Thursday, February 27, 2020

অবিশ্বাসের অযৌক্তিকতা (১ম অংশ)





অবিশ্বাসের অযৌক্তিকতা







এম আহমদ


মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে এক নতুন বেশ্যা


ভূমিকা
এই লেখাটি মানুষের অসহায়ত্ব, দুর্বলতা ও ধর্ম-অধর্ম নিয়ে। আধুনিক উগ্র নাস্তিকতা একটি অধর্ম, এবং এটি মানুষের দুর্বল দিকটি ব্যবহার  করে ভুল আশ্বাসের আহবানে সমাজে এক নতুন বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। এ নিয়েই আমার এই লেখা। এটিকে ৪টি ছোট ছোট অনুচ্ছেদে বিভক্ত করেছি। প্রথম অনুচ্ছেদে সকল ধর্ম ও ধার্মিকের জীবন সাধারণী মাত্রায় আসবে। তারপর মানুষ কেন ধর্ম-অধর্মের দিকে আকৃষ্ট হয় সেই দিকটির কথা এবং মূল ধর্মের মহৎ উদ্দেশ্যের কথা।
দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে ধর্ম গ্রন্থের পটভূমিগত কিছু সমস্যার কথা বলা হবে। এটি অনভিজ্ঞ পাঠক, ও বিশেষ করে, উগ্রনাস্তিকদের ব্যাপারে প্রায়ই সমস্যা হিসেবে দেখতে পাওয়া যায়। এই সাথে ধর্মীয় কিছু জটিলতার কথা বলা হবে। কোনো সমস্যা বুঝা পারা ও স্বীকার করা হলে সমাধানের চিন্তা আসতে পারে। তবে এক্ষেত্রে এটাও বলা হবে যে কিছু সমস্যা মানব প্রকৃতির সাথে জড়িত। তাই এগুলোর সার্থক ও সামগ্রিক উত্তরণ নেই বা সমাধানও নেই।
তৃতীয় অনুচ্ছেদে মানুষের প্রকৃতিগত দুর্বলতার দিকটি উল্লেখ করে উগ্র-নাস্তিকতাবাদের আহবান নিয়ে কিছু আলোচনা আসবে। অতীত কালে অনেক অধর্ম যেভাবে মানুষের দুর্বলতাকে পুঞ্জি করে ময়দান সরগরম করেছিল, এবং এখনো করে যাচ্ছে,  ঠিক সেভাবে মানবতার মুক্তির নামে এই নতুন ধর্মমানুষকে বিভ্রান্ত করছে এই আলোচনা।  
চতুর্থ অনুচ্ছেদে উগ্র-নাস্তিক্যবাদের স্পন্সররা কীভাবে বিশ্বে বিপর্যয় ঘটিয়ে যাচ্ছে এবং কীভাবে একটি চামচা বাহিনী গঠন করে তাদের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করছে সেই আলোচনা। অবশেষে সকল আস্তিক সম্প্রদায়ের ঐক্যভিত্তিক পদক্ষেপের প্রয়োজনের কথা বলা হবে।
এই লেখাটি অনেকটা বক্তৃতার বৈশিষ্ট্যে রচিত।
-এক-
এই বিশ্বের বিভিন্ন দূরত্বে অবস্থিত মানুষের ধর্ম ও বিশ্বাস বিবেচনা করলে কিছু মৌলিক বিষয় অনুধাবন করা যাবে। অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, ভারত, ইউরোপ ইত্যাদির কথা চিন্তা করা যেতে পারে। তবে এই বিবেচনার জন্য সময়-সীমাকে অন্তত দেড়-দুই হাজার বছর পর্যন্ত পিছিয়ে নিতে হবে। এসব দেশের সকল বিশ্বাসের পিছনে অশরীরী সত্তার উপর বিশ্বাস পাওয়া যাবে; আত্মায় বিশ্বাস পাওয়া যাবে; এক খোদার ধারণা পাওয়া যাবে। আবার এই জগত পরিচালনার কার্যে কিছু অধস্তন দেব-দেবীও। মানুষের জীবন দেখা যাবে খোদায়ী ধারণা ঘিরে: সুখে, দুখে, ব্যথা-বেদনায়।
মানুষ এক অসহায় সত্তা। তার অসহায়ত্বকে ঘিরেই দেখা যাবে ধর্ম ও অধর্ম সবই চালিত: কেই রোগে ভুগছে আরোগ্য চায়; কারো বাচ্চা মরছে বাঁচাতে চায়; কারো বিপদ উদ্ধার পেতে চায়। এভাবে অসংখ্য প্রয়োজন। মানুষ তার দুর্বলতার সীমা বুঝে; প্রয়োজনে সেই সীমা অতিক্রম করতে চায়।
আপনি একটি সুন্দরী মেয়ে দেখেছেন বিয়ে করতে চান, কিন্তু সে আপনাকে চায় না, বা তার পরিবার রাজি হবে না। এখন তাবিজাত-পথ ধরবেন, বা যাদুর। আপনি খেলায় জয়ী হতে চান, তাই যাদু-বুড়ির কাছে যাওয়া। এসব হচ্ছে ক্ষমতার সীমাকে ঘিরে আপনার দুর্বলতাকে লাঘব করতে। একটি দুর্বল সত্তার চাহিদা যে মিটিয়ে দেবে সে তার কাছে যাবেই সোজা কথা। কিন্তু চাহিদা মেটানো আর চাহিদা মেটানোরআশ্বাসনিয়ে খেলা এই দুটি জিনিস কখনো এক নয়। ধর্ম ও অধর্মের খেলা এখানেই। অনেক বস্তুতান্ত্রিক ব্যবসায়ও এই সূত্রে প্রথিত দুর্বলের অসহায়ত্ব ঘিরে।
ধর্ম হচ্ছে মানুষ মানুষকে প্রতারণা করা থেকে বিরত রাখা, অপরকে না ঠকানো; জুলুম নির্যাতন না করা। প্রাচীন সমাজ এগুলো করত। আজকের সমাজও তাই করে। বরং এখন তা চরম রূপে। ইসলাম ধর্মের নবী (সা) বলেন, ধর্ম হচ্ছে নসিহত প্রাচীন আরবিতে নাসাহাক্রিয়ার অর্থ হচ্ছে কোন কিছু নিষ্কলুষ হওয়া, পবিত্র হওয়া। এই শব্দটি মধু সংগ্রহ থেকে ধারিত। যখন মৌমাছি তাড়িয়ে গৃহীত মধুকে অনাঙ্ক্ষাখিত বস্তু থেকে পবিত্র করা হত তখন সেই মধুর বিশেষণ হতনাসিহা’, আর  কার্যটি হত নাসাহাএই রুপকালঙ্গার থেকে  গৃহীত ধারণা হল আপনি আপনার অন্তরকে পবিত্র করবেন: প্রথমে নিজেকে, তারপর যা নিজের জন্য ভাল তা অন্যের জন্য কামনা করবেন। এই উদ্দেশ্য আপনার সামগ্রিক জীবনকে বেষ্টন করবে ব্যক্তি থেকে আর্থ-সামাজিকতা পর্যন্ত। এটাই ধর্ম। নসিহত আবার উত্তম পরামর্শ দানও এটাও সেই কল্যাণের অর্থ থেকে আসা।
-দুই-
ধর্মের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের কল্যাণ, তাকে বাঁচানো, কিন্তু ধর্মীয় টেক্সট সময়ের বিভিন্ন ও করুণ প্রেক্ষিতে, এবং নাজুক ঘটনাসমূহের আলোকে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে, এমনভাবে সজ্জিত হয়ে গিয়েছে যা পরবর্তীতে, প্রেক্ষিত অনুপস্থিত হয়ে যাওয়ায়, তার মূল ভাব ও অর্থ অনভিজ্ঞ পাঠকের কাছে অর্বাচীন হয়ে পড়েছে। সময়ের ধারায় অনেক ধর্মযাজকও ধর্মকে এমন ভাব ও আবেগে ব্যক্ত করেছেন যা কালের সাথে সম্পর্কিত হয়ে পরবর্তী কালের জন্য ধর্মান্তরায়হয়ে গিয়েছে: অনেক কিছু মিশ্রিত হয়ে ধর্মের আহবানকে সমস্যা বহুল করেছে।
আরও কিছু জটিলতা -কোনটি ধর্ম’, কোনটি অধর্ম’? বাজারে নির্ভেজাল তেল থাকলেও ভেজালও যে আছে এই জটিলতার স্বীকৃতির প্রয়োজন। আমি যদিধর্ম-ব্যবসায়জড়িত থাকি, তবে আমার কাছে আমার অধর্মকখনো প্রতিভাত হবে না, কারণ আমার অধর্ম ধর্মহিসেবে সত্যহয়ে প্রতিষ্ঠিত। আমি হয়ত স্কুল খুলে আছি, বংশ ও ঘরানা পরম্পরায় পাঠ্য সিলেবাস তৈরি করে পড়িয়ে যাচ্ছি; সার্টিফিকেট বিতরণ করে সেটিকে সত্য-ধর্মের আঙ্গিকে চালিয়ে নিচ্ছি নিষ্ঠার সাথেই। কিন্তু এখানে স্বার্থ যে সুপ্ত স্থান থেকে কাজ করে যাচ্ছে সেটি খেয়ালে আসার মত নয়: প্রায় অসম্ভব। এভাবেই চলে প্রাতিষ্ঠানিক সত্য। তবে, নিছক কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া, প্রায় সব সত্যই প্রাতিষ্ঠানিক বস্তুবাদসহ। পরিবার, গোত্র, সহপার্টি, নির্বাচিত সাহিত্য, নির্বাচিত যোগাযোগ মাধ্যম, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, সম্প্রদায় ইত্যাদিই সেই সত্যের বাহক ও স্থাপক। আস্তিক-নাস্তিক সবার। বর্ষবরণ, জন্ম দিবস, মৃত্যু দিবস, বিশেষ সংগীত, ম্যারেজ-এনিবার্সারি, মাদার্স-ডে, ফাদার্স-দে, ভ্যালেন্টাইন্স-ডে, ইত্যাদিও ধর্ম-রূপীসেক্যুলার আনুষ্ঠানিকতা। সকলের সত্যের আদর্শরয়েছে; আদর্শ স্বপন দেখাচ্ছে, আশ্বাসের যোগান দিচ্ছে; শান্তি লাভের এহসাস সঞ্চার করছে:  বৈপরীত্যও সাথে থাকছে। এইডস রোগে আক্রান্ত একজন নাস্তিককেও নানান হাতুড়ে চিকিৎসকদের দারস্ত হতে দেখবেন, কারণ সে মানুষ, সে দুর্বল, সেআশ্বাসেপ্রভাবিত দোষের কিছু নেই।
মানুষ যতদিন মানুষ থাকবে ততদিন ধর্ম-অধর্মের খেলাও থাকবে এটা নিশ্চিত, কেননা, বিষয়টি হচ্ছে মানবের প্রকৃতি ঘিরে: তার অসহায়ত্ব, তার আত্মকেন্দ্রিকতা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, লোভ-লিপ্সা ঘিরে। বিভিন্ন বিশ্বাসের সমন্বয়ে তা অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে, কিন্তু একান্ত সরানো সম্ভব কীনা সন্দেহ।
-তিন-
আপনি যখন চরম নিরুপায় হবেন, তখন পতিতা হতে পারেন, পতিতার খদ্দের হতে পারেন, ‘তকদীরেরকথা বলতে পারেন, অথবা কপালেরও। তারপরও, বিশ্বাসও করবেন, ‘আশ্বাসেথাকবেন, এসবে তাত্ত্বিক দোষের কিছু নেই আছে মানবিক দুর্বলতা আর অসহায়ত্ব।
এই অসহায় মানুষকে মুক্তির আশ্বাসদিতে কত মিথ্যাচার হয়েছে, আরও কত যে হবে কে জানে। আপনি ১০ টাকায় সর্বরোগের মহৌষধ বিক্রি করেন আপনি একা। চামচা-চাটুকার পেলে ধর্মীয় জোব্বায় পীরাকী চালাতে পারেন। কোম্পেনী হলে বীমা বিক্রি করবেন, রাষ্ট্রীয় স্বপ্ন হলে এই-তন্ত্র”, সেই-তন্ত্রকরবেন। এভাবে এক প্রজন্মের প্রতারক ও প্রতারিতরা নিঃশেষ হয় বটে, কিন্তু এইআশ্বাসেরশেষ নেই: নতুন প্রতারক আসে, আর নতুন প্রজন্মে চালিয়ে নেয়। এভাবেই চলছে। 
http://shodalap.org/wp-content/uploads/2017/12/picture-of-deception-300x189.pngআধুনিক উগ্র-নাস্তিকতা একটি চরম প্রতারণা। এই নতুন বেশ্যাটিকে নামানো হয়েছে বিশ্ব মানবতার আহবানে নতুন আশ্বাসেএটি নাকি ধর্ম নির্মূল করবে; বিশ্ব মানবতাকে একত্রিত করবে; ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করবে; সকল বিভেদ দূর করবে। একটু শান্ত হোন। এগুলো কি নতুন কিছু? নতুন আশ্বাস? এই নবীনাকে নামিয়েছে যায়োনবাদী বৈশ্বিক ধনতান্ত্রিক শক্তি। ঊর্ধ্বতন চালিকা শক্তি ধনাঢ্য হলেও এর কর্মী বাহিনী মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে আসা: এরা শহুরে প্রাণী’ (urban animals)এরা জীবনের চরম অসহায়ত্ব উপলব্ধি করেনি, বিচ্ছিন্ন উদাহরণ ভিন্ন। মানব জীবনের দুর্বলতা কোথায়, এই বিশ্ব-মানবতা কোন কারণসমূহের কারণে প্রতারিত বাস্তবতায় আসে, মানুষ কেন একে অন্যকে ঠকায়, কেন তারা শক্তি প্রয়োগ করে, কেন নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড চালায়? এসবের সাথে মানব প্রকৃতি কীভাবে সম্পর্কিত হয়? ধর্ম নির্মূল করলেই কি মানব প্রকৃতি ভিন্ন হয়ে পড়বে? জগত স্বর্গ হয়ে যাবে? এটা ধাপ্পার স্বর্গ, না  বোকার?
-চার-  
মানুষের দুর্বলতাকে ব্যবহার করে যারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বাণিজ্য করছে, তারা তা কেন করছেকেন এই বাণিজ্য-লীলায় লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন অবলীলায় হারিয়ে যাচ্ছে? কেন লক্ষ কোটি বাড়ি-ঘর আধুনিক বোমার ভূমি-কম্পে ধূলিসাৎ হচ্ছে? কেন লক্ষ লক্ষ নিরীহ প্রাণ দেশান্তর হচ্ছে? যারা বন্দুক আর গোলাবারুদ তৈরি করতে জানে না, যারা জঙ্গলি দাড়ি আর আদিম-বস্ত্র পরে পাথরের ঢিল-মিরাক্কেলে আধুনিক জঙ্গি-বিমান উড়ানোর ঈমানের আস্ফালন দেখায়, তাদের হাতে যারা অস্ত্র তুলে দিয়ে যুদ্ধ-বাণিজ্য চালাচ্ছে এরা কারা? কাদের মুনাফার যুদ্ধ এটা? কারা বিশ্বকে করায়ত্ত করতে চায়? কারা নিজেদের কুকর্ম আড়াল করতে প্রোপাগাণ্ডা শ্রেণী তৈরি করছে? এই বিশ্রি বিকট দৈত্য কীভাবে চাটুকার বাহিনী তৈরি করে তার নিজের চেহারা মায়াবিনী করে তুলছে? এই কর্মগুলোর সাথে কী মানব প্রকৃতির কোনো সম্পর্ক নেই? মোহ,পাশবিকতা নেই?
চিন্তা করুন, চোখের সামনে এই সত্যগুলো উদ্ভাসিত থাকা সত্ত্বেও সেগুলো না দেখে যারা হাজার বছর আগে কে কয়টি বিয়ে করেছিল সেই কাহিনীর প্রোপাগান্ডায় জড়িত হয়ে নিজেদের পেট-বাণিজ্য চালাচ্ছে তারাই বুঝি বিশ্ব-মানবতায় শান্তি আনার আশ্বাসদেবে? ওরে তোরা কে কোথায় রে, এক গেলাস বিষ এনে দেয়, খেয়ে মরি!
বলেছি, এই মানুষের অসহায়ত্ব ও দুর্বলতা ঘিরেই চলে প্রতারণা, এই আশ্বাস, সেই আশ্বাস: ১০ টাকার বড়ি বিক্রি, কোটি টাকার সুদী কারবার, বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র-ব্যবসা সবই এক, কিন্তু মাত্রার তফাৎ আকাশ পাতাল। কে ফতোয়া দিয়ে কার মুখ বন্ধ করল সেটা দেখবেন বটে, কিন্তু কারা অন্যদেরকে সন্ত্রাসীবানিয়ে তাদেরকে ও তাদের বাড়িঘর বোমায় উড়িয়ে দিয়ে নির্বাক করলসেটা দেখবেন নাহায়রে চান্দু! তোমরা সব সময়ই চামচা থেকে যাও কারণ একটিই: মানবিক দুর্বলতা, লিপ্সা। এই কয় যুগ আগ পর্যন্ত মুসলিমদের মধ্যে কোন সন্ত্রাস ছিল না, আজ এল কোথা থেকে?
ধর্মের অঙ্গনে মূল চিন্তা কী? ধর্ম বিশ্বাসের ভিত্তিতে মানুষের স্বভাবজাত দুর্বলতার সমাধান খুঁজে। আপনি আইন করে সব অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। মানুষের ঘরে ঘরে পুলিশ মোতায়েন করতেও পারবেন না। আইন বাহ্যিক বিচারের একটি বিধান মাত্র। কেবল খোদাতে বিশ্বাসেই মানুষের ভিতর থেকে সেই তদারকি আসতে পারে। মানুষ, প্রধাণতভাবে, বিনিময়ের ভিত্তিতেই কর্মে সাড়া দিয়ে থাকে: পরকালে সে পুরষ্কৃত হবে, স্রষ্টার সন্তুষ্টি পাবে এই বিশ্বাস তাকে উত্তম কর্মে উদ্বুদ্ধ করতে পারে, তার মন থেকে সাড়া আসতে পারে। এভাবেই ধর্মের কাজ। এ সংসারে সব লোক ধার্মিক না হলেও নৈতিকতার জগতে একটি ভারসাম্য তৈরি হবে এটাও উদ্দেশ্য।
আমার পূর্বের লেখায় বলেছি যে আজ বিভিন্ন জাতি-ধর্মের লোক, যে কারণেই হোক, অনেক পাশাপাশি হয়েছে। আজ তারা চাইলে তাদের ধর্মীয় বাণীসমূহকে, নিজ নিজ ধর্মে থেকেও, পারস্পারিক সৌহার্দে এক নতুন সমাজ গড়ার ব্যাখ্যায় আনতে পারেন। এই কাজটি জরুরি। কেননা, বিষয়টি যেন মার্টিন নীমোলারের তারা প্রথমে এলোকবিতার মত না হয়। আজ মানব জাতির ঐতিহ্যের একটি বিশেষ দিক ধ্বংসের মুখামুখি।





উগ্র-নাস্তিক্যবাদ: একটি বিষবৃক্ষ



http://shodalap.org/wp-content/uploads/2017/11/destroyed-nature-03-300x142.png

 

মানুষের কালীন বিশ্বাস

মানুষ প্রাচীন কাল থেকে এই বিশ্ব জগতের স্রষ্টা ও মালিকের সাধনা করে আসছে: তাকে মনের মধ্যে খুঁজেছে, মনের বাইরে খুঁজেছে, সুখে-দুখে খুঁজেছে, আশা-আকাঙ্ক্ষায় খুঁজেছে, কাজে কর্মে খুঁজেছে। এই প্রভুর সাধনা, চিন্তা-চেতনা মানুষের মনের গহীন থেকে উৎসারিত হয়েছে, এবং তার জীবনকে ঘিরে রয়েছে।  সকল ধর্মের মধ্যে এই বিশ্বাসের স্থানটি খুঁজে পাওয়া যায়; সকল ধরণের বক্তব্য অতিক্রম করে এক খোদার ধারণাও পাওয়া যায়।
কিন্তু মানুষের এই চলার পথে রয়েছে অনেক করুণ কাহিনী, অনেক করুণ কারণও:  তারা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করেছে, অপরের সাথেও করেছে। তারা এই ভব-সংসারের নানান টানা-পোড়নে নানান ভূখণ্ডে ছড়িয়েছে, নানান আচার-আচরণ ও প্রথায় বিভক্ত হয়েছে। এতে যেমন রয়েছে দ্বন্দ্ব তেমনিই সংহতি: এই দ্বিত্বরূপ তার প্রকৃতির অংশ।  তারপর, বেঁচে থাকা ও নিরাপত্তার জন্য নিয়ম-নীতি তৈরি করেছে, কিন্তু সর্বত্র রয়েছে প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য: তাদের সহজাত স্বার্থ, অস্তিত্বের টানা-টানি, শান্তি-অশান্তি, যুদ্ধ-সন্ধি ইত্যাদি। আবার সকল কিছুর মধ্যে তারা খোদাকে জড়িয়েছে: তাকে খুঁজেছে, তার সাহায্য প্রার্থনা করেছে। এজন্য, করুণ হলেও সত্য যে সকলের খোদা সকল পক্ষের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়তে হয়েছেকেননা তিনি সকলের আষ্টেপৃষ্ঠে, মনের গভীর পর্যন্ত। পরের গল্প হল, লক্ষ-কোটি ভুখা প্রাণী নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে, অপর লক্ষ-কোটি প্রাণ গিলে নিজেদের মধ্যে বিলীন করেছে, আর এভাবে, বলতে পারেন, এই অস্তিত্বের শক্তি (existential energy) স্থানান্তরিত হয়েছে।

পার্থক্য ও অভিন্নতা

যদিও ইতিহাসের অনেক কাহিনী করুণ, অনেক তিক্ততায় ভরপুর, তথাপি এসবের পরতে পরতে পাওয়া যাবে মানবিক ভালবাসা, পারস্পারিক সম্পর্ক, সাহায্য-সহযোগিতা। তাদের ধর্মসমূহ ভিন্ন হলেও, বিশ্বাস ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে আছে অসংখ্য সামঞ্জস্যতা: চুরি, ব্যভিচার, ডাকাতি, ধর্ষণ, হত্যা এগুলো মন্দ। প্রতিবেশীর ভালবাসা, অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসা, পারস্পারিক সহযোগিতাএগুলো ভাল। এমন অসংখ্য কিছু।
অতীতে মানুষ ভৌগলীকভাবে অনেক বিচ্ছিন্ন ছিল। আজ সেই বিচ্ছিন্নতা অনেক দূরীভূত হয়েছে। আজ বিভিন্ন জাতি-ধর্মের লোক, যে কারণেই হোক, অনেক পাশাপাশি হয়েছে। তাই, এখন তাদের সম্পর্ক এক নতুন ধারায় গড়ে তোলার অবকাশ এসেছে। সকলের খোদা এক সময় অনেকটা পাক্ষিক দেখা গেলেও, মূলের বিষয়টি আগের মতই রয়েছে: তিনি সবার, তিনি এক, অদ্বিতীয় তিনি সকলের মালিক। তাকে ঘিরেই সকলের জীবন সংসার, নীতি-নৈতিকতা। তাকে বাদ দিলে ধীরে ধীরে এই জগত সংসার ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে পড়বে। অতীত কালের গ্রন্থিক ব্যাখ্যা যাই হোক, সকল গ্রন্থসমূহে সকলের মধ্যে ঐক্য ও পারস্পারিক সৌহার্দের বাণীও রয়েছে। আজ তারা চাইলে সেই বাণীসমূহকে, নিজ নিজ ধর্মে থেকেও, পারস্পারিক ভালবাসায় এক নতুন সমাজ গড়ার ব্যাখ্যায় আনতে পারেন।

উগ্র-নাস্তিকতাবাদ -তথ্য বিনাশ, জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ

কিন্তু এই কাজটির অন্তরায় হচ্ছে উগ্রনাস্তিকতাবাদ: এটি হচ্ছে যায়োদবাদী ধনতান্ত্রিক একটি আন্দোলন। এর উদ্দেশ্য মানুষকে এক নব্য-গোলামীর ইন্দ্রজালে আবদ্ধ করা, এবং তাদেরকে এক ধরণের পণ্যেরূপান্তরিত করা। মেশিন থেকে যে পণ্য (product) বেরিয়ে আসে, তা বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে একই। তারপর ইলেক্ট্রনিক হলে, এগুলোকে একই কোডে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এই যায়োনবাদী বৈশ্বিক আন্দোলনটি মানবতার বিষবৃক্ষ। এটিই মানব জাতির হাজার হাজার বছরের নৈতিক ভিত্তি উড়িয়ে চরম পাশবিকতায় উপনীত করতে ব্যস্ত। এটা নিরঙ্কুশ ব্যক্তি স্বাধীনতা, অধিকার, ও বিজ্ঞানের নামে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। কেবল ধর্মীয় আক্রমণ চালাচ্ছে, কিন্তু বিকল্প হিসেবে কী দেবে সেই আলোচনা করছে না। যুদ্ধ ব্যবসার বাজার সৃষ্টি করে চামচা-গোলামদের মাধ্যমে হাজার বছর আগের যুদ্ধের সমালোচনা চালিয়ে নিচ্ছে। নারীদেরকে যৌন-পণ্যে রূপান্তরিত করে হাজার বছর আগে কোথায় কে কী করেছিল সেই ইতিহাস ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে আলোচনায় আনছে। এভাবে মানুষের ধর্মীয় নৈতিকতা ধ্বংস করে মানব সভ্যতায় মরুভূমি রচনা করছে।
আমি অন্তর্নিহিত দিক দিয়ে নাস্তিক বিশ্বাস নিয়ে উদ্বিগ্ন নই এটি নিছক একটি বিশ্বাস, বরং নাস্তিক্যবাদনিয়ে। অতীত কাল থেকে যেসব ইজম/বাদ এই মানবতাকে নানান চাকচিক্য দেখিয়ে বিপর্যয়মুখী করেছে এটি তাদের অন্যতম। এটি একটি বস্তুতান্ত্রিক খোদাহীন আদর্শ -খোদার নাম  শুনলেই আঁতকে উঠে। মানুষ ধর্ম ছেড়ে দিলে নাকি এই জগত শান্তির আধার হয়ে যাবে, এখানে মান্না-সালয়ার সয়লাব হবে, দানা-দানি হানা-হানি থাকবে না এমন অসংখ্য চৌকশ আশ্বাস। কিন্তু যারা মানব প্রকৃতিকে গভীর থেকে দেখেছেন, তারা এই বাণীর মিথ্যাচার বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই আন্দোলন চালানো হচ্ছে স্থূলদর্শী পঙ্গপালের মাধ্যমে যায়োনবাদী মিডিয়া, আর্থিক আনুকূল্য ও কালচার ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করে।

সবকিছু নষ্টের পথে

বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, ‘মানুষ দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝে না।এই বিশ্ব মানবতা হাজার হাজার বছরে সমাজ-কাঠামোর যে নৈতিক-ভিত্তি গড়েছে তা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেলে আবার ফিরিয়ে আনা দুষ্কর হবে। পূর্ণ বিবেচনার দিক দিয়ে এই নাস্তিকতাবাদে আদৌ নৈতিকতার কোন ধারণা নেই। যেসব চুনোপুঁটি নৈতিকতার কথা বলছে তা মূলত ধর্মীয় নৈতিকতা: বলার স্বার্থে ধার করা কথা। এই বিষবৃক্ষের একটি উদাহরণ নেয়া যাক।
ধরুন কোনো মা-ছেলে উভয়ই নাস্তিক্যবাদী, এবং উভয়ই নিজেদের স্বাধীন বিবেক ও যুক্তির ব্যবহারের পক্ষপাতী। উভয় আধুনিক, না বরং সর্বাধুনিক। তারা ব্যক্তি স্বাধীনতার ও ব্যক্তি অধিকারের কঠোর প্রবক্তা। তারা যৌন-কাজকে নিছক একটি আনন্দ (physical and creative exercise) হিসেবে গ্রহণ করেন। তারা যদি নিজেদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক রাখতে চান, তাহলে কি কোনো অন্তরায় থাকতে পারে? তারা বাচ্চা নেবেন না; তাদের নিজ ঘরে কেউ দেখতে পাবে না, (আর দেখলেই বা কী?); তারা কারো ক্ষতি করছেন না, নিছক আনন্দ করতে যাচ্ছেন, পরস্পরকে আনন্দ দিতে যাচ্ছেন। তারা গর্ভনিরোধক (contraceptive) ব্যবহার করে নিরাপদ যৌনতা উপভোগ (safe sex) করবেন। এক্ষেত্রে উভয়ই যদি তাদের পরিপক্ব (mature) সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সেই কাজটি করেন, তবে তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতা ও অধিকারকে কে খর্ব করার অধিকার রাখবে, এবং কোন যুক্তির ভিত্তিতে? এই নৈতিকতা কি পদার্থবিদ্যা বা প্রাণীবিদ্যা থেকে পাওয়া যেতে পারে?
আমি যে উদাহরণ দিয়েছি তা যে এখনো বাস্তবে হচ্ছে না তা নয়: ইউটিউবে গিয়ে মা-ছেলে, ভাই-বোন ইত্যাদি যৌন সম্পর্ক নিয়ে সার্চ দিন, দেখবেন বাস্তবতা কোন দিকে যাচ্ছে।
একটু চিন্তা করুন, এসব বিষয় বিজ্ঞানের নয়। বিজ্ঞানবাদআরযুক্তিবাদেরমাধ্যমে এবং নির্বাচিতভাবে ধর্মীয় কিছু টেক্সটের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে, ব্যাঙ্গ-বিদ্রূপ করে, ধর্ম-নির্মূলের যে যায়োনবাদী আন্দোলন চলছে এর শেষ পরিণতি কি? এই মানবের সমুদ্র কি পঙ্কিল হয়ে পড়বে?


মুক্তচিন্তক -না প্রভাবিত?


http://shodalap.org/wp-content/uploads/2018/02/20180205-influence-300x227.png

মুক্তমনাদের ধারণা যে তারা স্বাধীন চিন্তার লোক, শাব্দিক অর্থে যেমন তেমনই: মুক্তমনা। এই  অস্তিত্বের ধারায় তাদের স্বাধীন চিন্তা ও বিবেচনাবোধই মূল সম্বল।  তাদের ধারণা যে সৃষ্টির দিক থেকে এখানে ধর্মীয় চিন্তার কোন স্থান নেই, কেননা আমরা বিগব্যাং (Big Bang) থেকে ধরলে মূলত Cause and Effect এর বিষয় প্রধান পাই। অর্থাৎ এক বা একাধিক বস্তু (বা বস্তুতান্ত্রিক নিয়ম পদ্ধতি) আরও এক বা একাধিক বস্তুকে প্রভাবিত করে গড়ে তুলছে, না হয় চুরমার করছে। এখানে ধর্মীয় ধারণার কিছু নেই -ধর্মীয় ধারণা, অতি সংক্ষেপে, পূর্ববর্তীতায় প্রভাবিত -'অবৈজ্ঞানিক' তো বটে।
ঠিক আছে, আমরা ধর্মীয় ধারণা বাদ দিয়ে মুক্তচিন্তার স্থানটি দেখি।
হ্যাঁ, যুক্তি ও উদাহরণ দিয়ে যখন দেখানো হয় এই জগত, ক্রমধারায়, একটা বস্তুর বা বস্তুর কার্যকারণের প্রভাবে (effect) অন্য আরেকটি বস্তু প্রভাবিত হয়ে অস্তিত্বে আসছে, বা তার অস্তিত্ব ঠিকিয়ে রাখছে, তখন আমরা এই কোজেল থিওরিতে কী পাই? আমরা কী অস্তিত্বের ধারায় স্বাধীনমর্মের কিছু পাই, নাপ্রভাবিত”, পরাধীন মর্মের? এই ধারণাটি কী মুক্তচিন্তার অবকাশকে তুলে আনে, না পারস্পারিক প্রভাবিত চিন্তাধারার?
আমরা বিষয়টি বর্ধিত করলে দেখতে পাই যে আমাদের এই পৃথিবীটি অন্যান্য গ্রহ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আছে। আমরা সূর্য ও চন্দ্রের কথা প্রথমে চিন্তা করতে পারি। আমাদের এই পরিবেশটিও সেভাবে। এখানে কোন কিছুই স্বাধীন পছন্দিতারভিত্তিতে আসছে না, বরং ইচ্ছা বা পছন্দিতার বাইরে থেকে।  মানুষ হিসেবেও আমরা কেউ এখানে নিজ ইচ্ছায় অস্তিত্বশীল হই নি। আমাদের নিউরোলজিক্যাল ডেভেলপম্যান্ট মাতৃগর্ভে যখন শুরু হয়, তখন আমাদের ইন্টেলিজেন্সকেমন হবে -এমন বিবেচনা করার কোন স্বাধীনতা বা পছন্দিতাও  থাকেনি। যে পরিবারে আমাদের জন্ম, যেখানে আমাদের মানসিক কালচার রূপায়িত হয়েছে, এবং অনেকটা ডিটারমিনড ও প্রভাবিত হয়েছে, সেখানে কী এমন কোনো পছন্দিতা ছিল?
কোন এক ব্যক্তি যখন নিজেকে মুক্তচিন্তক/মুক্তমনা বলেন, তখন এর অর্থটা কী দাঁড়ায়? তিনি কী অন্যদের চিন্তায় প্রভাবিত নন, অন্যদের লিখা বইপুস্তকের  প্রভাব-প্রতিফলন থেকে মুক্তযদি না হয়, তাহলে তিনিও প্রভাবিত, তিনিও স্বাধীন ধারার পরিবর্তে অন্যান্যদের দেখা ও দর্শন-ধারায় চালিত। এখানে মুক্তচিন্তক কথাটি খুব একটা শুদ্ধ বলে মনে হয় না।  আমাদের এই মানব জাতি ছোট-বড় গোষ্ঠীতে পারস্পারিক প্রভাব ধারায় চালিত।  কেউ হয়ত বলতে পারেন মানুষের চিন্তাগুলো ক্রমধারায় বিবর্তিত  কিন্তু এতে মুক্তবাস্বাধীনএর তাৎপর্য পাওয়া যায় না। বরং মায়ের পেট থেকে এখন পর্যন্তপ্রভাবেরগল্পই প্রবলভাবে কার্যকর দেখা যায়।
যে বস্তুটি প্রভাব ধারায় অস্তিত্বশীল সেটি স্বাধীনভাবে আসে নি।  ‘স্বাধীনতাপ্রভাবপারস্পারিকভাবে অসামঞ্জস্যশীল (incompatible) সুতরাং দেখাই যাচ্ছে, এক ব্যক্তি মুক্তমনাবললেই পারিপার্শ্বিক ও ঐতিহাসিক সকল প্রভাব-ধারা থেকে মুক্ত বিবেচিত হয়ে যান না। ধার্মিকগণ যেভাবে প্রভাবিত তারাও সেভাবে। এখানে মুক্ত-ধারণা মুখের উচ্চারণ মাত্র।
আমরা এই অস্তিত্বে শুধু যে প্রভাবিত তাই নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে যেখানে আপাতত স্বাধীনতা প্রয়োগ করার বিষয় রয়েছে সেখানেও, স্বাধীনতা প্রকাশের জন্য, প্রভাব ধারার পূর্ব উপকরণ থাকতে হয়। আপনার একটি জটিল রোগ হয়েছে এবং আপনার অনেক টাকা।  আপনার চিকিৎসা করার সক্ষমতা ও স্বাধীনতা আছে, কিন্তু পূর্ববর্তী প্রসেস ধারায় যদি উপযুক্ত এনালিটিক্যাল যন্ত্রের আবিষ্কার না হয়ে থাকে এবং উপযুক্ত ঔষধ না থাকে, তাহলে সেই স্বাধীনতার মূল্য নেই।
সবদিক থেকে বিবেচনা করলে অষ্টাদশ শতাব্দীতে মুক্তচিন্তানামে যে শব্দটি এসেছিল সেটি এখন সেকেলে।
Publication date: Feb , ২০১৮
Archive date: 03/10/2017
________________
অন্যান্য লেখা:
(1) মুক্তমনা ও নাস্তিক মিলিট্যান্সি
(2) কলমের ভাঁওতাবাজিতে সামাজিক বিপর্যয়
(3) ক্রুসেডের যুদ্ধ
(4) নব্য-ক্রুসেডের অন্তরালে নাস্তিক মিলিটেন্সি
(5) আপনি কি সত্যিই শান্তি চান ও নিজেকে বিজ্ঞানমনষ্ক ভাবেন?
(6) পার্থক্যের অস্তিত্বে মানুষ ও বিশ্বাস -১ম পর্ব
(7) ঐশী বাণী: বিশ্বাস অবিশ্বাস ও নাস্তিকতা (২য় পর্ব)
















কলমের ভাঁওতাবাজিতে সামাজিক বিপর্যয়


তোমাদের প্রত্যেকই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকই নিজ দায়িত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে (হাদিস)।  যে কেউ এক অণু-পরিমাণ সৎকাজ করবে সে তা দেখতে পাবেআর যে কেউ এক অণু-পরিমাণ মন্দ-কাজ করবে সেও তা দেখতে পাবে (কোরান, ৯৯:৭-৮)।

অসি না মসি? আসল কথা কী?

প্রথমে একটি প্রবাদরূপী কথা (cliché) দিয়ে শুরু করা যাক। অসির মোকাবেলায় মসি’ –আমরা এমন কথা বলে থাকি এবং শুনেও থাকি। অর্থগত দিক দিয়ে অসি হচ্ছে তলোয়ার বা হাতিয়ার, আর মসি হচ্ছে কলমের কালি তবে রূপকতায় কলম, এটাও হাতিয়ার।  মসি শব্দটি শুনতে নেহায়েত নিরাপদ মানায়। কিন্তু ঘটনা কী সত্যিই তাই? মসি-ধারীরা কি নিরাপদ? ওরা কি গ্রেফতার হয় না, নির্যাতিত হয় না, আদালতে উঠে না, জেলে যায় না, ফাঁসিতে ঝুলে না? যদি তাই হয়, তাহলে?
তাহলে, তা চিন্তার বিষয়, বুঝার বিষয়, দায়িত্ব তো আছেই। এখানে কেউ নিজেকে মসিধারী বললেই সে পরিকুলের কোন নাদুস-নুদুস, অথবা ফেরেশতাকুলের খালাত-মামাত কেউ, এমনটি ধারণা করা ঠিক নয়। আবার কেউ কাউকে অসিধারী আখ্যায়িত করলেই সে নরকের পৈটা -এমন কিছু হয়ে যায় না। বাস্তব জগত এমন সাদা-সিধে হয়ে রূপায়িত হয় না।

হাতিয়ার

অসি-মসি উভয়ই মানুষের তৈরি, মানুষেরই হাতিয়ার (tools), তার উদ্দেশ্য সাধনের বাহন। মানুষ যখন তার প্রতিপক্ষের মোকাবেলায় উদ্দেশ্য সাধন করতে যায়, বা সংঘর্ষে উপনীত হয়, তখন অসি-মসির আপাত পার্থক্য খুব একটা স্থির থাকে না, অনেকটা বিলীন হয়ে যায়। মসি অসিরূপে আসতে পারে। ঔষধের কাজ সুস্থ করা। কিন্তু এই ঔষধও বেশি পরিমাণ খাইয়ে কাউকে মেরে ফেলা যায়। এটা তখন হাতিয়ার (tool) হয়। আজকাল অনেক ধরণের ঔষধ নিয়ে বিমানে চড়া যায় না। ডাক্তারের ছাড়পত্র দেখাতে হয়। তাই কোন পক্ষের মসি প্রতীকী ও ব্যবহারে প্রতারিত হতে নেই।

অসি মসির পার্থক্য -কতটুকু ও কোথায়

কেউ কলম দিয়ে লিখেন, অথবা মুখ দিয়ে বলেন, তা যদি কোন বিশেষ পক্ষের আদর্শ ও উদ্দেশ্য নিধন বা নির্মূলের উদ্দেশ্যে হয়, তাহলে বিপদও আসতে পারে। সেদিন দেখলাম একজন ইমাম নাকি শেখ মুজিবের শানে উল্টা-পালটা কথা বলার কারণে গ্রেফতার হয়েছেন। এখন হয়ত তার নাকে গরম পানি ঢালা হতে পারে রূপক অর্থে বলছি (তবে বাস্তব অর্থে হলেও আশ্চর্যের কিছু নেই)। মুজিব-কন্যা হাসিনার শানে গত বছর দু-এক আগে ফেসবুকে কে কী বলেছিল, এজন্য তাকে নাকি জেল খাটতেও হয়েছে। এদের কারও হাতে কিন্তু চাপাতিছিল না, এবং এ জন্য গ্রেফতারও হয়নি।
আমি হাসিনা সরকারের উদাহরণ দিয়ে হয়তবা ভুল করলাম। যারা হাসিনা সরকারের পক্ষের লোক তারা হয়ত নাক উঁচু করতে পারেন। তাই হাসিনা সরকার বাদ দেন, ধর্মও বাদ দেন। উদাহরণের স্থান আরও রয়েছে।
রাজনৈতিক আদর্শিক যুদ্ধের ময়দান ও ইতিহাসের ধারাবাহিকতার দিকে তাকালে দেখা যাবে যে অসি-মসির পার্থক্য (distinction) সব সময় ধারিত নয়। কমিউনিজমের পক্ষে বিপক্ষে অসংখ্য মসিধারীকে প্রাণ দিতে হয়েছে, নির্যাতিত হতে হয়েছে। এসব উদাহরণ ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, আরব অনারব দেশগুলোতে বিপুল পরিমাণে পাওয়া যাবে। আবার সরকারকে বাদ দিয়ে, সামাজিক পর্যায়েও মারামারি, হাতাহাতির ইতিহাস বিশ্ব জুড়ে বিপুল সম্ভারে পাওয়া যাবে। তাই মসি-হাতে বললেই কারো উদ্দেশ্য মহান হয়ে যায় না। মসিধারী  কী নির্মূল করতে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছে তা ভুলে গেলে চলবে না।

সবার কথা ভাবুন মসি নয়, উদ্দেশ্য দেখুন

মানুষের উদ্দেশ্য-জগত অতিশয় বিপুল। এই বিপুল পরিসরে মসির স্থান রয়েছে বটে তবে তা উদ্দেশ্য জগতের অন্তর্ভুক্ত। উদ্দেশ্যই প্রধান। বাক, নির্বাক, ভাষিক, প্রতীকী, আকৃতি, ইঙ্গিতী ইত্যাদি কাজ কতভাবে করা যায়। ধরুন কোন এক অশিষ্ট পক্ষ, তার সাংঘর্ষিক কারণে, তার নিজ সড়কের দাঁড়িয়ে বসন উন্মোচন করে, বিনা বাক্য-ব্যয়ে, প্রতিপক্ষকে 'একটা কিছু' বলে দিল। অথবা প্ল্যালেকার্ডে কিছু ইতরামি কথা লিখে দেখিয়েদিল। কিন্তু সে তখনো তার নিজ সড়কের উপর দাঁড়িয়ে। হয়তবা তার বিবেক মোতাবেক নিজ ইচ্ছা ও কর্মের স্বাধীনতা নিয়ে ভাবছে। কিন্তু প্রতিপক্ষ যে সমাজ নিয়ে আছে, তার বসবাসের যে সংস্কৃতি, তার যে শালীনতা, সভ্যতা যা তার পূর্বপুরুষ থেকে প্রাপ্ত এবং তার পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তর করতে আদিষ্ট এবং যা তার কাছে মূল্যবান, সে তো এইঅসভ্যআচরণে পীড়িত হবে। আবার ঘটনা যদি এই হয় যে, এই অশিষ্টের কোনপ্রাপ্তমূল্যবোধ না'ই থাকে, বা অন্যের ক্রীড়নক হয়ে থাকে যাদের উদ্দেশ্য কেবল সংঘর্ষ টিকিয়ে রাখা, তাহলে এমন পরিস্থিতি ও পরিবেশে সন্তপ্ত (aggrieved) পক্ষ কী করবে?
বাস্তবতা বরং এভাবে হতে পারে যে একটি শ্রেণীতে হয়ত কয়েক প্রজন্ম ব্যাপী বিয়েশাদী, ধর্মীয় মূল্যবোধ, ঈমান-আমল হারিয়ে গিয়েছে। এখন তাদের মধ্যে বিয়েশাদির বাইরে যৌন-আচরণ ও সংস্কৃতি স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। অন্য শ্রেণী হয়ত এখনো ধার্মিক, প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধ নিয়ে বেঁচে আছে; এখানে মা-বাপের মান-মর্যাদা, ধর্মীয় আচার-আচরণ, ধর্মীয় নৈতিকতা পালিত হচ্ছে। এখানে তাদের বিশ্বাসের সত্তা: আল্লাহ-রাসূল তাদের মা-বাপের চাইতেও অধিক সম্মানজনক। ওদের প্রতি তাদের ভালবাসা তাদের জীবনের চাইতেও অধিক মূল্যের। এখানে যদি আল্লাহ রাসূল নিয়ে ইতরি ভাষায় গালাগালি হয়, লেখালেখি হয়, আর বলা হয়, ‘আমরা মসি দিয়ে তোমাদের এই অন্ধ প্রথা ও বিশ্বাস দূর করে দেব, তোমাদেরকে সভ্য করব, বিজ্ঞান শেখাব, মানুষ বানাব, তাহলে কি হবে? এই পরিস্থিতিতে এখন সন্তপ্ত পক্ষ কি করবে? অথচ গণতান্ত্রিক দিক দিয়ে তাদের অবস্থান বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ!

নাগরিক সভ্যতা কী করবে?

এখানে আইনের দিকে না তাকিয়ে উপায় নেই। তবে, আইন অবশ্যই থাকতে হবে, আইনের সুস্থ আচরণ থাকতে হবে। তারপর এই অঙ্গন থেকে বাক-স্বাধীনতাসংজ্ঞায়িত হতে হবে, সীমা নির্ধারিত হতে হবে, তা না হলে বিপদ আসন্ন।  একটি অতি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিদেশি কলোনাইজারদের সাহায্য-সহযোগিতায় সংখ্যাগরিষ্ঠদের আদর্শ ও মূল্যবোধের উপর আগ্রাসী হয়ে উঠতে দেয়া যেতে পারে না। মানুষ কেন সমাজ ও সরকার গড়ে? এখানে ইতর ভদ্র সবাই বাস করবে, এবং কারো অধিকার যাতে খর্ব না হয় সেই ব্যবস্থাও থাকতে হবে। কিন্তু আইন অচল হলে সমাজ থাকবে না; আইন বেআইনি হলেও থাকবে না।
সমাজ নানান উপাদানে গঠিত, তসবীর দানার মত সম্পর্কিত। এতে আছে বিভিন্ন বিশ্বাস, মূল্যবোধ, প্রথা, ঐতিহাসিকতা। এসবের সমন্বয় অটুট রাখার বাস্তবতা আবহমান কালের। কেউ যদি এই আবহমান কালের বিশ্বাস, প্রথা, মূল্যবোধ ধ্বংস করতে চায়, এবং এই কাজ করতে পারাতেই তার স্বাধীনতা দেখে, তার অধিকার দেখে, সভ্যতা দেখে, তবে এই সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে?
কেউ ব্যক্তি স্বাধীনতা, মসি, বিজ্ঞান, প্রগতি ইত্যাদি আওড়িয়ে গেলেই সভ্য হয়ে যায় না। আবার কেউ এগুলো না আওড়ালে অসভ্য হয়েও যায় না। দায়িত্বের দিকে তাকাতে হবে, সমাজের দিকে তাকাতে হবে। কেউ কখনো আইনকে নিজ হাতে তোলে নিতে নেই। আইনি ব্যবস্থায়  অবিচল থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে আইনের বাইরে কোন সমাধান নেই।
কিন্তু এতেও আইন, আলোচনা ও সমঝোতা আসতে হবে। যারা মসি-হাতে ফাঁকা বুলির আস্ফালন, গালমন্দ করেন তাদেরকে দায়িত্বের সমঝে আসতে হবে।

মসিওয়ালার দায়িত্ব কি?

মসিওয়ালার দায়িত্ব হল কালি যেন চর্তুদিকে না ছড়ায়, অন্যের কাপড় যাতে নষ্ট না করে; ব্যক্তিক ও সামষ্টিক উপবেশনের স্থান কালিমাময় না করে। তারপর মসিকে যদি তীর ভাবা হয় তবে সেই তীর যেন অন্যের ঘাড়ে গিয়ে না পড়ে।  তারপর লিখা 'শিখতে' হবে, দায়িত্ব বুঝতে হবে। লিখার প্রথায় সভ্য আচরণ আসতে হবে।

সামাজিক পরিবর্তন ও সাম্রাজ্যবাদ

বলা হয় বাংলাদেশ হচ্ছে ৯০% মুসলমানের দেশ। এই ভূখণ্ড তিন দিক থেকে ভারত কর্তৃক বেষ্টিত (তবে শক্তির দিক থেকে বলতে গেলে চার দিকেই এই আবেষ্টন)। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির প্রেক্ষিতে মুসলমানদের এই সংখ্যাটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং হয়ত এখানেই আপনা মাসে হরিণা বৈরী।
এই আলোকে একটু পিছনের দিকে তাকানো যেতে পারে। আজকের বাংলাদেশে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এক শ্রেণীর লোক জাতীয় সম্পদ লুট করেছে এবং করছেও। এতে রয়েছে ব্যাঙ্ক, বিমান, মৎস্য, বন, প্রকৃতি: ব্যাপক হরিলুট। ঘোষ তো আছেই। এদের ব্যবসা বাণিজ্য ও ব্যাঙ্ক একাউন্ট সাম্রাজ্যবাদীদের দেশে, তাদের নিরাপত্তায়। মনে রাখা দরকার, নব্য-সাম্রাজ্যবাদের বাহ্যিক রূপ আগের মত নয়। এই বিগত কয়েক দশকে যেসব দেশে বিপর্যয় হয়েছে এবং এক শ্রেণীর লোক জাতীয়সম্পদ হরিলুট করেছে, তাদের বিষয়টি পাঠ করা যেতে পারে।  তাদের টাকা পয়সা কী নিজ দেশে রেখেছে না ইউরোপ আমেরিকায় সঞ্চয় ও নিয়োগ করেছে? এরা যে ডাকাত তা কি এই দেশগুলো জানে না? রাশিয়ার পরিচিত ডাকাত ব্রিটেনে এসে কীভাবে বড় আকারের ব্যবস্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়, সুযোগ পায়? এই রাশিয়া থেকে বাংলা, পাকিস্তান, আফগান, ইরাক সিরিয়া ইত্যাদি দেশের চোরগুলো কেবল বিগত ২০ বছরে যে টাকা লুট করেছে সেই টাকা এখন কোথায়? এদের ছেলেমেয়েরা কোন ভাষায় কথা বলে? এদের জীবন প্রণালী কীরূপ? এই সাম্রাজ্যবাদ কী আদর্শ ও সংস্কৃতি বিবর্জিত? এসব কী নিয়ন্ত্রণ ব্যতীত স্থাপিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়? এই সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্র কী ওতপ্রোত নয়? এই নিয়ন্ত্রণের বাজারে কী ক্যাপিটাল ইনভেস্ট করতে হয় না? লোকজন লাগে না? এখানে কী এই আদর্শ ও বিশ্বাসের শ্রেণী তৈরির প্রয়োজন হয় না?  সব কিছু মিলিয়ে আজকের সমাজে অনেক জটিলতা এসেছে।

হেমলিনের বংশী সুরে মোহগ্রস্ত

আজকের এই কন্ট্রোল, বাক-স্বাধীনতা, এই গণতন্ত্র, এই সন্ত্রাস এসব যারা বুঝে নি, বা বুঝার পরিসর ও বাস্তবতায় উপনীত হয় নি, তাদেরকে হেমলিনের বংশী দিয়ে পাগল করা হচ্ছে। বুঝে, না বুঝে সুরের পিছনে ছুটে চলেছে। উঠছে, পড়ছে, আর যাচ্ছেই। অপ্রয়োজনীয়ভাবে  সংঘর্ষ সৃষ্টি করছে।  যে যুদ্ধ তার নয়, সেই যুদ্ধও সে করছে। কিন্তু কেন এমন হবে? কেন মিথ্যাচারের মাধ্যমে যুবক-যুবতিদেরে এমন এক প্রোপাগান্ডা ডিসকোর্সে’ (discourse) ঢুকানো হবে যা বুঝার ক্ষমতা, জ্ঞান, পড়াশুনা তাদের অনেকের নেই? আজ বিশ্বের দিকে তাকিয়ে হয়ত অনেকের বলতে ইচ্ছে করছে: কেন একটি সর্বগ্রাসী বৈশ্বিক ব্যবস্থায় আমাদের প্রাচীন সমাজ উলট পালট হচ্ছে, কেন আমাদের এই ধ্বংস আর  ক্ষয়-ক্ষতি হচ্ছে

‘… যাহা আসে কই মুখে

আমার কথাগুলো ঠিকভাবে বলতে পারছি কী না জানি না। চাচ্ছি সকল জটিলতাকে সামনে রেখে কিছু কথা বলতে।
এবারে অন্য একটি দিক আলোচনা করি।   যে ভৌগলীক ভূখণ্ডের খণ্ডিত-সুরেএখন নৃত্য চলছে, সেই ইউরোপের মিলিটারিজমের বিষয়টি দেখুন। এই মিলিটারিজমের ইতিহাস হচ্ছে হাজার হাজার বছরের ইতিহাস। এখানে সর্বদাই দুই ধরণের লেখা রয়েছে -একটা পাবলিকের জন্য আর অন্যটা ক্লাসিফাইড গোপন, শাসকদের জন্য। তারপর, রাজকীয় লাইব্রেরী তো ভিন্ন, ওখানে কেউ যেতে পারবে না।
এই মিলিটারিজমকে যদি কেবল খৃষ্টপূর্ব ষষ্ট শতকের ক্লাইস্তেনিস (Cleisthenes) থেকে শুরু করে আধুনিক কালের সাম্রাজ্যবাদ পর্যন্ত আসেন তবে চোখ ঘুলিয়ে যাবে। এখানে দেখা যাবে এই যে সেদিন থেকে অস্ত্র শানিত হচ্ছে, সেই শান এখনও দেয়া হচ্ছে। এখান থেকে বড় আকারের হিংস্র কাজ হয়ে যেতে পারে এবং যৌথভাবে (in corporation) করা হয়ে যেতে পারে। এই ধরণের কাজ সব দেশের লোক করতে পারে না। আধুনিক বিজ্ঞানের মূলনীতি মুসলমানদের কাছে মধ্যযুগ থেকে থাকলেও তারা এই হিংস্রতা এবং প্রকৃতি-বিপর্যয়ের মাধ্যমে, বেপরোয়াভাবে, যৌথ উদ্যোগ সহকারে নিতে পারেনি, তাই সেই জ্ঞান মাটির লেভেল থেকে উঠতে পারে নি। হিরোসীমা নাগাসাকীর ঘটনা মুসলমানদের পক্ষে সম্ভবই হত না। গান-পাউডার পেলেও মাস-মার্ডারের বন্দুক তৈরির চিন্তা আসত না। এই মানসিকতার লোক আমেরিকায় গিয়ে সেখানকার জনবসতিকে কীভাবে নিশ্চিহ্ন করেছিল এবং খেলার উদ্দেশ্য কীভাবে গরু, মহিষ, পশু পাখী নিধন করেছিল তা এখনো শুনতে লোমহর্ষ হয়।
এই মিলিটারিজমে যে বিপুল প্রোপাগান্ডা’, মিথ্যাচার জড়িত এসবেরও সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এগুলো সঠিক পথে অনেক বৎসর অধ্যয়ন না করলে কেউ বুঝতে পারবে না।
চিন্তা করুন, যে গৃহে একটি আলোচনা দুই মাস ধরে চলছে, আপনি সেই ঘরে ঢুকে কী সহসা সেই আলোচনা বুঝে ফেলবেন? কোন পক্ষ কোন কথা কোন কারণে এবং কোন উদ্দেশ্যে বলছে তা বুঝতে পারবেন না। কিন্তু যে আলোচনা হাজার বছর ধরে চলে আসছে সেই আলোচনা আপনি পদার্থ বিজ্ঞান বা রসায়ন বিজ্ঞান পড়েই কী বুঝে ফেলবেন? এই সমস্যাই হচ্ছে আজকের নব্য উগ্র বঙ্গাল নাস্তিকদের। আজকে অপরের যুদ্ধে বিজ্ঞানের নামে হেয়ালীভাবে ঢুকে পড়ছে।  আর এতে ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদী আদর্শের গ্রাউন্ড-ওয়ার্ক তাদের মাধ্যমেই হয়ে যাচ্ছে। তাদেরকে’-এর যুক্তি দেখিয়ে ’-এর বক্সে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে।
আজকে যারা হেমলিনের বংশী-সুরে নৃত্য করছে, এই শ্রেণির দিকে তাকান, এদের বয়সের দিকে তাকান, এদের শিক্ষার প্রেক্ষিত দেখেন। বিগত কয়েক দশকে বাংলায় হরিলুটের মাধ্যমে যে সামাজিক পরিবর্তন এসেছে, এবং এতে যে সামাজিক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, সেসবের সাথে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের বিষয় দেখুন। এখানে অনেক জটিলতা আছে। তারপর এসবের সাথে ভারতবেষ্টিত আঞ্চলিক অবস্থান দেখুন। তারপর, ইসলাম বিদ্বেষী প্রোপাগান্ডা সাহিত্যের দিকে তাকান, এবং নিজেকে প্রশ্ন করুন মুসলমানরা কী সত্যিই বিজ্ঞান বিমুখ? সত্যিই কী বিজ্ঞান ও মুসলমান এবং বিজ্ঞান ও ইসলামের মধ্যে এমন কোন বিরোধ বিরাজমান যে কেউ বিজ্ঞান চর্চা করতে গেলে মুসলিমরা সন্ত্রাসী হয়ে উঠবে? যদি এমন কিছু না থাকে, তবে কেন খামাখা বিবাদের ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করা হবে? কেন অন্যের ধর্ম ও মূল্যবোধের উপর আঘাতের আন্দোলন সৃষ্টির প্রয়োজন হবে? কেন এসবের মাধ্যমে প্রাণহানি হবে? প্রাণ যারই হোক না কেন। একটি প্রাণের সাথে আরও কত প্রাণ জড়িত, পরিবার জড়িত, একটি সমাজ জড়িত এসব কী দায়িত্বের সাথে বিবেচনা করা হবে না? আল্লাহর ওয়াস্তে শান্তি ও সমঝোতার ভাষা আসুক, প্রজ্ঞার উদয় হোক।  

বিজ্ঞান ও মুসলিম বিশ্ব

আপনি কেন ভাবেন যে ইসলাম ও মুসলিমগণ বিজ্ঞান বিরোধী? এই ধর্মে কী বিজ্ঞান অধ্যয়ন হারাম ঘোষিত হয়েছে? ইসলাম তো পাঠেরঅনুজ্ঞায় শুরু হয়েছে।লেখারমাধ্যমে মানুষ যে অগ্রগতি লাভ করেছে, সেই লেখার প্রথাকে স্বীকৃতি দিয়েই এসেছে; আল্লাহ নিজেই বলেছেন তিনিই মানব মনে লেখার উপায় জাগ্রত করেছেন, কলমের প্রথা বা লেখা শিখিয়ে দিয়েছেন। প্রথম দিনের অহীর বাক্যাবলী এভাবেই ছিল: পাঠ করুন (অর্থাৎ হে মুহাম্মাদ, জিব্রাইল যা বলেন তা আপনি তা পাঠ করুন এবং বিশ্বাসীদেরকে পাঠ করান)। আপনার পালনকর্তার নামে (আপনি পাঠ করুন), যিনি সৃষ্টি করেছেন; যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট-রক্ত থেকে। পাঠ করুন! আপনার পালনকর্তা অতিশয় মহান; যিনি মানুষকে কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না। নিশ্চয় মানুষ সীমালঙ্ঘন করে থাকে, কারণ সে নিজেকে স্বয়ংসমৃদ্ধ ভাবে” (৯৬:১-৬)।
জ্ঞানীদেরকে আল্লাহ মর্যাদা দান করেছেন। জ্ঞানের পক্ষে অসংখ্য আয়াত ও হাদিস বিবৃত রয়েছে এবং এই জ্ঞানের পথে মুসলিম উম্মাহ বিগত ১৪ শো বছর ধরে হেঁটে চলেছেন। ইউরোপ যখন অন্ধকারের যুগে, তখন মুসলিমরা এই জগতে জ্ঞানের আলো উজ্জ্বল করছেন এবং এখনো তারা জ্ঞান বিজ্ঞানের সপক্ষে। একটিবার চোখ বন্ধ করে চিন্তা করুন, সত্যিই কি ইউরোপ মসিধারী আর ইসলাম অসিধারী? এখন যেসব দেশে যুদ্ধ চলছে এগুলোর উৎপত্তি কোথায়? কারণ কি? এই অস্ত্র কোথা থেকে সাপ্লাই হচ্ছে?
এবারে আপনি ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ও সিলেবাস দেখুন। তারপর মুসলিম বিশ্বের ইউনিভারসিটি ও কলেজগুলোর দিকে তাকান। দেখবেন পদার্থ বিজ্ঞান হোক অথবা রসায়ন, সমাজবিজ্ঞান হোক অথবা রাষ্ট্রবিজ্ঞান সবগুলোই মুসলমানরা অধ্যয়ন করছে। দানের টাকায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামী মাদ্রাসাগুলো পরিদর্শন করে দেখুন। সেখানেও দেখবেন যতটুকু বিজ্ঞান পড়ানো তাদের কেপাসিটির ভিতরে রয়েছে, ততটুকু পড়ানো হচ্ছে। তারা সব বিজ্ঞান পড়ানোর জন্য সরকারী সাহায্য নিতেও প্রস্তুত যদি সে সাহায্য তাদের মাদ্রাসা কন্ট্রোলভুক্ত করতে না হয়। খামাখা একটি শ্রেণির প্রতি বিদ্বেষী, আক্রোশি হওয়াতে বিজ্ঞান বর্ধিত হয় না, এতে বরং সমাজ বিভক্ত হয়, যা সাম্রাজ্যবাদের পক্ষের বিষয় হয়।
বিজ্ঞান পড়া হারাম এমন ফতোয়া কী ইসলামী বিশ্বে আছে? যদি না থাকে, তাহলে এই ছেলেমেয়েদেরকে নাস্তিকতায় কারা উগ্র বানাচ্ছে? আজ ইসলাম বিদ্বেষী ইউরোপীয়/জায়নবাদী প্রোপাগান্ডা সাহিত্যের মাধ্যমে যাদের মাথা ধোলাই দেয়া হচ্ছে, সেই সাহিত্যের ঐতিহাসিকতা কী? এগুলো কী জানার দরকার নেই? আজকে যাদেরকে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও  বিজ্ঞানের নামে পরধর্ম অসহিষ্ণু করে তোলা হচ্ছে এর মূল রহস্য কী, কারণ কী? এই আন্দোলন ও উগ্রতার সাথে কী সাম্রাজ্যবাদী আদর্শ ও শিক্ষা সংস্কৃতির সম্পর্ক নেই? আমি ইউরোপের সবকিছু মন্দ বলছি না। সব সমাজে ভাল-মন্দ থাকে। সব সমাজ থেকে কিছু না কিছু শেখার থাকে। আমি মন্দের বিপক্ষে বলছি। ইউরোপেও এই সাম্রাজ্যবাদী ধনতান্ত্রিক আদর্শের বিপক্ষে বলিষ্ঠ আওয়াজ রয়েছে। আমি নতুন কিছু বলছি না।

কোন বিজ্ঞানীর আবিষ্কারে বাধা পড়ল?

বিজ্ঞানের নামে যেসব ছেলেমেয়েদের মাথা ধোলাই দেয়া হয়েছে, এবং সাম্রাজ্যবাদের অনুকূলে লিখিত ইসলাম বিদ্বেষী সাহিত্য দিয়ে ইসলাম ও মুসলিম আক্রমণমুখী করে তোলা হয়েছে, তাদের দিকে আরেকটু লক্ষ্য করুন। এরা কোন পর্যায়ের বিজ্ঞানী? তাদের আবিষ্কার কী? বিজ্ঞানে স্মর্তব্য অবদান কী? তারা কেন এত আক্রোশি-বিদ্বেষী হয়ে উঠল? তারা মানব জাতির কল্যাণের উদ্দেশ্যে কোন কোন আবিষ্কার করতে গিয়েছিল আর মধ্যযুগে পড়া-থাকা মুসলমানদের বাধার কারণে মানবজাতি সেই কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হল? এমন কি কোন নজির আছে? যদি না থাকে, তবে কেন এত বিবাদ, কেন এত চিল্লাচিল্লি?
মূল কথা হচ্ছে ইসলাম ও মুসলমানগণ বিজ্ঞানের বিরোধী নয়। বরং ঝোপ-জঙ্গলে যে হৈচৈ হচ্ছে তা করছে বানরের দল এক ডাল থেকে অন্য ডালে লম্ফ-ঝম্প দিচ্ছে, আর বিকট শব্দ করছে। এখানে বিজ্ঞান নয় বরং মুসলিম বিশ্ব বিবর্তনবাদে সাড়া দিচ্ছে না, যে কয়জন সাড়া দিয়েছে, তারা প্রাণখোলে সাড়া দেয় নি। কেবল মিন মিন করে হ্যাঁবলছে, আর সন্দেহও প্রকাশ করেছে। কিন্তু, নাস্তিকতা গিলে নি, আর এতে বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদের ধনতান্ত্রিক আদর্শের মোকাবেলায় ইসলামখাড়াথেকেই যায়: শেষ হয় না। কিন্তু, যাদের হাজার বছরের প্রজেক্ট এইকটি উদ্দেশ্যে চালিত তা এই ধর্মের মোকাবেলায় আটকে যেতে পারে না, এটাকে ধরাশায়ী করতে হবে। এখানেই হয়ত 'বিজ্ঞান বিমুখীতার' আওয়াজ। ওয়াল্লাহু আ'লাম।





















মুক্তির অনন্তর সন্ধানে মানুষ

 

 

20151212 freedom

 

-এক-

সহজাত প্রকৃতি ও জ্ঞান
মানুষের জীবন যাত্রার শুরু থেকেই সে অনুসন্ধানী, বিজ্ঞানী। তার জীবনকে উন্নত করতে এবং বাঁচার  তাগিদে, সে তার চিন্তা ও কর্মের যে উৎকর্ষ সাধন করতে যা কিছু করে যাচ্ছে তাই জ্ঞান-বিজ্ঞানের অংশ হয়ে আছে। মানুষ ভুল করে, পরে বুঝতে পায়, তারপর শুধরিয়ে নেয়। এভাবেই তার যাত্রা।
যন্ত্রের ব্যবহার তার জীবনে প্রথম থেকেই। তার অনুসন্ধিৎসার শেষ নেই। সে চর্মচক্ষে আকাশ-রাজ্য দেখেছে, এবং এক প্রকার জ্ঞান লাভ করেছে, তারপর যন্ত্র ব্যবহার করেছে, এবং যান্ত্রিক দেখার জ্ঞান লাভ করেছে। এভাবে চর্মচক্ষে পদার্থের মৌলিক জ্ঞান লাভ করেছে, তারপর যান্ত্রিকভাবে পদার্থের ক্ষুদ্রাংশের জ্ঞান লাভ করেছে। তার নতুন নতুন যন্ত্র জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন নতুন দিগন্ত, এবং দিগন্তের প্রকৃতি বুঝার সুযোগ দিয়েছে। এই ধারাতেই তার চলার পথ আবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু তার জীবনের সমস্যা ও সমাধান কখনো একান্ত এই বস্তুকেন্দ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে নিবদ্ধ নয়। অধিকন্তু বস্তুকেন্দ্রিকতা তাকে বার বার বস্তুর জিঞ্জিরে আবদ্ধও করেছে, আর সে বার বার মুক্ত হতে চেয়েছে এই হচ্ছে তার অনন্তর সংগ্রামের মৌলিক ইতিহাসের একটি দিক।

সত্তাগত অনুভূতি, ইন্দ্রজাল ও দাসত্ব

মানুষের চিন্তা চরিত্রে যেমন ভাল দিক আছে, তেমনি আছে স্বার্থকেন্দ্রিকতা, হিংস্রতা ও লোভপ্রবণতা। একথা মানুষ বুঝেছে। সে আরো বুঝেছে যে তার ভিতরে বস্তুর প্রতি আকর্ষণ, বিত্তের প্রতি মত্ততা রয়েছে। এগুলোই কালে কালে তাকে বন্দী করে, এবং এগুলোর সূত্র ধরেই এক শ্রেণী আরেক শ্রেণীকে গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ করে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতরা শুধু ভূ-সম্পত্তি দখল করেনি, বরং জ্ঞান-বিজ্ঞানকে কব্জা করে। তারা কর্তৃত্ব দখল করে নিজেরদের জন্য শিক্ষারমাধ্যম তৈরি করে অপর শ্রেণীকে প্রশিক্ষিত দাস-শ্রেণীতে পরিণত করে। এটা ঠিক জন্তু জানোয়ারকে নিজেদের স্বার্থে শিক্ষা দেয়ার মত। তবে মানুষ চক্রান্তের সীমা ত্রিসীমাও বুঝে, এবং এটাও বুঝে যে 'বোঝতে পারাই' সবকিছু নয়। আর প্রভু-শ্রেণীও বুঝে যে ওরা বুঝলেই কাজ হবে নাজিঞ্জির ছিন্ন হবে না।
জ্ঞান-বিজ্ঞান আপনাতেই ভাল বা মন্দ নয়। ব্যবহারেই তার রূপ। যে শ্রেণীটি প্রভু হয়ে বসে, তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানকে নিজেদের উন্নয়ন, ক্ষমতা বৃদ্ধি, ও নিজ শ্রেণীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। এই কাজে আমলা-বাহিনী (bureaucrats/staff) গড়ে, অবস্থান সুদৃঢ় করে। মন্দ লোকের হাতে পড়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের মন্দ দিক চরম বিস্তৃতি লাভ করে।
'শিক্ষা-লাভ', 'জ্ঞান-লাভ' –এসব কথা মূল্যবোধ (value-led) তাড়িত। কার শিক্ষা, কার স্বার্থে? কোন জ্ঞান এমনিতেই ভাল হওয়ার নিশ্চয়তা দেয় না।  ‘ভালশব্দটিও মূল্যবোধ তাড়িত। কার দৃষ্টিতে, কোন সমঝের আলোকে ভাল? মানুষ তো জেনে-বুঝেও তার নিজ স্বার্থে মন্দ-কাজ করতে পারে। যে লোক ডাকাতি করে সে জানে ডাকাতি অন্যায়। যে ঠকিয়ে ব্যবসা করে সেও জানে কাজটি মন্দ। কিন্তু স্বার্থাগ্রহই মন্দের দিকে আগ্রহান্বিত করে। আবার, মন্দ-কাজ করার পরও মানুষ মন্দের পক্ষে নানান যুক্তি খোঁজে পায়। তার ভাষিক ও সৃষ্টিশৈলী শক্তি তাকে একাজে সহায়তা করে। সুতরাং, একান্ত জানারকারণে, বা জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জিত হলেই কেউ ভাল মানুষহয়ে যাবে -এমন ধারণা ভুল। হিরোশিমা ও নাগাসাকির কথা চিন্তা করুন। এই বোমাগুলো কে তৈরি করেছিল? কারা এগুলোর জ্ঞানদিয়েছিল, কারা এই বিধ্বংসী কাজের নির্দেশ দিয়েছিল, কারা এগুলো বাহন-ভর্তি করেছিল, কারা এগুলো নিক্ষেপ করেছিল এই বিষয়গুলো চিন্তার বিষয়। এই প্রেক্ষিতের যুদ্ধগুলোর শুরু, শুরুপূর্ব রাজনীতি, দুর্নীতি, সমাজের আভ্যন্তরীণ শ্রেণীবিন্যাস, আত্মকলহ, আধিপত্যবাদের আদর্শগত অমানবিকতা, এবং 'অপর সমাজ ও মানবতাকে' পাশবিকতায় দেখার যুগান্তরব্যাপী স্তূপীকৃত ধারণা এসব কথা খেয়ালে রাখলে ভাল হয়।
মন্দ ধারার শিক্ষা
আজকের, এবং অতীতের, জল, স্থল ও বায়ু দূষণের কথা চিন্তা করুন; অতীতের যুদ্ধে ব্যবহৃত জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিষয় ও উপকরণের কথা চিন্তা করুন; মানব চরিত্রের সার্বিক দিকগুলোর কথা চিন্তা করুন। জ্ঞান-বিজ্ঞান সবদিনই ছিল। ক্রমান্বয়েই আমরা আজকের এই স্থানে এসেছি। আজকের জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাশাপাশি মানব চরিত্রের মন্দের পরিব্যাপ্তি, প্রসার ও পরিণতি কীরূপ হয়েছে এবং এখন তা কোন গতিতে এবং কোন ধারায় ছুটে চলেছে -এই বিষয়টির উপরও মনোনিবেশ করা হোক। আজকের অস্ত্র ইন্ডাস্ট্রির ৮৫ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসার কথাও মনে রাখা যাক -সাথে সাথে ক্ষমতার রাজনীতির পরিমণ্ডলকেও। শিক্ষামানুষকে যদি 'মানুষ' করে ফেলত, তবে বন্দুকের (দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের কথা বলছি) নলগুলো কেন এক শিক্ষিতজাতি অপর শিক্ষিতজাতির প্রতি নিশানা করে রাখছেকেন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দিয়ে নিউক্লিয়ার বোমাগুলো সাজিয়ে রেখেছে?  “অশিক্ষিতলোকগুলো কী কারো হুমকি হওয়ার কারণে এসব হচ্ছেআজ পর্যন্ত এই শিক্ষা ব্যবস্থা কার স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে কোন শ্রেণী এগুলো করায়ত্ত করে কোন শ্রেণীকে বিভ্রান্ত করছে? আপনার পোষা ময়নাটি যখন গণতন্ত্র, সেক্যুলারিজম, ব্যক্তি-স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, সভ্যতা ইত্যাদি শব্দ আওড়াবে, তখন কী বুঝতে হবে? বুঝতে হবে ময়নাটির উপর প্রশিক্ষণ কার্যকর হয়েছে।
এই বিশ্বে যে লুটপাট হচ্ছে সেটার দিকে একটু মনোনিবেশ করুন। এই লুট, ঠকবাজি, এই আধিপত্যের কথা ব্যক্তি থেকে একটু আলাদা করে সামষ্টিক ও আদর্শিকভাবে দেখুন। ব্যক্তির কুযুক্তি কীভাবে সামষ্টিক রূপ পরিগ্রহ করে, এর পক্ষে কীভাবে জ্ঞান বিজ্ঞানকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারা যায়, সেই বিষয়টি অনুধাবন করুন। অতঃপর ভাষাকে কীভাবে সৃষ্টিশৈলী রূপ দিয়ে সত্যকে মিথ্যা, অন্যায়কে ন্যায়, মন্দকে ভাল দেখানো যায় সেটাও দেখুন। এর সবই শিক্ষার অংশ হয়ে আছে। এসবের অনেক কিছু শিক্ষার থিওরিতেও রূপায়িত হয়েছে। যারা শিক্ষা-দর্শনের সাথে পরিচিত তাদের অনেকেই দেখতে পাচ্ছেন যে এই শিক্ষাব্যবস্থা বস্তুমোহী আধিপত্যচক্রের বৈশ্বিক বিস্তারবাহী মানসিকতা সৃষ্টি করছে। গোলামীকে স্বাধীনতা ভাবার হেয়ালী মানসিকতা তৈরি করছেস্বার্থ ও লোভের গুণকীর্তনের (celebration) সয়লাব বৃদ্ধি করছে। আজ এই শিক্ষা ব্যবস্থা এমন হয়েছে যে এক ব্যক্তি কেবল একজন চাকর হওয়ার জন্য ২০/২৫ বছর পড়াশুনা করতে হয়। অতঃপর আরও ২০ বছর চাকুরী করার পর যখন প্যাচসমঝে আসে, তখন আর ফিরার পথ নেই। ফিরার চিন্তাই বেকারত্বের চরম ভীতি! এই হচ্ছে শিক্ষা। হায় আক্ষেপ। আমরা এখানে।
-দুই-
Privileged শিক্ষা ও হারানো শিক্ষা
এক কালে শিক্ষার ধারণাটি দুটি ধারায় বহমান ছিল। একটি ছিল বাদশাহের হিসেব রক্ষক হওয়া, তার সোনা-দানার অংক কষা। অর্থাৎ বাদশাহের কোন্‌ গোলাম কত পেল আর কত বাকী রইল এই হিসেব লেখা, আর তার চৌদ্দগোষ্ঠীর ইতিহাস রচনা করা, (History মানি His-story, রাজকীয় কাহিনী), মন্দকেও গৌরবের রঙ চড়িয়ে কীর্তন (glorify) করা, মিথ্যার স্তম্ভ গড়ে অথবা দেয়াল নির্মাণ করে তার রক্তে রাঙানো বাহাদুরির (!) দুটি কথা এঁকে দেয়া। কিন্তু বাদশাহের সংস্পর্শে এসে এই লেখকও, এই হিসেবকারীও তাদের নিজ নিজ সমাজে মর্যাদাবান হয়েছে; তারা বাদশাহের চাকর হয়েও আপন সমাজে ক্ষমতা ও দাপটের স্থান পেয়েছে। তারা যখন বাড়ি ফিরেছে, তখন তাদের মা, বাকি ছেলেদেরকে একপাশে রেখে, (যারা তাকে মাছ ধরে খাওয়াত, জমি চষে সংসার চালাত এই জগতের জ্ঞানছিল বলেই)মুরগী জবাই করে খাইয়েছে, কেননা, “শিক্ষিতছেলে ঘরে এসেছে। এভাবে সমাজ নূতনত্বের (of novelty) মোহে এক শিক্ষাকে” (যেমন আবাস-জ্ঞান (knowledge of the habitat, চাষবাস ইত্যাদি) অপর শিক্ষারউপর অগ্রাধিকার দিয়ে বসেছে। একটিকে শিক্ষাবলেছে আর হেয়ালীভাবে অপরটিকে শিক্ষাহীনতাবলে মেনে নিয়েছে!
আজ দুঃখজনকভাবে সত্য যে আবহমানকালের বেঁচে থাকার জ্ঞানকে ধ্বংস করে, যা স্বনির্ভরশীলতায় প্রতিষ্ঠিত ছিল, সবকিছু প্রায় ইন্ডাস্ট্রিয়েলাইজ হয়ে গিয়েছে। ব্যক্তি ও পরিবার 'শিক্ষিত' হয়ে তাদের বংশ পরম্পরায় অর্জিত জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হয়েছে, সেই সংস্কৃতি থেকে অপরিচিত (alienate) হয়েছে, এবং সবকিছু আরেক শ্রেণীর হাতে দিয়ে তারা ওদের চাকর-বাকর হয়েছে।
আক্ষরিক শিক্ষার ধারাকে প্রাধান্য দিয়ে (by orienting it on a privileged position), অনেক প্রাচীন স্বনির্ভরশীল জীবন ধারা ধ্বংস করে, আজ স্বেচ্ছায় পরনির্ভরশীল জীবনকে বরণ করা হয়ে গিয়েছে। তা একদিনে নয় বরং ধনতান্ত্রিকতার কব্জায় ধীরে ধীরে, ড্রাকুলারের কুকুর দাঁত (canine teeth)  শতাব্দীর ধারাবাহিকতায় গজিয়ে এসেছে। আজকের অনেক বুদ্ধিজীবী ধনতন্ত্র ও বস্তুবাদের দালাল, অনেক আবার ঘিলুহীনওদেখতে দেখতে এই বিশ্বটি, হেয়ালীভাবে, আবার ফিরাউনের শিক্ষায়, ফিরাউনের গোলামীতে আত্মাহুতি দিল!
কীভাবে কী হল?
চিন্তা করুন, বাদশাহর চাকর হয়েও যে লোকটি দাপটের স্থান পেয়েছিল, তার মূলে কী ছিল? সেটা ছিল এই আক্ষরিক শিক্ষা। বাদশাহ এই শিক্ষিত গোলামদের মাধ্যমে তার সাম্রাজ্য টিকিয়েছে। সেনানী শিক্ষার কথাও মনে রাখতে হবে। অতঃপর, কালান্তরে, বাদশাহের যাবতীয় প্রশিক্ষণ ব্যবস্থায় গোলামগণ দাখিল হয়ে সেই ব্যবস্থারই সম্প্রসার করেছে। বাদশাহের অর্থায়নে এই শিক্ষার দরজা দিয়ে পতঙ্গপাল প্রবেশ করে গোলামীর শিক্ষাকে প্রথাগত রূপ দিয়েছে। কালন্তরে আজ তা মহীরূপে বিরাজিত। (কিছু কথা এখানে সাধারণী (generalised) মাত্রায় বলছি, কেননা নানান ব্যতিক্রমের পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা এখানে সম্ভব নয় এটি সেই মেজাজের লেখা নয়)। আবার চিন্তা করুন, আজ এক ব্যক্তির ২০ বছরের পড়াশুনার পর, তার শেষ অবস্থানটি কী হয় (what end product does s/he become) -স্বনির্ভরশীল, না পরনির্ভরশীল? বাস্তবতা হচ্ছে এই যে এই শিক্ষা একজনকে আমলা বানায়, অথবা প্রাইভেট সেক্টরে চাকর বানায়, অথবা একজন সুদ-বন্দী ব্যবসায় দাখিল হয়, এবং ভাগ্য ভাল হলে এক সময় প্রভু শ্রেণীতে একাত্ম হয়ে প্রভু শ্রেণীর সাজানো খেলায় অংশ নেয়। আজকের মানবতা এই স্থানে উপনীত হয়েছে।
-তিন-
এক সময় যখন সংঘবদ্ধ (organised) সমাজ ব্যবস্থা ছিল না, তখন প্রকৃতিতে মানুষ স্বাধীন ছিল। তখন সে স্বনির্ভর ধারায় তার জীবনের অভিজ্ঞতা রপ্ত করছিল। কিন্তু কিছু দুষ্ট মানুষ যখন সংঘবদ্ধ হয়ে জোরপূর্বক অপরের অর্জন ছিনিয়ে নেওয়া শুরু করেছিল, তখন তারা গোত্রপতি, সমাজপতি, এবং পরে, বাদশাহের অধীনে নিজেরাই সংঘবদ্ধ (organised) হতে হয়েছে, নিজেদের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তাকে অন্যভাবে বাঁচিয়ে রাখতে। কিন্তু বাদশাহের কাঠামোগত আমলাতন্ত্রে (structural bureaucracy) যারাই ঢুকেছে তারাই পরবর্তীতে মানুষকে পরাধীন করেছে, মানুষের প্রভু হয়ে বসেছে এবং কালের আবর্তনে এটাকেই শিক্ষাররূপ-ধারায় সাজিয়ে নিয়েছে। এই প্রকৃতির বিবর্তন ধারা বেয়ে বেয়ে আজ আমরা এই আধুনিক শিক্ষায় উপনীত হয়েছি।
বন্ধুগণ, আজও আমরা এক প্রেক্ষিতে পরাধীন! অন্য প্রেক্ষিতে আমরা ৮/১০ হাজার বছরের পূর্বের অবস্থান থেকে আরও মন্দ অবস্থানে। আজ বিজ্ঞান, বিজ্ঞান বলে চিৎকার করে লাভ নেই। বিশ্বায়নের মাধ্যমে প্রতিটি দেশ ও সমাজ কাদের হা-করা মুখের দিকে ছুটে চলেছে এবং এত্থেকে তাদের মুক্তির পথ কোথায় সেই চিন্তাই করুন।
আজকের শিক্ষাঙ্গনে অনেক কিছু শিক্ষণীয় হয়ে আছে যার প্রভাব ও সংশ্লেষ (implication) অনেককে চিন্তিত করে কিন্তু তাদের করার কিছু নেই। বিপক্ষে দাঁড়াতে গেলে চাকুরীর উপায় থাকে না, কেননা যে শিক্ষার মাধ্যমে তাদের রুটি-রুজি, তার বাইরে তারা অসহায় -দাঁড়াবার স্থান নেই। সুতরাং এই জিঞ্জির থেকে মুক্তি আসবে কীভাবে? মুক্তির পথ যেন রুদ্ধ। এই গোলামীর জিঞ্জির মনস্তত্ত্বের অতল তলে ঢুকে গিয়েছে। এখান থেকে মুক্তির আশা যেন নিরর্থক, বৃথা! তবে থামুন! নিরাশ হলে চলবে না।
স্টোয়িক (stoic) দর্শনে শান্তির পথ হচ্ছে আপনি যেখানে যেভাবে আছেন, সেই অবস্থান গ্রহণ করে নেবেন, এটাকে মেনে নিয়েই শান্ত হয়ে যাবেন অবস্থা জুলুমের হোক অথবা গোলামীর। যদিও একটি পরতে এখানে ইসলামের সামান্য ছোঁয়া রয়েছে কিন্তু মূলত তা ইসলামী নয়। মানুষ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারো গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ হয়ে থাকতে পারে না, জুলুম সহ্য করা যেতে পারে না। এখানে নিরাশার স্থান নেই। একটি স্ফুলিঙ্গও বিপুল অগ্নিকুণ্ডের সম্ভাবনাময়ী। এখানে বিশ্বাসী অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হয়েও বিজয়ের আশায় থাকে উদ্দীপ্ত। “‘হে মানুষ, বল, ‘লা ইলাহা ইল্লালল্লাহ, তুফলিহু বল, আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, তোমরা সফলকাম হয়ে যাবে’” (হাদিস)। মুসা (আ.) ফিরাউনের জিঞ্জির ছিন্ন করেছিলেন। নবী মুহাম্মাদ (সা) বস্তুতান্ত্রিকতা, ইয়াহুদী সুদীর জিঞ্জির, তাদের অস্ত্র-বাণিজ্যের জিঞ্জির [১], যুগান্তরের আরব গোত্রীয় রক্তারক্তির অটুট ও অপ্রতিরুদ্ধ হানাহানির জিঞ্জির -যার সংযুক্তিতে ছিল গোত্রীয় কবিদের আবেগ উস্কানো ইন্দন, ব্যঙ্গ কবিতার হীন-জিঘাংসার উত্তেজনা, এসব থেকে মানবতাকে মুক্ত করেছিলেন। কে বলে অসম্ভব? কাল সে এক বিপুল সম্ভাবনার চলন্ত ধারা। পরিবর্তন এখানে হয়ই হয়। এখানে কিছুই স্থির নয়। ঐ সুদূরের সীমারেখায় যে সুউঁচু পাহাড়, সেও ক্ষয়িষ্ণু। আর পরমাণুতেও রয়েছে চঞ্চল গতি। এই অম্বর, সে সীমাহীন তেমনই চিন্তার দিগন্ত।
-চার-
 মুক্তির সূচনা কোথা থেকে হবে?
মুক্তির সূচনা সেখান থেকেই হতে হবে যেখান থেকে বস্তুমোহে, লোভে ও ক্ষমতাগ্রহে মানুষ তার মানবতা হারিয়েছে। বিত্তের সীমা বৃদ্ধির জন্য যে মোহ তাকে আচ্ছন্ন করেছিল, সেটিই ছিল তার কালো-নাগ। তার সামনে যারাই বাধা হয়েছিল সে তাদের কবর রচনা করে তবেই তার যাত্রাপথ সুগম করেছিল। জোর-জুলুম নির্যাতন সবই ছিল তার কাছে নৈতিক ও যৌক্তিক। সে দেখেছিল আইন ও পুলিশ তাকে আটকাতে পারে নি। তার সৃষ্টিশৈলী গুণ পুলিশসহ সকলের কৌশল কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল, স্থানভেদে তার শিক্ষা তাকে আরও ধূর্ত করেছিল। সে কৌশলে অন্যের সাথে সংঘবদ্ধও (corporative) হয়ে তার অন্তঃস্থিত কালো-নাগিনীর খোরাক বৃদ্ধি করেছিল। যে ধারণাস্থলে তার অস্তিত্বের প্রকৃতি, আজ সেখান থেকেই মুক্তি খোঁজতে হবে। তার এই খুদিকে (নফসকে) আটকানোর পথ একটিই, যদি পুলিশকে তার মনের ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়া যায়, যদি মোহগ্রস্ততার প্রতিকূলে অন্তর্দৃষ্টি স্থাপন করা যায়। ব্যক্তি ও সামাজিক মুক্তির মূল হচ্ছে বিশ্বাস আল্লাহতে বিশ্বাস, পরকালে বিশ্বাস। তার কলবে এই ধারণা উপনীত হতে হবে যে সে মরণশীল। অঢেল বিত্ত গড়লেও তাকে মরতে হবে। এই সত্য তার হৃদয়ের গহীন রন্ধ্র স্পর্শ করে আসতে হবে। তবেই মুক্তি, না হলে নেই।
মানুষ বাদশাহর অধীনে সংগঠিত সামাজিক ব্যবস্থা গড়েও নিরাপত্তা লাভ করে নি। বাদশাহর  অন্তর্নিহিত রোগতাকে ক্ষমতা লোভী ও ক্ষমতা হারানোর ভীতিতে সচঞ্চল করেছিল। ফলশ্রুতিতে, ও কালের ধারায়, সে ও তার আমলারা মিলে তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করেছে, মানুষকে তাদের প্রতিভূ বানিয়েছে -ভাল যুক্তি দেখিয়ে, শব্দের খই ফুটিয়েছে, কিতাব রচনা করে, শিক্ষা-প্রশিক্ষার মাধ্যমে। কিন্তু আজকের এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে দেশ ও সমাজ যাদের পদপ্রান্তে নিষ্পেষিত হচ্ছে তাদের মিথ্যাচার আর অপশাসনের স্বরূপ এমনই নগ্ন ও রাক্ষসী হয়েছে যে তা দেখলে অনেক ক্লাসিক্যাল বাদশাহও হয়ত বিস্মিত হয়ে যেত।
আমি এখানে মূলত ধর্মের কোনো বিস্তৃত রূপ  আলোচনা করছি না। শুধু বিশ্বাসের একটি মৌলিক স্থানে ব্যক্তির নিজ ও সামাজিক অস্তিত্বের বিষয়টি দেখাচ্ছি। এই মরণশীলতার চিন্তা, এর দর্শন ও বিত্তের ঊর্ধ্বের জীবন ও চিন্তার দিগন্তের কথা বলছি। এখানেই হচ্ছে শিক্ষারঅপর দিক। এই শিক্ষা হারিয়ে মানুষ আজ বস্তুর মোহনীয় জিঞ্জিরে আবদ্ধ। কিন্তু মুক্তির সংগ্রামও নিস্তব্ধ হয়ে যায় নি। কালের ধারা বেয়ে সেই অনন্ত সংগ্রাম এখনো চলমান. মুক্তি আত্ম-সংযমেই নিহিত, এই শিক্ষায়, এই সাধনায়।
অতঃপর, যে ব্যক্তি তার প্রভুর সামনে দণ্ডায়মান হতে ভয় করে [২] এবং (তার) অন্তরকে কামনা-বাসনা হতে নিবৃত্ত রাখে, নিশ্চয়ই (তার) বাসস্থান হবে জান্নাত (৭৯:৪০-৪১)।  
__________________________________________
নোট:
[১] এখানে স্থান-কালের সকল ইয়াহুদী ধর্তব্য নয়।
[২] যে ব্যক্তি তার প্রভুর সামনে দণ্ডায়মান হতে ভয় করে’ –অর্থাৎ যার অন্তরে এই ঈমান রয়েছে যে সে একদিন আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে যেখানে তার ভাল-মন্দ কাজের হিসাব দিতে হবে, সে মন্দ কাজের তাড়না থেকে নিজেকে সংযত করবে, এই ধরণের মর্মই এখানে। 














নব্য-ক্রুসেডের অন্তরালে নাস্তিক মিলিটেন্সি



-এক-
নব্য ক্রুসেড ও কিছু প্রশ্ন
মুসলমানরা যে আল্লাহতে বিশ্বাস করেন সেই আল্লাহ বস্তুর অংশ নন এবং বস্তুর গুণে গুণান্বিত নন। আপনি এই আল্লাহর অস্তিত্বে অস্বীকার করেন। যদিও আপনার কোন দলিল প্রমাণ নেই, কিন্তু মুসলিমদের বিপক্ষে আক্রমণমুখর। হয়ত আপনি নাস্তিকতার ছদ্মাবরণে ইসলাম বিদ্বেষী হিন্দু। ঐতিহাসিক হিংসা-বিদ্বেষ ও রেষারেষি বুকে নিয়ে এই যুদ্ধে নেমেছেন। আবার হয়ত নাস্তিকও হতে পারেন। ইউরোপের হাজার বছরের ক্রুসেড যুদ্ধে শরিক হয়েছেন। উদ্দেশ্যের মিল আছে বলে। অথবা আপনি হুজুগী নাস্তিক -বিষয়ের গভীরতায় না গিয়েই অপরের বৈশ্বিক যুদ্ধে নেমে পড়েছেন। আপনি যে বনের পাখি আর আপনার কণ্ঠের যে গান তা বেমানান হয়ে আছে।  আপনি হয়ত হেয়ালীভাবে নেমেছেন। না বরং ভাইরাসেআক্রান্ত হয়েছেন, কিন্তু হয়তবা তা চিন্তা করে দেখেন নি। এই ভাইরাসটা কি? জানা না থাকলে, একটু গুগ্লিং করে ভাইরাসের সংজ্ঞা ও তথ্য পাঠ করে নিন। তারপর ভাবুন, বায়োলজিক্যাল প্রেক্ষিতে এটা কি বিশ্বাসের সাথে সমন্বয়শীল কোন বস্তু বা ধারণাআপনার নিজ বিশ্বাসের সাথে তুলনা করুন।বিশ্বাসকথাটি একটু বর্ধিত ধারণায় গৃহীত হোক। তারপর বিবেচনা করুন এই ভাইরাসের উপমা কি সঠিক উপমা? এটা কি বৈজ্ঞানিকঅভিব্যক্তি (expression)? না এখানে ভাষার ধাপ্পাবাজি হচ্ছে? প্রচলিত অর্থের ভাইরাসের ধারণাকে পণ্য বিক্রির বিজ্ঞাপনী কায়দায় অন্য বস্তুর সমন্বয়-প্রলেপে ধাপ্পাবাজি সাজানো হয়েছে তাই না? আপনি কি এই ভাইরাসে আক্রান্ত? যদি না হন, তবে কেন এই যুদ্ধে? এই যুদ্ধ কার? একটু প্রেক্ষিত নিয়ে চিন্তা করুন। ভাবুন, এই ভাইরাস কি বাস্তব কোন জিনিস, না এটা বিভ্রান্তি ছড়ানোর একটি কৌশল, পরিকল্পনা?
এবারে আসুন এই ভাইরাসের অঙ্গন ও উপমায়।  এখানে একটি বস্তুর আলোকে অন্য একটি বস্তু বিবেচিত হচ্ছে, এবং এতে ভাষার এক বিশেষ  ‘ব্যবহারিকরূপ প্রকাশ পাচ্ছে। এই ধারায় ধর্মকে সংযুক্ত করে আলোচনায় নামলে (অথবা ধর্মীয় অঙ্গন এক পাশে রাখে অন্য অঙ্গনে গেলেও) ভাষার প্রকৃতি আসবে, এবং দর্শন আসতে পারে। ব্যবহারিক মারপ্যাঁচের বিষয় আসবে বা আসতে পারে। ভাষিক ব্যবহার কীভাবে সত্য মিথ্যাকে (engage করতে বা) জড়াতে পারে, অথবা মিশ্রণের ঘোলাটতৈরি করতে পারে এমন বিষয়ও আসতে পারে। এখানে অনেক বিষয়ের সংযুক্তি রয়েছে। তাই প্রথমেই বলা যাক আপনি কি ভাষা দর্শন অধ্যয়ন করেছেন? যুক্তি ভাষায় কীভাবে কাজ করে সে বিষয় অধ্যয়ন করেছেন? উপমা কীভাবে যুক্তির মোড়কে স্থানচ্যুত করতে পারে, সেসব বিষয় ভালভাবে অবগত? তারপর, যে যুদ্ধে নেমেছেন সে যুদ্ধ কি ঐতিহাসিকতাশুন্য -এটা ভেবেছেন? ইতিহাস দর্শন সম্পর্কে জ্ঞাত? ‘বাস্তবতাইতিহাসেরমধ্যকার সম্পর্ক বিষয়ে জ্ঞাত? অতঃপর, ধর্মে ভাষা কীভাবে ব্যবহৃত হয় এবং এখানে রূপকতা কীভাবে কাজ করে সে বিষয় নিয়ে অধ্যয়ন করেছেন? সূর্য আল্লাহকে কীভাবে সেজদা করে? কীভাবে আরশের নিচে যায়? আরশ কোথায়? এই আসমান আর জমিন কীভাবে আল্লাহকে সেজদা করে? কীভাবে ভূ ও নভোমণ্ডলে যা কিছু আছে -সবকিছু:  সূর্য, চন্দ্র, তারকারাজি, পর্বতরাজি, বৃক্ষলতা, জীবজন্তু তাকে সেজদা করে (২২:১৮)? সেজদার অর্থ ও তাৎপর্য কি? ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়াশুনা করেছেন? ধর্ম ছাড়াও ভাষা কীভাবে বিভিন্ন অঙ্গনে কাজ করে, রূপায়িত হয় তা জানেন? না, কোন বিদ্যালয় থেকে এক টুকরা কাগজহাতে পেয়ে সর্ববিদ্যায়মহাপণ্ডিতহয়ে গিয়েছেন? না, ঘটনা এমন যে কেউ বিজ্ঞানের নামে মাথা ধোলাই করে দিয়েছে, তাই দিশেহারা? আপনি কার যুদ্ধ করছেন?
সমাজের সাধারণ মানুষের সাথে আপনার কীসের যুদ্ধ? যাদের সাথে আপনার যুদ্ধ হতে পারে, বিতর্কের কিছু থাকতে পারে, তাদের সাথে বিতর্ক করতে পেরেছেন, যুদ্ধ করতে পেরেছেন? আপনি কি লাদেনদের সাথে কখনো কথা বলতে পেরেছেন? আইসিসদের সাথে কথা বলতে পেরেছেন? বুকো-হারামের সাথে কথা বলেছেন? আপনি কি এসব আন্দোলনের রাজনৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক কারণসমূহ অধ্যয়ন করেছেন? আপনি কি ঐতিহাসিক যুদ্ধের এনালিটিক্যাল (বিশ্লেষণাত্মক) পর্যবেক্ষণের পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন?
আপনি কেন সাধারণ মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে নেমেছেন? আপনি কেন ক্রুসেডারদের প্রশ্ন ও বক্তব্য কপি-প্যাস্ট করে সাধারণ মুসলমানদের সাথে বিবাদ সৃষ্টি করছেন? সাধারণ মুসলিমরা কি এসব প্রশ্ন ও বক্তব্যের উত্তর দেবার উপযুক্ত লোক? কেন এই বিভ্রান্তির এজেন্সি আপনার হাতে? কোন স্বার্থেএই যুদ্ধ: বৈশ্বিক সূত্রে, না বাক-স্বাধীনতার হেয়ালীপনায়? আপনি কি কখনো চিন্তা করেছেন যে যেসব বক্তব্য ও প্রশ্ন আপনি ফেরি করে বেড়াচ্ছেন সেগুলো অন্য উৎসে উৎসারিত, এবং অন্য উদ্দেশ্যে সজ্জিত? যুক্তি যুক্তি করে, কুযুক্তির মিথ্যাচারে সাধারণ মানুষের সমাজ বিপন্ন করার বিষয়টি কি চিন্তা করেছেন? এটি কার যুদ্ধ?
-দুই-
যুক্তি দর্শানো ছাড়া কি সত্যানুভূতি নেই?
মানুষের ধর্ম-কর্ম প্রধানত প্রায়োগিক (functional)এটা জীবন পদ্ধতি-সদৃশ বা জীবন পদ্ধতি। যেমন, কোন পরিবেশে মানুষ চাষবাস করে। এখানে একজন দা, কুড়ল, খুন্তি, লাঙল, জোয়াল, মই ইত্যাদির ব্যবহার শিখে। কোন্‌ মাসে কী কাজ করতে হয় তা শিখে। ফসলের রোপণ, পরিচর্যা থেকে ফসল তোলার জ্ঞান লাভ করে, এতেই তার জীবন। কিন্তু এসব বিষয়ের ঐতিহাসিকতা কী, কোন্‌ হাতিয়ার কালের আবর্তনে কীভাবে পরিবর্তিত/পরিবর্ধিত হয়েছে, অথবা জাতীয় জীবনে তার পরিবারের অবস্থান এবং অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায় তারা কোন্‌ স্থানে আছেন অথবা কোন্‌ ধরণের ভূমিকা (role) পালন করেন; অথবা তাদের শ্রেণির জীবন যাপনের দার্শনিক দিক কী অথবা অন্যান্য সমাজ ব্যবস্থার সাথে তাদের তুলনীয় রূপ কী এসব বিষয় সে সুন্দর করে, যৌক্তিক ভাষায় বুঝিয়ে দেবার জ্ঞান হয়ত রাখবে না। বিষয়টি এভাবেই। কেননা এসব বিদ্যায় সে বছরের পর বছর কাটিয়ে সেই ভাষাআত্মস্থ করেনি। কিন্তু আপনার ভাষায়ও আপনার যুক্তিতেতার কথা সাজিয়ে পটর-পটরকরতে পারে নি বলে তার আক্কেল বুদ্ধির কোন কমতি আছে এমনটা কি ভাবা যাবে?
কোন ব্যক্তি যে কাজ করে, দর্শন, যুক্তিতে তার কাজের ব্যাখ্যা কীভাবে হবে তা নিয়ে এক ভিন্ন ধরণের লটর-পটরকরার সংস্কৃতি প্রায় আড়াই শো বছরের মত লক্ষ্য করা যায়। এই সংস্কৃতিতে সব কিছু ভাষিক (rationalising) ব্যাখ্যায় তোলে ধরতে পারাটাই একটা বড় বিষয় হয়ে গিয়েছে। কোন এক মহিলা কেন বিবাহ ছাড়াই ১০ পুরুষের সাথে দৈহিক সম্পর্ক রাখছেন, অথবা একজন পুরুষ বিবাহিত হয়েও পরকীয়া সম্পর্কে জড়িত তা তারা সুন্দরভাবে সাইকো-সস্যিয়েল যুক্তিতে ও ভাষায় নৈপুণ্যের সাথে ব্যক্ত করতে পারাতে তাদের কথা শ্রবণ, বিবেচনা ও সভ্যতায় গ্রহণের শ্রেণী ও সংস্কৃতি সমাজে রূপলাভ করেছে। এখানে ইংরেজি প্রবচন gift of the gab  বা মুখের জোরঅত্যন্ত মূল্যবান বস্তু হয়েছে।
-তিন-
সাধারণ মানুষের ধর্ম নির্মূল করে কার মূল্যবোধ ও বিশ্বাস চাপানো হবে?
আমাদের ধর্মের বিষয়টি হচ্ছে আমল-কেন্দ্রিক (তবে প্রশস্ত অর্থে সকল ধর্মেরই); এখানে যুক্তি, দর্শনে ধর্ম ব্যাখ্যায় পারদর্শী হওয়া জরুরি নয়। একজন আল্লাহতে বিশ্বাস করবে, পরকালে বিশ্বাস করবে, তার ভাল-মন্দ কাজের হিসাব নেয়া হবে এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে সে জীবন সাজাবে। এটাই হচ্ছে ধর্ম জীবনের মূল বস্তু। যৌক্তিকতায় কী দেখাতে পারল, বা কী পারল না, তাতে কিছুই যায় আসে না। প্রায়োগিক মূল্যই বড় মূল্য। এমনটাই বিশ্ব-মানবে স্থান কালের পরিক্রমায় পাওয়া যাবে এটাই নানান ধর্ম ও সংস্কৃতিতে গড়ে-ওঠা এই মানবের এক বড় ঐতিহ্য। এতে কোন ভাইরাস নেই। এটা নিয়ে যুদ্ধেরও কিছু নেই, যদি না তাতে অর্থ-স্বার্থ ও আদর্শিক দ্বন্দ্ব থাকে। এখানে ভাইরাসের সংযুক্তি হবেবিজ্ঞান মূর্খতা
আমাদের ধর্ম বিশ্বাসের মূল বস্তুর বর্ধিতরূপ আসে এভাবে: সে নামাজ পড়বে, রোজা রাখবে, জাকাত দেবে, হজ্জ করবে, হালাল রুজি করবে, দান-খয়রাত করবে, প্রয়োজনে অপরের সাহায্যে এগিয়ে যাবে, অপরের দোষ-ত্রুটি মার্জনার চোখে দেখবে, ছেলে-মেয়ে বড় হলে বিয়ে-শাদী দেবে, কেউ মারা গেলে দাফন-কাফন করবে। এসব কাজের আরও বিবরণ-বিস্তৃতি আছে। এসবের মধ্যে সে, তার পরিবার, তার সমাজ সবই পারস্পারিকতায় সংযুক্ত। এখানে উল্লেখিত ধর্ম-কর্মে বিশেষ জ্ঞান, বিশেষ জিজ্ঞাসা, বিশেষ নিয়ম-কানুনের সন্নিবেশও রয়েছে। কিন্তু সকলকে সেই জ্ঞান অর্জনের দরকার হয় না। কিছু লোকসেই জ্ঞান অধ্যয়ন করলেই বাকিদের জন্য সেই প্রায়োগিক প্রয়োজন পূরণ হয়ে যায়। এভাবেই কালীন প্রবাহে অনেক উত্তম প্রথা প্রবাহিত হয়।
-চার-
মুসলিম সমাজে মাদ্রাসার ঐতিহ্যগত প্রথা আসলে কি শিখায়?
বাংলাদেশের সাধারণ মাদ্রাসা শিক্ষার কার্যক্রম মূলত এই প্রায়োগিক বা functional বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত। বিশ্বাস কী; আমল আখলাকের বিবরণ কী; বাচ্চাদেরকে কী কী পড়ানো দরকার; পবিত্রতা কী; ইবাদত বন্দেগী কী এবং এতে কীরূপ পবিত্রতার প্রয়োজন, নামাজ কীভাবে পড়তে হয়; অজু কীভাবে করতে হয়; মসজিদে ইমামতি কীভাবে করতে হয়; বিয়ে কীভাবে পড়াতে হয় এবং কীভাবে তা কার্যকর হয়; বিয়ে যদি সমস্যাবহুল হয়, তবে তালাকের নিয়মকানুন কীভাবে কার্যকর হয়, এই ধারায় দৈনন্দিন জীবনে এবং যাবতীয় ক্ষেত্রে সকল হুকুম আহকাম পালনের প্রায়োগিক কাজ সমাধা করার উপযোগী লোক তৈরি করাই হয় এই ব্যবস্থার প্রধান কাজ। এখানে কাউকে তর্কবাগীশ বানানো হয় না। ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন, সমাজ বিজ্ঞান, রাষ্ট্র বিজ্ঞান ইত্যাদি পাঠ করে কোন আলোচনা যেসব শব্দ ও পরিভাষায় করা হয় তারা সেই ভাষা আত্মস্থ করে সেই ভঙ্গিতে বক্তব্য উপস্থাপনের স্কীল শিখে বের হন না। কারণ তাদের ধর্মীয় দৈনন্দিন জীবনের প্রায়োগিক উদ্দেশ্য ভিন্ন। কিন্তু এই ব্যবস্থা মানুষকে সৎলোক করে। সামাজিক ও পরকালমুখি করে। মানব উদ্দেশ্যকে ধারণ করে।
ধর্মহীনতা ও ধর্মহীন শিক্ষা ব্যবস্থা মানুষকে দারুণভাবে অসৎ ও জবাবদিহীতামুক্ত করতে পারে। আজকের বাংলাদেশের বড় বড় চুরি, ডাকাতি, গুম-রাহাজানি, হত্যা-চাঁদাবাজি, জাতীয় সম্পদের হরিলুট: ব্যাঙ্কলুট, ভূমিদস্যিপনা, নারী-ব্যবসা এই ধর্মহীন সেক্যুলার শিক্ষার লোকজনই করে আসছে। ১৯৭১ সালের হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন সেক্যুলার আদর্শে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী করেছে, (আপাতদৃষ্টে অনেকের মনে হতে পারে যে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী 'ইসলামী' শিক্ষা, আদর্শ ও নৈতিকতায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনী ছিল -এই ধারণা ভুল। ওরা ছিল ঔপনিবেশ আমলের সেক্যুলার শিক্ষা ও আদর্শে  প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং পাকিস্তানও 'ইসলামী' দেশ ছিলনা), যেভাবে তা ইরাকে, আফগানিস্তানে, প্যালেস্টাইনে এবং অপরাপর ভূখণ্ডে করা হয়েছে। ইউরোপীয় মিলিটারি ইতিহাসে তা রোমান ও রোমান-পূর্ব এথেনিয়ান যুগ পর্যন্ত পাওয়া যাবে। একাত্তরের বাংলাদেশে তা মাদ্রাসায় শিক্ষিতরা করে নি বরং গ্যাজেট-বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তান সরকার সর্বসাধারণ থেকে যে রাজাকার বাহিনী তৈরি করেছিল (এখানেও আছে সেক্যুলার উপাদান) তাদের সহযোগিতায় ঐ সেনাগণ করেছেএবং তারা (সেনারা) নিজেরাও সরাসরি করেছে কেননা তারা এই দেশের ভূ-পরিচিতিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী ছিল। তারপর স্থানভেদে দেশের মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্ব, পূর্ব-শত্রুতা, কলহ, হিংসা-বিদ্বেষ ও প্রতিশোধ প্রবণতাও কাজ করেছিল। এসবের মধ্যে আবার যুদ্ধকালীন বিচ্ছিন্ন ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও যে ছিল না তা নয়। পরবর্তীতে স্বার্থান্বেষী, আলট্রা-সেক্যুলার এবং নাস্তিকমহল চেতনা-ব্যবসার প্রোপাগান্ডা-কৌশলে হত্যা-ধর্ষণে আলেম সমাজের নাম জড়িয়েছে, এবং রেডিও, টিভি, গান, গল্প, নাটক, ছায়াছবি ইত্যাদিতে তাদেরকে কোণঠাসা করে সাধারণ মানুষের একাংশকে বিভ্রান্ত করেছে। এসবের পিছনে ছিল রাজনৈতিক ও আদর্শিক দ্বন্দ্ব, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব। আদর্শইতিহাস ও ঘটনাপ্রবাহের এক প্রধান ইন্টারপ্রিটার। 
আজ ধনতান্ত্রিক বৈশ্বিক উদ্দেশ্য, ক্রুসেড ও যায়োনবাদী উদ্দেশ্য, ব্রাহ্মণ্যবাদী উদ্দেশ্য পারস্পারিক সংযুক্তি ও অধিক্রমণে এসেছে। আজ ইসলাম রাষ্ট্রশুন্য, কিন্তু চতুর্দিক থেকে ইসলামের উপর আক্রমণ আসছে। এই আক্রমণ নানান ধারায় হচ্ছে। এসবের মধ্যে রয়েছে পেশিশক্তি, মিথ্যাচার, ইতরামি, মিডিয়া প্রোপাগান্ডা, রাষ্ট্রীয় আক্রমণ। বাংলাদেশে হাজার হাজার এনজিও কাজ করছে। অনেক লিস্টেড, অনেক আনলিস্টেড। সবার কাজ মানবতাবাদী হবে এমনটি আশা করা যায় না। আবার যারা বৈশ্বিক উদ্দেশে’ (new world order) সমাজ পরিবর্তনের কাজ করছেন এবং যারা বিদেশ থেকে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়, ইরাকি এক্সপাট্রিয়টদের (expatriates) ন্যায়, সেই একই কাজ সেই সূত্রেই করছেন, তাদের নিজেদের দৃষ্টিতে নিজেদের কাজ মানবতাবাদীহবে -সন্দেহ নেই। কিন্তু অন্য দৃষ্টিতে তা বিদেশি আদর্শ ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে সমাজ পরিবর্তের ষড়যন্ত্র। আজকের এই জটিল যুদ্ধ হচ্ছে নানান ভাঁওতাবাজিতে।
-পাঁচ-
ধনতান্ত্রিক নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থা ও নব্য ক্রুসেড
আজকের বিশ্ব-ব্যবস্থার প্রধান চালিকা শক্তি হচ্ছে ধনতান্ত্রিক আদর্শ। এখানে একটি পণ্য বিক্রি করতে কতভাবে অসমন্বিত বিষয়ের সমন্বয় হয়, অসম্পর্কিত দূরের বিষয়ের সাথে সম্পর্ক জুড়া হয়, কখনো মিথ্যাচারও হয়। আজকের কর্পোরেট শক্তি ক্ষেত্র বিশেষে রাষ্ট্রেরও ঊর্ধ্বে।
যায়োনবাদী কব্জার রাষ্ট্র, শিক্ষা ও আইনি ব্যবস্থা হচ্ছে গোলামীর কারখানা। এর বৈশ্বিক অগ্রযাত্রার প্রধান শত্রু হিসেবে বিবেচিত হয়ে পড়েছে ইসলাম ধর্ম। এখানে সুদ হারাম। এটা এক বড় অন্তরায়। তাই মুসলিম বিশ্বের গ্রামে-গঞ্জেও সূদের বিস্তার ঘটানো হচ্ছে, কেননা এরই মাধ্যমে ব্যক্তিকে গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ করা যায়। ইসলাম আপাত সুখের ইউরোপীয় হেডোনিক (hedonic) প্রলোভন ও চাকচিক্যের জীবন পদ্ধতির বিপক্ষে। এই বস্তু ফেলে দিয়ে ঐ বস্তু কেনা, অযথা খরচ করা, অযথা অব্যবহারিক বস্তুতে ঘর ভরা এসবের বিপক্ষে। জুয়া, জুয়া-ব্যবসার বিপক্ষে, ক্যাসিনোর বিপক্ষে, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের বিপক্ষে; বিবাহিত ও অবিবাহিত নারী-পুরুষের স্বতঃপ্রবৃত্ত অবৈধ যৌন সংগম (sexual relations between consenting adults)  তথা যিনা-ব্যভিচারের বিপক্ষে, মদের বিপক্ষে, মাদকের বিপক্ষে, সার্বিকভাবে ইসরাফের (অপচয়ের) বিপক্ষে। বস্তুর প্রতি অত্যধিক আকৃষ্টির বিপক্ষে যা স্থানভেদে পৌত্তলিকতায় পৌঁছে। ধনতান্ত্রিক আদর্শের অনেক বাণিজ্যের রকমারি হের-ফেরে বেচা-কেনার বিপক্ষে। অতঃপর নানান প্রক্রিয়ার ধানাই আর পানাই, যেখানে যুক্তি নাই সেখানে যুক্তির অবতারণা, যেখানে মানুষের পরাধীনতা সেখানে স্বাধীনতার ধোঁয়া তোলা ইত্যাদির বিপক্ষে।
ইসলাম আধুনিক ম্যাজিকেরমুখোশ উন্মোচক। তাই ধনতান্ত্রিক যায়োনবাদী বিশ্ব-ব্যবস্থা ইসলামের নখ-দাঁত উপড়ে ফেলতে চায়, সমূলে নির্মূল করতে চায়, অথবা খৃষ্টিয়ানিটির মত আছে-আছে, নাই-নাইকরে রাখতে চায়। এইসব কাজের জন্য দেশি দালালের দরকার। নারিকেলের দরকার (brown outside, white inside) চঞ্চল-প্রকৃতিস্থ, বেপরোয়া, উচ্চাভিলাষী, ধনাঢ্যে প্রতিষ্ঠিতার স্বপ্ন বিলাসী লোকের দরকার যাদের মাধ্যমে ইসলামকে নানান নেতিবাচক সমন্বয়ের প্রলেপেরকাজ করানো যায়। এবারে বিশ্বাসের ভাইরাসআর আমেরিকান বিলবোর্ডের ইসলাম বিদ্বেষী মিলিয়ন ডলারের বিজ্ঞাপনী বাস্তবতা চিন্তা করুন। এক চিন্তার সাথে অন্যের মিতালি কীভাবে রূপলাভ করতে পারে  তা নিয়ে চিন্তা করলে অন্তর্দৃষ্টিতে অনেক বিষয় এসে ধরা দিতে পারে।
ধনতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা এবং এর শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যক্তিকে এমন মানসিকতায় গড়ে যাতে সে সহজে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার মর্ম ভেদ করে দাঁড়াতে না পারে। তাকে চতুর্দিক থেকে বেষ্টন করা হয়। ব্যক্তি যখন £২০০,০০০ পাউন্ড সুদে ঘর কিনে তখন তার জীবন সুদীদের হাতে জমা দিয়ে আসে, এটা না করেও তার উপায় নেই, কেননা আর্থ-সামাজিক অবস্থা ধীরে ধীরে এই সীমায় সাজিয়ে আনা হয়েছে। তারপর তার রাতদিন পাত হয় এই ঋণ আদায়ে।  অন্য কোন চিন্তার সময় থাকে না। সুদী জনগোষ্ঠী কখনও বিপ্লবী চিন্তায় যেতে পারে না। এই কথাটি বুঝা অত্যন্ত জরুরি। সে তো এক সপ্তাই কাজ ছাড়া চলতে পারবে না। মাসের কিস্তি আদায় না হলে বিপদ! এরই সাথে তার মন মগজ ঘুলানো থাকে বিলাসী পণ্যের  ছোট বড় অনেক ঋণে। তার ঘরে অনেক আসবাবপত্র, বিলাসী উপকরণ -যেগুলোর এক দশমাংশও হয়ত সে রীতিমত ব্যবহার করে না। কিন্তু এগুলো তার থাকা চাই। এর পক্ষে তার পর্যাপ্তযুক্তি ও ভাষা আছে। কিন্তু এসবের পিছনেই যে তার জীবন নিঃশেষ হচ্ছে সেটা চিন্তা করার সময় নেই, সেই প্রজ্ঞাও নেই। ধনতান্ত্রিক সেক্যুলার শিক্ষা তাকে অন্য মানসিকতায় গড়েছে। সে যে ক্ষেত্র বিশেষে, ক্লাসিক্যাল যুগেরকেনা-গোলামেরচেয়েও অধম, সেই দৃষ্টিও হারিয়েছে। কিন্তু চটর-পটরের যুক্তিতেমাথা ভরে আছে। সে অনর্গল বলতে পারে। তার অশান্তিতেও সুখেরভাণ করতে পারে। এই হচ্ছে ধনতান্ত্রিক সভ্যতাস্বাধীনতাএর প্রধান রূপ।  এর জন্যই যুদ্ধ। এর জন্য কত লাখ মারা গেল, সেটা কোন কথাই নয়। টিভি ক্যামেরা সেদিকে যাবে না। মোল্লার অসভ্যদাড়ি আর সপ্তম শতকের অসভ্যআবরণে বেষ্টিত নারীর দিকেই যাবে।
এই দাসত্ব থেকে মুক্তি কোথায়? এই মুক্তি রয়েছে ইসলামের বিশ্বাস ও চিন্তা চেতনায়। ইসলাম মানুষকে সপ্তম শতকেও বের করে এনেছিল: সুদী সমাজ ব্যবস্থার ইন্দ্রজাল থেকে মুক্ত করেছিল। তাই, বস্তুবাদী জাহেলী প্রথা ও সুদী ব্যবসায়ী ইয়াদীচক্র এটাকে গলাটিপে হত্যা করতে চেয়েছিল। আজকের যায়োনবাদী ব্যবস্থা ও আদর্শ সেই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ইসলাম-নির্মূলে বিপুল অর্থ নিয়োগ করছে; চক্রান্ত করছে; ইসলামের বিপক্ষে বিউটি পার্লারেরকাজ করিয়ে নিচ্ছে। কর্পোরেট ব্যবস্থায় বিজ্ঞাপন অঙ্গনে পণ্যকে যেভাবে অসাধু সংশ্লিষ্টতার সমন্বয়ে আনে এবং তাতে যে মনস্তাত্ত্বিক রূপ দান করে সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই ইসলামকে নানান নেতিবাচক ধারণার সংশ্লিষ্টতায় আনছে। ইতিহাসের দুর্বল বর্ণনা কেয়াফুলি সেলেক্ট করে এনে, তিলকে তাল করে, কোরান হাদিসের বাণী কোথাও বিকৃত করে, কোথাও প্রসঙ্গ কেটে মিথ্যা সংশ্লিষ্টতায় জুড়ে, কখনো বক্তব্যের খণ্ড চিত্র তৈরি করে ইসলামের নামে এক সমন্বয় প্রলেপতৈরি করছে, এবং এর পিছনে এক বিরাট জনগোষ্ঠীর নিয়োগ দিয়েছে। এরা মিডিয়া থেকে কালচার ইন্ডাস্ট্রি পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত।
ইসলামের প্রথম শতাব্দী থেকে যেসব দেশের লোকজন ইসলামের ছায়াতলে এসেছিল, এবং এতে যেসব শাসক গোষ্ঠী নিজেদের ক্ষমতা গুটিয়ে নিতে হয়েছিল তাদের উত্তরসূরিরা তা এখনো ভুলতে পারে নি। সেই যুদ্ধ তারা নানান সময়, নানানভাবে জারি রেখেছে। ধারাবাহিকতায় ক্রুসেডের হাজার বছরের যুদ্ধ হচ্ছে অন্যতম। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এই যুদ্ধে যাদের কমন উদ্দেশ্য রয়েছে তারা হচ্ছে ইসলাম বিদ্বেষী ব্রাহ্মণ্য ও হিন্দু-চক্র এবং ইসলাম বিদ্বেষী মিলিটেন্ট নাস্তিক মহল, (আমার বক্তব্য যে specific আকারে ব্যক্ত করছি, সে আকারেই বুঝতে হবে, এটাকে generalise করা যাবে না)। বিভিন্ন ভাঁওতাবাজিতে তারা ইউরোপীয় ক্রুসেডের সাথে একাত্ম হয়ে এই যুদ্ধ করছে। আজকের মুক্তমনা, বিজ্ঞানমনষ্ক, বিশ্বাসের ভাইরাস ইত্যাদির অন্তরালেই চলছে নব্য ক্রুসেডের যুদ্ধ; বিশেষভাবে, ৯/১১ এর উদ্দেশ্য ঘিরে।
___________
এই ধারায় আমার আরও কয়েকটি লেখা আছে পড়ে দেখতে পারেন।
(১) মুক্তমনা ও নাস্তিক মিলিট্যান্সি
(২) কলমের ভাঁওতাবাজিতে সামাজিক বিপর্যয়
(৩)  অভিজিৎ হত্যা
(৪) আপনি কি সত্যিই শান্তি চান ও নিজেকে বিজ্ঞানমনষ্ক ভাবেন?
(৫) কুসংস্কারেরগর্তে নাস্তিকের শেষকৃত্য -বিনোদন
(৬) সশস্ত্র নাস্তিকের হাতে ৩ জন নিরীহ মুসলিম খুন
(৭) যুক্তি, বিশ্বাস ও কোরান
(৮) Rationality and Religion
(৯) আধুনিক সমাজের শান্তি -না বিশ্বাসে, না অবিশ্বাসে
(১০) আত্মহত্যা ও বিশ্বাস
(১১) আলো-আঁধারের খেলা
(১২) ক্রুসেডের যুদ্ধ
নোট: এই লেখায় 'বিশ্বাসের ভাইরাস' নামক একটি বিষয়ের উল্লেখ এসেছে কিন্তু ব্যাখ্যা আসে নি। তাই বিষয়টি বুঝতে এস. এম. রায়হানের ইসলামকে ভাইরাস প্রমাণ করার জন্য অভিজিৎ রায়ের আর কতগুলো সন্ত্রাসী হামলা দরকার?” –এই লেখাটি পড়ে নিতে পারেন।














পার্থক্যের অস্তিত্বে মানুষ ও বিশ্বাস -১ম পর্ব



পার্থক্যের বৈচিত্র্য
কতনা রঙ ও রূপের বৈচিত্র্যে রূপায়িত আমাদের এই জগত, আর কতনা বৈচিত্র্যময় আমাদের নিজেদের অস্তিত্ব আমাদের ধ্যান ও ধারণা। এই আলো-আঁধারের রাত-দিন, কতনা সৌন্দর্যে যে তা বিরাজেকত যে কোলাহলে মেতে ওঠে আমাদের চারিধার। এই বিমল ধরার জলের কল কল, বৃষ্টির ঝির ঝির, এই সবুজে ঘেরা প্রাণবন্ত সৃষ্টির উচ্ছ্বাস, এই নানান কণ্ঠের নানান গান, নানান সুর, এই যে সুন্দরের ছড়াছড়ি -আমরা খুব কমই এসবের দিকে তাকাই; খুব কমই হৃদয়ের দোয়ার খোলে দিয়ে এই রূপের মহিমা ভিতরের দিকে টানি, খুব কমই বুঝতে চেষ্টা করি যেসব বৈপরীত্যে এই বিমলের রূপ অস্তিত্বে প্রকাশ পায়।
তারপর, কত যে ভিন্নতা আমাদের গঠনে, মন ও মানসিকতায়। আমাদের আগ্রহ, অনাগ্রহ ও বিগ্রহে কমতি নেই। এ সবই আবহমান কালের: সৃষ্টির মূল থেকেই। আর কালের এই চক্রেই আমাদের আসা ও যাওয়া।  এই অস্তিত্বের স্ট্যাজে এসে যে পাখী যে গানে সুর ধরে, সে গান অনেক আগ থেকেই চলে আসা, এবং সে চলে যাবার পরও সেই গান চলতে থাকে। যে রাগ-সঙ্গীতের পরিধিতে (within the restraints of the raga) যে লোক সুর তুলে, সেখানে এদিক সেদিক বিচরণের কিছু স্বাধীনতা থাকলেও, সে সেই রাগের সীমানা ধরেই ব্যঞ্জনায় মত্ত হতে হয়। তবে রাগের ভিন্নতায়, কেহ এই রাগে, কেহ সেই রাগে অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে থাকেন। আমি কিন্তু রাগের কথা বলছি না। রাগ এখানে উপমা।
কোন পাঁচজন লোক কোন বাগানে ঢুকলে নিজেদের ভিন্নতার আঙ্গিকেই বাস্তবতা দেখেন। পরের দিন গল্পে বসলে দেখা যাবে একজন যা দেখেছেন অন্যজন হয়ত তা পুরাপুরি দেখেন নি, বা দেখেনই নি। একটি কবিতা বা উপন্যাস পাঁচজনকে পাঠ করিয়ে দেখুন। এখানে এমন অনেক লোক পাবেন যারা কবিতা পাঠ করে তেমন কিছু দেখেন না, বুঝেন না। তবে কোন শিক্ষক বুঝিয়ে দিলে আপাতদৃষ্ট মামুলি কবিতায়ও অনেক অর্থের বৈচিত্র্য দেখেন ও বিস্মিত হন।
এই জগতে আমরা যা কিছু সুন্দর বা অসুন্দর বলি তা সবই আমাদেরই বর্ণনা (description)রঙধনু জানে না সে রঙধনু, আর গোলাপ জানে না সে গোলাপ। দুই আর দুইয়ে মিলে চার হয়, কিন্তু বাগানের পূর্ব-পশ্চিমে গাছের সংখ্যা যে চারএকথা গাছেরা জানে না (হয়তবা জানে, তাইবা কে জানে?)আমরা আমাদের ধারণাই বস্তু জগতে আরোপ করি, আর বিজ্ঞান বিজ্ঞানকরি। মূলত বস্তুজগতকেকন্ট্রোলকরাই উদ্দেশ্য। অন্য অর্থে, আমাদের স্বার্থে প্রকৃতিকে কন্ট্রোল করতে যে অবিরাম সাধনা করি, তার নির্যাসকে ‘(বি)জ্ঞানবলে উল্লেখ করি।
সুর ও সৌন্দর্য
আমাদের চোখে যা কিছু সুন্দর/অসুন্দর হয়ে ভাসে তা বিপরীত ধর্মী বস্তুর  সমন্বয়েই। নিজেরাও বৈপরীত্যের সমন্বয়ে সুন্দরের রূপ দেই এবং তা করতে গিয়ে দীর্ঘ সাধনা করি।  সঙ্গীতে দেখুন সাতটি স্বরের পার্থক্যে কত ব্যঞ্জনা সৃষ্টি হয়। আর তা করতে গিয়ে কতনা আয়োজন। বাঁশী বানাতে উপযুক্ত উপাদান বাঁশবন থেকে কেটে আনি, তারপর উত্তপ্ত লোহায় পুড়ে, ছিদ্র করে, তবেই তৈরি করি বাঁশি। এই বাঁশী ও সুরের অনেক অধ্যয়ন-অধ্যবসায়ের পরে আসে সুরের ব্যঞ্জনা। বাঁশি হাতে নিয়ে ৫/১০ বার ফুঁৎকার করলেই বিদ্যা অর্জিত হয় না। সুরের সৌন্দর্য আসে না। যেকোনো বিদ্যার আদ্য-পাদ্য বুঝতে ও আত্মস্থ করতে অনেক, অনেক সময় লাগে। এটাই নিয়ম। তবে নাস্তিকদের কোরান পাঠে সময় লাগে না। মোল্লারা না বুঝে ২৫/৩০ বছর পড়ে। বৌদ্ধ-তপস্যায় শ্বাস-নিশ্বাসে শিষ্য বছরের পর বছর কাটায়। এসবের কীসের প্রয়োজন? নাস্তিকের বুদ্ধিতে এত 'মামুলি' বিষয় কোলায় না, কেননা সে বৈজ্ঞানিক”! বুঝে হোক অথবা না বুঝে।
এই মহাবিশ্ব
এই মহাবিশ্ব এক awesome বাস্তবতা, (awesome এর সঠিক বাংলা করতে পারছি না। এখানে বিশালতার বৈপরীত্য, অদ্ভুত-বিস্ময়, আতঙ্কদ্দীপক-সম্ভ্রম ইত্যাদির সমন্বয় র‍্যেছে এতে)। এখানে কীযে এক ভাব: বিমল-ভয়ঙ্কর, অপরূপ-বিধ্বংসী! এই বিস্ময় হেয়ালী  যুক্তির বিষয় নয়। এখানে শুধু করুণা নয়, অকরুণের দিকেও তাকান। মানুষের দৃষ্টি আপেক্ষিক (relative)কতনা কোটি প্রাণী এই অস্তিত্বের স্ট্যাজ থেকে বিলীন হয়েছে; কতনা গ্রহ-নক্ষত্র, আর কতনা তারকারাজি। লক্ষ-কোটি বছরে সেগুলো সৌন্দর্যে সুশোভিত হয়েছে, তারপর এক আঘাতে জাহান্নামের অগ্নিসম বিস্ফুরিত হয়েছে, চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়েছে। এই বিধ্বংসী ভাঙা ও গড়ার ধারা অতি বৃহৎ থেকে অতি ক্ষুদ্র পরিসরে প্রতিনিয়ত ঘটছে।
জাহান্নাম শুনেই থুবড়ে যাবেন না। আপনার আমার যুক্তি-বুদ্ধি আর বোধ-আবেগ দিয়ে এই সীমাহীন সৃষ্টি রচিত নয়। তবে হয়তবা কোন রহস্যজনিত কারণে জাহান্নাম শুনেই কেউ খোদা বিমুখ হয়ে আছেন। হয়তবা এখানেই বৈপরীত্যের কোন এক প্রেক্ষিত নীরবে কাজ করে যাচ্ছে। অনেক সময় এভাবে হয় যে আপনি যাকে ঘৃণা করেন, দেখবেন, বেশি না হলেও, সেই ঘৃণার গুণগুলোর কিছু না কিছু আপনাতেই যেন নিহিত। আপনার অন্তরাত্মা আপনাতেই তা বুঝে নিয়ে আতঙ্কিত হচ্ছে মাত্র। কেউ হয়তবা এখনি জাহান্নামে শুরুর পর্যায়ে। আগুণ হৃদয়েও থাকতে পারে। যার প্রকৃতির সংযুক্তি যেখানে, সে হয়ত তার নিজ যুক্তিধারাতেই সে পথে হাঁটছে। তার ইচ্ছাও হয়ত পরিষ্কার। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘The road to Hell is paved with good intentions.’
আমরা কি সর্বত্র যৌক্তিক?
ধরুন সংগীত চলছে। আয়োজনও সুন্দর। কিন্তু স্ট্যাজের পিছনে যে গোস্ত উনুনে উৎরচ্ছে, সেই মৃত সত্তা কে? কার দেহ টুকরো টুকরো হয়ে এখন উত্তপ্ত হাড়িতে তুল্পাড় খাচ্ছে? সে কী তার কোন অবিশ্বাসের কারণে এই স্থানে উপনীত হয়েছে? সে তো এখন এই সঙ্গীতের, এই আয়োজনের অংশ। আহা! সে এখানে কেন? এই ব্যঞ্জনার সাথে তার সম্পর্ক কি? যুক্তিটা কোথায়?
মুরগী ভুনা খেয়ে সৌন্দর্যের চিন্তা আসতে পারে, সঙ্গীত উপলব্ধি হতে পারে, কবিতায় মন মুগ্ধ হতে পারে। কিন্তু নিষ্ঠুরতায় যে পেট ভরে আছে, সেটা কী দেখার অংশ হতে পারে না? মানুষের দেখা ও যুক্তি চালনার সীমানাটা কী? প্রকৃতি কি? এটা কি সীমিত ও আপেক্ষিক নয়? যার পেট আছে এবং কথা বলতে পারে, তার যুক্তিও আছে। তাই না? যুক্তি ভাষায় তৈরি করা এক হাতিয়ার। তাই দেহ-ভক্ষণেরও যুক্তিও থাকতে হবে। সেই দেহধারী মুরগী হোক অথবা গাভী। যুক্তি নিজ কেন্দ্রিক, অস্তিত্বের স্বার্থ ঘিরে। তাই, নাস্তিকের যুক্তির গান শুনে দৌড় দেবেন না, তার যুক্তির ভিত্তিও একই: পেট, উপভোগ, অবাধ-যৌনতার বিস্তারবেঁচে থাকা, এখানেই স্বর্গ এসবের আঙ্গিকে ফুসফাস, এখানেই বিতণ্ডা: আল্লাহ নাই, রাসূল নাই, সব বুঝে ফেলেছি; জ্ঞান আর বিজ্ঞানে দিয়ে আত্মস্থ করেছি এই বিশ্ব! তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন শুক্রকীট থেকে, অথচ দেখো! সে একজন প্রকাশ্য বিতন্ডাকারী” (১৬:৪)।
বিপরীতে গঠিত সৌন্দর্য
ক্যানভাসের চিত্রের বিপরীতে যে ভিন্ন রঙগুলো রয়েছে, যেগুলোর আলোকেই চিত্র সুশোভিত; এটা সুপরিকল্পিত। এই সৃষ্টিলোকও স্রষ্টার পরিকল্পিত। তিনি ইচ্ছা অনুযায়ী সাজান। আগুন-পানি তৈরি করেন, ইতি-নেতি, আলো-আঁধার, রাত-দিন এমন বিপরীতে সৃষ্টি করেন। এভাবেই ইহকাল ও পরকাল: জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি, বিপরীতের মোকাবেলায় অস্তিত্বশীল। কেবল তিনিই বেজুড়, তিনি এক, তিনি অদ্বিতীয়এখানেই তিনি সৃষ্টি জগত থেকে আলাদা। অনন্তে অনন্তে তিনি একা। তার মত কেউ নেই। তার কোন সাদৃশ্য নেই। তার কোন তুলনা নেই। তিনি বস্তুর অংশ নন, বস্তুর গুণে গুণান্বিত নন। তাই বস্তুর অনুসন্ধানে তাকে দেখা যাবে না, বুঝা যাবে না। তিনি আর এই সৃষ্টিলোক বিপুল পার্থক্যে বা ধারণাগত দূরত্বে। এই কথা আমরা নিজেদেরকে বার বার তার নাম উচ্চারণের সাথে সাথে স্মরণ করিয়ে দেই। বলি, ‘আল্লাহ সুবহানাহু ও তাআলাঅর্থাৎ আল্লাহ যাকে আমার সীমিত ধারণা যেভাবে ধারণ করে তিনি তার চাইতে পবিত্র, তিনি তার চেয়ে ঊর্ধ্বে, সুমহান। এই ধারণা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রার্থনায় কাজ করে। আমরা আল্লাহু আকবার, সুবহানা রাব্বি আল আলা, সুবহানা রাব্বি আল আযীম ইত্যাদি তাসবীহ যখন উচ্চারণ করি তখন সেই পবিত্রতার স্তুতি গেয়ে যাই, সেই পার্থক্যে এবং নিজেদের সীমাবদ্ধতার আঙ্গিকে। এভাবেই তাকে স্মরণ করি। এখানে বস্তু-কেন্দ্রিক শিরক থেকে তাওহীদের ধর্ম ও ধারণা সম্পূর্ণ আলাদা।
বৈপরীত্যের অস্তিত্ব ও যুক্তি
বিপরীত ধর্মী বস্তুর সমন্বয়ে এই অস্তিত্ব: আছে ভাঙ্গা-গড়া, ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, করুণ-অকরুণ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস। আপনি এই বৈপরীত্যের (binary র্থে) কোন পার্শে? মনে রাখতে হবে, আগেও বলেছিএখানে সব যুক্তির বাহানা জীবনের প্রয়োজন ঘিরে ও জীবিকা নির্বাহের তাগিদে সৃষ্ট। নিজ সত্তা-কেন্দ্রিক-আপেক্ষিক (relative to the subject’s own interest) ভাল-মন্দ, করুণ-অকরুণ, ন্যায়-অন্যায় সবই মানবঅস্তিত্বের রঙে রঞ্জিত, যুক্তিতে ধারিত। গরু যদি কথা বলতে পারত তবে বলত, ‘তোমার সঙ্গীতে আমার দেহ দান কেন হবে? একী নিষ্ঠুরতা! আপনার মত নৈতিক সত্তার কথা কী কল্পণা করা যায়?’
কিন্তু এই জগত না ভক্ষকের যুক্তিতে রচিত, আর না ভক্ষিতের। এটা কেবল আল্লাহর ইচ্ছায়ই রচিত। তিনি যা ইচ্ছা তাই করেন।তিনি কাউকে আগুনের ইন্দন করেন, কাউকে শান্তির নিলয়ে বসিয়ে দেন। আর এতে তার না আছে কোন প্রাপ্তি, আর না কোন ক্ষয়-ক্ষতি। তাকে কখনও আমাদের মত দেখতে নেই। তিনিই একমাত্রই তিনি। নিষ্ঠুর বলুন অথবা করুণাময় তাতে তার কিছুই যায় আসে না। তবে বিশ্বাসীরা ভিন্ন। আমরা প্রার্থণায় তার উদ্দেশে বলি, ‘ওয়া নুসনি আলাইকাল খাইর আমরা ভাল ও উত্তমের সমন্বয়ে আপনার স্তুতী জ্ঞাপন করি।আমরা কখনো বলি না, হে মন্দের স্রষ্টা, কেননা মন্দ আমাদের আপেক্ষিকতায় মন্দ, (it is only relative to us, human)।  
জাহান্নাম শুনে কারো মনে বিব্রতি জাগতে পারে। জাগুক। যদি আল্লাহকে অস্বীকার করে মনের অবস্থা লাঘব হয়, তবে করুক।  তবে চিন্তা করুন, তিনি কিন্তু এখনো আপনার মন জুড়ে আছেন, আপনার চিন্তা তার থেকে মুক্ত নয়। বিষয়টা শুধু রিভার্স। আপনি এই আলোচনাতেই আছেন, তবে বিপরীত পক্ষে। আপনি ম্যাজিসিয়ানের পর্দার অন্তরালে, তার কব্জায়। যখন প্রয়োজন হবে, তখন পর্দা উন্মোচিত হবে। এই মানবিক অস্তিত্বে যারাই এসে গিয়েছেন, তাদের মুক্তি নেই। লোকাবার স্থান নেই। ম্যাজিসিয়ান যে স্ট্যাজ যে কালের জন্য স্থাপন করেছেন, সে কালের সীমায় যাকে যেখানে রাখছেন, সে সেখানেই থাকতে হবে। অতঃপর পুণরুত্থান। এখানে আমরা অথবা তোমরা সঠিক পথের উপর, অথবা নির্ঘাৎ পথভ্রষ্টতায়” (৩৪:২৪)।



ঐশী বাণী: বিশ্বাস অবিশ্বাস ও নাস্তিকতা (২য় পর্ব)


[আগের অংশ পড়লে ধারাবাহিকতা বুঝা যাবে, তবে না পড়লেও অসুবিধে নেই।]

ভাষিক বাণী ও ভিন্নতা
আগের পর্বে পার্থক্য ও ভিন্নতার কথা বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলা হয়েছে। এবারে শুধু এতটুকুই:  পার্থক্য যেমন দৃশ্যজাত বস্তুতে থাকে তেমনি নৈর্বস্তুক বিষয়েও। এই কথাটি মনে রেখে নবী রাসূলের বাণীর দিকে মনোনিবেশ করা যাক। নবীদের বাণী ও তাদের ওহীতে প্রাপ্ত বাণী ভাষার বাহনে চালিত। আর এই ভাষাতেও পার্থক্যের প্রকৃতি রয়েছে। মোখিকভাবে ব্যক্ত অথবা লিখিত কথায় ভিন্ন ভাবার্থের স্থান খোঁজা যেতে পারে। একটি সরল কথাকেও গরল অর্থে নেয়ার অবকাশ তৈরি করা যেতে পারে (হোক তা ন্যায্য অথবা অন্যায্য, সেটা ভিন্ন কথা)।
ওহীর বাণীকে একটি বাগানের মত অথবা একটি দীর্ঘ কবিতার মত ধরা যাক। কোন গাইড বা শিক্ষক ছাড়া যারা ওখানে ঢুকবে তারা নিজেদের অবস্থানও ভিন্নপ্রকৃতিরকারণে নিজেদের দেখাই দেখবে। তারা তাদের নিজেদের ভিন্নতাই বাণীর গায়ে প্রতিফলিত হতে দেখবেন। নবী রাসূলের বাণী যেহেতু প্রচলিত অনেক বিশ্বাস ও আচরণের প্রতিকূলে ছিল, তাই সেখানে প্রতিক্রিয়ার উদ্ভব হয়েছে, দৃষ্টিভঙ্গির কঠোর ভিন্নতা প্রকাশ পেয়েছে। অবিশ্বাসীদের প্রথা ও মূল্যবোধ তাদের অর্থগ্রহণের স্থানকে "আত্ম-কেন্দ্রিক" (self-centric, centripetal) করেছে, এবং নবীদের বাণীকে বহির্ভাবাপন্ন’ (Other, centrifugal/oppositional) করেছে। এতেই এসেছিল "নিজ/পর সাংঘর্ষিকতা" (বিশ্বাস ও আদর্শের প্রেক্ষিতগত সাংঘর্ষিকতা/ the 'self' and the ‘Other’ dichotomy – কেবল এই স্থানটি নিয়ে আলাদা একটি প্রবন্ধ রচনা করা যায়।
কোন টেক্সটের পাঠেই সকলের অবস্থান সমান হবে না এটাই স্বাভাবিক। এই ওহীর বাণী বৃষ্টির পানির ন্যায় ছিল। ওখানে কারো ছিল পৌষ মাস, আর কারো সর্বনাশ। তারপর, যার ঘটি যেমন ছিল, সে সেই পরিমাণের পানিও পেয়েছিল। কোন বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল, কোন বীজ হয় নি, কোথাও পানি জমাট হয়েছে, কোথাও হয় নি। এই পানির উপমা সরাসরি কোরান থেকে নেয়া যাক।
তিনি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন। অতঃপর স্রোতধারা প্রবাহিত হতে থাকে নিজ নিজ পরিমাণ অনুযায়ী। অতঃপর স্রোতধারা স্ফীত ফেনারাশি উপরে নিয়ে আসে। এবং অলঙ্কার অথবা তৈজসপত্রের জন্যে যে বস্তুকে আগুনে উত্তপ্ত করে, তাতেও তেমনি ফেনারাশি থাকে। এমনিভাবে আল্লাহ সত্য ও অসত্যের দৃষ্টান্ত প্রদান করেন। অতএব, ফেনা তো শুকিয়ে খতম হয়ে যায় এবং যা মানুষের উপকারে আসে, তা জমিতে অবশিষ্ট থাকে। আল্লাহ এমনিভাবে দৃষ্টান্তসমূহ বর্ণনা করেন। যারা পালনকর্তার আদেশ পালন করে, তাদের জন্য উত্তম প্রতিদান রয়েছে, এবং যারা আদেশ পালন করে না, যদি তাদের কাছে জগতের সবকিছু থাকে এবং তার সাথে তার সমপরিমাণ আরও থাকে, তবে সবই নিজেদের মুক্তিপণ স্বরূপ দিয়ে দেবে। তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর হিসাব। তাদের আবাস হবে জাহান্নাম। সেটা কতইনা নিকৃষ্ট অবস্থান। যে ব্যক্তি জানে যে, যা কিছু পালনকর্তার পক্ষ থেকে আপনার প্রতি অবর্তীর্ণ হয়েছে তা সত্য সে কি ঐ ব্যক্তির সমান, যে অন্ধ? তারাই বোঝে, যারা বোধশক্তি সম্পন্ন (কোরান, ১৩:১৯)।
বিষয়টি এভাবেই ছিল এই বাণী কারো প্রাণ স্পর্শ করেছে, কারো কর্ণকুহরে প্রবেশই করে নি। কিন্তু যারা প্রাণবন্ত হয়েছিলেন, এর অর্থের গভীরতা অনুভব করেছিলেন, তারপর যখন শিক্ষকের (নবী/রাসূল) সাথে বসেছিলেন তখন তাদের সেই অর্থের সাথে আরও অর্থের দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল ((আল্লাহ নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের জ্যোতি, তাঁর জ্যোতির উদাহরণ যেন একটি কুলঙ্গি, যাতে আছে একটি প্রদীপ, প্রদীপটি একটি কাঁচপাত্রে স্থাপিত, কাঁচপাত্রটি উজ্জ্বল নক্ষত্র সদৃশ্য। তাতে পুতঃপবিত্র যয়তুন বৃক্ষের তৈল প্রজ্বলিত হয়, যা না পূর্বমুখী, আর না পশ্চিমমুখী। অগ্নি স্পর্শ না করলেও তার তৈল যেন আলোকিত হওয়ার নিকটবর্তী। জ্যোতির উপর জ্যোতি। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথ দেখান তাঁর জ্যোতির দিকে (২৪:৩৫))। অতঃপর  এই স্নিগ্ধ আলোয়ে অন্তরাত্মা উদ্ভাসিত হলে বিশ্বাসীদের আর ফিরার কোন পথ ছিল না। যে সত্য তারা দেখেছিলেন, সেই সত্যের জন্য জীবন বাজী রাখতে দ্বিধাগ্রস্ত হন নি।
অপরদিকে এই বাণীকে সমাজপতিরা তাদের মত করে দেখেছেন ও ব্যাখ্যা করেছেন। রাসূলদের (আ) মোকাবেলায় তারাও এই বাণীর পালটা ব্যাখ্যায় শিক্ষকের ভূমিকায় নেমেছেন। তাদের অনুসারীগণ তাদের ব্যাখ্যায় আস্থা স্থাপন করেছেন, এবং এজন্য যুদ্ধ করতেও প্রস্তুত হয়েছেন।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, কিছু মানুষ বিনা-গাইডে বা বিনা-শিক্ষকে সেই বাগান বা বাণীতে ঢুকলে কিছু জিনিস দেখতে পান, এবং শিক্ষক বা গাইডের ব্যাখ্যায় সেই দেখা বা পাঠের বর্ধিতরূপ অনুভব করেন। আসলে, মানবকুলের বৃহত্তর অংশ অপরের দেখানো বা বুঝানো ব্যতীত কোন গভীর ভাবার্থ ভেদ করতে পারেন না। তারা ব্যাখ্যাবিদদের পিছনে থাকেন। তবে ব্যক্তির সুপ্ত প্রকৃতির সঞ্চালনে তার মনের সায় থাকে। এখানেই আস্তিক, নাস্তিক, কাফির, মুনাফিক। কেউ আত্মপথের এদিকে, কেউ সেদিকে গিয়ে শ্রেণীভুক্ত হয়, যার প্রকৃতির টান যেখানে, অন্তরের সায়ও সেখানে ব্যাপারটা অনেকটা এভাবেই।
তোষের অনলে যা জ্বলে
আবারও সেই বাগান ও কবিতার উপমায় আসা যাক। আপনি বাগানে ঢুকে কী কী দেখেছেন বা কোন কবিতা পাঠ করে কোন কোন বিষয় অনুভব করেছেন এবং কোন কোন বিষয় এড়িয়ে গিয়েছেন -এসবের সাথে রয়েছে আপনার শিক্ষা, আপনার মানসিক সত্তার প্রকৃতি ও গঠনের সম্পর্ক। মানসিক প্রকৃতি মাতৃ-গর্ভ থেকে গোটা ব্যক্তি-ইতিহাস পরিব্যাপ্ত। দেখতে হবে আপনার জন্ম, আপনার পরিবার, পরিবারের অবস্থান কোন সমাজের কোন শ্রেণীতে। দেখতে হবে কোন আর্থিক, সাংস্কৃতিক ওজ্ঞানগতসুযোগের প্রেক্ষিতে আপনি বড় হয়েছেন, শিক্ষা লাভ করেছেন, এবং পরবর্তীতে কাদের সাথে উঠা-বাসা করার সুযোগ হয়েছে, এবং কাদের সাথে পিয়ারিং (peering) হয়েছে। শেষের কথাটি অত্যন্ত জরুরি। আপনি জীবনের যে অঙ্গনে থাকার কারণে যেসব বই পড়েছেন, যাদের প্রবন্ধ পাঠ করেছেন, যাদের সাথে কথাবার্তায় সময় কাটিয়েছেন, আপনি তাই হয়েছেন যা এই পরিসরে ছিল। আপনি যে ধর্মীয় এটিটিউড (attitude) অর্জন করেছেন, তা কী এক দিনে, দুদিনে হয়েছে? এগুলো অবশ্যই চিন্তার বিষয়।
মুক্তমনা-স্বাধীন?
কেউ স্বাধীন, মুক্তমনা, মুক্তচিন্তক বললেই স্বাধীন বা মুক্তচিন্তক হয়ে যায় না। সে দাবী করতে পারে বটে কিন্তু দাবীর পরে সে কোন নতুন কথাটি বলতে পেরেছে যা অতীতের মানুষ শুনে নি, কোন দেখাটি দেখেছে যা অতীতের লোক দেখে নি, অথবা কোন আলোচনা করেছে যা আলোচিত হয় নি? সে যদি আবহমান কালের চলমান আলোচনাতেই সংযুক্ত হয়ে থাকে, অন্যের কথা নিজের করে বলে, তবে সে কীসের মুক্তচিন্তক? যে গানে সে কণ্ঠ দিচ্ছে সে গানের অতীত রয়েছে, প্রাতিষ্ঠানিকতা রয়েছে, সংস্কৃতি রয়েছে। যদি তাই হয়, তবে সে কী বলছে? মূলত, এই গানগুলো পুরাতন; এই জগত পুরাতন; আর এই চন্দ্র, এই সূর্য। আপনি নিজের পায়ের নিচ থেকে একটি পাথর তুলে জিজ্ঞেস করুন তার বয়স কত। আপনি চলে যাবার পরও সে থাকবে। তাই আপনার মাথায় যদি হঠাৎ এক টন বুদ্ধি এসে ভর করে, তবে তা কোন ভাল লোকের সাহায্যে নামিয়ে রাখুন। না হলে, পরকালে, আপনার চরম সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে।
আস্তিক নাস্তিক -অন্তরের কাজ
বিশ্বাস অন্তর থেকেই আসে। জন্মসূত্র বাদে, তা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার আসে। আস্তিক নাস্তিকতায় আকস্মিকভাবে তেমন কিছু হয় বলে মনে হয় না। অর্থাৎ কেউ হঠাৎ করে আস্তিকও হয় না, নাস্তিকও হয় না। তবে অস্বাভাবিক ঘটনা ছাড়া। এখানে তাদের চিন্তার ইন্দ্রজাল, রেখা ও রন্ধ্রের ভিতরে তাদের প্রকৃতি, ব্যক্তি-গঠন, মানসিকতা নীরবে নীরবে কাজ করে যেতে থাকে। অন্তরের কাজঅন্তরকে অনেক আগ থেকে অথবা বহুকাল আগ থেকেই করে আসতে পাওয়া যেতে পারে। কোন নির্দিষ্ট তারিখের নিরিখে কোন গৃহীত সিদ্ধান্ত হয় সেই ধারার পূর্ণ পরিণতি মাত্র।
কোরানে করীমে হেদায়াতের ক্ষেত্রে অন্তরেরবিষয়ই প্রধান হিসেবে দেখা হয়। কালব (قلب), ফুয়াদ (فؤاد) ও লাব্ব (لَبٌّ) –এই তিন স্থানের কার্য বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রেক্ষিতে কাজ করে থাকে [এ কথাটি নিচের টীকায় খানিক বর্ধিত করা হয়েছে।]। এগুলোই বক্ষস্থিত হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন বৃত্তির (function) স্থান। কোরানে হেদায়াত সম্পর্কিত বিষয় কর্ণ, চক্ষু ও অন্তর এই ধারায় উল্লেখ হয়। আল্লাহ বলেন, “وَاللَّـهُ أَخْرَ‌جَكُم مِّن بُطُونِ أُمَّهَاتِكُمْ لَا تَعْلَمُونَ شَيْئًا وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ‌ وَالْأَفْئِدَةَ ۙ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُ‌ونَ -আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের মায়ের গর্ভ থেকে বের করেছেন। তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদেরকে কর্ণ, চক্ষু ও অন্তর দিয়েছেন, যাতে তোমরা অনুগ্রহ স্বীকার কর” (১৬:৭৮)। এখানে মানবসত্তার ক্রিয়াসম্ভাবের ঘনত্ব ও পরিমাণের মাত্রার ধারা অবলম্বিত হয়েছে বলে মুফাসসিরগণ মনে করেন। মাতৃগর্ভ থেকেই আমরা শুনতে শুরু করি। আমাদের চোখের পাতি (পাতা) রয়েছে, ইচ্ছে করলে চোখ বন্ধ করতে পারি। কিন্তু কান সব সময়ই খোলা থাকে, ঘুমালেও অতি ক্ষীণভাবে কান শুনেই যায়। মাতৃগর্ভ থেকে শুরু হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত কান খোলাই থাকে। চোখের কাজ কানের চেয়ে কম। আর হৃদয়েরহৃদয়ঙ্গমকাজ সবচেয়ে কম। তাই কম লোকই হেদায়াতের উপর থাকে। ধর্মের নামেও পথভ্রষ্ট থাকতে পারে।
মানুষ প্রধানত তাই দেখে যা সে দেখতে চায়; যদি মনেরআগ্রহ হয়, তবেই মনোনিবেশ করে। শুনার ব্যাপারেও তাই। যখন মনবসে না, তখন শুনেও শুনে না। নবীর (সা) মজলিসে বসেও অনেক মুনাফিক নবী (সা) কী বলেছেন, তা খেয়াল করতে পারত না, পরে অন্যদেরকে জিজ্ঞেস করত। আল্লাহ বলেন, “আর তাদের মধ্যে কিছু লোক আছে যারা আপনার কথা শোনে, তারপর তারা যখন আপনার কাছ থেকে বেরিয়ে যায় তখন যাদের জ্ঞান দেওয়া হয়েছে তাদের বলে, ''সে (নবী) এইমাত্র কী বললে!’’ এরাই তারা যাদের হৃদয়ের উপরে আল্লাহ্ মোহর মেরে দিয়েছেন, আর তারা নিজেদের খেয়ালখুশিরই অনুসরণ করে” (৪৭:১৬)।
আমাদের প্রকৃতি ও বিশ্বাস
আমরা আবেগ-অনুভূতি সম্পন্ন প্রাণী: এখানে আবেগের পরিধি ব্যাপক অর্থের। এতে ভাব, আসক্তি, নিরাসক্তি, কোন বস্তুর প্রতি ইতিবাচক-নেতিবাচক মনোভঙ্গি ইত্যাদির সমন্বয় বিবেচিত হবে। অনেক বিষয় আমরা অনুভূতিতে পরশ করি। পরে তা ভাষায় সজ্জিত করি। যখন ন্যায্যতা দেখাই তখন ন্যায্যতা দেখানোর হাতিয়ার ব্যবহার করি (অর্থাৎ ভাষিক যুক্তিতে দেখাই)। এদিক থেকে ধর্মের ময়দানেও যৌক্তিক ভাষায় সাজানোর অনেক বিষয় রয়েছে। এটা এভাবে না হলে ধর্ম সুদূর থেকে এই ঐতিহাসিক পথ পাড়ি দিয়ে আসত না।
আজকের আস্তিক, নাস্তিক, কাফির, মোনাফেক যাদেরকে যে হিসেবে চেনেন, তাদের কথাবার্তার প্রতি মনোনিবেশ করুন। তারপর কোরান খোলুন। দেখবেন, সেই যে হাজার হাজার বছর আগ থেকে নবী, রাসূলদের পক্ষে বিপক্ষে যেসব যুক্তি ও আলোচনা হচ্ছিল আজও সেই ভাষা, সেই যুক্তি পরিবাহিত হচ্ছে। এখানে কেউ আস্তিক হয়ে বদ্ধদ্বারে আবদ্ধ হয় নি, আর কেউ নাস্তিক হয়েও মুক্তচিন্তক হয় নি। বলেছি, এই দুনিয়া পুরাতন। তার আকাশ পুরাতন। তার চন্দ্র-সূর্য পুরাতন। আমরা এক বিস্ময়কর অস্তিত্বে এসেছি। যদিও আমরা কালের প্রবাহে ক্ষুদ্র বিন্দু। এই চার পাশের লক্ষ কোটি বছরের বিদ্যমান অস্তিত্ব সম্পর্কে আমি আর আপনি কতটুকু জানি আর বুঝি?
মুক্ত না প্রভাবিত?
বলেছি যে মানুষ তার নিজের ব্যাপারে যেকোনো কিছু দাবী করে বসতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা  অন্য কিছু হতে পারে। কেবল আলোচনার গভীরে গেলেই মূল জিনিসটি কী -তা বুঝা যাবে। আলোচ্য ক্ষেত্রে কারও ধারণার ঐতিহাসিকতা এবং প্রভাব বিবেচনার প্রয়োজন হবে। যা যুক্তিপূর্ব, তাও দেখতে হবে। কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তের আগে, অন্তর বা অন্তরস্থ প্রকৃতির প্রবণতা কোন স্থানে ছিল, কোনঅনুভূতিরবিষয় কী থেকে কী হয়ে ভাষায় সজ্জিত হয়ে এসেছে এবং তাতে কোন ধরণের পূর্ববর্তীতা, পূর্ব ইতিহাস, পাঠ ও পাঠ্য প্রভাব সজ্ঞায় কাজ করে গিয়েছে তাও বিবেচনা করতে হবে। এভাবে, কোন সিদ্ধান্তে ব্যক্তির পূর্বজ্ঞান, তার শিক্ষা, তার পরিবেশ, তার পিয়ারগ্রুপ ইত্যাদির সংযোগ ও প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলেই বুঝা যাবে কোথায় মুক্তচিন্তা আর কোথায় স্বাধীনতা। কোন একটি পয়েন্টকে যৌক্তিকভাবে সাজানোর কাজ হচ্ছে ভাষার কনভেনশনের একটি রূপ বা অংশ মাত্র। এটা সমাজ ও শিক্ষা থেকে প্রাপ্ত। অনেক দার্শনিক এটাকে নিছক হাতিয়ার’ (tool) মনে করেন। তবে আমি এখানে যুক্তিকে (reason per se) অস্বীকার করছি না। বরং যুক্তির আগে মনের সুপ্ত অনুভূতির প্রভাবের ভিত্তিতে সজ্জিত বস্তু যুক্তির আকৃতিতে রূপায়নের কথা বলছি। চিন্তার প্রভাব ও পূর্ববর্তীতার কথা বলছি। তাছাড়া যে সীমাবদ্ধ উপাদানের আওতায় প্রকৃত যুক্তি সংগঠিত হয় তাও ব্যক্তি ইতিহাসের সীমিত পরিধির প্রেক্ষিতে প্রিডিক্টেবল একটি রূপ মাত্র। যার মানসিক উপাদানের সমষ্টি (জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা) X তার সিদ্ধান্ত Y এর প্রেক্ষিতে A to D স্কেলের ভিতরেই থাকবে। মুক্তচিন্তক বললেই প্রিডিক্টেবল সীমার বাইরে আচমকা কিছু হয়ে যাবার মত নয়।
এবারে শেষ কথা। আবার সেই বাগান ও কবিতার উপমা। রাজকীয় বাগান, বড় লোকের বাগান, আর কুড়ে ঘরের বাগান এসবে পার্থক্য রয়েছে। দৃষ্ট বস্তুর প্রকৃতি ও প্রকারভেদ রয়েছে। এসবে দ্রষ্টার যোগ্যতা ও প্রকৃতির ভিন্নতা রয়েছে। কবিতায়ও তার জোনরা (genre) বা প্রকারভেদ রয়েছে। এখানে কে কী দেখে, কে কী দেখে নাএসব আলোচনা আপনি আর আমি চলে যাবার পরও চলবে। এ আলোচনা হাজার হাজার বছরের আলোচনা। কে কোন স্থানে দাঁড়িয়ে কী দেখেছে, কীসের ভিত্তিতে দেখেছে, কী বুঝেছে তার বুঝই বা কী, আর তার দেখাইবা কী? কালের বহমান স্রোতে দ্রষ্টা আর দৃষ্টবস্তুর ওলটপালটে কোনটির প্রকৃতিতে কী ভাসছে? এই চলন্ত ধারায় আমরা যা-কিছু দেখতে ঢুকেছি তা বুঝার আগেই কিন্তু বেরিয়ে পড়ছি। আল্লাহ আমাদের যে জ্ঞান দিয়েছেন তা অতি অল্প (১৭:৮৫)। যারা বোঝার দাম্ভিকতা প্রদর্শন করছে্ন, আর যারা এই বিশ্বের বিরাজিত বিস্ময় দেখে দীনতাভরে আল্লাহতে আত্মসমর্পণ করছেন এই দুই পক্ষের মধ্যকার পার্থক্য এক বিরাট, বিরাট পার্থক্য।
________________________________________
টীকা:
[১] আলেমগণ অন্তর ভিত্তিক তিন স্তরকে সাতটি স্তরে বিভাজন করেন। যেমন, সাদর (صدر), কালব (قلب), শাগাফ (شغاف), ফুয়াদ (فؤاد), হাব্বাতুল কালব ( القلب حبة), সুওয়াইদাউল কালব (القلب سويداء) ও মহাজ্জাতুল কালব (القلب مهجة)
সদর হচ্ছে ইসলাম গ্রহণ/বর্জনের অভিপ্রায়ের স্থান (৬:১২৫), কালব  হচ্ছে ঈমান ও প্রজ্ঞার স্থান, শ্রুতি ও অন্তদৃষ্টির স্থান (৪৯:১৪); ফুয়াদ হচ্ছে সত্যাশ্রয়ী অনুভূতির স্থান, সত্য অনুভব, অন্তরদৃষ্টি (vision), স্থির দৃষ্টির স্থান (১১:১২০, ২৮:১০)। শাগাফ হচ্ছে যেখানে দুনিয়াবী প্রেম-ভালবাসা অতিমাত্রায় স্থান পায়, বা যা দুনিয়াবী বস্তুতে আকৃষ্ট এবং যা পর্দায় কালব থেকে আলাদা হয়ে থাকে সেই স্থান। ইউসূফ আলাইহিস সালামের প্রেমে জোলাইখার যে অবস্থা হয়েছিল সেটিই ছিল শাগাফের একটি উদাহরণ (১২:৩০)। হাব্বাতুল কালব হচ্ছে সত্যের উপলব্ধি ও ভালবাসার স্থান; সুওয়াদাউল কালব হচ্ছে দ্বীনি জ্ঞানের স্থান; এবং মাহাজ্জাতুল কালব হচ্ছে গুণের বৈশিষ্ট্য ধারণ ও বিকাশের স্থান।
[২] এই লেখাটি কারও পছন্দ হলে তাদের ফেসবুকে লিঙ্ক করতে পারেন যাতে চিন্তার স্রোতটি প্রসারিত ও প্রশস্ত হয়।
[৩] আস্তিক, নাস্তিকতা যুক্তি ইত্যাদি প্রসঙ্গ ঘিরে আরও কিছু লেখা দেখা যেতে পারে:
যুক্তি, বিশ্বাস ও কোরান
Rationality and Religion
আধুনিক সমাজের শান্তি -না বিশ্বাসে, না অবিশ্বাসে
আত্মহত্যা ও বিশ্বাস
আলো-আঁধারের খেলা
আপনি কি সত্যিই শান্তি চান ও নিজেকে বিজ্ঞানমনষ্ক ভাবেন?
কুসংস্কারেরগর্তে নাস্তিকের শেষকৃত্য -বিনোদন
মুক্তমনা ও নাস্তিক মিলিট্যান্সি
কলমের ভাঁওতাবাজিতে সামাজিক বিপর্যয়
অভিজিৎ হত্যা
সশস্ত্র নাস্তিকের হাতে ৩ জন নিরীহ মুসলিম খুন

















No comments:

Post a Comment