজন প্রকাশকের বেশকিছু বিষয় মাথায় রাখা উচিত।
প্রথমত, প্রকাশকের উচিত সেই বইটা আগাগোড়া এক-দুইবার পড়ে ফেলা। বইটার প্রথম পাঠক উনি নিজেই হবেন। একদম নিরপেক্ষ মন নিয়ে, একজন প্রকাশক না হয়ে, পাঠকের ভূমিকায় থেকে পাঠ করতে পারলেই উনি আঁচ করতে পারবেন বইটা সমাজের জন্য, ব্যক্তিজীবনের জন্য, মোটাদাগে উম্মাহর জন্য গুরুত্বপূর্ণ কি না। যদি উনি মনে করেন যে বইটা প্রকাশের মাঝে কল্যাণ আছে, তাহলে এরপর তিনি সেটা অনুবাদের কাজে মন দিতে পারেন।

কিন্তু, বইটা পাঠ করতে গিয়ে তিনি যদি এমনকিছু খুঁজে পান বা এমন আকিদা সংশ্লিষ্ট ব্যাপার সামনে চলে আসে যা আসলে উনি নিজেও বিশ্বাস করেন না- তাহলে সেই বই নিয়ে কাজ করা যাবে কিনা সেটা নিয়ে বেশ কয়েকবার ভাবা দরকার। অভিজ্ঞজনদের সাথে মাশোয়ারা করা, পড়ুয়া কিছু লোককে দিয়েও বইটা কয়েকবার পড়িয়ে নেওয়া। তাদের কাছ থেকেও ফিডব্যাক নেওয়া। এবং, অতি অবশ্যই সালাতুল ইস্তিখারা পড়া। আল্লাহর সাহায্য চাওয়া।

দ্বিতীয়ত, কোন লোক এসে যদি আপনার সামনে একটা বইয়ের গদগদ প্রশংসা করে বসে, সেই বইটা অনুবাদ করে ফেলার জন্য পাগলপারা হয়ে যাবেন না। একজন পাঠকের রিভিউয়ের উপর নির্ভর করে গোটা পাঠকসমাজের জন্য কিছু নির্ধারণ করে ফেলাটা খুব বোকামি। যদি কেউ কোন বইয়ের বিশেষ প্রশংসা করে, সেটা আগে আপনি পড়ুন। কাছের কাউকেও পড়তে দিন যাদেরকে আপনি ভালো 'পাঠক' মনে করেন। তাদেরও ফিডব্যাক নিন। এরপর আগান।

তৃতীয়ত, একটা বই অনুবাদ শেষে প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর পুনঃরায় সম্পাদনা করা লাগলে ব্যাপারটা দুঃখজনক। সম্পাদনার আগে ভাবা উচিত- এই সম্পাদনা করার অনুমতি কি মূল লেখক আপনাকে দিয়েছে? যদি দিয়ে থাকে তাহলে ভালো। যদি না দেয়, তাহলে এটা মূল লেখকের সাথে খিয়ানত করা হয়। একজনের বইতে আমি চাইলেই আমার মনের মতো কথাবার্তা সংযোজন করে দিতে পারিনা। যদি তাতে হাজার ভুল থাকে, তবুও।

এক্ষেত্রে কি করা যায়? মূল টেক্সট একই রেখে শারঈ' ভুলগুলোর জায়গাগুলোতে ফুটনোট যুক্ত করে সঠিক ব্যাপারটা বলে দেওয়া যায়। এতে পাঠকও বিভ্রান্ত হবেনা, এবং মূল লেখকের সাথেও খিয়ানত করা হয়না। আমি মনে করি এই পদ্ধতিই উত্তম।

চতুর্থত, বই সিলেকশানে সতর্ক হওয়া। এমন বই নিয়ে কাজ না করা যেগুলো নিয়ে আসলেই বিতর্ক আছে এবং সেই বিতর্কের পরিমাণ এতো বেশিই যে- এই একটা ব্যাপারই আপনাকে মানসিকভাবে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেয়। যতো ঝামেলা এড়িয়ে চলা যায়, কাজের গতি ততোই বাড়ানো যায়।

এবার সমালোচকদের ব্যাপারে আসি। খুব সম্প্রতি একটা বইয়ের ব্যাপারে বেশ সমালোচনা হচ্ছে। যারা সুন্দর, যৌক্তিক সমালোচনা করেছেন তাদের সাধুবাদ। প্রকাশকের প্রতি অনুরোধ তিনি এসব সমালোচকদের আমলে নিবেন এবং তাদের দেওয়া পরামর্শগুলো ভেবে দেখবেন। কিন্তু, এর বাইরে তিক্ত কিছু দেখারও সৌভাগ্য হলো বটে!

কেউ কেউ দেখলাম সেই বইয়ের অনুবাদক আর প্রকাশককে প্রকাশ্যে পিটানোর দাবি তুলেছেন। সিরিয়াসলি ম্যান? এতো অসহিষ্ণুতা কেনো? আপনারা না দ্বীন ইসলামকে রিপ্রেজেন্ট করেন? আপনারা না সেই নবীর উম্মত যিনি তায়েফে পাথরের আঘাতে জর্জরিত হয়েও তায়েফবাসীর জন্য দু'হাত তুলে দোয়া করেছিলেন?

ভার্সিটি লাইফে আমরা দেখেছি, তাবলিগের ভাইয়েরা হারাম রিলেশানশীপে থাকা একজন ভাইকে, ইয়াবা-সিগারেট খাওয়া ভাইদেরকে কতো নরম, মোলায়েম গলায় দাওয়াত দিতেন। তাদের কথা বলার ধরণ, এপ্রোচ এতো বেশিই সুন্দর ছিলো যে- ক্যাম্পাসে 'মারমার কাটকাট' রাজনীতি করে বেড়ানো ছাত্রনেতাটাও তাদের সামনে ভদ্রভাবে কথা বলতো।

আর, একটা বইয়ের ভুল ধরা পড়ায় সেই বইয়ের অনুবাদক আর প্রকাশককে আপনারা প্রকাশ্যে পিটানোর কথা বলেন। প্রকাশকের বাবাকে ফোন করে হুমকি দেন। তার ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলেন। এটাই আপনাদের কিতাবের শিক্ষা? আপনাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে লব্ধ ব্যবহার, প্রাপ্ত আচরণ?
আলহামদুলিল্লাহ্‌, দ্বীনে আসার আগে আমরা আপনাদের চেহারাটা দেখিনি বা আপনাদের মতো এমন 'দ্বীনি' চেহারার মানুষগুলোকে দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। শুকরিয়া আল্লাহর।

আপনাদের এমন আচরণ দেখে একজন রিভার্টেড মুসলিমের একটা উক্তি মনে পড়ে গেলো। উনি বলেছিলেনঃ

'ভাগ্যিস ইসলাম গ্রহণের প্রাক্কালে মুসলিমগুলোকে দেখার আগে আমি কুরআন হাতে পেয়েছি। নাহয় আমি এই মানুষগুলোকেই ইসলাম ভেবে নিতাম আর আমার ইসলামে আসাও হতোনা'।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে ক্ষমা করুন।

No comments:

Post a Comment