Thursday, February 27, 2020

অহঙ্কারঃ একটি মারাত্মক গুনাহ (১ম অংশ)







অহঙ্কারঃ একটি মারাত্মক গুনাহ










https://islamqa.info


9229: অহংকার থেকে মুক্তির উপায়

প্রশ্ন: কিভাবে একজন মানুষ অহংকার থেকে মুক্তি পেতে পারে?
Published Date: 2015-01-21

উত্তর:
আলহামদুলিল্লাহ।
এক:
অহংকার একটি খারাপ গুণ। এটি ইবলিস ও দুনিয়ায় তার সৈনিকদের বৈশিষ্ট্য; আল্লাহ যাদের অন্তর আলোহীন করে দিয়েছেন।
সর্বপ্রথম আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টির উপর যে অহংকার করেছিল সে হচ্ছেলানতপ্রাপ্ত ইবলিস। যখন আল্লাহ তাকে নির্দেশ দিলেনআদমকে সেজদা কর; তখন সে অসম্মতি জানিয়ে বলল: আমি তার চেয়ে উত্তম। আমাকে বানিয়েছেন আগুন দিয়ে; তাকে বানিয়েছেন মাটি দিয়ে।আল্লাহ তাআলা বলেন: আর আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করলাম, এরপর আকার-অবয়ব তৈরি করেছি। অতঃপর আমি ফেরেশতাদেরকে বললামআদমকে সেজদা কর; তখন সবাই সেজদা করল। কিন্তু ইবলিস সেজদাকারীদের মধ্যে ছিল না। আল্লাহ বললেন: আমি যখন তোকে সেজদা করার আদেশ দিলাম তখন কিসে তোকে সেজদা করতে বাধা দিল? সে বলল: আমি তার চেয়ে উত্তম। আমাকে বানিয়েছেন আগুন দিয়ে; তাকে বানিয়েছেন মাটি দিয়ে।” [সূরা আরাফ, আয়াত: ১১-১২]
তাই অহংকার ইবলিসি চরিত্র। যে ব্যক্তি অহংকার করতে চায় সে জেনে রাখুক সে শয়তানের চরিত্র গ্রহণ করেছে। সে সম্মানিত ফেরেশতাদের চরিত্র গ্রহণ করেনি, যারা আল্লাহর আনুগত্য করে সেজদায় লুটিয়ে পড়েছিল।
অহংকার অহংকারীর জান্নাত থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণ, ইজ্জতের মালিক আল্লাহকে সরাসরি দেখতে না পাওয়ার কারণ। দলিল হচ্ছে এ দুইটি হাদিস:
১. আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেন: যার অন্তরে বিন্দু পরিমাণ অহংকার আছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। একলোক বলল: যে কোন লোক পছন্দ করে তার জামাটা ভাল হোক, তার জুতাটা ভাল হোক? তিনি বললেন: নিশ্চয় আল্লাহ সুন্দর; তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন। অহংকার হচ্ছে সত্যকে উপেক্ষা করা এবং মানুষকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা।”[সহিহ মুসলিম]
সত্যকে উপেক্ষার অর্থ: সত্য জেনেও সেটাকে প্রত্যাখ্যান করা।
মানুষকে তুচ্ছ করার অর্থ: মানুষকে ছোট করা, হেয় করা।
২. আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি অহংকারবশতঃ কাপড় ঝুলিয়ে হাঁটবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দিকে তাকাবেন না। আবু বকর (রাঃ) বললেন: আমার কাপড়ের একটা অংশ ঝুলে পড়ে যায়; আমি বারবার সেটাকে টেনে নেই। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: তুমি তো অহংকারবশতঃ সেটা কর না।” [সহিহ বুখারি (৩৪৬৫)]
দুই:
অহংকার এমন একটি গুণ যা শুধু আল্লাহর জন্যই প্রযোজ্য। যে ব্যক্তি এ গুণ নিয়ে আল্লাহর সাথে টানাটানি করে আল্লাহ তাকে ধ্বংস করে দেন, তার প্রতাপ নস্যাৎ করে দেন ও তার জীবনকে সংকুচিত করে দেন।
আবু সাঈদ খুদরি (রাঃ) ও আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তাঁরা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন: সম্মান হচ্ছে- আল্লাহর পরনের কাপড়; আর অহংকার হচ্ছে- আল্লাহর চাদর। যে ব্যক্তি এটা নিয়ে আমার সাথে টানাটানি করে আমি তাকে শাস্তি দেই।”[সহিহ মুসলিম (২৬২০)]
নববী বলেন:
সহিহ মুসলিমের সব কপিতে এভাবে আছে। ازارهرداؤه শব্দদ্বয়ের ه জমির (সর্বনাম) দ্বারা আল্লাহকে বুঝানো হচ্ছে। এখানে বাক্যের কিছু অংশ উহ্য রয়েছে সেটা হচ্ছে-قال الله تعالى : ومن ينازعني ذلك أعذبه (অর্থ- আল্লাহ বলেন: যে ব্যক্তি সেটা নিয়ে আমার সাথে টানাটানি করবে আমি তাকে শাস্তি দিব)।
আমার সাথে টানাটানিকরবে এর অর্থ- এ গুণ লালন করবে; ফলে সে অংশীদার এর পর্যায়ে পড়বে। এটি অহংকারের কঠিন শাস্তি ও অহংকার হারাম হওয়ার স্পষ্ট ঘোষণা।[শারহু মুসলিম (১৬/১৭৩)]
যে ব্যক্তি অহংকার করতে চায় ও বড়ত্ব দেখাতে চায় আল্লাহ তাকে নীচে ছুড়ে ফেলে দেন ও বেইজ্জত করেন। যেহেতু সে তার মূলপরিচয়ের বিপরীতে গিয়ে কিছু করার চেষ্টা করেছে তাই আল্লাহ তাকে তার ইচ্ছার বিপরীতে শাস্তি দিয়ে দেন। বলা হয়: শাস্তি আমলের সম জাতীয় হয়ে থাকে।
যে ব্যক্তি মানুষের উপর অহংকার করে কিয়ামতের দিন তাকে মানুষের পায়ের নীচে মাড়ানো হবে। এভাবে আল্লাহ তাআলা অহংকারের কারণে তাকে লাঞ্ছিত করবেন। আমর ইবনে শুয়াইব তার পিতা থেকে তিনি তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেন: কিয়ামতের দিন অহংকারীদেরকে ছোট ছোট পিপীলিকার ন্যায় মানুষের আকৃতিতে হাশরের ময়দানে উপস্থিত করা হবে। অপমান ও লাঞ্ছনা তাদেরকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলবে। তাদেরকে জাহান্নামের একটি জেলখানায় একত্রিত করা হবে, যার নাম হবে বুলাস। আগুন তাদেরকে চতুর্দিক থেকে ঢেকে ফেলবে। জাহান্নামীদের শরীরের ঘাম তাদেরকে পান করতে বাধ্য করা হবে।[সুনানে তিরমিজি (২৪৯২), আলবানী সহিহ তিরমিজি গ্রন্থ (২০১৫) এ হাদিসটিকে হাসানবলেছেন]
তিন:
অহংকারের নানান রূপ রয়েছে:
১. সত্যকে গ্রহণ না করা; অন্যায়ভাবে বিতর্ক করা। যেমনটি আমরা আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের হাদিসে উল্লেখ করেছি। অহংকার হচ্ছে- সত্যকে উপেক্ষা করা এবং মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা।
২. নিজের সৌন্দর্য্য, দামী পোশাক ও দামী খাবার ইত্যাদি দ্বারা অভিভূত হয়ে পড়া এবং মানুষের উপর দাম্ভিকতা ও অহংকার প্রকাশ করা। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অথবা আবুল কাসেম বলেছেন: একদা এক ব্যক্তি হুল্লা পরে, আত্মম্ভরিতা নিয়ে, মাথা আঁচড়িয়ে হাঁটছিল এমতাবস্থায় আল্লাহ তাকে সহ ভূমি ধ্বস করে দিলেন এবং এভাবে কিয়ামত পর্যন্ত সে নীচের দিকে যেতে থাকবে।”[সহিহ বুখারি (৩২৯৭) ও সহিহ মুসলিম (২০৮৮)] এ ধরণের অহংকারের মধ্যে ঐ ব্যক্তির আচরণও পড়বে যার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেছেন: সে ফল পেল। অতঃপর কথা প্রসঙ্গে সঙ্গীকে বললঃ আমার ধন-সম্পদ তোমার চাইতে বেশী এবং জনবলে আমি অধিক শক্তিশালী।”[সূরা কাহাফ, আয়াত: ৩৪]
কখনো কখনো আত্মীয়স্বজন ও বংশধরদের নিয়ে গৌরবের মাধ্যমেও অহংকার হতে পারে.
চার:
অহংকার প্রতিরোধ করার উপায় হল- নিজেকে অন্য দশজন মানুষের মত মনে করা। অন্যসব লোককে নিজের সমতুল্য মনে করা। তারাও এক বাপ-মা থেকে জন্মগ্রহণ করেছে। যেভাবে আপনিও এক বাপ-মা এর ঘরে জন্মগ্রহণ করেছেন। আর আল্লাহভীতি ব্যক্তির মর্যাদা পরিমাপের মানদণ্ড। আল্লাহ তাআলা বলেন: নিশ্চয় তোমাদের যে ব্যক্তি বেশি তাকওয়াবান সে আল্লাহর নিকট বেশি সম্মানিত।”[সূরা হুজুরাত, আয়াত: ১৩]
অহংকারী মুসলিমের জানা থাকা উচিত সে যতই বড় হোক না কেন পাহাড় সমান তো আর হতে পারবে না; জমিন ছিদ্র করে তো বেরিয়ে যেতে পারবে না। যেমনটি আল্লাহ তাআলা বলেছেন: অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না। পদচারণায় মধ্যবর্তিতা অবলম্বন কর এবং কণ্ঠস্বর নীচু কর। নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।”[সূরা লোকমান, আয়াত: ১৭-১৮]
কুরতুবী বলেন:
পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো নাএখানে অহংকার থেকে বারণ করা হয়েছে এবং বিনয়ী হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আয়াতে المرح শব্দের অর্থ- তীব্র আনন্দ। কেউ কেউ বলেছেন: হাঁটার মধ্যে অহংকার করা, কেউ বলেছেন: কোন মানুষের তার মর্যাদার সীমা অতিক্রম করে যাওয়া।
কাতাদা বলেছেন: হাঁটার ক্ষেত্রে অহংকার। কেউ কেউ বলেছেন: প্রত্যাখান। কেউ কেউ বলেছেন: উদ্যম।
এ উক্তিগুলো সমার্থবোধক। কিন্তু এগুলো দুইভাগে বিভক্ত:
একটি: নন্দিত অপরটি: নিন্দিত।
অহংকার, প্রত্যাখান, দাম্ভিকতা এবং কোন মানুষের তার সীমা অতিক্রম করা: নিন্দিত।
আর আনন্দ ও উদ্যমতা: নন্দিত।[তাফসিরে কুরতুবী ১০/২৬০]
অহংকার প্রতিরোধ করার আরেকটি উপায় হলো- এটি মনে রাখা যে, অহংকারীকে কিয়ামতের দিন পিঁপড়ার ন্যায় ছোট করে হাশর করা হবে মানুষের পায়ের নীচে মাড়ানো হবে। অহংকারী মানুষের নিকট অপছন্দীয় যেমনিভাবে সে আল্লাহর নিকটও অপছন্দনীয়। মানুষ বিনয়ী, নম্র, ভদ্র, সহজ, সরল মানুষকে ভালবাসে। আর কঠিন ও রুঢ় স্বভাবের মানুষকে ঘৃণা করে।
অহংকার প্রতিরোধ করার আরেকটি উপায় হলো- অহংকারী যে পথ দিয়ে বের হয়েছে পেশাবও সে পথ দিয়ে বের হয়। তার সৃষ্টির সূচনা হয়েছে নাপাক বীর্য থেকে। তার সর্বশেষ পরিণতি হচ্ছে- পচা লাশ। এ দুই অবস্থার মাঝখানে সে পায়খানা বহন করে চলছে। সুতরাং অহংকার করার মত কী আছে?!!
আমরা আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করছি তিনি যেন আমাদেরকে অহংকার থেকে মুক্তি দেন এবং আমাদেরকে বিনয় দান করেন।
আল্লাহই ভাল জানেন।



















জান্নাতের অন্তরায়ঃ অহংকার/দাম্ভিকতা


অনুবাদ: মোঃ মুনিমুল হক

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহ্‌মাতুল্লাহ,
নিশ্চয়ই সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্‌র জন্য। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা) এবং তাঁর পরিবার ও সঙ্গী-সাথীদের উপর। মহাগ্রন্থ কুরআন আল কারীমে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ
নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না।[সূরা লোকমান; ৩১:১৮]
অহংকার পতনের মূল-এই প্রবাদটি মোটামুটি আমাদের সকলের জানা। কিন্তু আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন এবং তাঁর রাসূল (সা) এ ব্যাপারে কি বলেছেন তা আমরা অনেকেই হয়তো জানি না। চলুন, জানার চেষ্টা করি কুরআন ও হাদীস কি বলে এ ব্যাপারে!
আব্দুল্লাহ্‌ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা) বলেছেনঃ
যার অন্তরে অণু পরিমান অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেনা।এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলঃ যদি কেউ সুন্দর জামা আর সুন্দর জুতা পরিধান করতে ভালবাসে? তখন নবী করীম (সা) বললেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন। অহংকার মানে হল সত্য প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করা।” [সহীহ্‌ মুসলিম; কিতাবুল ঈমান, অধ্যায়ঃ ১, হাদীস নম্বরঃ ১৬৪]
অহংকারীর ঠিকানা হল জাহান্নাম। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ
সুতরাং,তোমরা দ্বারগুলি দিয়ে জাহান্নামে প্রবেশ কর, সেখানে স্থায়ী হবার জন্যে; দেখ অহংকারীদের আবাসস্থল কত নিকৃষ্ট।[সূরা নাহল; ১৬:২৯]
তাছাড়া উপরে বর্ণিত হাদীস থেকেও এটা পরিষ্কার বুঝা যায় যে, যার অন্তরে অণু পরিমান অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেনা।  আর এতেই প্রমানিত হয় যে, অহংকার মানুষকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায় এবং জান্নাতে যাওয়া পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া রাসূল (সা) এর এই হাদীসে অহংকার বলতে কি বুঝায় তার পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা খুব সুন্দরভাবে দেওয়া আছে। এই হাদীস অনুযায়ী অহংকার  দুই ধরনেরঃ
. সত্য প্রত্যাখ্যান করাঃ সত্য প্রত্যাখ্যান করা বা তা গ্রহন না করাই হল অহংকার বা  দাম্ভিকতা। তাই মহান আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন কুরআন আল কারীমে প্রিয় নবী (সা) এর মাধ্যমে যে সত্য আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন তা বিনয়ের সাথে গ্রহন করা এবং মেনে চলা আমাদের জন্য ফরজ। আর যারাই কিনা অহংবোধ আর দাম্ভিকতার কারনে আল্লাহ্‌ এবং তার রাসূল (সা) এর বাণী ও বিধানে বিশ্বাস স্থাপনে অপারগতা প্রকাশ করে এবং তা মেনে চলতে অনীহা প্রকাশ করে তারাই হল কাফির বা অবিশ্বাসী। তাদের ঠিকানা হল জাহান্নাম, যেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে। কারন, নবী-রাসূলদের মাধ্যমে তাদের কাছে যখন সুস্পষ্ট প্রমানসহ সত্য (কুরআন ও আসমানী কিতাবসমূহ) পাঠানো হয়েছিল, তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছিল; অহংবোধ ও দাম্ভিকতা তাদেরকে সত্য গ্রহন করা থেকে বিরত রেখেছিল। কুরআন আল কারীমে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ
যখনতার নিকট আমার আয়াতসমূহআবৃত্তি করা হয়, তখনসে দম্ভভরে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যেনসে এটা শুনতেই পায়নি, যেন তার কর্ণদুটি বধির।অতএব, তাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দিয়ে দাও[সূরা লোকমান; ৩১:৭]
.
যারা নিজেদের নিকট কোন দলীল না থাকলেও আল্লাহ্‌র নিদর্শন সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত হয়, তাদের আছে শুধু অহংকার, যা সফল হবার নয়। অতএব,আল্লাহ্‌র শরণাপন্ন হও; তিনিতো সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। [সূরা আল-মুমিন; ৪০:৫৬]
অন্য এক আয়াতে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ
ভূ-পৃষ্ঠে দম্ভভরে বিচরণ করো না। তুমিতো কখনোই পদাভরে ভূ-পৃষ্ঠকে বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনোই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না। [সূরা বানী ইসরাইল, ১৭:৩৭]
তবে যাদের ঔদ্ধত্য এবং অহংবোধ তাদেরকে পরিপূর্ণভাবে সত্য গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখে-অর্থাৎ যারা মতের অমিলের কারনে বা খেয়াল-খুশিমত সত্য আংশিকভাবে মেনে চলে এবং আংশিক মেনে চলা থেকে বিরত থাকে-তারা কাফির নয়। তবে তাদের দাম্ভিকতার জন্যও রয়েছে যথাপোযুক্ত শাস্তি। আর একারনেই আলেমরা এই ব্যাপারে একমত যে, যখন কেউ আল্লাহ্‌র রাসূল (সা) এর সুন্নাহ্‌ সম্পর্কে অবগত হয় তখন তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া তার পক্ষে সমীচীন নয়; ঠিক তেমনি সমীচীন নয় তার উপরে অন্য কারোর কথা বা কাজকে প্রাধান্য দেওয়া সে যেই হোক না কেন-যত প্রভাবশালী ব্যক্তিই হোক না কেন। তাই প্রকৃত জ্ঞান অন্বেষণকারীদের কর্তব্য হল অন্য কারো কথার আগে আল্লাহ্‌ এবং তাঁর রাসূলের (সা) কথাকে নিরঙ্কুশ প্রাধান্য দেওয়া; তারা কি বুঝাতে চেয়েছেন তা গভীরভাবে অনুভবের ও অনুসন্ধানের চেষ্টা করা এবং তার উপর ভিত্তি করে চিন্তাভাবনা করা, মতামত প্রদান করা ও জ্ঞান চর্চায় অগ্রসর হওয়া। কেউ এই স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম (Golden Rule) মেনে সত্য উদ্‌ঘাটনে অগ্রসর হলে তার জন্য রয়েছে কল্যাণ আর সফলতা। আর তা করতে গিয়ে কোন ভুলত্রুটি হয়ে থাকলে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে, ইনশাআল্লাহ্‌। কেননা, তার একমাত্র উদ্দ্যেশই ছিল সত্যকে সঠিকভাবে জানার এবং তা মেনে চলার সর্বাত্মক চেষ্টা করা। আর এটাই হল বিনয়ের সাথে সত্য গ্রহন করা।
২. মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করাঃ এই ধরনের অহংকারের অন্তর্ভুক্ত হল  মানুষকে অবজ্ঞা করা, তাদের ঘৃণা করা, নিজের সম্পর্কে অতি উচ্চ মনোভাব পোষণ করা এবং অন্যদের ছোট/ নিচু মনে করা, অন্যকে ছোট প্রমানিত করার উদ্দ্যেশ্যে নিজেকে জাহির করা, বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করা ইত্যাদি। এই ধরনের মনোভাবের/অহংকারের সূচনা হয় যখন মানুষ নিজেকে অনেক বড় মনে করে, নিজের সম্পর্কে অতি উচ্চ ধারনা পোষণ করে, নিজেকে অন্য সবার চাইতে উত্তম মনে করে; আর এটাই তাকে উদ্বুদ্ধ করে আল্লাহ্‌র সৃষ্টিকে ঘৃণা, অবজ্ঞা আর হাসিঠাট্টা করতে। যেটা প্রতীয়মান হয় তার কথা এবং কাজে। এই অহংকারের ব্যাপারে কুরআন আল কারীমে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ
“(অহংকারবশে) তুমি মানুষ হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না এবং পৃথিবীতেউদ্ধতভাবে বিচরণ করো না; কারণ আল্লাহ্‌ কোন উদ্ধত, অহংকারীকে পছন্দ করেন না। [সূরা লোকমান, ৩১:১৮]

সহীহ্‌ মুসলিমে বর্ণিত এক হাদিসে প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা) বলেছেনঃ
একজন মুসলিমের জন্য এটা অনেক বড় একটি গুনাহের কাজ যদি সে তার অপর এক মুসলিম ভাইকে অশ্রদ্ধা/অবজ্ঞার চোখে দেখে।” [সহীহ্‌ মুসলিম; অধ্যায়ঃ ৩২, হাদীস নম্বরঃ ৬২১৯]
আর এই কারনেই হাদীসে উল্লেখিত লোকটি জিজ্ঞাসা করেছিল, যদি কেউ সুন্দর জামা আর সুন্দর জুতা পরিধান করতে ভালবাসে/গর্ববোধ করে তবে তারও শাস্তি হবে কিনা। তখন রাসূল (সা) তাকে বলেছিলেন যে যেহেতু লোকটি সত্য প্রত্যাখ্যান করেনি বা কাউকে অবজ্ঞা  করেনি তাই ওটাকে অহংকার বলা যাবেনা। তাছাড়া সত্তা, কর্ম এবং গুনাবলীতে আল্লাহ্‌ নিজে যেমন সুন্দর, ঠিক তেমনি অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় প্রকারের সৌন্দর্যকেই ভালবাসেন তিনি।
এখানে বাহ্যিক সৌন্দর্যের অর্থ হল শরীর, পোশাক-পরিচ্ছদ ও পরিবেশের পরিচ্ছন্নতা এবং পবিত্রতা। আর আভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য বলতে বুঝানো হয়েছে চারিত্রিক দৃঢ়তা। আর তাই প্রায়সময় নবী করীম (সা) এই বলে প্রার্থনা করতেন যেঃ
হে আল্লাহ! তুমি আমার চরিত্র ও আচার-ব্যবহারকে সুন্দর করে দাও; এ ব্যাপারে তুমি ছাড়া আমার আর কোন সাহায্যকারী নেই। আর দূরে সরিয়ে রাখ আমার নিকট থেকে সকল মন্দকাজ এবং মন্দগুনাবলী; এই বিষয়েও তুমি ব্যতীত আমার অন্যকোন সাহায্যকারী নেই[আন-নাসাঈ; হাদীস নম্বরঃ ৮৬১; আল্লামা নাসিরুদ্দীন আল আলবানি (রঃ) তাঁর কিতাবুস্‌ সীফাত” (পৃষ্ঠা-৯৩) তে হাদীসটিকে সহীহ্‌ বলে উল্লেখ করেছেন]
তাই আসুন, আমাদের প্রিয় নবী (সা) এর মত আমরাও সাহায্য প্রার্থনা করি আল্লাহ্‌র কাছে, যেন তিনি আমাদের চরিত্রকে সুন্দর করে দেন এবং দূর করে দেন আমাদের অন্তরের যাবতীয় অহংকার আর দাম্ভিকতা; যেন বাঁচিয়ে রাখেন আমাদের সবাইকে জাহান্নামের ভয়াবহ আযাব থেকে যার জ্বালানী হবে পাথর আর মানুষ; সর্বোপরি, আল্লাহ্‌ যেন আমাদেরকে জান্নাতের পথে পরিচালিত করেন। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের প্রতিশ্রুতিই হলঃ
এটা আখিরাতের সে আবাস যা আমি নির্ধারিত করি তাদের জন্যে যারা পৃথিবীতে উদ্ধত হতে ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় না। শুভ পরিণাম মুত্তাকীদের জন্য। [সূরা আল কাসাস্‌; ২৮:৮৩]

বায়তুল মোকাররমের খুতবা
ইসলামের দৃষ্টিতে অহংকার
হাফেজ মাওলানা মিজানুর রহমান 
ভারপ্রাপ্ত খতিব, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ

ইসলামের দৃষ্টিতে অহংকার একটি কবিরা গুনাহঅহংকার মানুষকে জাহান্নাম পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয়। আল্লাহতাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা আমাদের আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করে এবং তা থেকে অহংকারবশে মুখ ফিরিয়ে থাকে, তাদের জন্য আকাশের দুয়ারসমূহ উন্মুক্ত করা হবে না এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ না সুইয়ের ছিদ্রপথে উষ্ট্র প্রবেশ করে। এভাবেই আমরা পাপীদের বদলা দিয়ে থাকি।’ (সূরা আরাফ ৭/৪০)।
এ আয়াতে আল্লাহ কুফরিবশে বা অজ্ঞতাবশে বলেননি, বরং অহংকারবশেবলেছেন। ফলে অহংকারী কাফিরের জান্নাতে প্রবেশ করা ওইরূপ অসম্ভব, যেরূপ সুইয়ের ছিদ্রপথে উটের প্রবেশ অসম্ভব। কাফির তওবা করে ইমান আনতে পারে, অজ্ঞ ব্যক্তি জানার পরে ফিরে আসতে পারে। কিন্তু অহংকারী ব্যক্তি স্বীয় অহংকারের ওপর অটল থাকে এবং একসময় সে ধ্বংস হয়ে যায়। অহংকার তাই মারাত্মক পাপ। যা সাধারণত হিংসার পরই আসে এবং যা অধিকাংশ পাপের উৎস। আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ মানুষকে অহংকারের পাপ ও তার ভয়াবহ পরিণতি বিষয়ে সাবধান করেছেন। অহংকারমানবস্বভাবের একটি নিকৃষ্ট অংশ। বিশুদ্ধ-অশুদ্ধ সব আকিদা-বিশ্বাসের লোকের মধ্যেই থাকে। এর উপকারিতার চেয়ে অনিষ্টকারিতা বেশি। একে দমন করে সৎকর্মে লাগানোর মধ্যেই মানুষের কৃতিত্ব নির্ভর করে। মানুষের মধ্যে ষড়রিপু হলোকাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য। এর মধ্যে মদহলো দম্ভ, গর্ব, অহংকার। মাৎসর্যহলো ঈর্ষা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা। প্রতিটি রিপুই মানুষের প্রয়োজনে সৃষ্ট এবং প্রতিটির দক্ষ ব্যবহার কাম্য। যেমন টক-ঝাল-মিষ্টি-লবণ প্রতিটিই খাদ্যের জন্য প্রয়োজন। কিন্তু অধিক বা অন্যায় ব্যবহারে প্রতিটিই ক্ষতিকর। জীবনে চলার পথে ষড়রিপু আমাদের সার্বক্ষণিক সাথী। দেহের মধ্যে লুক্কায়িত উপরোক্ত ছয়টি আগুনের মধ্যে মদবা অহংকার হলো অন্যতম প্রধান স্ফুলিঙ্গ; যা একবার জ্বলে উঠলে ও নিয়ন্ত্রণ হারালে পুরা মানব গাড়িটাকে পুড়িয়ে বা ধ্বংস করে ছাড়ে।
অহংকারের আরবি নাম কিব্র’; যার অর্থ বড়ত্ব। অন্যের চেয়ে নিজেকে বড় মনে করাই এর অন্তর্নিহিত বক্তব্য। এর পারিভাষিক অর্থ, সত্যকে দম্ভভরে প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান করা। নিম্নের হাদিসটিতে এর পরিণতি ও ব্যাখ্যা দুটিই বর্ণিত হয়েছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা.) বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ওই ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না যার অন্তরে কণা পরিমাণ অহংকার রয়েছে। জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, লোকেরা চায় যে, তার পোশাক সুন্দর হোক, তার জুতা জোড়া সুন্দর হোক। জবাবে রসুল (সা.) বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দর। তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন। কিন্তু অহংকারহলো সত্যকে দম্ভের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান করা[১]
তিনি বলেন, ‘যেখানেই তোমরা থাকো না কেন, মৃত্যু তোমাদের গ্রাস করবেই। যদিও তোমরা সুদৃঢ় দুর্গের মধ্যে অবস্থান কর।’ (নিসা ৪/৭৮)। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা স্বাদ ধ্বংসকারী বস্তুকে বেশি বেশি স্মরণ কর।অর্থাৎ মৃত্যুকে। [১]
অতএব মানুষের জন্য অহংকার করার মতো কিছু নেই। কেননা সে তার রোগ-শোক, বার্ধক্য-জরা কিছুকেই প্রতিরোধ করতে পারে না। শতবার ওষুধ খেলেও আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া তার রোগ সারে না। শত চেষ্টায়ও আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া তার বিপদ দূরীভূত হয় না। ফলে সে একজন অসহায় ব্যক্তি ছাড়া কিছুই নয়। সুতরাং তার উচিত সর্বদা নিরহংকার ও বিনয়ী থাকা।
২. আখিরাতে জওয়াবদিহিতার ভয়ে ভীত হওয়া : কিয়ামতের দিন প্রত্যেকের আমলনামা তার হাতে দিয়ে আল্লাহ বলবেন, ‘তোমার আমলনামা তুমি পাঠ কর। আজ তোমার হিসাব নেওয়ার জন্য তুমিই যথেষ্ট।’ (ইসরা ১৭/১৪)। অতঃপর যখন তারা স্ব স্ব আমলনামা দেখবে, তখন সেই সময়কার অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘সেদিন উপস্থিত করা হবে প্রত্যেকের আমলনামা। অতঃপর তাতে যা আছে তার কারণে তুমি অপরাধীদের দেখবে আতঙ্কিত। এ সময় তারা বলবে, হায় দুর্ভোগ আমাদের! এটা কেমন আমলনামা যে, ছোট-বড় কিছুই বাদ দেয়নি, সবকিছুই লিখে রেখেছে। তারা তাদের কৃতকর্মসমূহকে সম্মুখে উপস্থিত দেখতে পাবে। বস্তুত তোমার প্রতিপালক কারও প্রতি জুলুম করেন না।’ (কাহাফ ১৮/৪৯)।
অর্থাৎ আল্লাহ যাকে যে নিয়ামত দিয়েছেন ও দুনিয়াবি দায়িত্ব প্রদান করেছেন, আল্লাহর কাছে তার যথাযথ জবাবদিহিতার কথা সর্বদা স্মরণ করতে হবে এবং কীভাবে সে দায়িত্ব আরও সুন্দরভাবে পালন করা যায়, তার জন্য সর্বদা চেষ্টিত থাকতে হবে। কেননা আল্লাহ মানুষের হায়াত ও মউত সৃষ্টি করেছেন, কে তাদের মধ্যে সুন্দরতম আমল করে, তা পরীক্ষা করার জন্য।’ (সূরা মুলক ৬৭/২)। অতএব এই তীব্র দায়িত্বানুভূতি তাকে অহংকারের পাপ থেকে মুক্ত রাখবে ইনশা আল্লাহ। সুন্দরতম আমলঅর্থ শরিয়তের আলোকে সর্বাধিক শুদ্ধ আমল এবং অন্তরের দিক দিয়ে সর্বাধিক বিশুদ্ধ কর্ম। যা স্রেফ আল্লাহর জন্য নিবেদিত এবং সকল প্রকার রিয়া ও শ্রুতি থেকে মুক্ত।উল্লেখ্য, এখানে অধিক আমলবলা হয়নি। অতএব শিরকবিমুক্ত এবং সহি সুন্নাহ অনুমোদিত সৎকর্ম সংখ্যায় ও পরিমাণে অল্প হলেও তাই-ই সুন্দরতম আমলহিসেবে আল্লাহর কাছে গ্রহণীয় হবে।
আল্লাহতায়ালা আমাদের অহংকার থেকে বেঁচে থাকার তৌফিক দান করুন।  আমিন।




অহংকার মারাত্মক গুনাহ


মুফতি শামসুর রহমান পোরশা
 নিজেকে অন্যের তুলনায় উত্তম ও শ্রেষ্ঠ এবং অন্যকে নিজের তুলনায় তুচ্ছ ও ঘৃণ্য মনে করার নাম অহংকার। কুরআন ও হাদিসে এটির ওপর কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞারোপ করা হয়েছে। অহংকার একমাত্র আল্লাহ পাকের বৈশিষ্ট্য ও অভ্যাস। এটি বান্দার জন্যে শোভা পায় না। তাই অহংকার করা বান্দার জন্যে নির্বোধসুলভ আচরণ।
পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আমার নিদর্শনসমূহ থেকে তাদেরকে ফিরিয়ে রাখি, যারা পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে অহংকার করে।’ (সূরা আরাফ-১৪৬)
অর্থাৎ, নিজেকে অন্যের চেয়ে বড় ও উত্তম মনে করা এমনই দূষণীয় ও জঘন্য অভ্যাস যে, এতে যে পতিত হয়, তার সুষ্ঠু বুদ্ধি-জ্ঞান থাকে না। সে জন্যেই সে কুরআন বুঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং তা থেকে উপকৃত হতে পারে না।
তাফসিরে রূহুল-বয়ানে উল্লেখ করা হয়েছে, অহংকার এমন এক মন্দ অভ্যাস যা ঐশী জ্ঞান লাভের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, আল্লাহর জ্ঞান লাভ হতে পারে একমাত্র আল্লাহরই রহমতে। আর আল্লাহর রহমত হয় একমাত্র বিনম্রতার মাধ্যমে।  (তাফসিরে মাআরিফুল কুরআন-৪/৬৭)
অন্যত্র আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘পৃথিবীতে দম্ভভরে পদচারণা করো না। নিশ্চয় তুমি ভূপষ্ঠকে কখনোই বিদীর্ণ করতে পারবে না।’ (সূরা বনী ইসরাঈল-৩৭)
অর্থাৎ, এমন ভঙ্গিতে চলো না, যদ্দারা অহংকার ও দম্ভ প্রকাশ পায়। কেননা এটি অনর্থক কাজ।
অন্য আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ পাক অহংকারকারীদের পছন্দ করেন না।’ (সূরা নাহল-২৩)
কালামে পাকের অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, ‘এমনিভাবে আল্লাহ পাক প্রত্যেক অহংকার-স্বৈরাচারী ব্যক্তির অন্তরে মোহর লাগিয়ে দেন।’ (সূরা মুমিন-৩৫)
সূরা মুমিনের অন্য আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘যারা আমার এবাদতে অহংকার করে তারা অপমানিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ (সূরা মুমিন-৬০)
উপর্যুক্ত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, অহংকার একটি মারাত্মক গুনাহ। এটি আল্লাহ পাকের কাছে অত্যন্ত নিন্দনীয় ও অপছন্দনীয় বস্তু। তাই তা পরিহার করা অতীব জরুরী।
হাদিস শরীফে এ বিষয়ে কঠোর সতর্কবার্তা এসেছে, যেমন- হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘এমন কোনো ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে না, যার অন্তরে শস্যদানা পরিমাণ ঈমান থাকবে এবং এমন কোনো ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যার অন্তরে শস্যদানা পরিমাণ অহংকার থাকবে।’ (মুসলিম শরীফ-১/৬৫)
এ হাদিসে জান্নাত থেকে দূরে এবং জাহান্নামে প্রবেশের কারণ হিসাবে তাকাব্বর বা অহংকারকে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ, অহংকার এতো মারাত্মক গুনাহ যে, যার থেকে সামান্য অহংকার প্রকাশ পাবে, সে জান্নাতে স্থান পাবে না, তার ঠিকানা হবে একমাত্র জাহান্নাম। এতে সুস্পষ্ট প্রতীয়মান যে, অহংকার আল্লাহ পাকের কাছে কী পরিমাণ নিকৃষ্ট।
অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘আল্লাহ পাক বলেন, অহংকার আমার চাদর এবং শ্রেষ্ঠত্ব আমার ইযার। সুতরাং যে ব্যক্তি এদুটির কোনো একটি নিয়ে আমার সাথে বিরোধিতা করবে, আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো।’ (ইবনে মাজাহ -২/৩০৮)
অর্থাৎ, অহংকার এবং শ্রেষ্ঠত্ব এ দুটি আল্লাহ পাকের বিশেষ গুণ ও বৈশিষ্ট্য। আর আল্লাহ পাক নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন, যারা আমার এ দুটি বৈশিষ্ট্যকে নিজের মধ্যে প্রকাশ ঘটাবে, তাদেরকে আমি ভয়ানক শাস্তি প্রদান করবো।
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, আল্লাহ পাক তিন প্রকার ব্যক্তির সাথে কিয়ামতের দিন কথা বলবেন না, তাদের প্রতি (দয়ার) দৃষ্টিপাতও করবেন না এবং তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তিতারা হলেন, এক. বৃদ্ধ ব্যভিচারী দুই. মিথ্যাবাদী শাসক তিন. অহংকারী ভিক্ষুক। (মুসলিম শরীফ-১/৭১)
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, আমি কী তোমাদেরকে জান্নাতবাসী সম্পর্কে অবহিত করবো না? তারা হলেন, দুর্বল লোক তাদেরকে লোকেরাও দুর্বল ও হেয় মনে করে, কিন্তু আল্লাহর কাছে তারা এতো সম্মানিত যে, তারা যদি আল্লাহর নামে কসম করে, অবশ্যই আল্লাহ পাক তা সত্যে রূপান্তরিত করেন। তিনি আরো বলেছেন, আমি কী তোমাদেরকে জাহান্নাম সম্পর্কে অবহিত করবো না? তারা হলেন, অনর্থক বিবাদকারী, বদমেজাজী ও অহংকারী। (বুখারি শরীফ-২/৮৯৭)
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘আল্লাহ পাক ওহির মাধ্যমে আমার কাছে নির্দেশ প্রেরণ করেছেন যে, নম্রতা এবং হেয়তা অবলম্বন করো। অহংকার ও গর্ব করা থেকে বিরত থাকো।কেননা এগুলো আল্লাহ পাকের কাছে অত্যন্ত অপছন্দনীয় ও নিকৃষ্ট।(ইবনে মাজাহ-২/৩০৮)
এছাড়া কিয়ামতের দিনে অহংকারীদেরকে ভয়াবহ শাস্তি প্রদান করা হবে। এ ব্যাপারে হাদিস শরীফে কঠোর হুঁশিয়ার বাণী উচ্চারিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন অহংকারীদেরকে পিপীলিকার ন্যায় একত্রিত করা হবে এবং তাদের আকৃতি হবে পুরুষের মতো। অপমান-লাঞ্ছনা তাদেরকে বেষ্টন করে নিবে, তারপর তাদেরকে বাওলাসনামক জাহান্নামের দিকে তাদেরকে হেঁকে নেয়া হবে। আগুনের অগ্নিশিখা তাদের ওপর ছায়া হবে এবং তাদেরকে পান করানো হবে জাহান্নামীদের দেহ নিংড়ানো ত্বীনাতুল খাবালনামক পুঁজ-রক্ত।’ (তিরমিজি শরীফ-২/৭৬)
উপর্যুক্ত আলোচনা দ্বারা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট যে, অহংকার একটি মারাত্মক গুনাহ। যার শাস্তি অত্যন্ত ভয়াবহ। তাই তা পরিহার করে বিনয়ী হওয়া অত্যন্ত জরুরী। বিনয় মানুষের ভাব-মর্যাদাকে বৃদ্ধি করে, পক্ষান্তরে অহংকার মানুষের মর্যাদাকে বিনষ্ট করে। অহংকারকারী নিজকে নিজের কাজে অনেক বড় মনে করে। কিন্তু অহংকারীদের আল্লাহর কাছে কোনো মূল্য নেই। একই বাক্য উচ্চারিত হয়েছে, হযরত ওমর রাযি. এর কণ্ঠে, তিনি বলেন, ‘হে মানব সকল! তোমরা বিনয়ী হও। কেননা আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি, যে আল্লাহর জন্যে বিনয়ী হয়, আল্লাহ পাক তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। সে নিজের কাছে তুচ্ছ এবং মানুষের দৃষ্টিতে সম্মানি। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি অহংকার করে আল্লাহ পাক তাকে হেয় করে দেন। সে মানুষের দৃষ্টিতে অসম্মানি ব্যক্তিতে পরিণত হয় এবং নিজেকে অনেক বড় মনে করে। পরিশেষে সে মানুষের কাছে কুকুর অথবা শুকরের চেয়েও ঘৃণিত ও তুচ্ছে পরিণত হয়।’(শুয়াবুল ঈমান- ৬/২৭৬)
আল্লাহ পাক সকল এ ঘৃণিত কাজ থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুক।
-দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারি









অহংকার

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
إِنَّ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا وَاسْتَكْبَرُوا عَنْهَا لاَ تُفَتَّحُ لَهُمْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ وَلَا يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى يَلِجَ الْجَمَلُ فِي سَمِّ الْخِيَاطِ وَكَذَلِكَ نَجْزِي الْمُجْرِمِينَ- (الأعراف 40)-
নিশ্চয়ই যারা আমাদের আয়াত সমূহে মিথ্যারোপ করে এবং তা থেকে অহংকারবশে মুখ ফিরিয়ে থাকে, তাদের জন্য আকাশের দুয়ার সমূহ উন্মুক্ত করা হবে না এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ না ছুঁচের ছিদ্রপথে উষ্ট্র প্রবেশ করে। এভাবেই আমরা পাপীদের বদলা দিয়ে থাকি (রাফ ৭/৪০)
অত্র আয়াতে আল্লাহ কুফরী বশে বা অজ্ঞতা বশে বলেননি। বরং অহংকার বশেবলেছেন। ফলে অহংকারী কাফেরের জান্নাতে প্রবেশ করা ঐরূপ অসম্ভব, যেরূপ ছুঁচের ছিদ্রপথে উটের প্রবেশ অসম্ভব। কাফের তওবা করে ঈমান আনতে পারে, অজ্ঞ ব্যক্তি জানার পরে ফিরে আসতে পারে। কিন্তু অহংকারী ব্যক্তি স্বীয় অহংকারের উপরে দৃঢ় থাকে ও এক সময় সে ধ্বংস হয়ে যায়। অহংকার তাই মারাত্মক পাপ। যা অন্য অধিকাংশ পাপের উৎস। আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ মানুষকে অহংকারের পাপ ও তার ভয়াবহ পরিণতি বিষয়ে সাবধান করেছেন।
অহংকারমানব স্বভাবের একটি নিকৃষ্ট অংশ। এর উপকারিতার চেয়ে অনিষ্টকারিতা বেশী। একে দমন করে সৎকর্মে লাগানোর মধ্যেই মানুষের কৃতিত্ব নির্ভর করে। মানুষের মধ্যে ষড়রিপু হল কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য। এর মধ্যে মদল দম্ভ, গর্ব, অহংকার। মাৎসর্যল ঈর্ষা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা। প্রতিটি রিপুই মানুষের প্রয়োজনে সৃষ্ট এবং প্রতিটির দক্ষ ব্যবহার কাম্য। যেমন টক-ঝাল-মিষ্টি-লবণ প্রতিটিই প্রয়োজন। কিন্তু অধিক ব্যবহারে প্রতিটিই ক্ষতিকর। জীবনের চলার পথে ষড়রিপু আমাদের সার্বক্ষণিক সাথী। এগুলি ডাক্তারের আলমারিতে সাজানো পয়জন’ (Poison)-এর শিশির মত। যা তিনি প্রয়োজনমত রোগীর প্রতি ব্যবহার করেন। অথবা মটর গাড়ীর মাথায় রাখা আগুনের বাক্সের মত। যাকে সর্বদা পাখা দিয়ে বাতাস করতে হয় এবং ড্রাইভার সর্বদা গিয়ার পরিবর্তনের মাধ্যমে আগুন নিয়ন্ত্রণ করে গাড়ী চালিয়ে থাকেন। দেহের মধ্যে লুক্কায়িত উপরোক্ত ৬টি আগুনের মধ্যে মদবা অহংকার ও আত্মম্ভরিতা হল অন্যতম প্রধান স্ফুলিঙ্গ। যা একবার জ্বলে উঠলে ও নিয়ন্ত্রণ হারালে পুরা মানবগাড়ীটাকে খাদে ফেলে ধ্বংস করে ছাড়ে।
অহংকারের আরবী নাম কিব্র (الْكِبْر)যার অর্থ বড়ত্ব। অন্যের চাইতে নিজেকে বড় মনে করাই এর অন্তর্নিহিত অর্থ। এর পারিভাষিক অর্থ, সত্যকে দম্ভভরে প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা। নিম্নের হাদীছটিতে এর পরিণতি ও ব্যাখ্যা দুটিই বর্ণিত হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِى قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ. قَالَ رَجُلٌ إِنَّ الرَّجُلَ يُحِبُّ أَنْ يَكُونَ ثَوْبُهُ حَسَنًا وَنَعْلُهُ حَسَنَةً. قَالَ : إِنَّ اللهَ جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمَالَ الْكِبْرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ- ঐ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না যার অন্তরে কণা পরিমাণ অহংকার রয়েছে। জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, লোকেরা চায় যে, তার পোষাক সুন্দর হৌক, তার জুতা জোড়া সুন্দর হৌক। জবাবে তিনি বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দর। তিনি সৌন্দর্য পসন্দ করেন। অহংকারসত্যকে দম্ভের সাথে পরিত্যাগ করা এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা[1]
এর অর্থ এটা নয় যে, অহংকার করলেই সে জাহান্নামে যাবে। বরং এর অর্থ হল সত্য জেনেও মিথ্যার উপরে দৃঢ় থাকা এবং নানারূপ দোহাই দিয়ে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা। আর অন্যকে তুচ্ছ মনে করাঅর্থ সর্বদা নিজেকে অন্যের চেয়ে বড় মনে করা এবং অন্যের কাছে নিজের মূল্যায়ন কামনা করা। তার চাহিদা মতে যথাযথ মূল্যায়ন না পাওয়াতেই সে অন্যকে হেয় জ্ঞান করে।
আবু ওয়াহাব আল-মারওয়াযী বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারককে প্রশ্ন করলাম অহংকার (الْكِبْر) কাকে বলে? তিনি বললেন, মানুষকে হেয় জ্ঞান করা। পুনরায় প্রশ্ন করলাম, ‘আত্মম্ভরিতা (العُجْب) কাকে বলে? তিনি বললেন, তোমার কাছে যা আছে, অন্যের কাছে তা নেই বলে ধারণা করা।[2] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তিনটি ধ্বংসকারী বস্ত্ত থেকে মানুষকে সাবধান করেছেন (১) প্রবৃত্তি পূজারী হওয়া (২) লোভের দাস হওয়া এবং (৩) আত্ম অহংকারী হওয়া। তিনি বলেন, এটিই হল সবচেয়ে মারাত্মক (وَهِيَ أَشَدُّهُنَّ)[3]
শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,التَّكَبُّرُ شَرٌّ مِنَ الشِّرْكِ فَإِنَّ الْمُتَكَبِّرَ يَتَكَبَّرُ عَنْ عِبَادَةِ اللهِ تَعَالَى، وَالْمُشْرِكَ يَعْبُدُ اللهَ وَغَيْرَهُ. অহংকার শিরকের চেয়েও নিকৃষ্ট। কেননা অহংকারী ব্যক্তি আল্লাহর দাসত্বের বিরুদ্ধে অহংকার করে। আর মুশরিক আল্লাহর ইবাদত করে এবং সাথে অন্যেরও করে[4]
হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, أصُوْلُ الْخَطَايَا كُلِّهَا ثَلاَثَةٌ: الْكِبْرُ وَهُوَ الَّذِيْ أصَارَ إِبْلِيسَ إِلَى مَا أصاره، والْحِرْصُ وَهُوَ الَّذِي أخرج آدم من الْجنَّة، والْحَسَدُ وَهُوَ الَّذِي جرأ أحد بني آدم على أَخِيه، فَمن وقِي شَرَّ هَذِه الثَّلاَثَة فقد وقى الشَّرَّ كله- فالكفر من الْكبر والمعاصي من الْحِرْص وَالْبَغي وَالظُّلم من الْحَسَد- সমস্ত পাপের উৎস হল তিনটি : (১) অহংকার, যা ইবলীসের পতন ঘটিয়েছিল। (২) লোভ, যা জান্নাত থেকে আদম-কে বের করে দিয়েছিল। (৩) হিংসা, যা আদম (আঃ)-এর এক সন্তানের বিরুদ্ধে অপর সন্তানকে প্রতিশোধপরায়ণ করে তুলেছিল। যে ব্যক্তি উক্ত তিনটি বস্ত্তর অনিষ্ট থেকে বেঁচে থাকতে পারবে সে যাবতীয় অনিষ্ট থেকে বেঁচে থাকতে পারবে। কেননা কুফরীর মূল উৎস হঅহংকারপাপকর্মের উৎস হলোভআর বিদ্রোহ ও সীমালংঘনের উৎস হহিংসা[5]
অহংকার ও আত্মম্ভরিতা দুটিই বড়াই ও বড়ত্বের একক উৎস থেকে উৎসারিত। বস্ত্ততঃ এই রোগে যে আক্রান্ত হয়, সে নিজেকে নিজে ধ্বংস করে। তার দ্বারা সমাজ, সংগঠন, রাষ্ট্র এমনকি নিজ পরিবারও ধ্বংস হয়।
অহংকারের নিদর্শন সমূহ
(১) দম্ভভরে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা : এটাই হল প্রধান নিদর্শন। যা উপরের হাদীছে বর্ণিত হয়েছে।
(২) নিজেকে সর্বদা অন্যের চাইতে বড় মনে করা : যেমন ইবলীস আদমের চাইতে নিজেকে বড় মনে করেছিল এবং আল্লাহর অবাধ্য হয়েছিল। সে যুক্তি দিয়েছিল, خَلَقْتَنِي مِنْ نَارٍ وَخَلَقْتَهُ مِنْ طِينٍ আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং আদমকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে (রাফ ৭/১২)অতএব أَأَسْجُدُ لِمَنْ خَلَقْتَ طِينًا আমি কি তাকে সিজদা করব, যাকে আপনি মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন? (ইসরা ১৭/৬১) এই যুক্তি ও অবাধ্যতার শাস্তিস্বরূপ আল্লাহ তাকে বলেন, فَاخْرُجْ مِنْهَا فَإِنَّكَ رَجِيمٌ বের হয়ে যাও এখান থেকে। কেননা তুমি অভিশপ্ত’ (ছোয়াদ ৩৮/৭৬)। মানব সমাজেও যারা অনুরূপ অবাধ্য ও শয়তানী চরিত্রের অধিকারী, তারা সমাজে ও সংগঠনে এভাবেই ধিকৃত ও বহিষ্কৃত হয়। তবে যারা আল্লাহর জন্য বিতাড়িত ও নির্যাতিত হন, তারা ইহকালে ও পরকালে পুরস্কৃত হন।
(৩) অন্যের সেবা ও আনুগত্য করাকে নিজের জন্য অপমানজনক মনে করা : এই প্রকৃতির লোকেরা সাধারণতঃ উদ্ধত হয়ে থাকে। এরা মনে করে সবাই আমার আনুগত্য করবে, আমি কারু অনুগত হব না। এরা ইহকালে অপদস্থ হয় এবং পরকালে জান্নাত থেকে বঞ্চিত হয়। আল্লাহ বলেন, تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِيْنَ لاَ يُرِيْدُوْنَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلاَ فَسَادًا-পরকালের ঐ গৃহ আমরা তৈরী করেছি ঐসব লোকদের জন্য, যারা এ দুনিয়াতে উদ্ধত হয় না ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করে না’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৩)।
(৪) নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করা :
শক্তিশালী ব্যক্তি, সমাজনেতা, রাষ্ট্রনেতা, যেকোন পর্যায়ের পদাধিকারী ব্যক্তি বা কর্মকর্তা ও ধনিক শ্রেণীর কেউ কেউ অনেক সময় নিজেকে এরূপ ধারণা করে থাকে। সে ভাবতেই পারে না যে, আল্লাহ যেকোন সময় তার কাছ থেকে উক্ত নেমত ছিনিয়ে নিতে পারেন। আবু জাহল এরূপ অহংকার করেছিল। সে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে তার বিরাট দল ও শক্তিশালী জনবলের ভয় দেখিয়েছিল। তার পরিণতি অবশেষে কি হয়েছিল, সবার জানা। উক্ত প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, كَلاَّ إِنَّ الْإِنْسَانَ لَيَطْغَى، أَنْ رَآهُ اسْتَغْنَى কখনই না। মানুষ অবশ্যই সীমালংঘন করেকারণ সে নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করে’ (আলাক্ব ৯৬/৬-৭)। আল্লাহ একেক জনকে একেক মেধা, প্রতিভা ও যোগ্যতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। ফলে প্রত্যেক মানুষই পরস্পরের মুখাপেক্ষী। কেউ অভাবমুক্ত নয়। তাই মানুষের জন্য অহংকার শোভা পায় না। আল্লাহ কেবল মুতাকাবিবর’ (অহংকারী)। অহংকার তাঁর চাদর (الْكِبْرِيَاءُ رِدَائِيْ)[6] সকল প্রকার বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের মালিক তিনি। তাই অহংকার কেবল তাঁরই জন্য শোভা পায়।
(৫) লোকদের কাছে বড়ত্ব যাহির করা ও নিজের ত্রুটি ঢেকে রাখা:
মূসা (আঃ) যখন ফেরাঊনকে লাঠি ও প্রদীপ্ত হস্ততালুর নিদর্শন দেখালেন, তখন ফেরাঊন ভীত হল। কিন্তু নিজের দুর্বলতা ঢেকে রেখে সে তার লোকদের জমা করে ভাষণ দিয়ে বলল,أَنَا رَبُّكُمُ الْأَعْلَى- فَأَخَذَهُ اللهُ نَكَالَ الْآخِرَةِ وَالْأُولَى আমিই তোমাদের সর্বোচ্চ পালনকর্তাফলে আল্লাহ তাকে পরকালের ও ইহকালের শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করলেন’ (নাযেআত ৭৯/২৩-২৪)।
বস্ত্ততঃ ফেরাঊনী চরিত্রের লোকের কোন অভাব সমাজে নেই। সমাজ দুষণের জন্য এসব লোকেরাই প্রধানতঃ দায়ী। আজকাল নেতাদের গাড়ী বহর, মটর সাইকেল শোভাযাত্রা ও রাস্তায় রাস্তায় তোরণের ছড়াছড়ি ফেরাঊনী অহংকারের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
একবার হযরত উবাই ইবনু কাব (রাঃ)-এর পিছনে পিছনে একদল লোককে চলতে দেখে খলীফা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) তাকে চাবুক দিয়ে আঘাত করলেন। এতে চমকে উঠে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কি হে আমীরুল মুমেনীন! জবাবে খলীফা বললেন, هَذَا ذِلَّةٌ لِلتَّابِعِ وَفِتْنَةٌ لِلْمَتْبُوْعِ এটা অনুসরণকারীর জন্য লাঞ্ছনাকর এবং অনুসৃত ব্যক্তিকে ফিৎনায় নিক্ষেপকারী[7] এখানে ফিৎনাঅর্থ অহংকার। অথচ উবাই বিন কাব (রাঃ)-এর ন্যায় বিখ্যাত ছাহাবীর জন্য এরূপ ফিৎনায় পড়ার কোন অবকাশ ছিল না। কিন্তু খলীফা ওমর (রাঃ) চেয়েছিলেন উবাইয়ের মনের মধ্যে যেন কণা পরিমাণ অহংকারের উদয় না হয়। তিনি চেয়েছিলেন যেন তার এক ভাই অহেতুক অহংকারের দোষে দোষী হয়ে জাহান্নামে পতিত না হয়। এটাই হল পরস্পরের প্রতি ইসলামী ভালোবাসার সর্বোত্তম নিদর্শন। সুবহানাল্লাহি ওয়া বেহামদিহী
এরূপ দৃষ্টান্ত হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকেও এসেছে। তিনি তাঁর পিছনে অনুসরণকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, لَوْ تَعْلَمُونَ ذُنُوبِي مَا وَطِئَ عَقِبِي رَجُلاَنِ وَلَحَثَيْتُمْ عَلَى رَأْسِي التُّرَابَ، وَلَوَدِدْتُ أَنَّ اللهَ غَفَرَ لِي ذَنْبًا مِنْ ذُنُوبِي- আমার যে কত পাপ রয়েছে তা যদি তোমরা জানতে, তাহলে দুজন লোকও আমার পিছনে হাঁটত না এবং অবশ্যই তোমরা আমার মাথায় মাটি ছুঁড়ে মারতে। আমি চাই আল্লাহ আমার গোনাহসমূহ মাফ করুন[8]
(৬) অন্যকে নিজের তুলনায় ছোট মনে করা :
মূসা ও হারূণ (আঃ) ফেরাঊনের কাছে গেলে فَقَالُوا أَنُؤْمِنُ لِبَشَرَيْنِ مِثْلِنَا وَقَوْمُهُمَا لَنَا عَابِدُونَ তারা বলেছিল, আমরা কি এমন দুব্যক্তি উপরে বিশ্বাস স্থাপন করব যারা আমাদেরই মত এবং তাদের সম্প্রদায় আমাদের দাসত্ব করে’ (মুমিনূন ২৩/৪৭)।
মক্কার কাফের নেতারাও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট থেকে বেলাল, খোবায়েব, ছুহায়েব, ইবনু মাসঊদ প্রমুখ দুর্বল শ্রেণীর লোকদের সরিয়ে দিতে বলেছিলেন, যাতে তারা তাঁর সঙ্গে বসে কথা বলতে পারেন। তখন আয়াত নাযিল হয়, وَلاَ تَطْرُدِ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ مَا عَلَيْكَ مِنْ حِسَابِهِمْ مِنْ شَيْءٍ وَمَا مِنْ حِسَابِكَ عَلَيْهِمْ مِنْ شَيْءٍ فَتَطْرُدَهُمْ فَتَكُونَ مِنَ الظَّالِمِينَ যেসব লোক সকাল-সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালকের ইবাদত করে এবং এর মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে, তাদেরকে তুমি দূরে সরিয়ে দিয়ো না। তাদের কোন আমলের হিসাব তোমার দায়িত্বে নেই এবং তোমার কোন আমলের হিসাব তাদের দায়িত্বে নেই। এরপরেও যদি তুমি তাদের সরিয়ে দাও, তাহলে তুমি যালেমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’ (আনআম ৬/৫২)।
ধনে-জনে ও পদমর্যাদায় নিম্নস্তরের লোকদের প্রতি মনের মধ্যে কোন তুচ্ছভাব উদ্রেক হওয়াটা অহংকারের লক্ষণ। অতএব এই স্বাভাবিক রোগ কঠিনভাবে দমন করা অবশ্য কর্তব্য।
অন্যকে হেয় গণ্যকারী ব্যক্তিদেরকে আল্লাহ কিয়ামতের দিন উঠাবেন এমন অবস্থায় যে, তারা ঐসব দুর্বল শ্রেণীর লোকদের পায়ের নীচে থাকবে। এটি হবে তাদেরকে দুনিয়ায় হেয় জ্ঞান করার বদলা স্বরূপ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, يُحْشَرُ الْمُتَكَبِّرُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَمْثَالَ الذَّرِّ فِى صُوَرِ الرِّجَالِ يَغْشَاهُمُ الذُّلُّ مِنْ كُلِّ مَكَانٍ فَيُسَاقُونَ إِلَى سِجْنٍ فِى جَهَنَّمَ يُسَمَّى بُولَسَ تَعْلُوهُمْ نَارُ الأَنْيَارِ يُسْقَوْنَ مِنْ عُصَارَةِ أَهْلِ النَّارِ طِينَةِ الْخَبَالِ অহংকারী ব্যক্তিগণ কিয়ামতের দিন উঠবে মানুষের রূপে পিঁপড়া সদৃশ। সর্বত্র লাঞ্ছনা তাদেরকে বেষ্টন করে রাখবে। অতঃপর তাদের বূলাসনামক জাহান্নামের এক কারাগারের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। যেখানে লেলিহান অগ্নি তাদেরকে ঢেকে ফেলবে। সেখানে তারা জাহান্নামীদের পোড়া দেহের গলিত পুঁজ-রক্তে পূর্ণ ত্বীনাতুল খাবালনামক নদী থেকে পান করবে।[9]
একদিন ছাহাবী আবু যর গিফারী (রাঃ) নিগ্রো মুক্তদাস বেলাল (রাঃ)-কে তার কালো মায়ের দিকে সম্বন্ধ করে তাচ্ছিল্য করলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁকে ধমক দিয়ে বলেন, يَا أَبَا ذَرٍّ أَعَيَّرْتَهُ بِأُمِّهِ إِنَّكَ امْرُؤٌ فِيكَ جَاهِلِيَّةٌ হে আবু যর! তুমি তাকে তার মায়ের নামে তাচ্ছিল্য করলে? তোমার মধ্যে জাহেলিয়াত রয়েছে[10] আবু যর গিফারীর ন্যায় একজন নিরহংকার বিনয়ী ছাহাবীর একদিনের একটি সাময়িক অহংকারকেও আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বরদাশত করেননি।
(৭) মানুষের সাথে অসদ্ব্যবহার করা ও তাদের প্রতি কঠোর হওয়া : এটি অহংকারের অন্যতম লক্ষণ। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, একদিন জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাক্ষাৎপ্রার্থী হল। তিনি বললেন, তোমরা ওকে অনুমতি দাও। সে তার গোত্রের কতই না মন্দ ভাই ও কতই না মন্দ পুত্র! অতঃপর যখন লোকটি প্রবেশ করল, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার সাথে অতীব নম্রভাবে কথা বললেন। পরে আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি লোকটি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করলেন। আবার সুন্দর আচরণ করলেন, ব্যাপারটা কি? জবাবে তিনি বললেন, হে আয়েশা! إِنَّ شَرَّ النَّاسِ مَنْ تَرَكَهُ النَّاسُ اتِّقَاءَ فُحْشِهِ সবচেয়ে নিকৃষ্ট সেই ব্যক্তি যাকে লোকেরা পরিত্যাগ করে ও ছেড়ে যায় তার ফাহেশা কথার ভয়ে[11]
(৮) শক্তি বা বুদ্ধির জোরে অন্যের হক নষ্ট করা : এটি অহংকারের একটি বড় নিদর্শন। আল্লাহ কাউকে বড় করলে সে উদ্ধত হয়ে পড়ে এবং যার মাধ্যমে তিনি বড় হয়েছেন ও যিনি তাকে বড় করেছেন সেই বান্দা ও আল্লাহকে সে ভুলে যায়। সে এই কথা ভেবে অহংকারী হয় যে, আমি আমার যোগ্যতা বলেই বড় হয়েছি। ফলে সে আর অন্যকে সম্মান করে না। সে তখন শক্তির জোরে বা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে অন্যের হক নষ্ট করে। এই হক সম্মানের হতে পারে বা মাল-সম্পদের হতে পারে। অন্যায়ভাবে কারু সম্মানের হানি করলে ক্বিয়ামতের দিন অহংকারী ব্যক্তিকে পিঁপড়া সদৃশ করে লাঞ্ছনাকর অবস্থায় হাঁটানো হবে।[12] অথবা তাকে ঐ মাল-সম্পদ ও মাটির বিশাল বোঝা মাথায় বহন করে হাঁটতে বাধ্য করা হবে।[13]
(৯) অধীনস্তদের প্রতি দুর্ব্যবহার করা ও তাদেরকে নিকৃষ্টভাবে খাটানো : অহংকারী মালিকেরা তাদের অধীনস্ত শ্রমিক ও কর্মচারীদের প্রতি এরূপ আচরণ করে থাকে। যা তাদের জাহান্নামী হবার বাস্তব নিদর্শন। এই স্বভাবের লোকেরা এভাবে প্রতিনিয়ত হক্কুল ইবাদনষ্ট করে থাকে। অতঃপর তাদের হক পূরণ না করে নিজেরা ঘন ঘন হজ্জ ও ওমরায় যায়। আর ভাবে যে, সদ্য ভূমিষ্ট সন্তানের ন্যায় তারা পাপমুক্ত হয়ে ফিরে এল। আদৌ নয়। আল্লাহর হক আদায়ের মাধ্যমে কখনোই বান্দার হক বিনষ্টের কাফফারা আদায় হয় না। বান্দা ক্ষমা না করলে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, اتَّقِ دَعْوَةَ الْمَظْلُومِ ، فَإِنَّهُ لَيْسَ بَيْنَهُ وَبَيْنَ اللهِ حِجَابٌ তুমি মযলূমের দোআ থেকে বেঁচে থাক। কেননা মযলূমের দোআ ও আল্লাহর মধ্যে কোন পর্দা নেই (অর্থাৎ সাথে সাথে কবুল হয়ে যায়)।[14] الظُّلْمُ ظُلُمَاتٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ যুলুম কিয়ামতের দিন ঘন অন্ধকার হয়ে দেখা দিবে[15] তিনি একদিন বলেন, তোমরা কি জানো নিঃস্ব কে? সবাই বলল, যার কোন ধন-সম্পদ নেই। তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে নিঃস্ব সেই ব্যক্তি, যে কিয়ামতের দিন ছালাত, ছিয়াম, যাকাত নিয়ে হাযির হবে। অতঃপর লোকেরা এসে অভিযোগ করে বলবে যে, তাকে ঐ ব্যক্তি গালি দিয়েছে, মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, তার মাল গ্রাস করেছে, হত্যা করেছে, প্রহার করেছে। অতঃপর তার নেকী থেকে তাদের একে একে বদলা দেওয়া হবে। এভাবে বদলা দেওয়া শেষ হবার আগেই যখন তার নেকী শেষ হয়ে যাবে, তখন বাদীদের পাপ থেকে নিয়ে তার উপর নিক্ষেপ করা হবে। অবশেষে ঐ ব্যক্তিকে জাহানণামে নিক্ষেপ করা হবে।[16] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ক্বিয়ামতের দিন অবশ্যই হকদারকে তার হক আদায় করে দেয়া হবে। এমনকি শিংওয়ালা ছাগল যদি শিংবিহীন ছাগলকে গুঁতো মেরে কষ্ট দিয়ে থাকে, সেটারও বদলা নেওয়া হবে (মানুষকে ন্যায়বিচার দেখানোর জন্য)।[17]
তিনি বলেন,ابْغُونِى فِيْ ضُعَفَائِكُمْ فَإِنَّمَا تُرْزَقُونَ وَتُنْصَرُونَ بِضُعَفَائِكُمْ তোমরা আমাকে তোমাদের দুর্বলদের মধ্যে তালাশ কর। কেননা তোমাদেরকে রূযী পৌঁছানো হয় ও সাহায্য করা হয় তোমাদের দুর্বলদের মাধ্যমে।[18] এর অর্থ তোমরা আমার সন্তুষ্টি তালাশ কর দুর্বলদের প্রতি তোমাদের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে। তিনি বলেন, যখন খাদেম তোমার খাবার নিয়ে আসে, তখন তাকে খাইয়ে তুমি শুরু কর। অথবা তাকে সাথে বসাও বা তাকে এক লোকমা দাও।[19] আল্লাহ বলেন, তোমরা মানুষের সাথে সুন্দরভাবে কথা বলো’ (বাক্বারাহ ২/৮৩)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যেখানেই তুমি থাক, আল্লাহকে ভয় কর। আর মন্দের পিছে পিছে উত্তম আচরণ কর। তাহলে মন্দ দূরীভূত হয়ে যাবে[20] আল্লাহ বলেন, ভাল ও মন্দ সমান নয়। অতএব তুমি মন্দকে ভাল দ্বারা প্রতিহত কর। তাহলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে, সে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত হয়ে যাবে’ (হামীম সাজদাহ ৪১/৩৪)।
(১০) মিথ্যা বা ভুলের উপর যিদ করা : এটি অহংকারের অন্যতম নিদর্শন। নবীগণ যখন লোকদেরকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিতেন, তখন তারা বাপ-দাদার দোহাই দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করত এবং নিজেদের ভুল ও মিথ্যার উপরে যিদ করত। যদিও শয়তান তাদেরকে (এর মাধ্যমে) জ্বলন্ত অগ্নির শাস্তির দিকে আহবান করে (লোকমান ৩১/২১)।
কেবল কাফেরদের মধ্যে নয়, বরং মুসলমানদের মধ্যেও উক্ত দোষ পরিলক্ষিত হয়। যেমন শিরক ও বিদআতে অভ্যস্ত লোকেরা বিভিন্ন অজুহাতে উক্ত পাপের উপর টিকে থাকে। অমনিভাবে বিচারক ও শাসক শ্রেণী তাদের ভুল সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসেন না। বরং একটি অন্যায় প্রবাদ চালু আছে যে, ‘হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে নাঅথচ মানুষের ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক। খলীফা ওমর (রাঃ) যখন আবু মূসা আশআরী (রাঃ)-কে কূফার গভর্ণর করে পাঠান, তখন তাকে লিখে দেন যে, তুমি গতকাল কোন সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকলে সেখান থেকে ফিরে আসতে কোন বস্ত্ত যেন তোমাকে বাধা না দেয়। কেননা الرُّجُوعُ إِلىَ الْحَقِّ خَيْرٌ مِنَ التَّمَادِى فِى الْبَاطِلِ মিথ্যার উপরে টিকে থাকার চাইতে সত্যের দিকে ফিরে আসা উত্তম[21]
আব্দুর রহমান বিন মাহদী (৩৫-১৯৮ হিঃ) বলেন, আমরা এক জানাযায় ছিলাম। যেখানে ওবায়দুল্লাহ বিন হাসান উপস্থিত ছিলেন, যিনি তখন রাজধানী বাগদাদের বিচারপতির দায়িত্বে ছিলেন। আমি তাঁকে একটি মাসআলা জিজ্ঞেস করলে তিনি ভুল উত্তর দেন। তখন আমি বললাম,أصلحك الله، القول في هذه المسألة كذا وكذا আল্লাহ আপনাকে সংশোধন হওয়ার তাওফীক দিন! এ মাসআলার সঠিক উত্তর হল এই, এই। তখন তিনি কিছুক্ষণ দৃষ্টি অবনত রাখেন। অতঃপর মাথা উঁচু করে দুবার বলেন, إذًا أرجع وأنا صاغر এখন আমি প্রত্যাবর্তন করলাম এবং আমি লজ্জিতঅতঃপর বললেন, لأن أكون ذنبا في الحق أحب إلي من أن أكون رأسا في الباطل ভুল স্বীকার করে হক-এর লেজ হওয়া আমার নিকট অধিক প্রিয় বাতিলের মাথা হওয়ার চাইতে[22] অর্থাৎ হক-এর অনুসারী হওয়া বাতিলের নেতা হওয়ার চাইতে উত্তম।
অহংকারের কারণসমূহ
১. ভাল-র প্রতি হিংসা :
আসমানে প্রথম এ হিংসা করেছিল ইবলীস। সে আদমের উচ্চ মর্যাদার প্রতি হিংসাবশে তাকে সিজদা করেনি। এই হিংসাকে সে যুক্তির আড়ালে লুকিয়ে রেখে বলেছিল, ‘আমি তার চাইতে উত্তম। কেননা আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে’ (ছোয়াদ ৩৮/৭৬)।
অতঃপর যমীনে প্রথম হিংসা করেছিল ক্বাবীল তার ভাই হাবীল-এর প্রতি। কারণ হাবীলের কুরবানী আল্লাহ কবুল করেছিলেন। কিন্তু ক্বাবীলের কুরবানী তিনি কবুল করেননি। অথচ এতে হাবীলের কোন হাত ছিল না। এ বিষয়ে কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنْ أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنَ الْآخَرِ قَالَ لَأَقْتُلَنَّكَ قَالَ إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ তুমি তাদেরকে আদম পুত্রদ্বয়ের ঘটনা সত্য সহকারে বর্ণনা কর। যখন তারা পৃথক পৃথক কুরবানী পেশ করল এবং তাদের একজনের (হাবীলের) কুরবানী কবুল করা হ, অন্য জনেরটা (কাবীলের) হল না। তখন সে (ক্বাবীল) বলল, অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব। জবাবে সে (হাবীল) বলল, আল্লাহ তো মুত্তাক্বীদের আমলই কবুল করে থাকেন’ (মায়েদাহ ৫/২৭)।
এখানেও ছিল ভাল-র প্রতি হিংসা। যুগে যুগে এটা জারি আছে। যেজন্য নবী-রাসূলগণ ও তাদের যথার্থ অনুসারীগণ সর্বদা দুষ্টুদের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন। যদিও অহংকারীরা সর্বদা নিজেদের সাফাই গেয়ে মিথ্যা বলে থাকে। কথায় বলে, ‘এক হাতে তালি বাজে নাকথাটি অনেক ক্ষেত্রে সত্য হলেও আল্লাহভীরু সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের বেলায় তা খাটে না। উপরের দৃষ্টান্তগুলিই তার প্রমাণ।
২. মালের আধিক্য :
অধিক ধন-সম্পদ মানুষকে অনেক সময় অহংকারী করে তোলে। মাল ও সন্তান মানুষের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ। কিন্তু মানুষ অনেক সময় এর দ্বারা ফেৎনায় পতিত হয় এবং অহংকারে স্ফীত হয়ে পথভ্রষ্ট হয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ আল্লাহ ক্বারূণের কথা বর্ণনা করেছেন। যেমন তিনি বলেন, إِنَّ قَارُونَ كَانَ مِنْ قَوْمِ مُوسَى فَبَغَى عَلَيْهِمْ وَآتَيْنَاهُ مِنَ الْكُنُوزِ مَا إِنَّ مَفَاتِحَهُ لَتَنُوءُ بِالْعُصْبَةِ أُولِي الْقُوَّةِ إِذْ قَالَ لَهُ قَوْمُهُ لاَ تَفْرَحْ إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ الْفَرِحِينَ- ... قَالَ إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَى عِلْمٍ عِنْدِي أَوَلَمْ يَعْلَمْ أَنَّ اللهَ قَدْ أَهْلَكَ مِنْ قَبْلِهِ مِنَ الْقُرُونِ مَنْ هُوَ أَشَدُّ مِنْهُ قُوَّةً وَأَكْثَرُ جَمْعًا وَلاَ يُسْأَلُ عَنْ ذُنُوبِهِمُ الْمُجْرِمُونَক্বারূণ ছিল মূসার সম্প্রদায়ভুক্ত। কিন্তু সে তাদের প্রতি ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছিল। আমরা তাকে এমন ধন-ভান্ডার দান করেছিলাম, যার চাবিসমূহ বহন করা একদল শক্তিশালী লোকের পক্ষে কষ্টসাধ্য ছিল। তার সম্প্রদায় তাকে বলেছিল, দম্ভ করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ দাম্ভিকদের পসন্দ করেন না।’ ... ‘সে বলল, এ সম্পদ আমি আমার জ্ঞান বলে প্রাপ্ত হয়েছি। অথচ সে কি জানে না যে, আল্লাহ তার পূর্বে বহু মানবগোষ্ঠীকে ধ্বংস করেছেন, যারা তার চাইতে শক্তিতে প্রবল ছিল এবং সম্পদে প্রাচুর্যময় ছিল। আর অপরাধীদেরকে তাদের অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে না (তারা সরাসরি জাহান্নামে যাবে)’ (ক্বাছাছ ২৮/৭৬, ৭৮)।
ক্বারূণী ধন সবাই পেতে চায়। কিন্তু তা মানুষকে অহংকারী করে তোলে। যা তাকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করে। যেমন আল্লাহ বলেন,فَخَسَفْنَا بِهِ وَبِدَارِهِ الْأَرْضَ فَمَا كَانَ لَهُ مِنْ فِئَةٍ يَنْصُرُونَهُ مِنْ دُونِ اللهِ وَمَا كَانَ مِنَ الْمُنْتَصِرِينَ অতঃপর আমরা ক্বারূণকে ও তার প্রাসাদকে ভূগর্ভে ধ্বসিয়ে দিলাম। ফলে তার পক্ষে এমন কোন দল ছিল না, যে আল্লাহর শাস্তি হতে তাকে সাহায্য করতে পারে এবং সে নিজেও আত্মরক্ষায় সক্ষম ছিল না’ (ক্বাছাছ ২৮/৮১)।
৩. ইলম :
ইলম অনেক সময় আলেমকে অহংকারী বানায়। দুধরনের লোকের মধ্যে এটা দেখা যায়। জন্মগতভাবে বদ চরিত্রের লোকেরা যখন ইলম শিখে, তখন ইলমকে তার বদস্বভাবের পক্ষে কাজে লাগায়। এইসব আলেমরা কুরআন-হাদীছের অপব্যাখ্যা করে এবং নিজেকে অন্যদের তুলনায় বড় আলেম বলে যাহির করে। এদের মধ্যে ইলম থাকলেও সেখানে তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি থাকে না। তাদের সকল কাজে লক্ষ্য থাকে দুনিয়া অর্জন করা ও মানুষের প্রশংসা কুড়ানো। যা তাদেরকে অহংকারী করে ফেলে। যেমন আববাসীয় যুগের শ্রেষ্ঠ কবি আবুত ত্বাইয়েব আহমাদ বিন হুসাইন আল-মুতানাববী (৩০৩-৩৫৪ হিঃ)[23] বলেন,
مَا مُقامِي بِأَرْضِ نَخْلَةَ إلاَّ + كمُقامِ الْمَسيحِ بين اليَهُودِ
নাখলার জনপদে আমার অবস্থান ইহূদীদের মাঝে মসীহ ঈসার অবস্থানের ন্যায়।
অনুরূপভাবে অন্ধ কবি আবুল আলা আল-মাআররী (৩৬৩-৪৪৯ হিঃ) বলেন,
وأنِّي وإنْ كنتُ الأخيرَ زمانُهُ + لَآتٍ بِمَا لَمْ تَسْتَطِعْهُ الْأَوَائِلُ
আমি যদিও কালের হিসাবে শেষে এসেছি। তথাপি আমি যা এনেছি, তা পূর্বের লোকেরা আনতে সক্ষম হয়নি[24]
দ্বিতীয় কারণ হ, অল্প বিদ্যা। যেমন কিছু ইলম শিখেই নিজেকে অন্যের তুলনীয় মনে করা এবং বলা যে, هُمْ رِجَالٌ وَنَحْنُ رِجَالٌ তারাও মানুষ ছিলেন, আমরাও মানুষ[25] আমরা ও তারা সমান। এটা তাদের অহংকারের পরিচয়। নিঃসন্দেহে পূর্ববর্তী বিদ্বানদের মর্যাদা বেশী। কেননা তাদের পথ ধরেই পরবর্তীরা এসেছে। তাছাড়া সমকালীন প্রত্যেকেই পৃথক গুণ ও মেধার অধিকারী। অতএব কেউ কারু সমান নয়। প্রত্যেকেই নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল।
প্রকৃত ইলম হল সেটাই যা মানুষকে বিনয়ী ও আল্লাহভীরু বানায়। ইমাম মালেক বিন আনাস (৯৩-১৭৯ হিঃ)-কে ৪৮ টি প্রশ্ন করা হলে তিনি ৩২ টি প্রশ্নের উত্তরে বলেন, لاَ أَدْرِي আমি জানি না[26] বহু মাসআলায় তিনি বলতেন, তুমি অন্যকে জিজ্ঞেস কর।’ ‘কাকে জিজ্ঞেস করব? এরূপ প্রশ্নের উত্তরে তিনি কারু নাম না করে বলতেন, আলেমদের জিজ্ঞেস করতিনি মৃত্যুকালে কাঁদতে থাকেন। কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি আমার রায়অনুযায়ী যত ফৎওয়া দিয়েছি প্রতিটির বদলায় যদি আমাকে চাবুক মারা হত! ... হায় যদি আমি কোন ফৎওয়া না দিতাম!।[27] বহু ইখতেলাফী মাসআলায় ইমাম আহমাদ (১৬৪-২৪১ হিঃ) বলতেন, আমি জানি না[28]
ইমাম আবু হানীফা (৮০-১৫০ হিঃ) বলতেন, عِلْمُنَا هَذَا رَأْيٌ وَهُوَ أَحْسَنُ مَا قَدَرْنَا عَلَيْهِ ، وَمَنْ جَاءَنَا بِأَحْسَنَ مِنْهُ قَبِلْنَاهُ مِنْهُ আমাদের ইলম হরায়আমাদের নিকটে এটাই সর্বোত্তম হিসাবে অনুমিত হয়েছে। যে ব্যক্তি এর চেয়ে উত্তম নিয়ে আসবে, আমরা তার কাছ থেকে সেটা গ্রহণ করব[29] পরবর্তী যুগে সালাফে ছালেহীনের একটি সাধারণ রীতি ছিল এই যে, তাঁরা নিজস্ব রায় থেকে কিছু লিখলে শেষে বলতেন, واللهُ أَعْلَمُ بِالصِّدْقِ وَالصَّوَابِ আল্লাহ সত্য ও সঠিক সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত
সত্যসন্ধানী আল্লাহভীরু আলেমদের দিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ বান্দাদের মধ্যে আলেমরাই কেবল আল্লাহকে ভয় করে থাকে (ফাত্বির ৩৫/২৮)এখানে আলেম বলতে দ্বীনী ইলমের অধিকারীদের বুঝানো হয়েছে। কেননা দুনিয়াবী ইলম কাফের-মুশরিকরাও শিখে থাকে। কিন্তু তারা আল্লাহভীরু নয়। আর দুনিয়াবী ইলম কাউকে আল্লাহভীরু বানায় না আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ব্যতীত।
পক্ষান্তরে যারা ইলমকে দুনিয়া হাছিলের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করে, তাদের বিষয়ে হাদীছে কঠিন হুঁশিয়ারী এসেছে।
যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, ক্বিয়ামতের দিন প্রথম বিচার করা হবে শহীদ, আলেম ও দানশীল ব্যক্তিদের। দুনিয়াসর্বস্ব নিয়তের কারণে তাদেরকে উপুড়মুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।[30] তিনি বলেন, যে ব্যক্তি ইলম শিখল আলেমদের সঙ্গে বিতর্ক করার জন্য এবং মূর্খদের সাথে ঝগড়া করার জন্য অথবা মানুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য আল্লাহ তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন[31]
তিনি আরও বলেন, مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَى بِهِ وَجْهُ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ لاَ يَتَعَلَّمُهُ إِلاَّ لِيُصِيبَ بِهِ عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ যে ব্যক্তি ইলম শিখেছে যদ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়, অথচ সে তা শিখেছে পার্থিব সম্পদ লাভের জন্য,   ব্যক্তি  ক্বিয়ামতের  দিন  জান্নাতের
সুগন্ধিও পাবে না[32]
অথচ যে ব্যক্তি স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে ইলম শিখে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দেন। ফেরেশতারা তার (নিরাপত্তার জন্য) তাদের ডানাসমূহ বিছিয়ে দেন এবং আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে, এমনকি পানির মাছ ও গর্তের পিঁপড়ারাও তার জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে। এইসব আলেমগণ হলেনوَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءِনবীগণের ওয়ারিছঅর্থাৎ তাঁদের ইলমের উত্তরাধিকারী। কেননা নবীগণ কোন দীনার ও দিরহাম ছেড়ে যাননি, কেবল ইলম ব্যতীত। যে ব্যক্তি সেই ইলম লাভ করেছে, সে ব্যক্তি পূর্ণভাবেই তা লাভ করেছে’ (অর্থাৎ সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ ইলম সে লাভ করেছে)।[33]
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলতেন, لَيْسَ الْعِلْمُ بِكَثْرَةِ الرِّوَايَةِ، إِنَّمَا الْعِلْمُ الْخَشْيَةُ অধিক হাদীছ বর্ণনা প্রকৃত জ্ঞানার্জন নয়। বরং আল্লাহভীতিই হল প্রকৃত জ্ঞান[34]
অতএব আল্লাহকে চেনা ও জানা এবং আল্লাহভীতি অর্জন করাই হল ইলম হাছিলের মূল লক্ষ্য। আল্লাহভীতি সৃষ্টি হলেই বাকী সবকিছুর জ্ঞান তার জন্য সহজ হয়ে যায়। কুরআন ও হাদীছ হল সকল ইলমের খনি। সেখানে গবেষণা করলে মানবীয় চাহিদার সকল দিক ও বিভাগ পরিচ্ছন্ন হয়ে গবেষকের সামনে ফুটে ওঠে। আল্লাহর রহমতে তার অন্তর জগত খুলে যায়। ফলে সে অহংকারমুক্ত হয়।
৪. পদমর্যাদা :
উচ্চ পদমর্যাদা মানুষের মধ্যে অনেক সময় অহংকার সৃষ্টি করে। মূর্খরা এটাকে তাদের হীন স্বার্থে ব্যবহার করে। জ্ঞানীরা এর মাধ্যমে মানব কল্যাণে অবদান রাখেন। পদমর্যাদা একটি কঠিন জওয়াবদিহিতার বিষয়। যিনি যত বড় দায়িত্বের অধিকারী, তাকে তত বড় জওয়াবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, মনে রেখ, তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকে স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। শাসক তার প্রজাসাধারণের দায়িত্বশীল। তিনি তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। ব্যক্তি তার পরিবারের দায়িত্বশীল। সে তার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। স্ত্রী তার স্বামীর গৃহ ও সন্তানাদি সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। চাকর তার মনিবের মাল-সম্পদ বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব সাবধান! তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকে স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে[35]
যে ব্যক্তি পদমর্যাদা বা দায়িত্ব পেয়ে অহংকারী হয় এবং পদের অপব্যবহার করে, তার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَا مِنْ عَبْدٍ يَسْتَرْعِيهِ اللهُ رَعِيَّةً يَمُوتُ يَوْمَ يَمُوتُ وَهُوَ غَاشٌّ لِرَعِيَّتِهِ إِلاَّ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে লোকেদের উপর দায়িত্বশীল নিয়োগ করেন। অতঃপর সে তার লোকদের সাথে খেয়ানতকারী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, আল্লাহ তার উপরে জান্নাতকে হারাম করে দেন[36] মূলতঃ যুলুম-খেয়ানত সবকিছুর উৎপত্তি হয় পদমর্যাদার অহংকার থেকে। তাই জান্নাত পিয়াসী বান্দাকে এ বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لِكُلِّ غَادِرٍ لِوَاءٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرْفَعُ لَهُ بِقَدْرِ غَدْرِهِ أَلاَ وَلاَ غَادِرَ أَعْظَمُ غَدْرًا مِنْ أَمِيرِ عَامَّةٍ ক্বিয়ামতের দিন প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতকের কোমরে একটা করে ঝান্ডা স্থাপন করা হবে। যা তার খেয়ানতের পরিমাণ অনুযায়ী উঁচু হবে। মনে রেখ, সেদিন সবচেয়ে উঁচু ঝান্ডা হবে প্রধান শাসকের খেয়ানতের ঝান্ডা[37] অতএব পদমর্যাদা যেন মনের মধ্যে অহংকার সৃষ্টি না করে; বরং দায়িত্বের জন্য কৈফিয়ত দেয়ার ভয়ে হৃদয় যেন সর্বদা ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে, আল্লাহর নিকটে সর্বদা সেই তাওফীক কামনা করতে হবে।
৫. বংশ মর্যাদা :
বংশ মর্যাদা মানুষের উচ্চ সম্মানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি মানদন্ড। এই মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকে, যতক্ষণ বংশের লোকেরা বিনয়ী ও চরিত্রবান থাকে। উক্ত দুটি গুণ যত বৃদ্ধি পায়, তাদের সম্মান তত বৃদ্ধি পায়। কিন্তু যদি সেখানে কথায় ও আচরণে দাম্ভিকতা প্রকাশ পায়, তাহলে কচুর পাতার পানির মত উক্ত সম্মান ভূলুণ্ঠিত হয়।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللهَ أَوْحَى إِلَىَّ أَنْ تَوَاضَعُوا حَتَّى لاَ يَفْخَرَ أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ وَلاَ يَبْغِى أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ আল্লাহ আমাকে প্রত্যাদেশ করেছেন যে, তোমরা বিনয়ী হও। তোমাদের কেউ যেন একে অপরের উপর গর্ব না করে এবং একে অপরের উপর বাড়াবাড়ি না করে[38]
তিনি বলেন, লোকেরা যেন তাদের (মুশরিক) বাপ-দাদার নামে গর্ব করা হতে বিরত থাকে, যারা মরে জাহান্নামের অঙ্গারে পরিণত হয়েছে ... নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের থেকে জাহেলিয়াতের অহমিকা ও বাপ-দাদার অহংকার দূরীভূত করে দিয়েছেন। এক্ষণে সে আল্লাহভীরু মুমিন অথবা হতভাগ্য পাপী মাত্র। মানবজাতি সবাই আদমের সন্তান। আর আদম হল মাটির তৈরী’ (অতএব অহংকার করার মত কিছুই নেই)।[39] তিনি নিজের সম্পর্কে বলেন,لاَ تُطْرُونِى كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ ، فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ ، فَقُولُوا عَبْدُ اللهِ وَرَسُولُهُতোমরা আমার প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করো না, যেরূপ খ্রিষ্টানরা মারিয়ামপুত্র ঈসার ব্যাপারে করেছে। আমি আল্লাহর একজন বান্দা মাত্র। অতএব তোমরা বলো, আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল[40]
সঙ্গত কারণে বিশেষ অবস্থায় বংশ মর্যাদাকে ইসলাম গুরুত্ব দিয়েছে। যেমন (ক)  বৈবাহিক সমতার ক্ষেত্রে।[41] অনুরূপভাবে (খ) রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে। যেমন পরবর্তী খলীফা নির্বাচনের ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলে যান, الأَئِمَّةُ مِنْ قُرَيْشٍনেতা হবেন কুরায়েশ থেকে[42] তাঁর মৃত্যুর পরে খলীফা নির্বাচন নিয়ে মুহাজির ও আনছারদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হলে উক্ত হাদীছটির মাধ্যমে সব দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে। অতঃপর সবাই মুহাজির নেতা আবুবকর (রাঃ)-কে খলীফা হিসাবে মেনে নেন। এই সিলসিলা খেলাফতে রাশেদাহ, খিলাফতে বনু উমাইয়া ও আববাসীয় পর্যন্ত অব্যাহত  থাকে। (গ) যুদ্ধকালীন সময়ে। যেমন হোনায়েন যুদ্ধে শত্রুবেষ্টিত অবস্থায় সৃষ্ট মহা সংকটকালে দৃঢ়চেতা রাসূল (ছাঃ) খচ্চরের পিঠ থেকে নেমে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে কাফেরদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, أَنَا النَّبِىُّ لاَ كَذِبْ ، أَنَا ابْنُ عَبْدِ الْمُطَّلِبْ আমিই নবী মিথ্যা নই। আমি আব্দুল মুত্ত্বালিবের পুত্র।রাবী বলেন, সেদিন তাঁর চাইতে দৃঢ় কাউকে দেখা যায়নি[43]
এখানে তিনি আরবের শ্রেষ্ঠ বংশের নেতার পুত্র হিসাবে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করেছেন। এর দ্বারা তিনি শত্রুদের বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, কুরায়েশ বংশের শ্রেষ্ঠ সন্তান আমি বুক দিতে জানি, পিঠ দিতে জানি না। বস্ত্ততঃ তাঁর এই হুমকিতে দারুণ কাজ হয়। মাত্র ২০ দিন পূর্বে ইসলাম গ্রহণকারী কুরায়েশ নেতা আববাস, আবু সুফিয়ান বিন হারেছ, হাকীম বিন হিযাম সহ অন্যেরা সবাই দ্রুত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পাশে এসে দাঁড়ান এবং মুহূর্তের মধ্যে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। শত্রুপক্ষ নিমেষে পরাজিত হয় ও পালিয়ে যায়।
বংশ মর্যাদার এই তারতম্যকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করলেই সেটা দোষের হয়। অন্যায়ভাবে বংশের গৌরব করাকে তিনি জাহেলিয়াতের অংশ (عُبِّيَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ) বলে ধিক্কার দিয়েছেন।[44]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তোমাদের মধ্যে যারা জাহেলী যুগে উত্তম ছিলে, তারা ইসলামী যুগেও উত্তম, যদি তারা দ্বীনের জ্ঞানে পারদর্শী হয়[45] হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর প্রশংসায় তিনি বলেন, সম্ভ্রান্তের পুত্র সম্ভ্রান্ত। তাঁর পুত্র সম্ভ্রান্ত ও তাঁর পুত্র সম্ভ্রান্ত। তাঁরা হলেন ইবরাহীম, তাঁর পুত্র ইসহাক, তাঁর পুত্র ইয়াকূব এবং তাঁর পুত্র ইউসুফ[46] এতে বুঝা যায় যে, বংশমর্যাদা প্রশংসিত। কিন্তু অন্যায়ভাবে বংশগৌরব করাটা নিন্দনীয়।
ইসলামে দ্বীন ও আল্লাহভীতিকে সম্মান ও মর্যাদার মানদন্ড হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন,إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْ তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত সেই ব্যক্তি, যিনি সবচেয়ে আল্লাহভীরু’ (হুজুরাত ৪৯/১৩)। যেমন দ্বীন ও তাক্বওয়ার কারণেই কৃষ্ণাঙ্গ মুক্তদাস বেলাল উচ্চ সম্মান লাভ করেছিলেন। ওমর (রাঃ) বলতেন,أَبُو بَكْرٍ سَيِّدُنَا، وَأَعْتَقَ سَيِّدَنَا، يَعْنِى بِلاَلاً আবুবকর আমাদের নেতা এবং তিনি মুক্ত করেছেন আমাদের নেতাকে (অর্থাৎ বেলালকে)[47] মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে কাবাগৃহের ছাদে দাঁড়িয়ে আযান দিতে বলেন। তার এই মহাসম্মান দেখে কুরায়েশ নেতারা সমালোচনা করেছিলেন (ইবনে হিশাম ২/৪১৩)ওযূ নষ্ট হলেই তাহিইয়াতুল ওযূ এবং আযানের পরেই মসজিদে তাহিইয়াতুল মাসজিদ-এর নফল ছালাত আদায়ের নিয়মিত সদভ্যাসের কারণেই জান্নাতে বেলালের অগ্রগামী পদশব্দ স্বপ্নের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) শুনেছিলেন ও তার উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন।[48]
বস্ত্ততঃ ইসলামের উদার সাম্যের কারণেই কুরায়েশ নেতা আবুবকর ও ওমরের পাশাপাশি পায়ে পা লাগিয়ে ছালাতে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছেন আবিসিনিয়ার বেলাল হাবশী, রোমের ছুহায়েব রূমী, পারস্যের সালমান ফারেসী প্রমুখ ক্রীতদাসগণ। কোটি কোটি মুসলমান তাদের নাম উচ্চারণের সাথে সাথে দোআ করে বলেন, রাযিয়াল্লাহু আনহু (আল্লাহ তার উপরে সন্তুষ্ট হউন!)। স্রেফ দ্বীনের কারণে বেলাল এখানে উচ্চ সম্মানিত। পক্ষান্তরে কুফরীর কারণে তার মনিব উমাইয়া বিন খালাফ হলেন অপমানিত ও লাঞ্ছিত। অথচ তিনি ছিলেন অন্যতম কুরায়েশ নেতা এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আপন চাচা। অতএব ইসলামে বংশ মর্যাদা স্বীকৃত ও প্রশংসিত হলেও দ্বীন ও তাক্বওয়া না থাকলে তা নিন্দিত ও মূল্যহীন। এখানে সকলের সম্মান ও মর্যাদার মানদন্ড হল ঈমান ও তাক্বওয়া। মুসলমান সবাই ভাই ভাই। দাস-মনিবে কোন প্রভেদ নেই। পৃথিবীর কোন সমাজ ব্যবস্থায় এর কোন নযীর নেই। কেবল অহংকারী ব্যক্তিরাই এর বিপরীত আচরণ করে থাকে।
৬. ইবাদত ও নেক আমল :
ইবাদত ইসলামের মূল উদ্দেশ্য হলেও তা অনেক সময় মুমিনের মধ্যে অহংকার সৃষ্টি করে। যা তাকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করে।
বহু নেককার ও ইবাদতগুযার ব্যক্তি অলি-আউলিয়া, গাউছ-কুতুব-আবদাল, পীর-মাশায়েখ ইত্যাদি লকবে অভিহিত হন। তারা ভক্তের ভক্তি রসে আপ্লুত হতে ভালবাসেন। নযর-নেয়ায, পদসেবা গ্রহণ ইত্যাদি তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। যা তাদের মধ্যে লোভ ও অহংকার সৃষ্টি করে।
খাত্ত্বাবী বর্ণনা করেন যে, আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক একবার খোরাসানের এক বিখ্যাত দরবেশের খানক্বায় গেলেন। কিন্তু তিনি তাঁর দিকে ভ্রুক্ষেপ করলেন না। তখন তাকে বলা হ, আপনি কি জানেন ইনি কে? ইনি হলেন আমীরুল মুমিনীন ফিল হাদীছ আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারকএকথা শুনে দরবেশ দ্রুত বেরিয়ে গিয়ে তাঁর নিকটে ওযর পেশ করলেন ও তাঁকে উপদেশ দিতে বললেন। তখন তিনি তাকে বললেন,إِذَا خَرَجْتَ مِنْ مَنْزِلِكَ فَلا يَقَعْ بَصَرُكَ عَلَى أَحَدٍ إِلا أُرِيتَ أَنَّهُ خَيْرٌ مِنْكَ যখন তুমি ঘর থেকে বের হবে, যখন তুমি যাকেই দেখবে, তাকেই তোমার চাইতে উত্তম বলে মনে করবে[49]
পক্ষান্তরে সালাফে ছালেহীনের নীতি ছিল এই যে, তারা সর্বদা নিজেকে অন্যের চাইতে হীন মনে করতেন। যেমন (ক) বকর বিন আব্দুল্লাহ মুযানী বলেন,نَظَرْتُ إِلَى أَهْلِ عَرَفَاتٍ ظَنَنْتُ أَنَّهُ قَدْ غُفِرَ لَهُمْ لَوْلاَ أَنِّي كُنْتُ فِيهِمْ بِهِ আমি আরাফাহ ময়দানে অবস্থানরত সকলের দিকে দেখলাম এবং ভাবলাম যে, এদের সবাইকে ক্ষমা করা হয়েছে, যদি না আমি এদের মধ্যে থাকতামঅর্থাৎ কেবল আমাকেই ক্ষমা করা হয়নি।[50]
(খ) ইসলামের ইতিহাস প্রথম মুজাদ্দিদ খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীয (৬১-১০১ হিঃ)-কে বলা হ, আপনি মারা গেলে আমরা আপনাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কক্ষে দাফন করব। জওয়াবে তিনি বললেন,لأن ألقى الله بكل ذنب غير الشرك أحب إلي من أن أرى نفسي أهلاً لذلك শিরক ব্যতীত যাবতীয় পাপ নিয়ে আল্লাহর কাছে হাযির হওয়াটা আমার নিকট অধিক প্রিয় ঐ স্থানে কবরস্থ হওয়ার জন্য নিজেকে যোগ্য মনে করার চাইতে[51] এর মাধ্যমে তিনি নিজেকে হীন মনে করেছেন।
(গ) আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) বলেন, আমরা একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে বসেছিলাম। এমন সময় তিনি বললেন, ‘আল্লাহর নবী নূহ (আঃ) মৃত্যুকালে স্বীয় পুত্রকে অছিয়ত করে বলেন, আমি তোমাকে দুটি বিষয়ে নির্দেশ দিচ্ছি ও দুটি বিষয়ে নিষেধ করে যাচ্ছি। নির্দেশ হল তুমি বলবে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহকেননা আসমান ও যমীনের সবকিছু যদি এক হাতে রাখা হয় এবং এটিকে যদি এক হাতে রাখা হয়, তাহলে এটিই ভারি হবে। দ্বিতীয় হসুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহীকেননা এটি সকল বস্ত্তর তাসবীহ এবং এর মাধ্যমেই সকল সৃষ্টিকে রূযী দেওয়া হয়। আর আমি তোমাকে নিষেধ করে যাচ্ছি দুটি বস্ত্ত থেকে : শিরক ও অহংকার। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলা হ, আমরা সুন্দর জুতা পরি, সুন্দর পোষাক পরিধান করি, লোকেরা আমাদের কাছে এসে বসে- এগুলি কি অহংকার হবে? তিনি বললেন, না। বরং অহংকার হ, সত্যকে দম্ভভরে প্রত্যাখ্যান করা ও মানুষকে হেয় জ্ঞান করা।[52]
সত্য প্রত্যাখ্যান করা ও নিজের ভুলের উপর যিদ ও হঠকারিতার বিষয়টি বেশী দেখা যায় শিরক-বিদআত ও তাকলীদপন্থী লোকদের মধ্যে, নেতাদের মধ্যে এবং মূর্খ ও ধর্মান্ধ লোকদের মধ্যে। প্রত্যেকে নিজেকে নিয়েই গর্বিত থাকে। কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে নিজেকে সংশোধনের আকাংখা তাদের মধ্যে দেখা যায় না। বংশের নেতারা বড়াই করেন তাদের আভিজাত্য নিয়ে। নারীরা অহংকার করে তাদের সৌন্দর্য নিয়ে, ধনীরা অহংকার করে তাদের ধন নিয়ে, আলেমরা অহংকার করেন তাদের ইলম ও অনুসারী দল নিয়ে, দলনেতারা অহংকার করেন তাদের দল নিয়ে, রাষ্ট্রনেতারা অহংকার করেন তাদের শক্তি ও ক্ষমতা নিয়ে। অথচ সব অহংকারই ধূলায় মিশে যাবে আল্লাহর একটি কুনশব্দে। অতএব হে মানুষ! অহংকারী হয়ো না, বিনয়ী হও। উদ্ধত হয়ো না, কৃতজ্ঞ হও। অতীত ভুলো না, সামনে তাকাও।
পরিণতি :
দুনিয়াতে অহংকারের পরিণতি হল লাঞ্ছনা। আর আখেরাতে এর পরিণতি হত্বীনাতুল খাবালঅর্থাৎ জাহান্নামীদের পুঁজ-রক্ত পান করা। যার অন্তরে যতটুকু অহংকার সৃষ্টি হবে, তার জ্ঞান ততটুকু হরাস পাবে। যদি কারু অন্তরে অহংকার স্থিতি লাভ করে, তবে তার জ্ঞানচক্ষু অন্ধ হয়ে যায়। বোধশক্তি লোপ পায়। সে অন্যের চাইতে নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। কাম্য সম্মান না পেলে সে মনোকষ্টে মরতে বসে। তার চেহারায় ও আচরণে, যবানে ও কর্মে অহংকারের দুর্গন্ধ বের হতে থাকে। ফলে মানুষ তার থেকে ছিটকে পড়ে। এক সময় সে নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। একাকীত্বের যন্ত্রণায় সে ছটফট করতে থাকে। কিন্তু বাইরে ঠাট বজায় রাখে। এভাবেই সে দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে যায়। বদরের যুদ্ধে আবু জাহল মরার সময় বলেছিল, ‘আমার চাইতে বড় কোন মানুষকে তোমরা হত্যা করেছ কি’? অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘মদীনার ঐ চাষারা ব্যতীত যদি অন্য কেউ আমাকে হত্যা করত’?[53]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ الْجَنَّةِ كُلُّ ضَعِيفٍ مُتَضَعِّفٍ لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللهِ لَأَبَرَّهُ، أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ النَّارِ كُلُّ عُتُلٍّ جَوَّاظٍ مُسْتَكْبِرٍ আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতীদের বিষয়ে খবর দিব না? তারা হল দুর্বল এবং যাদেরকে লোকেরা দুর্বল ভাবে। কিন্তু তারা যদি আল্লাহর নামে কসম দিয়ে কিছু বলে, আল্লাহ তা অবশ্যই কবুল করেন। অতঃপর তিনি বলেন, আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নামীদের বিষয়ে খবর দিব না? তারা হল বাতিল কথার উপর ঝগড়াকারী, হঠকারী ও অহংকারী[54] অর্থাৎ হকপন্থী মুমিনগণ দুনিয়াবী দৃষ্টিতে দুর্বল হলেও আল্লাহর দৃষ্টিতে সবচেয়ে সবল। কেননা তাদের দোআ দ্রুত কবুল হয় এবং আল্লাহর গযবে অহংকারী ধ্বংস হয়।
পবিত্র কুরআনে জাহান্নামীদের প্রধান দোষ হিসাবে তাদের অহংকারকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَسِيقَ الَّذِينَ كَفَرُوا إِلَى جَهَنَّمَ زُمَرًا ... قِيلَ ادْخُلُوا أَبْوَابَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا فَبِئْسَ مَثْوَى الْمُتَكَبِّرِينَ- কাফিরদের দলে দলে জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে’... ‘তখন তাদেরকে বলা হবে তোমরা জাহান্নামের দরজা সমূহে প্রবেশ কর সেখানে চিরস্থায়ীভাবে অবস্থানের জন্য। অতএব অহংকারীদের বাসস্থান কতই না নিকৃষ্ট (যুমার ৩৯/৭১-৭২)এখানে কাফিরদের বাসস্থান না বলে অহংকারীদের বাসস্থানবলা হয়েছে। কেননা কাফিরদের কুফরীর মূল কারণ হল তাদের অহংকার।
অহংকার দূরীকরণের উপায় সমূহ
অহংকার মানুষের ভিতরে লুক্কায়িত একটা বিষের নাম। একে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না। কিন্তু একে দমিয়ে রাখতে হবে, যেন মাথা উঁচু করতে না পারে। যেমন ঝাড়িয়ে সাপের বিষ নামাতে হয়। মনের মধ্যে এই বিষ-এর এর উদয় হলেই বুদ্বুদের মত একে হাওয়া করে দিতে হবে। তাই কেবল অহংকার দূরীকরণের আকাংখাই যথেষ্ট নয়, বরং এ রোগের রীতিমত চিকিৎসা ও প্রতিষেধক প্রয়োজন। নিম্নে এ বিষয়ে বর্ণিত হল।-
১. নিজের সৃষ্টি ও মৃত্যুর কথা সর্বদা স্মরণ করা : মানুষ তার জন্মের সময় উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না। মৃত্যুর পর সে লাশে পরিণত হবে। আর মৃত্যুর ঘণ্টা সর্বদা তার মাথার উপর ঝুলে আছে। হুকুম হলেই তার রূহ যার হুকুমে তার দেহে এসেছিল তার কাছেই চলে যাবে। তার প্রাণহীন দেহটা পড়ে থাকবে দুনিয়ায় পোকার খোরাক হবার জন্য।
আল্লাহ বলেন, أَوَلَمْ يَرَ الْإِنْسَانُ أَنَّا خَلَقْنَاهُ مِنْ نُطْفَةٍ فَإِذَا هُوَ خَصِيمٌ مُبِينٌ- وَضَرَبَ لَنَا مَثَلاً وَنَسِيَ خَلْقَهُ قَالَ مَنْ يُحْيِ الْعِظَامَ وَهِيَ رَمِيمٌ- قُلْ يُحْيِيهَا الَّذِي أَنْشَأَهَا أَوَّلَ مَرَّةٍ وَهُوَ بِكُلِّ خَلْقٍ عَلِيمٌ মানুষ কি দেখে না যে, আমরা তাকে সৃষ্টি করেছি শুক্রবিন্দু হতে? অথচ সে এখন হয়ে পড়েছে প্রকাশ্যে বিতর্ককারীমানুষ আমাদের সম্পর্কে নানা উপমা দেয়। অথচ সে নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে ভুলে যায়। আর বলে, কে এই পচা-গলা হাড়-হাড্ডিকে পুনর্জীবিত করবে’? ‘তুমি বলে দাও, ওকে পুনর্জীবিত করবেন তিনি, যিনি ওটাকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলেন। বস্ত্ততঃ তিনি সকল সৃষ্টি সম্পর্কে সম্যক অবহিত’ (ইয়াসীন ৩৬/৭৭-৭৯)।
তিনি বলেন, أَيْنَمَا تَكُونُوا يُدْرِكْكُمُ الْمَوْتُ وَلَوْ كُنْتُمْ فِي بُرُوجٍ مُشَيَّدَةٍ যেখানেই তোমরা থাক না কেন, মৃত্যু তোমাদেরকে গ্রাস করবেই। যদিও তোমরা সুদৃঢ় দুর্গের মধ্যে অবস্থান কর (নিসা ৪/৭৮)রাসূল (ছাঃ) বলেন, أَكْثِرُوا ذِكْرَ هَاذِمِ اللَّذَّاتِ يَعْنِى الْمَوْتَ তোমরা স্বাদ ধ্বংসকারী অর্থাৎ মৃত্যুকে বেশী বেশী স্মরণ কর[55]
অতএব মানুষের জন্য অহংকার করার মত কিছু নেই। কেননা সে তার রোগ-শোক. বার্ধক্য-জ্বরা কিছুকেই প্রতিরোধ করতে পারে না। শতবার ঔষধ খেলেও আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত তার রোগ সারে না। শত চেষ্টাতেও আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত তার বিপদ দূরীভূত হয় না। ফলে সে একজন অসহায় ব্যক্তি ছাড়া কিছুই নয়। সুতরাং তার উচিত সর্বদা নিরহংকার ও বিনয়ী থাকা।
২. আখেরাতে জওয়াবদিহিতার ভয়ে ভীত হওয়া : ক্বিয়ামতের দিন প্রত্যেকের আমলনামা তার হাতে দিয়ে আল্লাহ বলবেন,اقْرَأْ كِتَابَكَ كَفَى بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيبًا তোমার আমলনামা তুমি পাঠ কর। আজ তোমার হিসাব নেওয়ার জন্য তুমিই যথেষ্ট’ (ইসরা ১৭/১৪)। অতঃপর যখন তারা স্ব স্ব আমলনামা দেখবে, তখন সে সময়কার অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,وَوُضِعَ الْكِتَابُ فَتَرَى الْمُجْرِمِينَ مُشْفِقِينَ مِمَّا فِيهِ وَيَقُولُونَ يَا وَيْلَتَنَا مَالِ هَذَا الْكِتَابِ لاَ يُغَادِرُ صَغِيرَةً وَلاَ كَبِيرَةً إِلاَّ أَحْصَاهَا وَوَجَدُوا مَا عَمِلُوا حَاضِرًا وَلاَ يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَدًا সেদিন উপস্থিত করা হবে প্রত্যেকের আমলনামা। অতঃপর তাতে যা আছে তার কারণে তুমি অপরাধীদের দেখবে আতংকিত। এ সময় তারা বলবে, হায় দুর্ভোগ আমাদের! এটা কেমন আমলনামা যে, ছোট-বড় কিছুই বাদ দেয়নি, সবকিছুই লিখে রেখেছে। তারা তাদের কৃতকর্ম সম্মুখে উপস্থিত পাবে। বস্ত্ততঃ তোমার প্রতিপালক কারু প্রতি যুলুম করেন না’ (কাহফ ১৮/৪৯)।
অর্থাৎ আল্লাহ যাকে যে নেমত দিয়েছেন ও দুনিয়াবী দায়িত্ব প্রদান করেছেন, আল্লাহর নিকটে তার যথাযথ জওয়াবদিহিতার কথা সর্বদা স্মরণ করতে হবে এবং কিভাবে সে দায়িত্ব আরও সুন্দরভাবে পালন করা যায়, তার জন্য সর্বদা চেষ্টিত থাকতে হবে। কেননা আল্লাহ মানুষের হায়াত ও মঊত সৃষ্টি করেছেন, কে তাদের মধ্যে সুন্দরতম আমল করে, সেটা পরীক্ষা করার জন্য (মুল্ক ৬৭/২)অতএব এই তীব্র দায়িত্বানুভূতি তাকে অহংকারের পাপ থেকে মুক্ত রাখবে ইনশাআল্লাহ।
(ক) হযরত ওমর (রাঃ) খেলাফতের দায়িত্বে (১৩-২৩/৬৩৪-৬৪৩ খৃঃ) থাকা অবস্থায় বলতেন, لَوْ مَاتَتْ سَخْلَةٌ عَلَى شَاطِئِ الْفُرَاتِ ضَيْعَةً لَخِفْتُ أَنْ أُسْأَلَ عَنْهَا যদি ফোরাত নদীর কূলে একটি ভেড়ার বাচ্চাও হারানো অবস্থায় মারা যায়, তাতে আমি ভীত হই যে, সেজন্য আমাকে কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হতে হবে[56]
(খ) খলীফা হারূনুর রশীদ (১৭০-১৯৩ হিঃ), যিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ব্যাপী বিশাল ইসলামী খেলাফতের অধিকারী ছিলেন, তিনি একদিন রাস্তায় চলছিলেন। এমন সময় জনৈক ইহূদী তার সাথে সাক্ষাৎ করল। সে তাকে বলল, ‘হে আমীরুল মুমিনীন! আল্লাহকে ভয় করুনতখন খলীফা ঘোড়া থেকে নামলেন ও মাটিতে সিজদা করলেন। অতঃপর ইহূদীটিকে বললেন, তোমার প্রয়োজন কি? সে বলল এবং তিনি তার প্রয়োজন মিটালেন। অতঃপর যখন তাকে বলা হ, আপনি একজন ইহূদীর জন্য সওয়ারী থেকে নামলেন? জবাবে তিনি বললেন, তার কথা শুনে আমার নিম্নোক্ত আয়াতটি স্মরণ হ, যেখানে আল্লাহ বলেছেন,وَإِذَا قِيلَ لَهُ اتَّقِ اللهَ أَخَذَتْهُ الْعِزَّةُ بِالْإِثْمِ فَحَسْبُهُ جَهَنَّمُ وَلَبِئْسَ الْمِهَادُ যখন তাদেরকে বলা হয় আল্লাহকে ভয় করতখন তার আত্মসম্মান তাকে পাপে স্ফীত করে তোলে। অতএব তার জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট। আর অবশ্যই তা নিকৃষ্টতম ঠিকানা[57]
একজন সাধারণ ইহূদী প্রজার সাথে খলীফা হারূণ যদি এরূপ নম্র আচরণ করতে পারেন, তাহলে অন্যদের সাথে তিনি কেমন নিরহংকার আচরণ করতেন, সেটা সহজে অনুমেয়। এই ঘটনায় ইসলামী খেলাফতে অমুসলিমদের প্রতি উদার ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। যা কথিত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলিতে মুসলমানদের প্রতি দেখা যায় না।
৩. নিজেকে জানা ও আল্লাহকে জানা :
প্রথমেই নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে জানতে হবে যে, মৃত শুক্রাণু থেকে সে জীবন পেয়েছে। আবার সে মরবে। অতএব তার কোন অহংকার নেই। কেবল বিনয় ও আনুগত্য কাম্য। অতঃপর আল্লাহ সম্পর্কে জানবে যে, তিনিই তাকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এনেছেন। তিনিই তাকে শক্তি দিয়ে মেধা দিয়ে পূর্ণ-পরিণত মানুষে পরিণত করেছেন। তাঁর দয়ায় তার সবকিছু। অতএব প্রতি পদে পদে আল্লাহর দাসত্ব ব্যতীত তার কিছুই করার নেই। আল্লাহ বলেন, وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلاَّ لِيَعْبُدُونِ আমি জিন ও ইনসান  সৃষ্টি করেছি কেবলমাত্র আমার দাসত্ব করার জন্য (যারিয়াত ৫১/৫৬)অতএব নিজেকে সর্বদা আল্লাহর দাস মনে করার মধ্যেই লুকিয়ে আছে অহংকার বিদূরণের প্রধান ঔষধ।
৪. যেসব বিষয় মনে অহংকার সৃষ্টি করে, সেগুলি সম্পর্কে  চিন্তা করা যে, এগুলিতে অহংকার করার মত কিছু নেই। যেমন বংশের অহংকার, ধনের অহংকার, পদমর্যাদার অহংকার, বিশেষ কোন নেমতের অহংকার। এগুলি সবই আল্লাহর দান। তিনি যেকোন সময় এগুলি ফিরিয়ে নিতে পারেন। আমরা হর-হামেশা এগুলো দেখতে পাচ্ছি যে, বহু জ্বালাময়ী বক্তা সুস্থ থেকেও নির্বাক হয়ে আছেন, বহু লেখক লুলা হয়ে গেছেন, বহু ধনী নিঃস্ব হয়েছেন, বহু নেতা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। বহু শক্তিমান পুরুষ প্যারালাইজড হয়ে বা স্ট্রোক হয়ে বা বার্ধক্যে জরজর হয়ে পড়ে আছেন। তাদের অসহায় চেহারাগুলি চিন্তা করলেই নিজের মধ্য থেকে অহংকার নিমেষে হারিয়ে যাবে।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,انْظُرُوا إِلَى مَنْ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَلاَ تَنْظُرُوا إِلَى مَنْ هُوَ فَوْقَكُمْ فَهُوَ أَجْدَرُ أَنْ لاَ تَزْدَرُوا نِعْمَةَ اللهِ   عَلَيْكُمْ (যদি তুমি সুখী হতে চাও), তাহলে যে ব্যক্তি তোমার চেয়ে নীচু, তার দিকে তাকাও। কখনো উপরের দিকে তাকিয়ো না। তাহলে তোমাকে দেওয়া আল্লাহর নেমত সমূহকে তুমি হীন মনে করবে না[58] অহংকার দূরীকরণের এটা একটি মহৌষধ।
৫. ইচ্ছাকৃতভাবে হীনকর কাজ করা :
মা আয়েশা (রাঃ) বলেন,كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَخْصِفُ نَعْلَهُ وَيَخِيطُ ثَوْبَهُ وَيَعْمَلُ فِى بَيْتِهِ كَمَا يَعْمَلُ أَحَدُكُمْ فِى بَيْتِهِ وقالت : كَانَ بَشَراً مِنَ الْبَشَرِ يَفْلِى ثَوْبَهُ وَيَحْلُبُ شَاتَهُ وَيَخْدُمُ نَفْسَهُ- রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজের জুতা নিজে ছাফ করতেন, কাপড় সেলাই করতেন ও বাড়িতে বিভিন্ন কাজ করতেন, যেমন তোমরা করে থাক। তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) অন্যান্য মানুষের ন্যায় একজন মানুষ ছিলেন। তিনি কাপড়ের উকুন বাছতেন, ছাগী দোহন করতেন এবং নিজের অন্যান্য কাজ করতেন।[59] মসজিদে নববী নির্মাণের সময়, খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খননের সময় তিনি নিজে মাটি কেটেছেন ও পাথর বহন করেছেন। বিভিন্ন সফরে তিনি ছাহাবীদের সঙ্গে কাজে অংশ নিয়েছেন।
তাঁর অনুসরণে ছাহাবায়ে কেরামও এরূপ করতেন। যেমন আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ) একদা কাঠের বোঝা মাথায় নিয়ে বাজার অতিক্রম করছিলেন। এ দৃশ্য দেখে জনৈক ব্যক্তি বললেন, হে আব্দুল্লাহ! আল্লাহ কি আপনাকে এ কাজ করা থেকে মুখাপেক্ষীহীন করেননি? (অর্থাৎ আপনার তো যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ রয়েছে! আপনি কেন একাজ করছেন?) জবাবে তিনি বললেন, بَليَ، وَلَكِن أَرَدْتُ أَنْ أَدْفَعَ الْكِبْرَ হ্যাঁ! কিন্তু আমি এ কাজের মাধ্যমে আমার অহংকারকে দমন করতে চাই। কেননা আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘যার অন্তরে কণা পরিমাণ অহংকার রয়েছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না[60]
অতএব সাধ্যে কুলায় এমন যেকোন হীনকর কাজ করার মানসিকতা অর্জন করতে পারলে মনের মধ্য থেকে সহজে অহংকার দূর হয়ে যাবে। যেমন আপনি অফিসের বস। টেবিলের ধূলা নিজে মুছলেন, মাকড়সার জালগুলো নিজে দূর করলেন, প্রয়োজনে টয়লেট ছাফ করলেন, এমনকি ঘরটা ঝাড়ু দিলেন। এসব ছোটখাট কাজ হলেও এগুলির মাধ্যমে অহংকার দূর হয়। সঙ্গে সঙ্গে অন্যের নিকট সম্মান বৃদ্ধি পায়। সর্বোপরি নিজের কাজ নিজে করায় রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত অনুসরণের ছওয়াব পাওয়া যায়। লোকেরা আপনাকে সামনে নিয়ে মিছিল করতে চায়, আপনার ছবি তুলতে চায়, আপনার নামে প্রশংসামূলক শ্লোগান দিতে চায়, আপনার সামনে আপনার নামে অভিনন্দন পত্র পাঠ করতে চায়, আপনি সুযোগ দিবেন না অথবা এড়িয়ে যাবেন।
৬. আল্লাহ আমার সব কাজ দেখছেন ও সব কথা শুনছেন, দৃঢ়ভাবে এ বিশ্বাস পোষণ করা :
আল্লাহ বলেন, إِذْ يَتَلَقَّى الْمُتَلَقِّيَانِ عَنِ الْيَمِينِ وَعَنِ الشِّمَالِ قَعِيدٌ- مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلاَّ لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ মনে রেখ দুজন গ্রহণকারী ফেরেশতা মানুষের ডানে ও বামে বসে সর্বদা তার কর্ম লিপিবদ্ধ করেসে মুখে যে কথাই উচ্চারণ করে তা লিপিবদ্ধ করার জন্য সদা তৎপর প্রহরী তার নিকটেই অবস্থান করে’ (ক্বাফ ৫০/১৭-১৮)।
রাসূল (ছাঃ) বলেন, তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত কর, যেন তুমি তাকে দেখছ। যদি তা না পারো, তবে এমনভাবে যেন তিনি তোমাকে দেখছেন[61]
৭. গরীব ও ইয়াতীমদের সঙ্গে থাকা ও রোগীর সেবা করা :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তোমরা আমাকে দুর্বলদের মধ্যে তালাশ কর[62] জনৈক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-কে তার অন্তর কঠিন হওয়ার অভিযোগ পেশ করলে তিনি তাকে বললেন, امْسَحْ رَأْسَ الْيَتِيمِ وَأَطْعِمِ الْمِسْكِينَ তুমি ইয়াতীমের মাথায় হাত বুলাও এবং অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দান কর।[63] তিনি বলেন, একজন মুসলমান যখন অন্য একজন মুসলমান রোগীর সেবা করে, তখন সে জান্নাতের বাগিচায় অবস্থান করে, যতক্ষণ না সে ফিরে আসে[64] তিনি বলেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, হে আদম সন্তান! আমি পীড়িত ছিলাম। কিন্তু তুমি আমার সেবা করোনি। বান্দা বলবে, হে আমার প্রতিপালক! কিভাবে আমি আপনার সেবা করব? অথচ আপনি বিশ্বচরাচরের পালনকর্তা। তখন আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা পীড়িত ছিল, অথচ তুমি তার সেবা করোনি? যদি তুমি তাকে সেবা করতে, তাহলে তুমি আমাকে সেখানে পেতে[65]
বস্ত্ততঃ যেকোন সেবামূলক কাজ যদি নিঃস্বার্থ হয় এবং পরকালীন লক্ষ্যে হয়, তবে সেগুলি অহংকার চূর্ণ করার মহৌষধ হিসাবে আল্লাহর নিকটে গৃহীত হয় এবং বান্দা জাহান্নাম থেকে বেঁচে যায়।
৮. নিজের সৎকর্মগুলি আল্লাহর নিকটে কবুল হচ্ছে কি-না সেই ভয়ে সর্বদা ভীত থাকা :
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে নিম্নোক্ত আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, وَالَّذِينَ يُؤْتُونَ مَا آتَوْا وَقُلُوبُهُمْ وَجِلَةٌ أَنَّهُمْ إِلَى رَبِّهِمْ رَاجِعُونَ- أُولَئِكَ يُسَارِعُونَ فِي الْخَيْرَاتِ وَهُمْ لَهَا سَابِقُونَ আর যারা তাদের যা দান করার তা দান করে ভীত-কম্পিত অন্তরে। এজন্য যে, তারা তাদের প্রতিপালকের কাছে ফিরে যাবেতারা দ্রুত সম্পাদন করে তাদের সৎকর্ম সমূহ এবং তারা সেদিকে অগ্রগামী হয়’ (মুমিনূন ২৩/৬০-৬১)। আমি বললাম, এরা কি তারাই যারা মদ্যপান করে ও চুরি করে? তিনি বললেন, لاَ يَا بِنْتَ الصِّدِّيقِ وَلَكِنَّهُمُ الَّذِينَ يَصُومُونَ وَيُصَلُّونَ وَيَتَصَدَّقُونَ وَهُمْ يَخَافُونَ أَنْ لاَ يُقْبَلَ مِنْهُمْ أُولَئِكَ الَّذِينَ يُسَارِعُونَ فِى الْخَيْرَاتِ وَهُمْ لَهَا سَابِقُونَ না হে ছিদ্দীকের কন্যা! বরং এরা হল তারাই যারা ছিয়াম রাখে, ছালাত আদায় করে ও ছাদাক্বা করে এবং তারা সর্বদা ভীত থাকে এ ব্যাপারে যে, তাদের উক্ত নেক আমলগুলি কবুল হচ্ছে কি-না। তারাই সৎকর্ম সমূহের প্রতি দ্রুত ধাবমান হয়[66]
৯. ভুলক্রমে বা উত্তেজনা বশে অহংকার প্রকাশ পেলে সাথে সাথে বান্দার কাছে, অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ كَانَتْ لَهُ مَظْلَمَةٌ لأَحَدٍ مِنْ عِرْضِهِ أَوْ شَىْءٍ فَلْيَتَحَلَّلْهُ مِنْهُ الْيَوْمَ، قَبْلَ أَنْ لاَ يَكُونَ دِينَارٌ وَلاَ دِرْهَمٌ، যদি কেউ তার ভাইয়ের সম্মানহানি করে বা অন্য কোন বস্ত্তর ব্যাপারে তার প্রতি যুলুম করে, তবে সে যেন তা আজই মিটিয়ে নেয়। সেদিন আসার আগে, যেদিন কোন দীনার ও দিরহাম তার সঙ্গে থাকবে না...।[67]
অন্যতম জ্যেষ্ঠ তাবেঈ মুত্বার্রিফ বিন আব্দুল্লাহ (মৃঃ ৯৫ হিঃ) হাজ্জাজ বিন ইউসুফের পক্ষ হতে নিযুক্ত খোরাসানের গভর্ণর মুহাল্লাব বিন আবূ ছুফরাকে একদিন দেখলেন রাস্তা দিয়ে খুব জাঁক-জমকের সাথে যেতে। তিনি সামনে গিয়ে বললেন, হে আল্লাহর বান্দা! কিভাবে তুমি রাস্তায় চলছ, যা আল্লাহকে ক্রুদ্ধ করে? একথা শুনে মুহাল্লাব বললেন, আপনি কি আমাকে চিনেন? তাবেঈ বিদ্বান বললেন, نعم، أَوَّلُكَ نُطْفَةٌ مَذِرَةٌ، وَآخِرُكَ جِيفَةُ قَذِرَةٌ، وَأَنْتَ فِيمَا بَيْنَ ذَلِكَ تَحْمِلُ الْعَذِرَةَ অবশ্যই চিনি। তোমার শুরু হল একটি নিকৃষ্ট শুক্রাণু থেকে এবং শেষ হল একটি মরা লাশ হিসাবে। আর তুমি এর মধ্যবর্তী সময়ে বহন করে চলেছ পায়খানার ময়লাএকথা শুনে মুহাল্লাব জাঁক-জমক ছেড়ে সাধারণভাবে চলে গেলেন।[68]
১০. অহংকারী পোষাক ও চাল-চলন পরিহার করা :
পোষাক স্বাভাবিক ও সুন্দর এবং পরিচ্ছন্ন হতে হবে। কেননা আল্লাহ সুন্দর, তিনি সৌন্দর্য পসন্দ করেন[69] এবং তিনি বান্দার উপর তাঁর নেমতের নমুনা দেখতে ভালবাসেন[70] কিন্তু স্বাভাবিক পোষাকের বাইরে অপ্রয়োজনে আড়ম্বরপূর্ণ কোন পোষাক পরিধান করা রিয়া’-র পর্যায়ে পড়ে যাবে। যা কবীরা গোনাহের অন্তর্ভুক্ত। যাতে অনেকে ফেৎনায় পড়েন ও তার মধ্যে অহংকার সৃষ্টি হয়। অনেক মসজিদে বিশেষ মুছল্লীদের জন্য বিশেষ স্থান ও জায়নামায দেখা যায়। এমনকি কারু জন্য বিশেষ দরজাও নির্দিষ্ট থাকে। যেগুলি অহংকারের পর্যায়ভুক্ত।
১১. গোপন আমল করা :
নিরহংকার ও রিয়ামুক্ত হওয়ার অন্যতম পন্থা হল গোপন আমল করা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللهُ تَعَالَى فِى ظِلِّهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلاَّ ظِلُّهُ ... وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ  فَأَخْفَاهَا حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ، وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللهَ خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ কিয়ামতের দিন সাত শ্রেণীর লোক আল্লাহর আরশের নীচে ছায়া পাবে, যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না। তাদের মধ্যে একজন হল ঐ ব্যক্তি ... যে গোপনে ছাদাক্বা করে এমনভাবে যে ডান হাত যা ব্যয় করে, বাম হাত তা জানতে পারে না এবং ঐ ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে, অতঃপর দুচোখ বেয়ে অবিরল ধারে অশ্রু প্রবাহিত হয়[71]
এজন্য তাহাজ্জুদের ছালাত রাত্রির শেষ প্রহরে একাকী নিরিবিলি পড়তে বলা হয়েছে (মুযযাম্মিল ৭৩/২-৩, ২০)   
১২. আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করা :
যদি কেউ আল্লাহর ভয়ে কাঁদতে পারে, তবে তার চোখের পানিতে অহংকার ধুয়ে-মুছে ছাফ হয়ে যাবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে কাঁদে, সে ব্যক্তি জাহান্নামে যাবে না। যেমন দুধ পুনরায় পালানে প্রবেশ করে না[72] তিনি বলেন, যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, আমি যা জানি তোমরা যদি তা জানতে, তাহলে তোমরা কাঁদতে বেশী, হাসতে কম।[73] তিনি বলেন, আল্লাহর কসম আমি জানি না। আল্লাহর কসম আমি জানিনা। অথচ আমি আল্লাহর রাসূল; কি হবে সেদিন আমার ও কি হবে সেদিন তোমাদের[74] হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, তোমরা তোমাদের অনেক পাপকে চুলের চাইতে সূক্ষ্ম মনে কর। অথচ রাসূল (ছাঃ)-এর যামানায় আমরা সেগুলিকে ধ্বংসকারী মনে করতাম[75] এক্ষণে অহংকারের মত মহাপাপ হৃদয়ে জাগ্রত হলে সেটাকে দ্রুত দমন করতে হবে, যা সহজেই অনুমেয়।
১৩. মানুষকে ক্ষমা করা ও সর্বদা নম্রতা অবলম্বন করা :
রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَا زَادَ اللهُ عَبْدًا بِعَفْوٍ إِلاَّ عِزًّا وَمَا تَوَاضَعَ أَحَدٌ لِلَّهِ إِلاَّ رَفَعَهُ اللهُ বান্দা কাউকে ক্ষমা করলে আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। আর যখন সে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিনয় অবলম্বন করে, তখন তিনি তার মর্যাদাকে সমুন্নত করেন[76] তিনি বলেন,إِنَّ الرِّفْقَ لاَ يَكُونُ فِى شَىْءٍ إِلاَّ زَانَهُ وَلاَ يُنْزَعُ مِنْ شَىْءٍ إِلاَّ شَانَهُ কোন বস্ত্ততে নম্রতা থাকলে সেটি তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এবং তা প্রত্যাহার করা হলে সেটি দোষযুক্ত হয়ে পড়ে[77]
এর দ্বারা বুঝা যায় যে, বিনয় ও আনুগত্য মানুষকে উঁচু ও সম্মানিত করে। পক্ষান্তরে অহংকার ও আত্মগর্ব মানুষকে নীচু ও লাঞ্ছিত করে।
১৪. নিরহংকার হওয়ার জন্য আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা :
অহংকার থেকে মুক্ত থাকার জন্য নিম্নের দোআটি পাঠ করা যেতে পারে।-
اللهُ أَكْبَرُ كَبِيراً وَالْحَمْدُ لِلَّهِ كَثِيراً وَسَبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ بُكْرَةً وَأَصِيلاً- اللَّهُمَّ إِنِّى أَعُوذُ بِكَ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ مِِنْ هَمْزِهِ وَنَفْخِهِ وَنَفْثِهِ-
অর্থ : আল্লাহ অতি মহান, আল্লাহর জন্য যাবতীয় প্রশংসা, সকালে ও সন্ধ্যায় তাঁর প্রশংসাসহ আল্লাহর জন্য সকল পবিত্রতা। আমি আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি বিতাড়িত শয়তান হতে এবং তার প্ররোচনা, তার ফুঁক ও তার কুমন্ত্রণা হতে। উক্ত হাদীছে نَفْخُهُ বা শয়তানের ফুঁক’-এর অর্থ সম্পর্কে রাবী আমর বিন মুর্রা বলেন, সেটা হ الْكِبْرُ বা অহংকার[78]
এছাড়াও সূরা নাস ও ফালাক্ব পড়া উচিৎ। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘কোন প্রার্থনাকারী প্রার্থনা করতে পারে না এবং কোন আশ্রয়প্রার্থী আশ্রয় চাইতে পারে না এ দুটি সূরার তুলনায়[79] 
যে অহংকার শোভনীয় :
(১) যখন মানুষ মিথ্যা ছেড়ে সত্যের অনুসারী হয়, তখন সে তার জন্য অহংকার করতে পারে। যেমন কুফর ছেড়ে ইসলাম গ্রহণ করা। (২) যদি কেউ জাল ও যঈফ হাদীছ ছেড়ে ছহীহ হাদীছের উপর আমল শুরু করে, তবে তার জন্য সে গর্ব করতে পারে। (৩) যখন কোন ব্যক্তি ফিরক্বা নাজিয়াহর সাথী হয়, তখন সে ঐ জামাআতের উপর গর্ব করতে পারে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি জান্নাতের মধ্যস্থলে থাকতে চায়, সে যেন জামাআতবদ্ধ জীবনকে অপরিহার্য করে নেয়[80] ক্বিয়ামত পর্যন্ত এই বিজয়ী দল হআহলুল হাদীছ[81]
খ্রিষ্টানদের সাথে সন্ধির জন্য তাদের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী সেখানে খলীফাকে উপস্থিত হওয়ার জন্য বায়তুল মুক্বাদ্দাস সফরকালে খলীফা ওমর (রাঃ) যখন একাকী খালি পায়ে উটের লাগাম ধরে হাঁটতে শুরু করেন, তখন সাথী আবু ওবায়দাহ (রাঃ)-এর আপত্তির জবাবে তিনি বলেন, إِنَّا كُنَّا أَذَلَّ قَوْمٍ فَأَعَزَّنَا اللهُ بِالْإِسْلاَمِ فَمَهْمَا نَطْلُبُ الْعِزَّةَ بِغَيْرِ مَا أَعَزَّنَا اللهُ بِهِ أَذَلَّنَا اللهُআমরা ছিলাম নিকৃষ্ট জাতি। অতঃপর আল্লাহ আমাদেরকে ইসলামের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন। অতএব যে কারণে আল্লাহ আমাদের মর্যাদা দান করেছেন, তা ছেড়ে অন্য কিছুর মাধ্যমে সম্মান তালাশ করলে আল্লাহ আমাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন।অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘আমরা সেই জাতি যাদেরকে আল্লাহ ইসলামের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন। এর বাইরে অন্য কিছুর মাধ্যমে আমরা সম্মান চাই না[82]
উপসংহার :
হাফেয যাহাবী বলেন, অহংকারের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম প্রকার হল ইলমের অহংকার। কেননা তার ইলম তার কোন কাজে আসেনা। যে ব্যক্তি আখেরাতের জন্য জ্ঞানার্জন করে, জ্ঞান তার অহংকারকে চূর্ণ করে দেয় এবং তার অন্তর আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকে। যে নিজেকে হীন মনে করে এবং সর্বদা নিজের হিসাব নিয়ে সন্ত্রস্ত থাকে। একটু উদাসীন হলেই ভাবে এই বুঝি ছিরাতে মুস্তাক্বীম থেকে বিচ্যুত হলাম ও ধ্বংস হয়ে গেলাম। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ইলম শিখে গর্ব করার জন্য ও নেতৃত্ব লাভের জন্য, সে অন্যের উপর অহংকার করে ও তাদেরকে হীন মনে করে। আর এটিই হল সবচেয়ে বড় অহংকার (أَكْبَرُ الْكِبْر)আর ঐ ব্যক্তি কখনই জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যার অন্তর কণা পরিমাণ অহংকার রয়েছে। লা হাওলা অলা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ[83]
পরিশেষে বলব, জাত-পাত, দল-মত ও যাবতীয় মিথ্যার অহংকার ছেড়ে আল্লাহ প্রেরিত মহাসত্যের দিকে ফিরে আসা এবং কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ করা আল্লাহর সৃষ্টি হিসাবে প্রত্যেক মানুষের জন্য কর্তব্য। বান্দার কোন অহংকার থাকলে তা হবে কেবল সত্যের অহংকার। অন্য কিছুর নয়। আল্লাহ আমাদেরকে মিথ্যা অহমিকা ও তার কুফল হতে রক্ষা করুন- আমীন!


[1]. মুসলিম হা/৯১; মিশকাত হা/৫১০৮ ক্রোধ ও অহংকারঅনুচ্ছেদ।
[2]. সিয়ারু আলামিল নুবালা ৮/৪০৭।
[3]. বায়হাক্বী, শুআবুল ঈমান, সনদ হাসান; মিশকাত হা/৫১২২।
[4]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ৩য় প্রকাশ ১৯৯৬ খৃঃ) ২/৩১৬।
[5]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ১৩৯৩/১৯৭৩) ৫৮ পৃঃ।
[6]. আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৫১১০।
[7]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩১২৪৪।
[8]. হাকেম হা/৫৩৮২ সনদ ছহীহ।
[9]. তিরমিযী হা/১৮৬২, ২৪৯২, মিশকাত হা/৩৬৪৩, ৫১১২।
[10]. বুখারী, ফৎহ সহ হা/৩০।
[11]. বুখারী হা/৬০৫৪; মুসলিম হা/২৫৯১, মিশকাত হা/৪৮২৯।
[12]. তিরমিযী হা/২৪৯২।
[13]. আহমাদ, মিশকাত হা/২৯৫৯, ছহীহাহ হা/২৪২।
[14]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৭৭২।
[15]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫১২৩।
[16]. মুসলিম হা/২৫৮১; মিশকাত হা/৫১২৭ যুলুমঅনুচ্ছেদ।
[17]. মুসলিম হা/২৫৮২; মিশকাত হা/৫১২৮।
[18]. আবুদাঊদ হা/২৫৯৪, মিশকাত হা/৫২৪৬।
[19]. ইবনু মাজাহ হা/৩২৯১, আহমাদ হা/৩৬৮০।
[20]. আহমাদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৫০৮৩।
[21]. দারাকুৎনী হা/৪৫২৫; বাগাভী, শারহুস সুন্নাহ ১০/১১৪।
[22]. তারীখু বাগদাদ ১০/৩০৮।
[23]. কথিত আছে যে, নবুঅত দাবী করার কারণে তিনি মুতানাববীনামে পরিচিত হন।
[24]. ইবনু খাল্লিকান, অফিয়াতুল আইয়ান ১/৪৫০।
[25]. ইবনু হযম, আল-ইহকাম (কায়রো : দারুল হাদীছ ১৪২৬/২০০৫) ৪/৫৮৪।
[26]. মুহাম্মাদ বিন আলাবী, মালেক বিন আনাস (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ২য় সংস্করণ ২০১০ খৃঃ) পৃঃ ৩২।
[27]. ইবনুল ক্বাইয়িম, লামুল মুওয়াক্কেঈন ১/৭৬।
[28]. , ১/৩৩।
[29]. ঐ ১/৭৫।
[30]. মুসলিম হা/১৯০৫, মিশকাত হা/২০৫।
[31]. তিরমিযী হা/৩১৩৮ হাদীছ ছহীহ; মিশকাত হা/২২৫ ইলমঅধ্যায়।
[32]. আহমাদ, আবুদাঊদ, ইবনু মাজাহ, হাদীছ ছহীহ; মিশকাত হা/২২৭।
[33]. তিরমিযী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/২১২-২১৩।
[34]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ ১৪৭ পৃঃ।
[35]. বুখারী হা/৭১৩৮, মুসলিম হা/১৮২৯, মিশকাত হা/৩৬৮৫।
[36]. মুসলিম হা/১৪২ ঈমানঅধ্যায়; মিশকাত হা/৩৬৮৬।
[37]. মুসলিম হা/১৭৩৮, মিশকাত হা/৩৭২৭।
[38]. মুসলিম হা/২৮৬৫; মিশকাত হা/৪৮৯৮ শিষ্টাচার সমূহঅধ্যায় পরস্পরে গর্বঅনুচ্ছেদ।
[39]. তিরমিযী হা/৩২৭০; আবুদাঊদ হা/৫১১৬; মিশকাত হা/৪৮৯৯।
[40]. বুখারী হা/৩৪৪৫; মিশকাত হা/৪৮৯৭।
[41]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩০৮২ বিবাহঅধ্যায়।
[42]. আহমাদ হা/১২৩২৯, ছহীহুল জামেহা/২৭৫৮, বুখারী হা/৭১৩৯, ফাৎহুল বারী, উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যা দ্রঃ, ইরওয়াউল গালীল হা/৫২০।
[43]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪৮৯৫।
[44]. তিরমিযী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৪৮৯৯।
[45]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪৮৯৩।
[46]. বুখারী হা/৩৩৯০; তিরমিযী হা/৩৩৩২; মিশকাত হা/৪৮৯৪।
[47]. বুখারী হা/৩৭৫৪।
[48]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৩২২; তিরমিযী, আহমাদ, মিশকাত হা/১৩২৬ ঐচ্ছিক ছালাতঅনুচ্ছেদ।
[49]. খাত্ত্বাবী, আল-উযলাহ (কায়রো : মাতবাআ সালাফিয়াহ, ২য় সংস্করণ ১৩৯৯ হিঃ) ৮৯ পৃঃ।
[50]. বায়হাক্বী শোআব, হা/৮২৫২।
[51]. ইবনুল জাওযী, ছাইদুল খাত্বের (দামেশক: দারুল কলম, ১ম সংস্করণ ২০০৪ খৃঃ) পৃঃ ২৯৫।
[52]. আহমাদ হা/৬৫৮৩; ছহীহাহ হা/১৩৪।
[53]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪০২৯।
[54]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫১০৬ ক্রোধ ও অহংকারঅনুচ্ছেদ।
[55]. তিরমিযী হা/২৩০৭, মিশকাত হা/১৬০৭।
[56]. বায়হাক্বী, শুআবুল ঈমান হা/৭৪১৫।
[57]. কুরতুবী, সূরা বাক্বারাহ ২/২০৬ আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য।
[58]. বুখারী হা/৬৪৯০, মুসলিম হা/২৯৬৩, মিশকাত হা/৫২৪২।
[59]. বুখারী হা/৬৭৬; আহমাদ হা/২৫৩৮০, ২৬২৩৭, মিশকাত হা/৫৮২২।
[60]. ত্বাবারাণী হা/৩৬৩; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩২৫৭।
[61]. বুখারী হা/৫০, মুসলিম হা/৮, মিশকাত হা/২।
[62]. আবুদাঊদ হা/২৫৯৪; ছহীহাহ হা/৭৭৯; মিশকাত হা/৫২৪৬।
[63]. আহমাদ, ত্বাবারাণী; ছহীহাহ হা/৮৫৪; মিশকাত হা/৫০০১।
[64]. মুসলিম, মিশকাত হা/১৫২৭।
[65]. মুসলিম হা/২৫৬৯, মিশকাত হা/১৫২৮।
[66]. তিরমিযী হা/৩১৭৫; ছহীহাহ হা/১৬২; মিশকাত হা/৫৩৫০ ক্রন্দন ও আল্লাহভীতিঅনুচ্ছেদ।
[67]. বুখারী হা/২৪৪৯; মিশকাত হা/৫১২৬ যুলুমঅনুচ্ছেদ।
[68]. কুরতুবী, তাফসীর সূরা মাআরিজ ৩৯ আয়াত।
[69]. মুসলিম হা/৯১।
[70]. তিরমিযী হা/২৮১৯।
[71]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৭০১।
[72]. নাসাঈ হা/৩১১০; মিশকাত হা/৩৮২৮।
[73]. বুখারী হা/৬৬৩১; মিশকাত হা/৫৩৩৯।
[74]. বুখারী হা/৩৯১৯; মিশকাত হা/৫৩৪০।
[75]. বুখারী হা/৬৪৯২; মিশকাত হা/৫৩৫৫।
[76]. মুসলিম হা/২৫৮৮, মিশকাত হা/১৮৮৯।
[77]. মুসলিম হা/২৫৯৪; মিশকাত হা/৫০৬৮।
[78]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/১৭৭৭, আলবানী, সনদ ছহীহ লিগাইরিহী।
[79]. নাসাঈ হা/৫৪৩৮; সনদ হাসান ছহীহ।
[80]. তিরমিযী হা/২৪৬১।
[81]. তিরমিযী হা/২১৯২, ছহীহুল জামেহা/৭০২; মিশকাত হা/৬২৮৩।
[82]. হাকেম ১/৬১-৬২; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৫১; ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, শিরোনাম: ওমর ইবনুল খাত্ত্বাবের হাতে বায়তুল মুক্বাদ্দাস বিজয়৭/৫৬।
[83]. যাহাবী, আল-কাবায়ির (বৈরূত : দারুন নদওয়াতুল জাদীদাহ পৃঃ ৭৮।























অহংকার সম্পর্কে হাদিস ও কুরআন কী বলে?



মাহফুজ আল মাদানী

অহংকার। গর্ব করা, নিজেকে বড় মনে করা। হাদিস শরিফের ভাষায়, ‘সত্য প্রত্যাখান করা ও মানুষকে তুচ্ছ মনে করার নাম অহংকারইমাম গাযালি (রহ.) বলেন, ‘নিজেকে বড় মনে করা এবং নিজের মর্যাদাকে অন্যের মর্যাদার ঊর্ধ্বে মনে করাই হলো অহংকারআল্লামা রাগেব ইস্পাহানী (রহ.) এর মতানুসারে, ‘অহংকার হলো কোনো ব্যক্তি নিজেকে অন্যের চেয়ে বড় ও মহৎ মনে করা এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা সত্য গ্রহণ না করে ইবাদতে অনীহা পেশ করাঅহংকারীকে সৃষ্টিকর্তাসহ কেউই পছন্দ করেন না। হজরত লোকমান আলাইহিস সালাম তার পুত্রকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন তার বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দাম্ভিক অহংকারীদের পছন্দ করেন না’ -(সুরা লোকমান : ১৮)।
অহংকার মানুষের জন্য শোভা পায় না। শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই শুভনীয়। হাদিসের ভাষ্যমতে, ‘হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, অহংকার আমার চাদর ও শ্রেষ্ঠত্ব আমার লুঙ্গিস্বরূপ। অতএব, যে ব্যক্তি দুটোর কোনো একটি নিয়ে আমার সঙ্গে টানাটানি করবে, আমি তাকে দোজখে ফেলব। অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে, তাকে দোজখের আগুনে নিক্ষেপ করব’ -(মুসলিম)। অহংকার করার কারণে মহান রাব্বুল আলামিন শয়তানকে বের করে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ বললেন, আমি যখন নির্দেশ দিয়েছি, তখন তোকে কিসে সেজদা করতে বারণ করল? সে বলল, আমি তার চাইতে শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটির দ্বারা। বললেন, তুই এখান থেকে যা। এখানে অহংকার করার কোনো অধিকার তোর নেই। অতএব তুই বের হয়ে যা। তুই হীনতমদের অন্তর্ভুক্ত’ -(সুরা আল আরাফ : ১২, ১৩)। শয়তান আদম আলাইহিস সালাম-এর সঙ্গে অহংকার করে সেজদা না করার কারণে আল্লাহর অবাধ্য হয়ে উঠেছিল। অহংকারের কারণে আল্লাহ তাকে নিকৃষ্টতম বানিয়ে দিয়েছেন। অহংকার একমাত্র সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও করার কোনো সুযোগ নেই।
আমাদের সমাজ অহংকারীদের পদচারণায় ভরপুর। যা আমাদের সমাজকে খুঁেড় খুঁেড় খাচ্ছে। অহংকারের কারণে বড়রা ছোটদেরকে ¯œহ করে না, তাই ছোটরাও বড়দের সম্মান দেখায় না। যদি আমরা আমাদের সমাজ থেকে অহংকার নামক সামাজিক ভাইরাস কে দূর করতে পারতাম তাহলে সমাজ হয়ে উঠত আদর্শ সমাজ হিসেবে। আমাদের সকলের আদর্শ, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনের কোনোকালে কোনো প্রহরে আত্মঅহমিকায় নিমজ্জিত হননি। বরং তিনি সরিষা পরিমাণ অহংকার থাকলে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না বলে সতর্কবাণী করেছেন। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, যার অন্তরে সরিষা পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না’ -(মুসলিম)। অতএব জান্নাতে প্রবেশ করার ইচ্ছা থাকলে অবশ্যই হিংসাকে চিরতরে বিদায় জানাতে হবে।
অহংকার করা হারাম। ইমাম যাহাবী (রহ.) বর্ণনা করেছেন, অহংকার কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। মহান আল্লাহ তায়ালা অহংকারীদের আবাসস্থলকে নিকৃষ্ট হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহর বাণী, ‘আর অহংকারীদের আবাসস্থল কতই না নিকৃষ্ট’ -(সুরা আন নাহল : ২৯)। প্রবাদে রয়েছে, অহংকার পতনের মূল। যার মধ্যে অহংকার-অহমিকা বিরাজ করবে সে সফল হতে পারবে না। বরং তার পরাজয়, পতন অনিবার্য। আমাদের সমাজে অহংকারীদের সংখ্যা কম বলার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের সমাজ অহংকারের করাল গ্রাসে নিমজ্জিত। আর তাই অহংকারের কারণে পতনের পথে হাঁটছে আমাদের সমাজ। আমাদের এ সমাজকে আদর্শের দিকে নিয়ে যেতে আমরা কি অহংকার মুক্ত হতে পারি না? অহংকার মুক্ত সমাজ হবে একটা আদর্শ সমাজ। যে সমাজের জনগণ হবে অহংকার বিমুখ, বিনয়ী। আসুন অহংকারকে ত্যাগ করে আদর্শ সমাজ গঠনে ঐক্যবদ্ধ হই।
লেখক: এম ফিল গবেষক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট


অহংকার!!! ইসলাম কি বলে?


অহংকার করা তার জন্যই মানায় যার মধ্যে কোন দুর্বলতা অথবা দোষ-ত্রুটি নেই। যা মহান আল্লাহর জন্যই নির্ধারিত।
আল্লাহ তায়ালা বলেন--- "অহংকারীকে আল্লাহ ভালোবাসেন না ।"
[
সূরা নাহাল ,২৩ নং আয়াত ]
" আল্লাহ কোন দাম্ভিক, অহংকারীকে ভালোবাসেন না "
[
সূরা লুকমান, আয়াত নং- 18]
নবী কারীম (সঃ) বলেন -----যাহার অন্তরে অনু পরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।
[
মুসলিম , হাঃ নং - 91 , আবূ দাউদ, হাঃ নং- 4091,তিরমিযী, হাঃ নং- 1999 ]
তাহলে বলুনতো অহংকার করে আপনারা কেউ কি জাহান্নামে যেতে চান???
আর ইবলিস তো নিজে ইবলিস শয়তান হয়েছে এই অহংকারের কারনেই ।।
আল্লাহ তায়ালা বলেল ---- " স্বরন করো যখন আমি ফেরেশতাদের বললাম, আদমের প্রতি নত হও, তখন ইবলিস ব্যতীত সকলেই নত হলো। সে অমান্য করলো ও অহংকার করলো, ফলে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল ।। "
[
সূরা বাকারা, আয়াত নং - 34 ]
সুতরাং যে অহংকার করবে সে ইবলিসের অনুসারী হবে ।
আবার রসূলুল্লাহ ( সঃ) বলেন , আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন
"
মাহাত্ম্য ও বুযুর্গী আমার পরিধেয় বস্ত্র এবং গর্ব আমার চাদর। যে ব্যক্তি এদুটি বিষয়ে আমার সাথে ঝগড়া করবে আমি তাকে শাস্তি দেব ।।"
[
মুসলিম, হাদিস নং - 2847 ]
সুতরাং যে অহংকার করবে সেতো অবশ্যই আল্লাহর সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হলো। আর কে এমন আছে যে, " সে আল্লাহর সাথে ঝগড়া করে নিজেকে ধ্বংস থেকে বাচাতে পারবে ??? জাহান্নাম থেকে নিজেকে হেফাজাত করতে পারবে ??? "
তাই সকল ভাই-বোনদের প্রতি অনুরোধ অহংকার থেকে দুরে থাকুন ।।
নিজেকে আল্লাহর নারাজি থেকে , জাহান্নামের কঠিন আযাব থেকে হিফাজাত করার চেষ্ঠা করুন ।
আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম আমাকেই অহংকার করা থেকে হিফাজাত করুন, পূর্ন হেদায়েত দান করুন।।
বিঃদ্রঃ অহংকার ও আত্তসন্মানবোধ এক বিষয় নয়, তাই আত্তসন্মানবোধ ত্যাগ করবেন না। নয়তো অতি সহজেই পাপে জড়িয়ে পড়বেন ।।


No comments:

Post a Comment