যুক্তি, বিশ্বাস ও কোরান
এই দুনিয়ায় কেউ বিশ্বাসী, কেউ অবিশ্বাসী। যুক্তি বিজ্ঞানের আলোকে
যদি বিশ্বাসের স্থানে পৌছা যেত, তবে
এই বিশ্বের বড় বড় মহাবিদ্যালয়গুলোতে
যারা আজীবন যুক্তি-শাস্ত্র, অংক
ও দর্শনের উপর শিক্ষকতা করে
আসছেন তাদের সকলকেই হয়ত বিশ্বাসী পেতাম। আবার যদি এই শাস্ত্রাদির মাধ্যমে
বিশ্বাসকে উড়িয়ে দেয়া যেত, তবে
সবাইকে হয়ত অবিশ্বাসীই পেতাম, কেননা
যুক্তি বিদ্যার সংজ্ঞা ও তার ব্যবহারিক জ্ঞান তাদের অবশ্যই আছে। বিশ্বাস আসলে
যুক্তিবিদ্যার মাধ্যমে সর্বসাধারণের আয়ত্তাধীন কোন বিষয় নয়। মানুষের আয়ত্তে যেসব বস্তু রয়েছে
এবং যেসব বস্তু তারা নিজেরাই
চেষ্টা সাধনা করে বের করতে সক্ষম, সেসব বস্তু ওহীর (ঐশীর) মুখ্য বিষয়
নয়। আল্লাহ
আছেন কী নাই, মৃত্যুর
পর জীবন আছে কী নাই, সেখানে
জবাবদিহির কোন বিষয়
আছে কী নাই –এগুলো
মানুষের পঞ্চেন্দ্রিয় অনুসন্ধানের বাহিরে।
কিয়ামত পর্যন্ত চেষ্টা করে সেখানে নিঃসন্দেহভাবে উপনীত হবার
কোন পথ নেই। তাই
আল্লাহ নিজেই পঞ্চেন্দ্রিয় পথে মধ্যস্থতা (intervene)
করে রিসালাতের
ব্যবস্থা করেছেন। আমাদের অস্তিত্ব যেমন এক মহান নেয়ামত, তেমনি এটাও। পঞ্চেন্দ্রিয় থেকে
অতীন্দ্রিয়তে পাড়ি দেয়ার এই বিষয়টিও আবার আসমান জমিনের মত। এটা এক ধরণের সম্ভব/অসম্ভবের
ব্যাপার। “মুহাম্মদ
বলেছেন তাঁর কাছে
সরাসরি এবং এক ফেরেশতার মাধ্যমে এই মর্মে বার্তা এসেছে যে আল্লাহ আছেন, তিনি এক,
অদ্বিতীয় এবং মানুষের মৃত্যুর পর পুনরুত্থান হবে অর্থাৎ পরকার
আছে” –এখানের
সত্য-মিথ্যা কীভাবে নির্ণয় করবেন?
আবার কোন যুক্তিতে
মুহাম্মদকে “আস্থায়” নিয়ে আপনার গোটা জীবন তাঁর সেই বাণীর
আলোকে সাজাতে যাবেন? অবস্থানের প্রকৃতি হচ্ছে এই যে হয়
তাঁকে বিশ্বাস করে সেই পথে পাড়ি
জমাবেন, আর
না হয় যেখানে আছেন সেখানেই থেকে যাবেন। এই সিদ্ধান্ত এক চরম সিদ্ধান্ত। তাই যে বিশ্বাস করতে পারল আর
যে পারল না –এই
দুজন কি এক? এমন ধরণের
অলঙ্কারবহুল (rhetorical) অনেক
প্রশ্ন কোরান বার বার করেছে। এই জটিল
কাজ কেউ করতে পারবে আর কেউ করতে পারবে না, এটাই অনুমেয় এবং বাস্তবতাও বটে। মানব
সভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাস এই পারা না-পারার সাক্ষ্য বহন করে। (তবে এ কথা মনে
রাখতে হবে যে মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন তিনি ফেরেস্তা দেখেছেন, বেহেস্ত-দোযখ দেখেছেন এবং
এ দিক থেকে তাঁর বাণীর একটি জ্ঞান-তাত্ত্বিক (epistemological) দিক রয়েছে, যেখানে রয়েছে seeing, perception, justication and knowledge, কিন্তু
এই আলোচনা আমরা সেদিকে নিতে চাচ্ছি না,
সেটা অন্য প্রকৃতির আলাদা আলোচনা। এর উপর এক সময় হয়ত আরেকটি
লেখা দেবো।)
বস্তুত যা পঞ্চেন্দ্রিয়
পদ্ধতিতে প্রমাণ বা প্রতিষ্ঠা করা যায়
তার জন্য ‘বিশ্বাস’ শব্দের প্রয়োগ যথাযথ নয়, এবং হয়ত সমীচীনও নয়। পঞ্চেন্দ্রিয়ের
যুক্তিতে যদি অতীন্দ্রিয় ‘অকাট্য’ হয়ে পড়ত, তাহলে আল্লাহ,
পরকাল নিয়ে মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে এত মশগত করত না।
বিশ্বাস/অবিশ্বাস, আমার ব্যাখ্যায়, যুক্তিপূর্ব মুহুর্ত্তে সাধিত হয়।
মানুষের প্রকৃতিতে একটি অতি সূক্ষ্ম প্রবণতা (disposition)
রয়েছে যা
ইতি/নেতির দোলকে (pendulum)
সুপ্তভাবে বিচরণ করে,
এবং স্থানভেদে কোমল
অনুভূতিতে দোলন জাগায় আর এখানেই আসে তার তকদীর। যাকে যে পথের
জন্য তৈরি করা
হয়েছে, তার
সুপ্ত দোলন সেদিকে ইঙ্গিত করবে এবং সেই পথের ‘যুক্তি’ অনুভব করবে। একটি হাদিসে এসেছে যে
মানুষের ক্বলব (অন্তরাত্মা) আল্লাহর দুই
আঙ্গুলের মধ্যে (রূপক কথা) অবস্থিত, তিনি তাকে যেদিকে ঘুরান, তার মন সেদিকেই যায়। যুক্তি অনেক পরের বস্তু।
আবেগে ধারণা যখন সম্পর্কশীল (emotive
sense associates with concept) হয়, যুক্তি তখন সৃষ্টি শৈলী প্রবণতায়
স্ফূলিঙ্গিত হয়ে ব্যাখ্যার অনুকূল ভাষা লাভ করে। শব্দ ও বাক্যের,
বিশেষ করে অনুকূল metaphor
পেয়ে গেলে যুক্তির পথ সুলভ হয়ে পড়ে। যুক্তির আগের মূহুর্ত্তটি হচ্ছে সুপ্ত
আবেগ পরশের মূহুর্ত্ত, ইতি
বা নেতির কোমল
অনুভূতি লাভের মুহুর্ত্ত। যুক্তি হচ্ছে simply
একটা হাতিয়ার (tool)
যা সেই অনুভূতিকে একটি বিশেষ রূপে রূপায়িত করে, গ্রহণীয় রূপে। বৃহৎ অর্থে আমাদের
গোটা ভাষাটাই একটি tool যা
আমাদের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা সাজাতে
সাহায্য করে। কোনো ছেলে যদি একটি মেয়েকে ভালবেসে ফেলে, তখন সে তাকে কেন বিয়ে করতে হবে –এর পক্ষে যুক্তি পেতে কোন অসুবিধে হবে
না। প্রয়োজনে সে ১০১
যুক্তি দাড় করাতে পারবে। কিন্তু মেয়েটিকে যদি তার মা-বাবা অপছন্দ করেন, তবে তাদেরও যুক্তি পেতে অসুবিধে হবে না।
তাদের সৃষ্টিশৈলী faculty-প্রজ্বলিত
হয়ে উঠবে এবং ১০১ বিপরীত যুক্তির অনুভূতি পাবেন।
যুক্তি হচ্ছে ব্যাখ্যার একটি relative
process and it is not an infallible tool. It works largely around
selective metaphors. Consider Marxism and their selective metaphors. What we
see there is the use of ‘structural’ metaphors: base, structure,
superstructures etc., and from there the Marxist argument lifts off. দাউদ
(আঃ) এঁর গৃহের দেয়াল ডিঙ্গিয়ে
যখন দুই ব্যক্তি বিচার চেয়ে প্রবেশ করেছিল তখন তাদের একজনের অভিযোগ ছিল যে তার একমাত্র ভেড়ীটি
প্রতিপক্ষের অধিকারে থাকা ৯৯ টি ভেড়ীর
সাথে দিয়ে দিতে হবে এবং যুক্তি দিয়ে তার প্রতিপক্ষ তাকে
পরাস্ত করেছে সুতরাং
সে ঐশী বিচার পেতে এসেছে!
যারা
আল্লাহতে বিশ্বাস করে না, তাদের
এই সিদ্ধান্ত যুক্তির অনেক
আগেই হয়ে গিয়েছে,
যুক্তি এসেছে পরে,
ব্যক্তির অবস্থানের justification
হিসেবে। ধর্মীয় বিশ্বাসের আবেদন হয় যুক্তির
পূর্ব-মুহুর্ত্তের ‘ক্বালবি’ অনুভূতি থেকে। তবে কেউ অনুভূতিতে সাড়া
না পেয়েও এবং যুক্তি ব্যতীরেকে
বিশ্বাস করতে পারেন,
তাতে অসুবিধে নেই। ধর্মীয় কাহ অভ্যাসে আত্মস্থ হলে যুক্তি
এক সময় আসবেই। তবে ঈমানের জন্য কোন যুক্তির প্রয়োজন নেই।
যুক্তিকেন্দ্রিক
বিষয়ের একটি উদাহরণ টানা যাক। মনে করুন আমি আপনাকে একটি বিল (bill) পাঠালাম, আপনাকে এই বিল পে করতে হবে। বিলের নিচে
যদি ছোট অক্ষরে
লিখা থাকে যে যদি ১৫ দিনের মধ্যে এই টাকা আদায় না করা হয়, তবে আপনার উপর কোর্টের শমন জারি করা হবে।
এত্থেকে বুঝতে হবে যে এখানে কোন
যুক্তি বা যৌক্তিক স্বাধীনতা বাকি থাকে নি। এখানে আইনি ‘হুমকি’
এসে গেছে।
কোন যুক্তি থাকলে,
তা আদালত সাপেক্ষ।
আমাদেরকে
ঈমানের দিকে আহবান করা হয়েছে, আসমান
জমিনের দিকে তাকাতে ইঙ্গিত
করা হয়েছে, গোটা
সৃষ্টির দিকে মনোনিবেশ করতে আহবান করা হয়েছে যাতে করে আমরা আল্লাহতে বিশ্বাস করতে পারি
এবং তাঁর অনুগত হতে পারি। কিন্তু
সেখানে এই হুমকিও রয়েছে যে যদি আমরা ঈমান আনতে ব্যর্থ হই এবং
তাঁর অবাধ্য হয়ে
পড়ি, তবে
আমাদেরকে দোযখের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে। এখানে আবেদন যুক্তি সংগত থাকত যদি বলা হত যে আসমান আর
জমিনের দিকে তাকাও এবং দেখ ঈমান আনতে
পার কি না। পারলে পেরেছ,
না পারলে নাই –এতে
কোন জোরাজুরি নেই, এতে শাস্তি-পুরষ্কারের
কিছু নেই। কিন্তু বিষয়টি এভাবে আসেনি। এখানে আসমান আর জমিনের দিকে তাকানোর আহবান প্রচলিত
অর্থের নিছক যুক্তির আহবান নয়, কেননা এই
যুক্তি হচ্ছে সামাজিক ও ভাষিক, এটা
ভাষার প্যাচে সৃষ্ট একটি দুর্বল
উপকরণ। তাই আহবান হচ্ছে অন্তরাত্মা দিয়ে ধ্যান ও তপস্যামূলক
আহবান। এই তাকানোতে
যুক্তিপূর্ব মুহুর্ত্তের ‘ক্বালবি’অনুভূতির প্রতি আহবান, এটা হচ্ছে লুবাবের ব্যাপার। কোরান এই শব্দটি
(এক বচনে বাব্ব, বহুবচনে
আলবাব) ও ক্বলব
শব্দটি (বহু বচনে ক্বুলুব) বার বার ব্যবহার করেছে। কোরান বলছে, চিন্তা করো, মননিবেশ করো ‘ওহে উলুল আলবাব’। ওহীর
এই আবেদন হচ্ছে জীবন সঞ্জীবনী, ক্বালবকে (অন্তরাত্মাকে) তার নির্জীব, রুগ্ন,
মুমূর্ষু অবস্থা
থেকে উত্তরণের জন্য। জীবন মৃত্যু যেমন তকদীরে অংশ তেমনি ক্বালবের ব্যাপারটি।
বৃষ্টি ঝরলে যেভাবে কিছু উদ্ভিদ জীবন্ত হয়ে ওঠে তেমনি ওহীর সয়লাবে কিছু ক্বালব জীবন্ত হয়ে ওঠে। এ
জন্য ওহীর উপমা বার বার মেঘের
বিচরণ, বৃষ্টির
অবতরণ আর তরু-লতা ও নানা উদ্ভিদ এবং ফলফসলের কথা দিয়ে এসেছে। ওহী হচ্ছে বৃষ্টি-ঝরা পানি। এই
পানিতে কিন্তু সব বীজ জীবন্ত হয়ে
ওঠে না, কিছু
উঠলেও মরে যায়, কিছু
উদ্ভিদ মাটির গভীরে জড় গেড়ে উপরের
দিকে প্রশস্ত হয় এবং কিছু জড় গভীরে যায় না, এগুলো ঝড় তুফানে নিঃশেষ হয়।
এগুলিই হচ্ছে ক্বালবের জগতের উপমা। এগুলোর আবেদন ভিন্ন।
আল্লাহর ইচ্ছা –কেনোর কোনো মানি নেই
আল্লাহ কেন এক দল লোককে হেদায়াত দেবেন
এবং কেন অন্যদলকে দেবেন না- এই
প্রশ্নের উত্তর অনাদি,
অনন্ত কালের সৃষ্টি প্রক্রিয়ার কার্যকারণের সাথে জড়িত, চিরন্তনতার সাথে সংযুক্ত। আমরা সেই
অনন্তে ছিলাম না, যেতেও
পারব না, আল্লাহ
আমাদেরকে এই বিশ্ব-লোকের সৃষ্টির সাক্ষ্য করেননি। এই বিষয়টি আমাদের সামাজিক ও ভাষিক যুক্তির উপকরণ
দিয়ে সামলানো সম্ভব নয়। আল্লাহ কেন
অসংখ্য গ্রহ উপগ্রহ কোটি কোটি বৎসরে সৃষ্টি করেন, কেন এগুলোকে নানান সৌন্দর্যে বিকশিত করেন, তারপর,
ব্যাং! এক আঘাতে চূর্ণ বিচূর্ণ করে ফেলেন! আমাদের মানবিক মূল্যবোধ দিয়ে এগুলো বিচার করতে গেলে
হিমসিম খেতে হয়।
এই
বিশ্ব জগত আমাদের পুরোগামী (it
precedes us)। এই
অনন্ত লোকের দিকে
তাকিয়ে তার নানান গঠন/সংগঠন কীভাবে হয় এবং কেন এটা এভাবে আর ওটা সেভাবে
–এগুলো
জানার মত বয়স আমাদেরকে দেয়া হয়নি। অনেক জিনিস বুঝার বস্তুও নয়। নবী রাসূলদেরকে আল্লাহ যা
জানিয়েছিলেন, (একান্ত
প্রয়োজন না হলে), তারা তাতেই সন্তুষ্ট থাকতেন। কেননা তারা
ছিলেন সম্পূর্ণ বিশ্বাসী।
বিলিয়ন বিলিয়ন বৎসরে গড়া আমাদের চারিধারের এই জগতের
মার-প্যাচ জানার তেমন
উপায় উপকরণ নেই। এটাই বাস্তবতা। আমরা সবকিছু জেনে শুনে এখানে আসি নি এবং
সবকিছু জেনে শুনে এখান থেকে যাবও না। সবকিছু জেনে বুঝে তবেই যদি ‘বিশ্বাস’করতে
হয়, তাহলে
৮০ মণ ঘিও আসবে না, রাধাও
নাচবে না। সবকিছু জানার দুঃসাহস
এক ধরণের ঔদ্ধত্য।
তকদীর
তকদীরের ব্যাপারটি যুক্তিজ্ঞানে জটিল
থেকে যায়। এর মূল কারণ হচ্ছে ওহীর
প্রকৃতি এবং যুক্তি ও অযুক্তি তথা মানসিক সেন্টারের rationality/irrationalityএর
অবস্থানিক পার্থক্য। মানুষ একান্ত যুক্তি সর্বস্ব প্রাণী নয় আবার সে
যুক্তির বাইরেও নয়। নবীর
উপর যখন ওহী নাজিল হত, তখন
তিনি আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয় যৌক্তিক জগতের
চেতনায় (consciousness-এ)
থাকতেন না। তার অবস্থার পরিবর্তন হত। প্রাচীন কাল থেকে আজ পর্যন্ত যেসব সাধকেরা
ধ্যান-সাধনায় মনোনিবেশ করতেন, তাদের মানসিক
চেতনা (consciousness) স্থানান্তরিত
হত। অনুভূতির জগতে তারা অনেক
কিছু বুঝতেন, যা
সামাজিক/ভাষিক যুক্তিতে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হত না। ভাষিক ব্যবহার হচ্ছে এক বস্তুর আলোকে (অর্থাৎ
উচ্চারণ ও লিখার symbolic মাধ্যমে
) অন্য
বস্তু বুঝানো, এটাই
তার সিস্টেম, এবং
এটা প্রকৃতিগতভাবে রূপক (metaphorical)। আর
রূপকতা (metaphoricity) অকস্মাৎ
যুক্তির ধারা ছেদন করতে পারে
অর্থাৎ যুক্তির এক ধারাকে অন্য ধারায় মোড়িয়ে দিতে পারে, ঘুরিয়ে দিতে পারে। তাই ভাষায় যা কিছু বলা হবে
তাতে দ্বৈততা, বৈপরীত্য
থেকে যেতে পারে
(because of its symbolic nature)। তাই
সাধকেরা অনেক বৎসর অতিবাহিত না
হলে নব্য-শিষ্যের সাথে তাত্ত্বিক আলোচনায় যেতেন না। যখন শিষ্যেরা
ভাষায় নিহিত
সমস্যার মার-প্যাচ অনুভূতিতে ধারণ করে,
এই মাধ্যম বা tool-টির সীমাবদ্ধতার
পর্যায়াদি আয়ত্ত করে, আলোচনার
পর্যায়ে উপনীত হতেন, অর্থাৎ গুরুর
বিবৃত কথার আপাতদৃশ্য ভাষিক অসামঞ্জস্যতা পুষিয়ে নেয়ার স্থানে পৌঁছতেন, কেবল তখনই গুরু-শিষ্য আলোচনা সংগঠিত হত।
কোরান
নাজিলের সময় নবী করীম (সঃ) অর্থ-জগত ও রূপক জগতের
( العالم
المعنوي والعالم المثالي) যা কিছু হৃদয়ঙ্গম করতেন, বুঝতেন এবং তাঁর জ্ঞান-পরিধি যে সসব
বস্তু পরিবেষ্টন
করত, তা
সর্বসাধারণ থেকে ভিন্ন। আমাদেরকে সে জগতের বিষয়
‘বিশ্বাস’ করতে
বলা হয়েছে, যেহেতু
আমরা সেই পর্যায়ে নেই। নবুওয়তের
মাক্বামে পৌঁছার কোন পথ নেই –এটি
হচ্ছে আল্লাহর এক বিশেষ নেয়ামত। ওহী নাজিলের
মাধ্যমে আমরা যে বস্তুটি পাচ্ছি, যে
বাণী পাচ্ছি, তা
‘ভাষায় প্যাক-করা’ বিবরণ। এ বিবরণ এমন এক জগত থেকে উদ্ভূত
হয়েছে যেখানে যৌক্তিক/অযৌক্তিক
(rationality/irrationality) এর
পার্থক্য নেই, যেখানে স্থান
ও কালের অনুভূতি ভিন্ন। এসব বিষয় বুঝতে হলে ধ্যানের জগতে চেতনা (consciousness) যেখানে rationality/irrationality -এর
পার্থক্য অতিক্রম করে
সেখানে পৌঁছতে হয়। যেহেতু বাণী ‘ভাষিক’ হয়ে পড়েছে, তাই ভাষা ও সমাজ কেন্দ্রিক তাবৎ জ্ঞান অর্জনও করতে হবে।
এগুলো অনেক বৎসরের সাধনা ও
ইবাদত-তপস্যার ব্যাপার।
কোরানের
বিষয়াদি বুঝতে গিয়ে আবার কিছু আয়াতকে অন্য কিছু আয়াত দিয়ে চাবকানি (বাড়াবাড়ি) করলেই বুঝা
সম্ভব নয়। এখানে সমস্যা হচ্ছে
ভাষার এবং সামাজিক যুক্তির। যুক্তি আমাদের সৃষ্ট একটি মাধ্যম, এর সীমাবদ্ধতা রয়েছে –যুক্তি স্থান ও কাল সর্বস্ব। মূল স্থানে
না গিয়ে আয়াতকে
আয়াত দিয়ে চাবকানি করাতে সমাধান নেই,
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এটা করতে নিষেধ করেছেন। মসজিদে এমন কিছু বিতর্ক
লক্ষ্য করে তিনি বলেছেন, তোমাদের
কি হল
যে তোমরা কোরানের এক অংশ অন্য অংশ দিয়ে কশাঘাত করছ?
তোমাদের
পূর্ববর্তীরা এভাবেই ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছে। (আহমদ/ইবন মাজাহ)।
যা যুক্তির মত দেখা যায়
কোরানের যে সব আয়াতে জীবন-জগতের
যুক্তির বিষয়াদি আসতে দেখা যায়, সেগুলো
সাধারণত দুই ধরণের যুক্তি বহন করে। একটি চিরন্তন,
যেখানে এই এহসাস
পাওয়া যায় যে একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া এখানে আর কিছুই
ঘটে না, ভাল-মন্দ
বিশেষণ আরোপণের ঊর্ধ্বে, সবকিছুই তার দিকেই সমন্বিত।
আর অন্যটা হচ্ছে
দৈনন্দিন জীবনের সামাজিক যুক্তিবাহী কথা। যেমন আমরা দৈনন্দিন জীবনের কথাবার্তায়
কর্তা ও ক্রিয়াপদকে সংগঠিত বিষয়ের সাথে সমন্বিত করি এবং তাতে যে
যুক্তি অনুভব করি, তাই।
যেমন আমি বললাম, ‘আমার
পিতা একটি ঘর বানিয়েছেন’। এখানে ঘর বানানোর সাথে আমার পিতার কর্ম, ইচ্ছা ও সামর্থ্য সম্পর্কিত হয়েছে –আল্লাহর ইচ্ছা ও তার তকদীরের সাথে
সম্পর্কিত নয়। মূল বাক্য
যদি এভাবে বলা হত, ‘আমার
পিতা আল্লাহর হুকুমে এবং তাঁর সাহায্যে একটি ঘর বানিয়েছেন’, তবেই তা বিশ্বাসের যুক্তিতে খাপ খেত, চিরন্তন যুক্তিতে যেত। কিন্তু সব কথা যদি এভাবে দীর্ঘায়ত
করা হয় তাহলে জীবন দুর্বিষহ হয়ে
উঠবে। তাই বস্তু জগতের কার্যকারিতার সাথে আমাদের কর্মকে
সংযুক্ত করে আমরা সচরাচর
যে আলাপ আলোচনা করে থাকি এবং যুগ যুগ ধরে করে আসছি,
তাই প্রথাগত
হয়ে পড়েছে। এখানে আমরা নিজেরাই কর্তা-পদে থাকি, বিশ্বাসে কোন বিঘ্নতা আসেনা।
সব ভাষাতেই এই প্রথা, এই
বৈশিষ্ট্য। আর কোরান যেহেতু আরবী ভাষায়
বিবৃত হয়েছে তাই সেখানে ভাষার বৈশিষ্ট্যাদি স্থান পেয়েছে।
কিন্তু বৃহত্তর ব্যাখ্যা
শুরু হলে সেখানে সব কিছুর উৎসই আল্লাহর দিকে সমন্বিত হবে।
যা মানুষের কর্ম স্বাধীনতার মত
দেখায়
দৈনন্দিন জীবনের ভাষিক-যুক্তির উৎস সমাজ
ও সামাজিক বিশ্বাসের সাথেও
সম্পর্কিত থাকে। ভাষা তার
ব্যবহার প্রক্রিয়ায় সেই বিশ্বাস ও সংস্কৃতিকে পরিবহন
করে চলে। অনেক পৌত্তলিক সমাজ/সভ্যতার নানান বিশ্বাস ভাষার বিভিন্ন অভিব্যক্তিতে
প্রথাগত হয়ে থাকতে পারে। কোনো জাতি তাদের ধর্ম পরিবর্তন করে অন্য ধর্মে চলে গেলেও পূর্ব প্রথার কিছু
কিছু জিনিস সেই ভাষার অংশ হয়ে
নতুন ধর্মে প্রবেশ করে (migrates
into the other) এবং যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকতেও
পারে। ভাষিক প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান (linguistic
archaeological investigation) চালালে
তা ধরা পড়তে পারে। একটি ভাষার সুদীর্ঘ জীবনে
(within the long span of a language’s life) তার
ব্যবহারকারীরা ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত
হয়। অন্য ধর্ম, বিশ্বাস
ও আদর্শ থেকে বিপরীতধর্মী অভিব্যক্তির
(expression) আগমন ঘটে,
সময়ের সাথে কিছু কিছু বৈপরীত্যের সামঞ্জস্য ঘটে আবার
অনেক জিনিসের সামঞ্জস্য হয় না। পূর্ব ও পরের ধারণাগত বিগ্রহ থেকেই যায়।
যেমন আমরা সিলেট জেলায় বলে থাকি, ‘আল্লাহ
চাল ফুঁড়ে লাল দেন না’ –এই
কথাটি Free Will এর
বিশ্বাস থেকে এসেছে, তকদীরের
বিশ্বাস থেকে নয়। তকদীরের
বিশ্বাসে চাল ফুঁড়ে লাল আসতে পারে যদি তা তকদীরে লেখা থাকে। কেননা,
আল্লাহ যার তকদীরে ‘লাল’ (টাকা/সম্পদ) রেখেছেন, সে ঘরে বসে থাকার অবকাশ পাবে না, তাকে বেরিয়ে পড়তেই হবে, সেই অনুভূতি, সেই জ্বালা তার অন্তরাত্মায় সৃষ্ট হবে এবং সেই তাড়াই
তাকে কর্মক্ষেত্রে নিয়ে যাবে। অথবা
অন্য কোথাও থেকে আল্লাহ তার রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন –যার কল্পনাও সে করেনি। মানুষের স্বাধীনতা/অধীনতার দর্শন
হাজার হাজার বৎসর থেকে স্থান, কাল, ধর্ম,
দর্শনের ময়দান চরে বেড়াচ্ছে। সেক্যুলার জগতে এই টান-পোড়েন free will versus social determination এবং
free will versus genetic
determination এ পর্যবেশিত হয়েছে। আমরা আল্লাহর
ইচ্ছার determination-এ
বা তকদীরেই বিশ্বাসী। এই বিশ্ব জগতে কেবল আল্লাহর শক্তি ছাড়া আর ছোট/বড় কোন কিছুই determine করতে পারেনা। আমরা ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ বলে এই ধারণার ঘোষণা দেই। আমার তকদীর
আমিই গড়ি –এমন
ধারণা ইসলামী নয়। এই বিশ্বে যদি আর কেউ শক্তি প্রয়োগ করতে পারে এবং সে
শক্তি যদি আল্লাহ থেকে ভিন্ন হয়, তবে
এমন (গাইরুল্লাহর) ধারণা শিরক
হবে। আমরা যে কাজ করার ইচ্ছা লাভ করি এবং যে কাজ সম্পাদন করার
শক্তি পাই –তা
আল্লাহ থেকেই আসে। আল্লাহ বলেন, ‘ওয়া
তাশাউনা ইল্লা আউইয়াশা আল্লাহু
রাব্বুল আলামীন’
–অর্থাৎ তোমরা ইচ্ছাই করতে পারবে না যদি আল্লাহ ইচ্ছা না করে
থাকেন।
যা বলা হল তাতে ভুল কিছু থাকলে আল্লাহর
ক্ষমা ও তাঁর আশ্রয় কামনা করি। সব সত্য কেবল আল্লাহই জানেন।
________________________
দ্রষ্টব্য ১, নিচে মন্তব্য সেকশনের 4.1
এ "দ্বিতীয়
আলোচনাঃ যৌক্তিক সমস্যা"
নিয়ে
কিছু গুরুত্বপূর্ণ
আলোচনা এসেছে যেখানে সজ্ঞা ও epistemology
নিয়ে আলোচনা এসেছে। এই অংশও মূল লেখার সাথে জরুরি।
দ্রষ্টব্য ২, এই লেখার বিষয় বস্তুর সাথে নিচের দু’টি লেখার সম্পর্ক রয়েছে, চাইলে দেখা যেতে পারে।
আলো-আঁধারের খেলা
২৫ অক্টোবর ২০১০। আজ সকালে এক বন্ধু আমাকে টেলিফোন করে বললেন টোনি ব্লেয়ারের শ্যালিকা লোরেন বোথ (Lauren Booth) ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। আমি বললাম আমার নিজের চোখে না দেখলে, আর নিজ কানে না শুনলে, আমার পক্ষে তা মানা সম্ভব নয়, (কেননা অনেক মিথ্যা কথা অনেক সময় রটানো হয়)। শেষে এর সত্যতা অবশ্য যাচাই করেছি। তার দুই ঘণ্টা পর, মটরওয়েতে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। হঠাৎ টেলিফোনের সেই আলোচনাটি মনে পড়ল। সাথে সাথে কোরানের আয়াতটিও: إِنَّكَ لاَ تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَـٰكِنَّ ٱللَّهَ يَهْدِي مَن يَشَآءُ وَهُوَ أَعْلَمُ بِٱلْمُهْتَدِينَ "আপনি যাকে পছন্দ করেন, তাকে (চাইলেই) হেদায়েত দিতে পারবেন না। কিন্তু আল্লাহ চাইলে যাকে ইচ্ছা তাকে হেদায়াত দিতে পারেন। তিনিই হেদায়াতপ্রাপ্তদের ব্যাপারে সম্যক অবগত।" ঈমান আত্মার জগতে এক ধরনের ‘রিজক’। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে সেই রিজক দান করেন -এতে অন্য কারো যুক্তি-টুক্তি নেই।
আমার এই সামান্য জীবনে অনেক লোককে ‘বিপথগামী’ হতে দেখেছি, আবার অনেককে ‘হেদায়াতপ্রাপ্ত’ হতেও দেখেছি। হেদায়াত ও বিপথগামীতা মনের জগতের ব্যাপার; আধ্যাত্মিক জগতের ব্যাপার (যদিও এর বহিঃপ্রকাশ নানাভাবে ঘটে থাকে)। এখানে প্রায়তই যুক্তি অক্ষম, জাগতিক প্যাঁচ-প্যুঁচ অক্ষম। এখানে মনের দিগন্তে কোথায় গিয়ে কার জন্য হঠাৎ কী যে খুলে যায়, তা বলা মুস্কিল। কা’বা যদিও একটি কিন্তু তার প্রবেশ পথ অনেক। ধর্মের অনেক গিট হাজার চেষ্টার পরও হয়ত নির্মুক্তই থেকে যেতে পারে। আবার হঠাৎ কোন অসম্ভাবনীয় স্থানে, অন্য কিছু পাঠ করতে গিয়ে বা ঘটতে দেখে, তারই আলোকে কিছু অনুভূতি লাভ করা যেতে পারে, যার আলোকবর্তিকা সেই নির্গূঢ় গিটটি খুলে দিতে পারে। এমন কত কিছু নিজের জীবনে দেখেছি। কখনো দর্শনের মার-প্যাঁচে কোলাকোলি করতে গিয়ে ধর্মের অনেক প্যাঁচ খুলতে অনুভব করেছি। কখনো প্রাচীন কালের ইতিহাস পড়তে গিয়ে, কখনো অন্য ধর্মের বই-পুস্তক পড়তে গিয়ে, কখনো নিরলে নিভৃতে, চিন্তায়, অনেক ধরনের সমাধান দেখেছি। আবার কখনও পথ চলাতে, নিজের অজান্তে, চিন্তার আলোর প্রক্ষেপণ কোথায়ও গিয়ে পড়েছে, আর তারই সূত্রধারায় জটিল কোন অনুভূতি সামনে এসে হাজির হয়েছে; আর সাথে সাথে তার সমাধানও।
যাদের জন্য সে দুয়ার খোলা হয়নি, তাদের অনেককে দেখা যায় সামান্য জিনিস নিয়ে প্যাঁচা-প্যাঁচি করছেন, তাদের ভিতরের জ্বালা প্রকাশ করছেন। কখনো মনে হয় তারা মূলত বিশ্বাসী, কিন্তু কারণ বশত: বিশ্বাস করতে না পারায়, জ্বালা প্রকাশ করছেন। আবার এসবের কোন কিছুই যুক্তিতে আলোচনা করার মত নয়। তবে আমরা কখনো (নিজেদের/মানব জাতীয়) স্বার্থকেন্দ্রিক যুক্তির ঊর্ধ্বে উঠে ‘অস্তিত্বের’ বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে পারলে, কিছু কিছু গিট খোলার সম্ভাবনা আসে। কিন্তু উলটো স্বার্থের যুক্তি আসলে, সে সম্ভাবনা থাকে না। অর্থাৎ আল্লাহ আমাকে ও আমার পরিবারকে বিপদমুক্ত করে বাঁচিয়ে রাখলে আমার ‘বিশ্বাস’ আছে, আর না রাখলে, তিনি আবার কীসের মহান? অথবা তিঁনি যদি ভূমিকম্প ও সুনামির মোকাবেলায় ‘আমাদের’ হাজার হাজার মানুষকে না বাঁচান, তবে তিঁনি আছেন কেমনে? তিঁনি কীসের করুণাময়ী? এখানে ‘আমি’ ও ‘আমরা’ বাঁচলেই বিশ্বাস আর না বাঁচলে নাই –এই হচ্ছে মূল কথা, মূল যুক্তি (?)। কখনো দেখা যাবে ধর্মগ্রন্থ নিয়ে (সব গ্রন্থের কথা বলছি), কটর মটর, তেনা-প্যাঁচানোতে অনেকেই আটকা পড়ে আছেন। অথচ তেনা-প্যাঁচানোর পদ্ধতিগত স্বরূপ থেকে বুঝা যাবে ধর্মগ্রন্থের ভাষার প্রকৃতি বুঝার যে আলোকবর্তিকা বা যে নির্দেশনার প্রয়োজন তা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। সেখানে দেখা যাবে ধর্মগ্রন্থই তাদের জন্য ‘ফিৎনা’হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব জটিলতা দৃষ্টে মুসা নবী (আঃ) বলেছিলেন, ‘এ সবই তোমার (প্রক্ষেপিত) ‘ফিৎনা’ (পরীক্ষা)। এ দিয়ে তুমি যাকে ইচ্ছা তাকে পথ ভ্রষ্ট করো। আর যাকে ইচ্ছা সরল পথ দেখাও। তুমি আমাদের রক্ষক; আমাদেরকে ক্ষমা করো আমাদের উপর করুণা বর্ষণ করো। তুমি সর্বাধিক ক্ষমাশীল (৭:১৫৫)।
মনে রাখতে হবে, আল্লাহ ‘আমাদের টার্মে' ও 'আমাদের সৃষ্ট যুক্তিতে' ধরা দিলে তাকে মানা হবে, আর না দিলে নাই -এমন মনোভঙ্গি নিয়ে তাকে বুঝা মুস্কিল। বরং এই মনোভঙ্গিকে surrender করে 'ঈমান' দিয়েই তাকে ধরতে হয়। আর এক অর্থে এই surrendering-ই হচ্ছে ইসলাম।
কোরানের কোনো বিষয় এমন যে তা প্রতিপক্ষের বিপথগামীতার পথকে প্রশস্ত করতে পারে। ‘আল্লাহ অনেককে এ দিয়ে বিপথগামী করেন, এবং অনেককে সরল/সঠিক পথও প্রদর্শন করেন’ (২:২৬)। আল-কোশাইরীর (মৃঃ ৪৬৫ হিঃ) মতে এই পুস্তক এক সম্প্রদায়ের জন্য (আত্মার) নিরাময় ও প্রশান্তি এবং আরেক সম্প্রদায়ের জন্য (আত্মার) ফিৎনা ও অভিযোগ। এখানে পথভ্রষ্টদের ব্যাপারে ইবন আরাবীর (মৃঃ ৬৩৮হিঃ) মত এই যে তারা ক্বালবের মাক্বাম থেকে বেরিয়ে নফসের মাক্বামে উপনীত হয়েছেন; তারা আত্ম-বৈষয়িক ক্ষেত্রে পথভ্রষ্ট।
লরেন বোথের জন্য দোয়া করি। এ পথে অনেক জটিলতা আছে। এগুলো অতিক্রম করতে হয়। তবে এখানে যারা মুক্ত প্রাণ নিয়ে আসেন ( إذ جاء ربه بقلب سيلم) আল্লাহ তাদের দুর্গম দ্বার অপ্রত্যাশিতভাবে সুগম করে দেন। ‘وَٱلَّذِينَ جَاهَدُواْ فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ ٱللَّهَ لَمَعَ ٱلْمُحْسِنِينَ ‘যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথ দেখিয়ে দেই। (যারা ভাল নিয়তে) সৎকাজ করেন আল্লাহ তাদের সাথেই থাকেন’ (২৯:৬৯)। এখানে ‘সাধনায় আত্মনিয়োগ’ বলতে ‘জিহাদ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। ইবন আরবী এটাকে আত্ম-পথের যাত্রা হিসেবে উল্লেখ করেন।
আল্লাহর এ পথটি কেবল তিনি ছাড়া আর কেউ দেখাতে পারেন না, কোন নবী রাসূলগণও নন। আল্লাহ বলেন:
إِنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَـٰكِنَّ اللَّـهَ يَهْدِي مَن يَشَاءُ ۚ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ [28:56]
"আপনি যাকে পছন্দ করেন, তাকে (চাইলেই) হেদায়েত দিতে পারবেন না। একমাত্র আল্লাহ চাইলেই যাকে ইচ্ছা হেদায়াত দিতে পারেন। তিঁনিই হেদায়াতপ্রাপ্তদের ব্যাপারে সম্যক অবগত।"
এবারে একটি ভিডিও দেখতে পারেন।
Loren Booth speaks about her journey in Islam
Rationality and Religion
It prompts me here to say a few words, just as a way of expressing a stream of thoughts. What one needs to bear in mind is that the issue to prove or disprove the existence of God is not quite within the grasp of rationality. It is not possible to extend truly a rational conversation over ‘things’ which lie beyond our fives sensory knowledge. In Islam this difficult realm is called al-ghaibiyyat: the world of ‘unseen’, included in it are God, angels, heavens, Hells, spirits and the entire caboodle of things that cannot be seen or empirically discussed. Hence, comes the appeal to ‘belief’. If one can believe, fine. If one cannot, that’s fine too, (as nothing can be done about it) and there is no real argument. There is no point quoting any Quranic verses, because the Quran is not yet an authority to the objecting party. The relevance of any religious scripture to anyone, mostly as authority, comes only after they had ‘believed’ in it, not before.
Having said what has been said about belief and reason, it should be said though, that, given careful thought and ponderance over the Heaven and the Earth, belief in God will appear more likely than not and it is this ponderance that religons appeal to, rather than the Greek system of logic.
To my understanding, people’s acceptance of a religion is not overwhelmingly based on logical application of the reading of scriptural texts and thereby deciphering ‘truth’ per se as understood through the five sensory means, but there are other psycho-social elements that lie behind this, (and here the intention is not to discount truth, for such truth dawns in heart-qalb through intuitive mental persuasive inclination ‘received’ differently, which will gradually be clear as we move on). At best when someone says they found the truth in a particular religion, all it appears to mean (outwardly) is that certain enquires sit well with their temperament of mind and convince them of the features as being truth. Let it be said now that there is another dimension of truth which is revealed and not truly the domain of logic. The outstanding question in the former sense will be, how did they know what they know was actually the truth, if it were to be enquired through logical means?
Truth is a difficult concept to define and truth cannot be truly understood, because technically truth is associated with infinity, (though there are certain social ranges of truth as they appear in the use of language). Religions only evoke truth, to be specific, Islam asks its adherents to ‘believe in’ certain things as true without demanding knowledge of them in full. The Islamic creed states, ‘I believe in Allah as He is’, that is a way to avoid an indulgence into something which cannot be known, so as to put it general term. This applies to all ghaibiyyat. Beliefs in certain things as true have mostly utilitarian purposes –living a spiritual, moral life without argumentation in terms of hard-sciences or historically constructed discipline of logic.
As stated, truth per se may present itself with extreme difficulties. Consider what a person can know about water. Rather let’s take the example of a child at a primary school and their knowledge about water. Water to them, at this age, would mean something specifically fixed and known. It is the liquid that quenches one’s thirst and it is necessary for survival. But when they move on to secondary schools studying physics as a subject, the fixed meaning of water can gradually take different clusters of meaning. For they would be exposed to the molecular basics of H2O (water). Moving from this position to graduation and then to Masters, the knowledge would change drastically: the component of water and the reality of it. When a PhD, say, in nuclear science, it would go far deeper into the molecular level with string theory, and light theory (especially as in quantum physics). It would become gradually massive and the field of knowledge will grow wider and wider and the truth about the reality will have have different clusters of meaning. If one were to live another 80 years after their PhDs, and after the years of teaching in universities, they would still find scope to improve on and to expand from the known to the unknown, endlessly. Thus, to understand truth per se, perhaps would require an infinity. The more one lives and the more they study, the more they tend know the reality from different positions. When the nature of truth in science is this complex, what can one expect from the religious text?
Consider the story of Adam. True or false? It is true but not scientific; rather a different type of truth, but behold! some narratives address the incomprehensible, the truth that is larger than life. Art, literature and religion have addressed it in their own ways. Mythical truth can sit comfortably with other forms of truth. Even evolutionism (speculative though it is) doesn’t automatically predicate atheism, because in the scheme of interpreting (the world) it only sits as one among many paradigmatic explanatory schemes, within the chain of causations, and if ever evidences for evolutionism become ‘indisputable’, it would reduce nothing from religion, as for Islam, and other religions, they have ample grounds for accommodating it within the scheme of divine creation, and atheism will not scratch a thing. Truth in Islam, and in some other religions, is part of the spiritual experience and understanding that God vouchsafes directly to the inner disposition, the qalb, which is again within the scheme of divine guidance. And it is part and parcel of the world-vision that lies in faith-Iman.
Rationality and scriptural text
Let us return to the issue of rationality and the Quran. The Quran is ‘a guide for the believers’ (for muttaqun– those who seek a path to live a godly life); its primary role begins only after the declaration of faith i.e. the acceptance of Islam; the text and its purpose is more like the communist party’s monthly magazine, (so to simplify), speaking more to its own readership, telling them what they want to hear and what they ought to hear. The texts of the Qur’an inspired a people during their hours of battle, during conflicts of many kinds, relating to their social situations, addressing their legal issues and of ethics and morality, as well the human conditions of their livelihood, and above all, guiding them to the realm of spirituality. Concerning truth, it approaches the qalb of the believers, their inner hearing, inner sight, their inner disposition of seeing, (and that the gnostics understand) and, here, truth evokes different ranges of strings. And the notes of these strings (so as to say) are so different that they are often beyond the grasp of material construction of reasoning. Truth has a different realisation in faith; it has its own story, from the means of its own of seeing. This said, knowingly that our seeing of the world is relative to the means and positions. Science only tells one story about the world, the story based on instrumental observation with utilitarian paradigm and ideology of knowing.
Knowing about ‘being’ through faith, through inner eye, through the means of meticulous observation and of pondering, has its own rationale, own logic, own grasp. It is only within faith that people gradually come to understand it. The things of the unseen (ghaibiyyat) may reflect in their inner seeing and that will not be understood or discussed through the five sensory logic. They are two streams of understandings perhaps like the flow of sweet and salt water, running side by side yet remaining distinct from each other. The inner ambient of faith is different and so its knowing. The believer knows that certain things cannot be explained in any other ways than the way as it comes through wahi-revelation.
Now let us reflect on the things that have been said about the molecule, its internal behaviour, its consistency in terms of gravitation and lack of gravitation and bring this complex knowledge to laity. Will it be easy to relate to them? If a seven years old asked a nuclear physicist what water was, is it likely that he would give a molecular explanation to him or an explanation suitable for him to understand? Muhammad (pbuh) did not claim to be a scientist or a logician or/and in this persuasion did not bring a scientific text for the people to build NASA centres across the world. Nor did he bring a text with principles/theories of logic for his adherents to challenge everyone who opposed. He claimed to be a prophet and preached a message of spirituality, guiding the way which couldn’t be found otherwise. His received text was rich in metaphoricity, allegory, mythical understanding of the past people, how they made sense of the world around them: all of which informed them of how best to conduct themselves in this world and live a godly life. The reading of the revealed text is not simple, (though in patches they may be, but not all across). The reading requires a range of skills and knowledge. As revealed in the seventh century and in Arabic, it is important to have good grasp of the Arabs’ perception of life, religion and spirituality, as well as what myths and allegories worked around their spiritual understanding and how the social relationships intertwined. A text is interrogated for its meaning within its own discursive system and domain, and within its historicity. For all texts are context bound, occurring within specific time and space.
The fierce debate
It appears the atheists here are not in listening mood, but bent on the zeal to annihilate religious belief all together. In face of this a few of the religious are desperately trying to counter them with a rationale defence. I suggest the believers remain calm. It may be of comfort to them hearing that something which was not based wholly on rationality, cannot be undone by rationality either. There llies complexity in the the process and nature of it. Faith and spirituality are a kind of knowledge in their right, not comparable to many other forms of knowledge. There is no need to jump on the rational wagon. No need either to be apologetic. Let everyone believe what they want. Yet the fact remains that the atheists have no escape from ‘belief’, they are but ‘believers’ in the reverse.
Rationality, irretionality and unconscious
Just one more thing on rationality. Our daily life is based on many assumptions and presumptions. If we are to stride every step of our way with rational consideration, our life would be impossible. We are both rationale and irrational animals. Look at our own life. Have we made every decision on rational basis? Have we been consistent throughout our lives? Are our families rationally consistent in their action and behaviours? What about our local government? Is it rationally consistent with all its polities and procedures and the way it conducts the businesses? Does it do what it tells us to do? What about the central government or for that matter the entire world? Consider our unconscious which plays a huge role in our life and it is largely not rational. Our dreams erode the demarcation between the rational and irrational –time and space are often cut across; (you can enter a house [in dream] in Bangladesh and can come out in USA by its back door). Dream influences our life and action too. Ask the psychiatrists. Now, come to religion. Its main concern is spirituality and to live a good, fulfilled life. In an anthropological approach we are social and ‘religious’ animals.
Our great poets and philosophers have addressed the rational and irrational not as a dichotomy but often recognising the existential disposition as part of us and tapping in spiritual understanding from the irrational. This topic can be a theme for a book, but in a few sentences let us consider the statement of the ‘dramatic I’ in the following stanza of the poem Bidrohi composed by the Bengali Poet-Musician Kazi Nazrul Islam. আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ/আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।(I am insane, I am insane/this day I realised myself -the veil is removed). In this, the persona of the poem Bidrohi expresses his knowledge about himself not from the position of sanity (rational) but from its diametrically opposite –insanity (irrationality). Now as insane, he has understood himself. Consider the journey of the persona from his first utterance of ‘বল বীর’ (speak, hero!) and the movement through the end; do we see rationality to progress through and through in the expressions? Of course not. Yet the poem is highly appreciated since its composition.
Rationality is only one element in our many faculties and how mad the aspiration could be to switch off all other ways of exploring the complexities and richness of our existence!
Another Bengali poet philosopher Lalon Shah seeking spirituality through poetry and music strikingly hits the cord in such expression as, সে আর লালন এক সাথে রয়, তবু লক্ষ যোজন ফাঁকরে/আমি একদিনও না দেখিলাম তারে। (He and Lalon live together yet there is a distance of thousands of miles/I have not seen him for once). How profoundly the persona has expressed his spiritual realisation about the One who is beyond his rational enquiry! Nazrul and Tagore’s poems, as well as their songs, contemplate on God in an enriched devotional manner. Until I studied classical music to a humble small limit, I couldn’t truly appreciate some lyrics of Tagore and some Islamic songs (Gajals) of Nazrul. But I noticed that as soon as the lyrics are brought into the play within the format of their appropriate ragas and talas accompanying with instruments, Devi Sharashwati (so as to put it in our neighbours’ expression, as a figure of speech) seems to jump on her feet and there appears a new dimension of meaning. There are many things that we cannot rationalise, but they are there to experience. Certain scriptural texts which demand recital such as the Quran which conveys different layers of meaning at the point of recital. The meaning of the word ‘Qur’an’ is not but ‘recital’. Our existence as human beings doesn’t seem to be totally around the material components –there are but more. Jalauddin Rumi, a Persian poet philosopher, writes in his Mathnawi, ‘rationality will show you the way as your Murshid, but when the inner realisation will hit its mark, it (rationality, the murshid) will take a back seat like a Shaghrid (student) following.’ This is again similar to Nazrul’s crossing the boundary of rational realisation.
The discourse of madness (the irrational) and the contribution to it by Michael Foucault, a post-modernist philosopher who suggests that there is no emancipation from human conditions/bondages and that truly there is no freedom; thus for example, secularism or feminism and all other isms are only other forms of bondages. For Foucault to be free would be ‘not to be’ a rational being. His work contains the Nietzschean idea that there is more to the irrational [madness] than scientific categorisation. This is being mentioned to appreciate the irrational dimension of the human animal. Religion addresses our unconscious, our irrational thoughts, our dreams, our wakeful life. The Quran is not a book showing the way to Mars or Neptune, but the way to the spirit, the soul, the journey of it from here to there -that was the point in my mind when I started to write this.
আত্মহত্যা ও বিশ্বাস
ভূমিকা
কোনো মানুষ কেবল তখনই আত্মহত্যা করতে উদ্যোত হতে পারে যখন তার নিরাশা অত্যন্ত চরমে পৌঁছে; যখন আশার কোনো আলো তার হৃদয়ে অনুভূত হয় না; যখন তার অস্তিত্ব ও সত্তার কোন মূল্যবোধ অবশিষ্ট রয়েছে বলে মনে হয়না। অর্থাৎ যেসব ‘মূল্যের’ ভিত্তিতে সে এতদিন অস্তিত্বে ছিল এবং যেসব ‘মূল্য-বোধের’ সাথে তার সত্তার পরিচিতি ছিল, সেই মূল্যে-নির্ধারিত ‘পরিচিতি’ এখন নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে: এখন তার বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই।এই ছোট্ট প্রবন্ধে ব্যক্তির প্রকৃতিজাত-স্পৃহা ও সামাজিক মূল্যবোধের মধ্যে যে পার্থক্য থাকে, সেই পার্থক্য এবং আল্লাহতে বিশ্বাসের অভাবে মানুষ কেন আত্মহত্যার কিনারায় উপনীত হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করব। প্রবন্ধটি একটু দীর্ঘ হবে, কেননা আমাকে মানুষের সামাজিক ও মানসিক অবস্থান দেখাতে হবে, যে মূল্যবোধের ভিত্তিতে মানুষ সমাজে পরিচিতি লাভ করে তা দেখাতে হবে, তার নানান সংঘাতের স্থান দেখাতে হবে, উৎস দেখাতে হবে এবং এক্ষেত্রে বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের স্থানও দেখাতে হবে।
প্রথমেই বলে রাখি ‘আশা’ হচ্ছে ঈমানের প্রধান এক অঙ্গ (আল্লাহর অনুগ্রহের আশা, তাঁর উদ্ধারের আশা)। আল্লাহ বলেন, ‘হে আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না’ (৩৯:৫৩)। আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না’ (৪:২৯)। যখন কেউ আত্মহত্যা করে তখন সে ঈমানের পরিধীর বাইরে গিয়েই করে, অর্থাৎ সে ঈমানশুন্য হয়ে করে। আত্মহত্যাকারী এক ব্যক্তির জানাযা নবী (সা.) পড়েন নি। এতেই ঈমানের সাথে বিষয়টির সম্পর্ক স্পষ্ট হয়। তবে জানাযা করার ফতোয়াও আছে।
বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও পরিচিতি
বিশ্বাস হচ্ছে মানুষকে হতাশা ও নিরাশা থেকে বাঁচানোর এক অতি মূল্যবান বিষয়। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ জীবনে তার পরিচিতি আসে। সমাজ কিছু মূল্যবোধের উপর গঠিত হয় এবং প্রত্যেক ব্যক্তি শৈশব থেকে সেই মূল্যবোধে প্রবেশ করতে থাকে। ভাষাই এর প্রধান বাহন। এই বাহনের মাধ্যমে সম্ভবত আড়াই থেকে সাড়ে তিন বৎসর বয়সেই তার ‘আমিত্ব’ (I-ness), অর্থাৎ তার নিজেকে আলাদা-সত্তা হিসেবে অনুভব করতে শুরু করে। সে অন্যদের থেকে আলাদা, তার আলাদা একটি নাম আছে –এই বুঝ পেতে থাকে। কিন্তু এই আমিত্বটাও বহুলাংশে সামাজিক (সেটা দীর্ঘ আলোচনা বিধায় আপাতত এক পাশে রাখা যাক)। সামাজিক সিস্টেমে পর্যায়ক্রমিকভাবে প্রবেশের সাথে সাথে সে সামাজিক মূল্যবোধকে আত্মস্থ করে।বয়সের সাথে সাথে ব্যক্তির অস্তিত্বের অনুভূতি ও তার সামাজিক মূল্যবোধের অনুভূতি নিবিড় হতে থাকে। এই মূল্যবোধের ভিত্তিতে তার নৈতিক-জীবন গড়ে। এই গড়ার মধ্যে নিহিত থাকে সমাজের আদর্শ। এটি তারই আদর্শ হয়। এরই সাথে নিজের আত্মপলব্ধি ও সচেতনতা অনুভব করে। তার পরিচিত ব্যক্তিবর্গ তাকে তাদের সংশ্লিষ্ট বিশ্বাস, কর্ম ও আদর্শের সংযুক্তিতেই চিনে থাকে। সমাজের সাথে সম্পর্কিত পরিচিতি ব্যক্তির সত্তাগত হয়। কিন্তু তার বায়োলজিক্যাল প্রকৃতি এবং সমাজ-সৃষ্ট-পরিচিতি (নৈতিকতা, মূল্যবোধ ইত্যাদি) প্রধানত এমনভাবে জড়িত নয় যেভাবে বীজের সাথে বীজের সত্ত্বার সম্পর্ক। ভাল এবং মন্দের ব্যাপার মূলত আপেক্ষিক। তবে, কিছু মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই যেন ভাল হয় এবং কিছু খারাপ -এটা লক্ষ্য করা যায়। ভাল লোক ভাল কাজ করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে। এটা যেন তার প্রকৃতিতে লেখা' বা সহজাত। কিন্তু এই দিকটি আবার অন্য ধরণের আলোচনার আহবান করে। কিন্তু আমরা শুধু সামাজিক গঠন-প্রকৃতিতে যে মানসিকতা ও সত্তাজাত পরিচিতি আসে সেখানেই থাকতে চাইব।
সামাজিক নৈতিকতা ও পরিচিতি
আল্লাহ মানুষের সমাজিক জীবনকে শৃঙ্খলে আনতে এবং ব্যক্তি ও সমাজের নিরাপত্তা বিধান করতে নৈতিকতার এহসাস দান করেছেন। ভাল কাজ করতে এবং মন্দ থেকে দূরে থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। এটাই হয়েছে ভাল মন্দের রূপরেখা। আল্লাহর আদেশ নিষেধের আলোকে মানুষ ভাল-মন্দের বিষয়টিকে আরও প্রশস্ত করেছে। ভাল-মন্দের পিছনে বৈক্তিক ও সামাজিক ন্যায়-পরায়ণতা, সামাজিক সুশৃঙ্খলতা ও নিরাপত্তার বিষয় স্থাপন করেছে। এসব জিনিসের কিছু বস্তু আপেক্ষিক এবং কিছু বস্তু চিরন্তন। চিরন্তন শুধু সেই অর্থে যে অর্থে আমাদের মানবতা জাগতিক অস্তিত্বে জড়িত। এখানে যে কথাটি বলা হচ্ছে তার নির্যাস হল ব্যক্তি যে আদর্শ ও মূল্যবোধের সত্ত্বায় নিজের সত্তা উপলব্ধি করে সেই উপলব্ধি ও পরিচিতি তার বায়োলজিক্যাল ‘প্রকৃতি’ থেকে ভিন্ন।মনে করুন এক ব্যক্তির সাথে একটি সুন্দরী, গুণবতী মেয়ের সম্পর্ক হয়েছে। তার মন-প্রাণ এখন ঐ মেয়েটাকে পেতে চায়। বায়োলজিক্যালি তার প্রকৃতিতে এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা তাকে ঐ মেয়েটির সাথে মিলিত হতে স্পৃহা জাগ্রত করছে। তার দেহ-প্রকৃতির প্রজননগত স্পৃহা তাকে সেদিকে টানছে। কিন্তু এখন তার পরিচিতি, বৈক্তিক-সামাজিক অবস্থান এবং ঐ মেয়েটির নিজ পরিচিতি ও তার বৈক্তিক-সামাজিক অবস্থান সেই ‘প্রকৃতিজাত-স্পৃহার’ অন্তরায় হতে পারে। এভাবে তার মন অনেক জিনিস চাইতে পারে, যেগুলো ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিতে মন্দ এবং যেগুলো তার ‘পরিচিতির’ প্রতিকূলে। মানুষ এখানেই আটকা পড়ে। এখানেই মানবের জাতিগত (as a species) সমস্যা। চুরি, বদমাশি, রাহাজানি, ডাকাতি: বড় পাপ, ছোট পাপ, গোপন পাপ, প্রকাশ্য পাপ ইত্যাদি।
পরিচিতির সংস্পর্শে প্রকৃতিজাত স্পৃহা ও নৈতিক সংঘাত
মনে রাখতে হবে যে যে সত্তাগত-পরিচয়ে সে সমাজে পরিচিত, এর অতি গভীরে রয়েছে কিছু ধারণা, কিছু বিশ্বাস। অর্থাৎ সে যদি ঐ মেয়েটির সাথে গোপনে মিলিত না হয়, অথবা সে যদি ব্যাঙ্কের টাকাটা আত্মসাৎ না করে, তাহলে এই আত্মসংযতিতে তার সামাজিক পরিচিত অক্ষুন্ন থাকবে। এমন কাজ না-করাতেই তার সামাজিক ও 'বিশ্বাসে-ধারিত ভাল’ নামক মূল্যবোধের বস্তু নিহিত। আর এই ধারিত-নৈতিকতার ভিত্তিতে জড়িত হয়ে তার সত্তার অনুভূতি প্রকাশ লাভ করেছে এবং তার ‘পরিচিতিও’ এর সাথে জড়িত হয়ে আছে। সমাজ ‘জানে’ যে অমুক সেই ‘ভাল’ লোক, সেই গুণে গুণান্বিত –এই মূল্যেই সে পরিচিত। কিন্তু প্রবৃত্তির কাছে ঐ মেয়েটির সাথে শয়ন করা এবং টাকাটা লুট করে নেয়ার পক্ষে হয়ত এখন তার প্রবণতার অধিক ঝোঁক, এটাই তার মনের দিক থেকে ভাল, প্রবৃত্তিগত স্থানে কাঙ্খিত, কিন্তু তা সামাজিক নৈতিকতার ঊর্ধ্বের। সমস্যা -যদি কেউ দেখে ফেলে। অর্থাৎ এটা তার জন্য ভাল যদি না এই কাজটি সমাজের চোখে ধরা না পড়ে! এখানে বিশ্বাসী 'ভাল' ও অবিশ্বাসী 'ভাল' -এর মধ্যে পার্থক্য আসে। বিশ্বাসী তার নিজ প্রবৃত্তির দাবীর প্রতিকূলে গিয়ে 'না-দেখা' খোদার বিশ্বাসে উদ্ভূদ্ধ হয়ে, পরকালে প্রাপ্তির আশায়, সেই মন্দ থেকে নিবৃত্ত হয়, যদিও সামাজিক ভয় আরেকটা বাড়তি উপাদান হিসেবে কাজ করে থাকে।প্রকৃতিগত এবং সামাজিক –এই দুইয়ের সংঘাত এবং মানসিকতার পরিবর্তন
এখানে লক্ষণীয়, ব্যক্তি সত্তার ‘প্রকৃতিগত’ ও ‘সমাজগত’ অনুভূতির মধ্যে যে সংঘাত থাকে তা বাস্তব এবং চিরন্তন। এর মধ্যে আরেকটি বস্তু জড়িত। প্রথমত ব্যক্তি-মানুষ এক ‘দুর্বল সত্তা’ (‘মানুষকে দুর্বল অবস্থায় সৃষ্টি করা হয়েছে’, ৪:২৮)। মানসিকভাবে তার চৈতন্য বা সজ্ঞা সব সময় একই অবস্থানে থাকে না। সকালে, বিকালে, দুপুরে, রাতে তার চিন্তা-চেতনা বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করে। তার শরীর ও চিন্তা-যন্ত্র তথা মস্তিষ্ক এক নরম বস্তু বা উপাদান। তার শরীর ও মনে সবলতা, দুর্বলতা আসে যায়। সে সর্বদা একই চেতনায় না। নয়। একেক চেতনায় সে একেক ধরণের যৌক্তিতা অনুভব করতে পারে। তাই তার জীবনের ঘটনা এমন হতে পারে যে সে তার দুর্বল মুহূর্তে এমনসব কাজ করে ফেলতে পারে যা তার ব্যক্তি ও সামাজিক পরিচিতির সাথে সাংঘর্ষিক। এটা নানানভাবে ঘটে যেতে পারে: জেনে-শুনে, বেখেয়াল-বশত, প্রবৃত্তির তাড়নায় ইত্যাদিতে।মানসিক বন্দীদশা, পরিচিতির তিরোধান ও আত্মহতা
কোন ব্যক্তি যদি এমন কিছু অনৈতিক/নেতিবাচক কাজে জড়িয়ে পড়ে (যা অতি স্বাভাবিক) যা তার পরিচিতির সাথে সাংঘর্ষিক এবং সেই কাজ যদি তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলে এবং যদি সেই বিজড়িত অবস্থা ব্যাপক জটিলতার সৃষ্টি করে, তবে সে এক সময় নিজেকে উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবেলায় ‘বন্দী’ হিসেবে দেখতে পাবে।সে জানে তার কাজ সমাজে প্রকাশ পেলে তার ‘পরিচিতি’ নিঃশেষ হয়ে যাবে। এই অবস্থায় তার চোখ যেদিকে প্রসারিত হবে সেদিকেই সে হয়ত মুক্তির দরজা বন্ধ দেখতে পাবে। এখানে হয়ত কিছুকাল বিমর্ষ (depressed) থাকবে, তারপর কোনো এক চরম মূহুর্তে ‘আত্মহত্যার’ কথা বিবেচনা করতে পারে। এই পর্যায় হচ্ছে চরম ‘নিরাশার’। অর্থাৎ তার সামনে আশার কোন আলো নেই। সে যে সত্তা ছিল তা বিলীন হয়ে গিয়েছে: মৃত্যুই তার কষ্ট থেকে নিবৃত্তির একমাত্র পথ। আত্মহত্যার মুহূর্তে মানুষ ঈমান-শূন্য থাকে।
আল্লাহ-নির্ভরশীলতা, আশা ও জীবন
ঈমানকে বুঝার অনেক স্থান রয়েছে এবং আত্মহত্যার স্থানটি হচ্ছে সেই সমঝের এক অতি স্পষ্ট স্থান। এখানে, বিশ্বাসের আঙ্গিনায় জীবন-মৃত্যুর কোলাহল অতি নিকট থেকে দেখা যায় এবং ইতিবাচক বিশ্বাস ও নেতিবাচক বিশ্বাসকে তাদের উন্মুক্তরূপে দেখা যায় -বাস্তবতা এখানেই চিত্রায়িত হয়।বলেছি, আল্লাহতে বিশ্বাস যে কয়টি স্তম্ভে ধারিত তাদের মধ্যে আশা অন্যতম। আল্লাহর উপর আশা রাখা, ভরসা করা, তার উপর চরম মুহূর্তেও আস্তায় ঠিকে থাকা এগুলো হচ্ছে প্রকৃত ঈমান। আগুনে ঢুকেও ইব্রাহীম (আ.) ঈমানদার, পুত্রের গলায় ছুরিকা চালিয়েও (পিতা-পুত্র, ইব্রাহীম-ইসমাঈল [আ].) ঈমানদার। এভাবে, বড় বড় নবীদের এবং অনেক ঈমানদের জীবন কাহিনী ঈমানের দিগন্ত বুঝার প্রেক্ষিত বহন করে। সব সময়, এবং বিশেষ করে, চরম মুহুর্ত্তে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল (নির্ভর) করতে মু’মীনরা দোয়া করে যান। এই মুহুর্ত্তে প্রয়াত কবি মতিউর রহমান মল্লিকের একটি ইসলামী গজলের প্রথম দুটি লাইন মনে পড়ছে:
আমাকে দাও সে ঈমান আল্লাহ মেহেরবান
যে ঈমান ফাঁসীর মঞ্চে ও সংকটে গায় জীবনের গান
আমাকে দাও সে ঈমান আল্লাহ মেহেরবান।।
বিশ্বাসের স্থান মানব প্রকৃতির মূল সমঝ থেকে এসেছে। বিশ্বাসের বই-পুস্তক যেহেতু সাধারণত দার্শনিক ভাষায় ব্যক্ত হয়ে আসে না, (এবং বিশ্বাসের দিক থেকে এর একটা কারণও রয়েছে –সে আলোচনা ভিন্ন) তাই আমরা মানব প্রকৃতির আলোচনা সেই নিরিখে পাই না, পাই ধর্মীয় ভাষায়, আধ্যাত্মিকতার নিরিখে।
বিশ্বাসের শিক্ষা ও আদমের কাহিনী
আল্লাহ মানুষকে বিশ্বাসের দিকে আহবানের সাথে সাথে তার সৃষ্টির মূলকথা বলেছেন -আদম সৃষ্টির কাহিনী বলেছেন। আদম সৃষ্টির কাহিনীকে এমনভাবে ব্যাখ্যা-বর্ণনায় এনেছেন যাতে তার বিশ্বাস ও ধর্ম-জ্ঞান সমৃদ্ধ হয়, বায়োলজি বা অন্য কোনো বিজ্ঞান শিখানোর আকারে নয়। এই কাহিনী-বর্ণনাতে এসেছে আদমের ‘জ্ঞান’ ও তাঁর বিপুল জ্ঞান-সত্ত্বেও তাঁর দুর্বলতা, (‘আমি ইতিপূর্বে আদমকে নির্দেশ দিয়েছিলাম। অতঃপর সে ভুলে গিয়েছিল এবং আমি তার মধ্যে দৃঢ়তা পাইনি’ (২০:১১৫), তাঁর স্মৃতি-বিস্মৃতি। তাঁকে যা না-করা উচিৎ ছিল তিনি তা করে ফেলার কাহিনী। তাঁর প্রকৃতির দুর্বলতা ও সবলতার কাহিনী। তাঁকে যখন বলা হল, 'তোমাকে যা না-করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, তুমি তা করে ফেলেছো।' তখন তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন। তাঁর মনের শান্তি চলে যায়, তিনি অশান্ত, উদগ্রীব হয়ে ওঠেন, মনের জ্বালায় বিদগ্ধ হতে থাকেন। তাঁর ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া বাস্তবে রূপায়িত হয়ে পড়ে। কিন্তু এখন তিনি কী করবেন, তাঁর যে দুর্বলতা সেই দূর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। আল্লাহ তাঁকে প্রথম জ্ঞান দানের পর এবারে দ্বিতীয় জ্ঞান দেন। তাঁর অশান্তি লাঘবের জন্য তাঁকে প্রত্যাবর্তনের (তওবার) পথ নির্দেশ করেন। অর্থাৎ এখানে এই ভুলের প্রতিক্রিয়ায় ও প্রভাবে পড়ে থাকলে হবে না, ভুল হয়েছে হোক। ভুলটাও প্রকৃতিজাত। আমি মানা করেছিলাম, তুমি ভুল করেছো, এখন আমার দিকে প্রত্যাবর্তন কর, আবার ভুল হোক, আমার ফিরে এসো, আবার ভুল হোক আবার ফিরে এসো, তারপর আবার –কিন্তু কখনো নিরাশ হয়ো না (কোরান)। নিরাশ কেবল শয়তানই হয়। শয়তান শব্দের আরেকটি অর্থ হচ্ছে যে চরমভাবে নিরাশ হয়ে গিয়েছে। একমাত্র পথভ্রষ্টরাই আল্লাহর রহমাত থেকে নিরাশ হতে পারে (১৫:৫৬)। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর রহমত থেকে কাফের সম্প্রদায় ব্যতীত অন্য কেউ নিরাশ হয় না’ (১২:৮৭)।আদম থেকে এবং আদমের কাহিনী থেকে আমাদের বিশ্বাসের শুরু। এই কাহিনীতে আমাদের ধর্মের সার-নির্যাস রয়েছে। ইউরোপীয় দর্শনে আমরা (মানব জাতি) যেভাবে আজ পর্যন্ত যত বিদ্যা অর্জন করেছি তা প্রাচীন গ্রিক-দর্শনের, বিশেষ করে প্ল্যাটো/এরিস্টেটলিয়ান দর্শনের, অসংখ্য ফুট-নোট হিসেবে বিবেচনা করতে পারি, তেমনি সকল নবীর কাহিনী ও শিক্ষা আদমের কাহিনীর ফুট-নোটস হিসেবে দেখা যেতে পারে, যদিও অনেক পার্থক্যের স্থান রয়েছে।
বিশ্বাসেই জীবন
আমরা আবার আগের স্থানে ফিরি। বিশ্বাসের সাথে আমরা নিজেদের সত্তার যে পরিচিতি ঘটাই তা সর্বদাই ‘জীবন’ দান করে। সর্বদাই আলো দিয়ে যায়, সর্বদাই ‘নিরাশা’ থেকে মুক্তির পথ দেখায়। প্রত্যহ প্রকৃতি-তাড়িত ভুল থেকে শুদ্ধের ধারণায় নিয়ে আসে। নামাজে যাওয়া বা নামাজ পড়তে যাওয়াতে প্রত্যাবর্তন (তওবা) বুঝায়; এখানে এই অর্থ নিহিত: আদম তুমি ফিরে এসেছো, আবার এসো। তোমার প্রকৃতিতে ভাল-মন্দের রূপরেখা টানা হয়েছে, তুমি ভুলের ঊর্ধ্বে থাকতে পারবে না, তোমার আদর্শ ও বিশ্বাসের স্থানে তুমি সর্বদা ‘পাথরের-মত’ শক্ত হয়ে থাকতে পারবে না, তোমার মস্তিষ্ক-যন্ত্র পাথরের মত (অপরিবর্তীত) নয়। তুমি দুর্বল, তোমার চৈতন্য (সজ্ঞা) দিনে দুপুরে ভিন্ন ভিন্ন মানসিক স্থানে বিচরণ করে, তুমি ভুল করবে কিন্তু শয়তানের মত জেদি হয়ে ওঠবে না। আর প্রত্যেক প্রত্যাবর্তনে (নামাজে, রোজায়, হজ্জে যাকাতে, জিকির আযকারে) বিনয়ী হবে, কেবল আমারই দিকে নিরঙ্কুশভাবে নিবেদিত হবে। অর্থাৎ গাদ্দারি থাকবে না: আমি ব্যাঙ্কের টাকাটা এখন মেরে নেব এবং পরে হজ্জ করে রেহাই পেয়ে যাব, উদ্দেশ্য প্রণোদিত এমন কাজ প্রত্যাবর্তন নয়, এটা শয়তানি। আদমের ঘটনা এমন ছিল না।আদমের বিবরণে মানবিক যে বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পাওয়া যায় সেখানে তাঁর ভুল, তাঁর সংশোধন, তাঁর বিনয়, তাঁর বিশ্বাস ও আনুগত্য রয়েছে –এগুলো ধর্মের যে এহসাস প্রতিষ্ঠা করে সেটাই হচ্ছে আমাদের ধর্ম। আল্লাহ রাসূল (সা.) বলেন, দ্বীন হচ্ছে ‘নাসিহাহ’, অর্থাৎ ধর্ম হচ্ছে বিশুদ্ধ ইচ্ছা, বিনয়, sincerity। এই দ্বীনেই ব্যক্তির মানসিক সুস্থতা, তার নিরাশার মুক্তি, খোদা-নির্ভরশীলতা ও তার আশাবাদ নিহিত। কেবল সেই সমাজই শান্তির সমাজ হতে পারে যে সমাজের ব্যক্তিগুলোর মন সুস্থ, যারা বাবা আদম ও মা হাওয়ার বিনয় ও প্রত্যয়ে নিজেদের জীবন গড়েন -যারা শয়তানের উদ্ধত পথে নয়। মানব জাতির মুক্তি তাই বিশ্বাসে। -সমাপ্ত-
দ্রষ্টব্য:
এই লেখাটির সাথে বিষয়গতভাবে সংশ্লিষ্ট আরেকটি লেখা এখানে রয়েছে, চাইলে দেখতে পারেন। লিঙ্ক: আধুনিক সমাজের শান্তি -বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের বাস্তবতা।লেখাটির প্রথম প্রকাশ: Nov ৭, ২০১২ @ ১৯:২৯
পরিশিষ্ট:
_______________এখানে আলাদা আরেকটি বিষয় সংযোগ করতে যাচ্ছি। একটি ধর্মীয় সমাজের অনেক লোক ও তাদের পরিবার মূলত তাদের ধর্মের সাথে পূর্ণভাবে বা আংশিকভাবে সমন্বিত নাও থাকতে পারে। এতে ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারণ থাকতে পারে। এমন ক্ষেত্রে তাদের জীবনে ধর্ম কেবল ‘ছায়ার’ মতই থাকতে পারে। মুসলিম সমাজের অবস্থা এই দাঁড়িয়েছে যে অনেক মুসলিম দেশের বড় এক অংশ হয়ত নামাজ পড়ে না, অনেকে রোজা রাখে না, হজ্জ করে না, কেউ কেউ মদ খায়, সূদের ব্যবসায় করে। এদের অনেকের জীবনে ধর্ম-কর্মের নাম নিশানাও নাই। এমন মুসলিম সমাজে ইসলাম ধর্মের মূল্যবোধ বুঝার জরিপ চালালে সেই তথ্যে যে মূল্যবোধ আসতে পারে তা আদপে ইসলামী নাও হতে পারে। মুসলিম সমাজের এমন ধর্মীয় অবস্থা যে কেউই চোখ খুললে দেখতে পাবেন। কিন্তু এই দুর্বল পর্যায়ের জনগোষ্ঠীতেও (অর্থাৎ যারা ইসলামী জীবন পদ্ধতি থেকে অনেক দূরে, যারা নামাজ-রোজাহীন) আত্মহত্যা বিষয়ক কোনো চালানো-জরিপে অপরাপর অনেক সমাজের তুলনায় ব্যাপক ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়।
কামাল ও লওয়েন্থাল (রয়্যাল হলোওয়ে ইউনিভারসিটি অফ লন্ডন) কিছু মুসলিম ও হিন্দু যুবক-যুবতীদের মধ্যে একটি জরিপ চালিয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে মুসলিমদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা হিন্দুদের চেয়ে কম। তাদের স্টাডিতে ইনিচেনের (Ineichen, 1998) জরিপ-সিদ্ধান্তের উদ্ধৃতি আনেন এবং উল্লেখ করেন যে হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানরা নৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে বেঁচে থাকতে অধিক যুক্তি দেখেন। তারা এক্ষেত্রে আত্মহত্যার প্রতি ইসলামের নিষেধাজ্ঞার প্রতিফলন দেখেন। তারা হাসান (Hassan, 1983) এর স্টাডি থেকে উল্লেখ করেন যে মুসলমানদের তুলনায় হিন্দুদের পুনর্জন্মবাদের ঐতিহ্য আত্মহত্যার ক্ষেত্রে কম নিবৃত্তিকর। অপর দিকে মুসলিম বিশ্বাসে আত্মহত্যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
তাছাড়া হিন্দুদের ধর্মীয় গ্রন্থাদি মুসলমানদের মত একক নয় (যেমন কোরান)। তাদের স্টাডিতে উল্লেখ করা হয় যে প্রাথমিক বেদিক-যুগে আত্মহত্যার অনুমোদন ছিল, যা পরবর্তী উপনিষদগুলোতে নিষিদ্ধ করা হয় এবং আত্মহত্যায় মৃত ব্যক্তির পরকালীন নাজাত লাভ অস্বীকার করা হয় (Ladha et al, 1996)।
Reference
Kamal, Z and Loewenthal, K.M. (No Date). Suicide Beliefs and Behaviour among Young Muslims and Hindus in the UK. Available: http://digirep.rhul.ac.uk/items/8f0def71-8625-dffa-6164-020f85f5df5a/3/. Last accessed 20 Oct 2012.
আপনি কি সত্যিই শান্তি চান ও
নিজেকে বিজ্ঞানমনষ্ক ভাবেন?
[এখানে উগ্র নাস্তিক যুদ্ধের বোধহীন, মূঢ় কর্মকাণ্ড দেখে বিস্মিত হয়ে কিছু কথা বলা হয়েছে – এই যা।]
-১- নির্মূল করবেন?
আপনি যদি (আপনি যেই হোন) আমাদের সম্প্রদায়ের ধর্ম ও মূল্যবোধকে “নির্মূল” করে আপনার নাস্তিক ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে চান, এবং এই কাজকে “বিজ্ঞান” মনে করেন, তবে আপনাকে কী ভাবব, ‘বিজ্ঞানী’, না ফ্যাসিস্ট? ধর্ম নির্মূল করলেই এই দুনিয়ায় চোর, ডাকাত, লুণ্ঠনকারী, ধর্ষক, হত্যাকারী কেউ থাকবে না; মানুষের মধ্যকার পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, রেষা-রেষি সব দূর হয়ে যাবে, এই দুনিয়া স্বর্গরাজ্য হয়ে যাবে – এটা কেমতে বিজ্ঞান হল? আপনি কিভাবে, কোন গবেষণায় এই বাস্তবতা নিরীক্ষণ করলেন?-২- বিজ্ঞানের নামে?
আপনি, যেই হোন, ইংরেজিতে লেখা কিছু বই-পুস্তকের তথ্য বাংলায় ছাপিয়ে দিলেই কি মহাবিজ্ঞানী হয়ে যান? কী উদ্ভট বাস্তবতা! আর এই মহাবিজ্ঞানের মোকাবেলায় মুসলিম সম্প্রদায় হয়ে পড়েন বিজ্ঞানবিমূখ; তারা নিমজ্জিত হয় কালো আঁধারে? তাই আপনি ‘ধর্মনাশক’ হয়ে এখন স্বর্গ গড়ে তোলবেন? আওয়াজটা যেন ‘অসুরনাশিনী’ বা ‘কলুষ নাশন’ এর মত শুনায়। বিশেষ করে নাস্তিক হয়েও যেখানে অনেকের পৈতৃক ধর্ম ঠিকই থেকে যায়, তখন সমস্যা তো যবনেরই হয়, তাই না? সময় বড় জটিল। কালের চালে আজ বিজ্ঞানবাদী গান তেওড়া তালে বাজছে। অথচ ইউরোপ যখন অন্ধকারের যুগে, তখন এই মুসলমানরাই ছড়িয়েছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো, এদের হাতেই ছিল আলোর যুগ। আজও তারা কি অন্ধ যুগে (age of darkness)? তারা কোন বিজ্ঞান কবে বিসর্জন করল? বিজ্ঞানের কোন শাখায় আপনার বিচরণ যেখানে তারা নেই? এদের ধর্ম, বিশ্বাস ও মূল্যবোধ যদি বিজ্ঞানকে হারাম করে থাকত, তাহলে তারা কি এই ময়দানে বিচরণ করতে পারত? যদি এমনটি না হয়ে থাকে, তাহলে আপনি কেন তাদের জীবন-পদ্ধতি নির্মূল করে আপনারটি প্রতিষ্ঠা করতে চান? জঙ্গিবাদ কোথায় নিহিত?-৩- ধর্মই সকল অনর্থের মূল?
বেশি দূরে না গিয়ে, প্রথম এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ কি ধর্মের জন্য হয়েছিল? এই যে কোটি কোটি মানুষ নিহত হল, কেন? হিটলার তো নাস্তিক ছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধ কি ধর্মের ছিল? নাস্তিকেরা যেসব ইউরোপীয় দেশকে নাস্তিক হিসেবে দেখে তাদের আত্মহত্যা, ধর্ষণ, বিবাহ বহির্ভূত যৌনাচার, ব্যভিচার, সার্বিক অনৈতিকতা, মারণাস্ত্র তৈরির কারখানা, বিশ্ব জুড়ে যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ এবং এসবের মাধ্যমে নিজেদের রাষ্ট্রীয় ইকোনমিকে যুদ্ধমুখী (war economy) করে রাখা, বিভিন্ন দেশে কৌশলে যুদ্ধ বাধানো, অস্ত্র সাপ্লাই – এগুলো কেন? এবং কেনো এগুলো বৃদ্ধি পাচ্ছে? এসবের মধ্যে কি ‘স্বর্গীয়’ ইঙ্গিত রয়েছে? আপনি কি ‘মুক্তমনে’ এসব নিয়ে কখনো চিন্তা করেছেন? কিছু লিখেছেন? প্রতিবাদ করেছেন? কোথায়? [তবে এই পয়েন্টে ইউরোপীয় সমাজের সবকিছু মন্দ বলা হচ্ছে না, বরং নাস্তিক্যবাদীদের সেলেক্টিভ তথ্যের মাধ্যমে নিজেদের ধর্ম প্রচারের স্থানটি দেখানো হচ্ছে, ভালমন্দ সব সমাজেই পাওয়া যায়, সে আলোচনা ভিন্ন। ধর্মতেই যদি সব অশান্তি হত তবে দুই নাস্তিক সমকামীর মধ্যে মারামারির নজির থাকত না, বিচ্ছেদ ও কোর্ট কাসারি করার নজির সৃষ্টি হত না। দুই নাস্তিক পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহের অবস্থান সৃষ্টি হত না, এটাই দেখানো।]এই যে ইরাক আক্রমণ হয়েছিল ওখানে কি সর্বগ্রাসী বিধ্বংসী মারণাস্ত্র (Weapon of mass destruction) ছিল? এটা কিসের যুদ্ধ ছিল? এই যে লক্ষ লক্ষ লোক নিধন হল, এই যে লক্ষ লক্ষ লোক বিকলাঙ্গ হল, লক্ষ লক্ষ বাড়িঘর ধ্বংস হল – কেন হল? সাদ্দাম ও তার বা’স পার্টি কি ধর্মীয় দল ছিল? আজ সেই এলাকা ধ্বংসের লীলাভূমি করে সেই স্তূপের উপর গড়ে তোলা হয়েছে অস্ত্র সাপ্লাই ও যুদ্ধ ব্যবসার আরেকটি বড় কারখানা! এই দেশগুলো কি খিলাফতি দেশ ছিল যেগুলো ভাঙতে হয়েছিল? এখানে ধর্মওয়ালা কারা? এই যেসব নারীরা ইরাক ও আফগান ও অন্যত্র সেক্যুলার বাহিনীর হাতে ধর্ষিতা হল, এই যে চরম নির্যাতন হল, কেন হল? এসব নিয়ে কি ‘মুক্তমনে’ চিন্তা করার সময় হয়েছে?
-৪- কোন ধরণের স্বাধীনতা ও সমাজ?
কারো ধর্ম না বুঝে, ধর্মজ্ঞান অর্জন না করে, তাদের ধর্ম নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, ঠাট্টা-উপহাস, গাল-মন্দ, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, হীন ভাষায় আক্রমণ করা, এসবে মুক্তচিন্তা, বিজ্ঞান, আধুনিকতা কীভাবে সংযুক্ত হয়? এখানে সমাজ ও ব্যক্তি কোথায়? অপরের মূল্যবোধ, স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার নিয়ে গর্হিত আচরণ করতে পারাতে সভ্যতা, না অসভ্যতা নিহিত? আমি মুক্তমনা, বিজ্ঞানমনষ্ক, আলোকিত, আমি বিজ্ঞানী, আপনারা বিজ্ঞানের 'ব' অক্ষরও বুঝেন না, আপনারা অন্ধ, সপ্তম শতকে পড়ে আছেন – এসব কি? কি হচ্ছে? একটি সমাজ নানান জাতের নানান লোক নিয়ে গড়ে। নানান মেজাজ ও পার্থক্যের লোক থাকে। কোথাও, সর্বত্র, কোনো শ্রেণী-গোষ্ঠীর বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের একক ব্যক্তির কথায় উঠাবসা করে না; অধিকন্তু ধর্মীয় আক্রমণে এমন কোনো কঠিন বিষয় থাকে না যে বিশেষজ্ঞ ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না। আপনার নির্মূলকাণ্ড যে সামাজিক ফিতনা সৃষ্টি করতে পারে, এই ‘বিজ্ঞান’ কি বুঝা হবে না? তারপর, সামাজিক জীবনে যে কেউই একান্ত সার্বভৌম নন, একচ্ছত্রভাবে স্বাধীন নন – একথাও কি দেখা হবে না? এখানে তো স্বাধীনতার অনেক মাত্রাকে বাকিদের সাথে শেয়ার ও সমঝোতা করে সামাজিকতা গড়া হয়। আপনি কেন হঠাৎ মহাবিজ্ঞানী হয়ে, বিজ্ঞানের মুখোশ পরে, নির্মূলের যুদ্ধ শুরু করে যুগ যুগ ধরে চলে আসা সামাজিক স্থিতি ধ্বংস করবেন? এটা কোন ধরণের ন্যায়নীতি হবে?-৫- দায়িত্বশীলতার সাথে সর্বরোগের বড়ি বিক্রি করুন
এই মানবের বিশাল সমুদ্রে আপনার কিছু বাণী থাকতে পারে। কিছু পণ্য বিক্রি করার থাকতে পারে। বিজ্ঞানের নামে হয়ত বিক্রি করতে চান। তবুও করুন। তবে পণ্যের গুণ দেখিয়ে করুন। অন্যের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তার পণ্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, তার মানবতা কেড়ে, তাকে গালিগালাজ করে নয়। লক্ষ্য করুন, ধর্ম (ধরুন পণ্য) তো তার যুক্তি ও গুণাগুণ বর্ণনার মাধ্যমে প্রচারিত হয়। এখানে নৈতিক জীবনের কথা, আল্লাহর আনুগত্যে শান্তির কথা, ভাল ও মন্দ কাজে ব্যক্তিক ও সামাজিক পরিণতি, পরকালমুখী জীবনের উদ্দেশ্য, আত্মার পথে চলা, এই জড় জগতের সীমায় নানান প্রতিকূলতায় আল্লাহর সান্নিধ্যের জন্য কষ্ট স্বীকার করে নিজের আচরণ সংশোধন এবং পরিণতে অসীম জীবনের সুখ – এসব কথা আসে।আপনার ধর্ম কী, মূল্যবোধ কী, সামাজিক নিয়ম-নৈতিকতা কী – এসব বলুন। কাউকে নির্মূল না করে স্বর্গ কীভাবে ধরায় ছড়িয়ে পড়বে সে কথা বলুন। কাউকে নির্মূলের মধ্যে বিজ্ঞান নেই, যৌক্তিকতা নেই। অপরের ধর্ম মন্দ হলেই আপনার ধর্ম ভাল হয়ে যায় না। আপনার পণ্য তার আপন “মহৎ” গুণেই প্রকাশ পেতে হবে, শান্তি ও সুন্দর মানব-মনে স্থান পেতে হবে।
আমি ধর্মীয় সমালোচনা বন্ধের কথা বলছি না। আপনি যদি ইসলাম ধর্মের সমালোচক হন, তবে হোন, সভ্যতার আঙ্গিকে হোন; সমালোচনার ভাষা আত্মস্থ করে হোন। এতে সাপও মরবে লাঠিও ভাঙ্গবে না। ইসলামের উপর সমালোচনার বই হাজার হাজার রয়েছে। সেগুলোর পদ্ধতি দেখুন। কিন্তু তা না করে তুমি অন্ধ, তোমার মাথায় ভাইরাস ঢুকেছে – এসব ফাইজলামি বন্ধ করুন। ভাইরাসের উপমাতেই ফ্যাসিবাদ নিহিত। ভাইরাসকে তো নির্মূলই করতে হয়।
-৬- আকাশ কুসুম স্বপ্ন নিয়ন্ত্রণে রাখুন
আপনার স্বর্গ আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে এবং এভাবে অপরের পরকালীন স্বর্গও। অপরকে ধ্বংস করে স্বর্গ গড়ার চিন্তাই নারকীয়। ধর্ম নাশ করলেই মানব জাতির প্রকৃতিজাত সকল ভিন্নতা অভিন্ন হয়ে পড়বে, সমাজ স্বর্গ হয়ে যাবে – এসব বাজে চিন্তা শুধু আকাশ কুসুম, কাল্পনিকই নয়, বরং অবৈজ্ঞানিকও বটে। এটাকেই প্রকৃত "বোকার স্বর্গ" বলা যেতে পারে।
মুক্তমনা ও নাস্তিক মিলিট্যান্সি
সূচনা
আমাদের সমাজে কিছু কিছু লোক নিজেদেরকে ‘মুক্তমনা’
ভাবেন। তাদের দাবি
হচ্ছে তারা নাকি মুক্ত-চিন্তক,
যুক্তিবাদী। তারা ট্র্যাডিশন বা প্রাচীন প্রাতিষ্ঠানিকতা-মুক্ত অথবা এগুলো থেকে
মুক্ত হতে কাজ করছেন এবং মানুষকে
মুক্ত করতেও চাচ্ছেন। তো হঠাৎ করে মানুষের মাথায় কি 'মুক্ত-চিন্তা' এসে হাজির হয়,
না চিন্তা আসলে ঐতিহাসিক,
মানুষের ক্রমান্বয়িক চিন্তার ফল?
যদি তা'ই হয়,
তবে বিষয়টি কী তা দেখা দরকার।
এখানে ‘মুক্তমনা’ হওয়ার যে
দাবি বা বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হচ্ছে আমরা
প্রথমে সেটা বুঝার চেষ্টা করব। প্রথমে ‘মুক্ত’
শব্দটি বিবেচনা করি।
সরল-সহজভাবে বলতে গেলে আমাদের ভাষার সকল শব্দ তাদের বিপরীত ধারণার মোকাবেলায়
অর্থ লাভ করে। ঠাণ্ডা গরমের মোকাবেলায়,
শক্ত নরমের মোকাবেলায়,
সত্য মিথ্যার মোকাবেলায় ইত্যাদি। আমরা যখন বলি ‘মুক্ত আকাশের পাখি’, তখন
‘মুক্ত’ কোন্
জিনিস তা সহজে বুঝতে পারি। আমরা যখন বলি পাখিটি খাঁচায় বন্দী,
অথবা লোকটি এখন রাজার বন্দীশালায় আবদ্ধ, তখন আবদ্ধ, বন্ধন আর মুক্ত অবস্থার কথা বুঝি। উদাহরণের পাখিটি ‘নিজ ইচ্ছায়’ খাঁচায় গিয়ে আবদ্ধ হয়নি
আর বন্দীশালার লোকটিও ‘নিজ
ইচ্ছায়’ বন্দীদশা
গ্রহণ করেনি। এখানে সতত ইচ্ছার
স্বাধীনতা ও অধীনতা প্রকাশ পায়। আমরা যদি বন্দীশালার লোকটির ব্যাপারে বলি, সে এখন ‘মুক্ত’, তখন বুঝি যে এখন তার স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে।
সে এখন যথেচ্ছ বিচরণ করতে পারে। তার কর্মে ইচ্ছার স্বাধীনতা এসেছে;
সে যেখানে সেখানে যেতে পারে। অর্থাৎ এখন সে স্বাধীন:
সর্বাবস্থায় মুক্ত।
কিন্তু যে ব্যক্তি কোন বন্দীশালায়
আবদ্ধ ছিল না, এবং
এখনও নয়, সে
যদি বলে, ‘আমি এখন মুক্ত মানুষ’ তাহলে বুঝতে হবে শব্দের রূপকতা (metaphoricity) ব্যবহার করা হচ্ছে।
এই ধরণের রূপক ব্যবহার অনেক ভাবে করা যেতে পারে। এক ব্যক্তি বন্দীশালার ভিতরে থেকেও বলতে
পারে, "আমি
মুক্ত আকাশের পাখি।" এখানে
শ্লেষাত্মক অথবা ব্যঙ্গাত্মক অর্থও আসতে পারে। এমন ব্যবহার সব
ভাষাতে আছে। আমি
গরীব হয়েও বলতে পারি, "প্রাচুর্যের
মধ্যে ডুবে আছি।" আপনি ‘বদ্ধমনা’ হয়েও বলতে পারেন মুক্তমনা, মুক্ত-চিন্তক। কেননা আপনি নিজের জন্য
যখন কোনো শব্দ
নির্বাচন করেন, তখন
কোন্ শব্দটি নির্বাচন করবেন তা একান্ত আপনার ইখতিয়ারে। আপনার কানা ছেলেকেও নাম দিতে
পারেন ‘পদ্মলোচন’। এতে কারো বলার কিছু নেই।
মনে রাখতে হবে যে কোন শব্দের অর্থ তার
শব্দের ‘ভিতরেই’ নিহিত নয়, বরং অর্থ হচ্ছে সামাজিক, প্রথা-ভিত্তিক, ও সামাজিক convention এর অংশ, (আমরা সবাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত ভাষিক প্রথার ‘ভিতরেই’
থাকি, আমাদের
অর্থ-বিনিময় [communication] এই
প্রথার বাইরে নয়)। আবার ‘অর্থ’ নিছক কোন একটি শব্দ-কেন্দ্রিক নয়, বরং অর্থের-সংযুক্তিতে জড়িত অন্যান্য
শব্দের জিঞ্জিরে (chaining with other words) গোটা
ভাষা ব্যবস্থার (system of language) মধ্যে
পরিব্যপ্ত।
‘মুক্তমনা’ যদি স্বাধীন চিন্তা ও স্বাধীন প্রত্যয়
কেন্দ্রিক হয় এবং এরই
প্রেক্ষিতে যদি এক ব্যক্তি বলে, "আমি
খোদাতে বিশ্বাস করি না," এবং
অন্য ব্যক্তি
যদি তার আপন স্বাধীন চিন্তা-চেতনা ও বিবেক অনুযায়ী বলে, "আমি খোদাতে
বিশ্বাস করি", তবে
উভয়ই মুক্তমনা হওয়া উচিত। কিন্তু,
প্রথম
ব্যক্তি যখন বলবে,
"না,
খোদাকে অস্বীকার না করলে মুক্তমনা হওয়া যাবে না", তখন বুঝতে হবে সেই লোকটির কোন ‘মতলব’
আছে, সে
কুযুক্তি উত্থাপন করছে। তারপর
যখন সে জেদি হয়ে উঠবে এবং তার শেষ কথা হবে, 'আপনি‘খোদাকে
অস্বীকার করলেই মুক্তমনা
হবেন', তখন
বুঝতে হবে, এই
‘মুক্তমনা’ শব্দটি নিয়ে এখন ‘ধাপ্পাবাজি’ শুরু হয়েছে, ভাষার রাজনীতি শুরু হয়েছে। ধাপ্পাবাজ
কোন নির্দিষ্ট
কারণে নিজের জন্য ‘মুক্তমনা’ শব্দটি ব্যবহার করছে। সে তার আপন দাবীর বিপক্ষে স্ববিরোধী (inconsistent) হয়ে ভাব ও শব্দের
এমন ব্যবহার
করছে, কেননা, it cannot be empirically proven that there is no God অর্থাৎ
কোন বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে খোদা নাই বলে প্রমাণ করা যাবে না,
সুতরাং চোখ বন্ধ করে খোদাকে অস্বীকার করলেই মুক্তমনা হওয়া যায়
না। বরং
এক বিশ্বাস থেকে আরেক্ বিশ্বাসে যাওয়া হয় মাত্র।
আবার মুক্তমনা হতে হলে পূর্ববর্তী সমাজ
সভ্যতা, আচরণ, বিশ্বাস সব কিছুতেই ‘সন্দেহবাদী’ হতে হবে,
প্রথাগত বিষয় (tradition)
সমঝে না এলেও
বর্জনের জন্য আহবান জানাতে হবে এবং আক্রমণাত্মক হতেই হবে, এটা না হলে হলে ‘মুক্তমনা’
হওয়াই যাবেনা –
এমন দাবি যখন কোন লোক করবে,
তখন সে ব্যক্তিকে
মুক্তমনা না বলে বরং ‘বক্রমনা’ই বলা যেতে পারে। বক্রমনা যদি 'সন্দেহবাদী' হতেই হয়,
তবে তার নিজ ঘর থেকেই শুরু করতে পারে। সে তার নিজ মা-বাপের সন্তান
কি-না এটাও সন্দেহে আনতে হবে, ব্যক্তির
identity-এর
মূল স্থান এখানে।
তাকে প্রথমে DNA টেস্ট
দিয়ে শুরু করতে হবে। তারপর, তার
পরিবারের সবার, তার মা-বাপ সহ। পরিবারের সয়-সম্পত্তি
দেখতে হবে। তার পিতা-প্রপিতা
ঘুষ ও চুরির মাধ্যমে ধন-সম্পদ অর্জন করলো কি-না তা দেখতে হবে। সম্ভাব্য
অসত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করলে সে তার নিজের সাথেই প্রতারণা করবে, তাই
এগুলো তার জানা চাই। ভাল কাজ ঘর থেকে শুরু
হওয়া উচিত। এগুলো সন্দেহবাদী
ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিসহকারে অনুসন্ধান
চালানো দরকার। ধর্ম তো অনেক পরে আসবে।
অতঃপর ‘নিজ-জ্ঞানের’ প্রেক্ষিতের উপর সন্দেহবাদী হতে হবে। সে
যা জানে তা কীভাবে
জানে – এই
’নিশ্চয়তায়’ উপনীত হতে হবে। এটা হচ্ছে দর্শনের মূল স্থান।
কোন ব্যক্তি তার নিজের ‘জ্ঞানের’ স্থান স্পষ্ট হওয়ার আগেই অপরকে সন্দেহবাদী
বানানোর ধৃষ্টতা না দেখালেই ভাল।
মূল কথা হচ্ছে এক ব্যক্তি যদি কোন
ব্যাপারে ‘সন্দেহ’ পোষণ করে,
তবে অপর
ব্যক্তি সেখানে ‘সন্দেহ’ নাও করতে পারে, উভয়ের পক্ষে/বিপক্ষে যুক্তির এবং অযুক্তির
স্থান থাকতে পারে। কেননা, উভয়ের
দেখার প্রেক্ষাপট, দেখার
থিওরি, ভিন্ন
হতে পারে। ভাষা-বিজ্ঞান, দর্শন, সমাজ বিজ্ঞান ইত্যাদিতে এভাবে ভিন্নতায়
দেখার প্রেক্ষিত উপস্থাপন করে। আপনার কাছে যা সন্দেহজনক, আমার কাছে সেই সন্দেহ নাও থাকতে পারে, কেননা আমি বিষয়টি অন্যভাবে দেখে নিয়ে থাকতে
পারি, আপনার
মতো নয়। কিন্তু আপনার সন্দেহবাদকেই আপনি যখন আমার উপর চাপিয়ে দেবেন এবং আমি তা মানতে না
পারলে, আপনি
আক্রমণাত্মক হয়ে উঠবেন, এমনটি
হচ্ছে অসভ্য লোকের কাজ, ইতর
প্রকৃতির কাজ, হিটলারের
কাজ। হিটলারের দলও
নিজেদেরকে মুক্তমনা ভাবতো, হিটলার
নাস্তিক ছিল, যুক্তিবাদ
ও বিজ্ঞানবাদের
ভিত্তিতে উন্নত সমাজ-সভ্যতার কথা বিবেচনা করত।
অন্ধ বিশ্বাস
মুক্তমনাদের খেলা হচ্ছে ভাষিক ডিগবাজি:
প্রতিপক্ষকে নেতিবাচক ব্যাখ্যায়
আনা। ধাপ্পাবাজ নিজের জন্য ‘মুক্তমনা’ শব্দ নির্বাচন করে যখন বলে উঠবে, "আমার আস্থা
মুক্তবুদ্ধিতে – অন্ধবিশ্বাসে
নয়", তখন
রাজনৈতিক ধাপ্পাবাজদের কথা
স্মরণ করা যেতে পারে। রাজনৈতিক অঙ্গনে ধাপ্পাবাজি অনেকটা বেশি স্পষ্ট হয়ে
ওঠে, বক্তব্যের
উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে দেখা যায়।
এখানে এই ক্ষুদ্র বাক্যাংশ (phrase), ‘অন্ধ বিশ্বাস’-এর ভাষিক ব্যবহার কীভাবে সমঝের স্থানকে (place of perception) এক জায়গা থেকে অন্য
জায়গায় নিয়ে
যাচ্ছে – তার
প্রতি লক্ষ্য রাখুন। এখানে ‘অন্ধ’ শব্দটি বিশেষণের বাইরে গিয়ে metaphor হয়ে কাজ করছে এবং এই
ব্যবহারের মাধ্যমে ধারণার
মূলবস্তুকে লক্ষ্যচ্যুত করা হচ্ছে, যুক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। অন্ধ রূপকতা
(metaphor of blindness) উত্থাপনে
চিন্তার লক্ষ্য রূপক বস্তুর দিকে
নিবিষ্ট হচ্ছে,
সংশ্লিষ্ট হচ্ছে এবং এই রূপকতার সাথে জড়িত অর্থ-চিত্র (picturesque meaning) ধারণায়
উপস্থিত হচ্ছে। কেউ যখন বলে ‘লোকটা কুত্তামনা’ তখন প্রবক্তা অপর ব্যক্তির মানবতাকে
চূর্ণ করে তার বক্তব্যের স্থান
তৈরি করে। কাউকে প্রথমেই অন্ধ-বিশ্বাসী আখ্যায়িত করে তার মানবীয় চিন্তাশক্তিকে
বিকলাঙ্গ হিসেবে দেখিয়ে, (আক্রমণাত্মক
হয়ে), নিজের বক্তব্যের
স্থান তৈরি করা হয়। মুক্তমনার ধাপ্পাবাজ প্রবক্তারা এভাবেই ভাষার ব্যবহারে তাদের নাস্তিক-ধর্মের
প্রচারণা চালাবার প্রয়াস পায়। এটা
মূলত শাব্দিক অর্থের মুক্তমনা-বৈশিষ্ট্য বহন করে না, ধাপ্পাবাজ মানসিকতা বহন
করে।
এবারে চিন্তা করুন, যে লোকটি প্রথমে নিজের জন্য ‘মুক্তমনা’
শব্দটি
নির্বাচন করল, তারপর
যখন খোদাতে বিশ্বাসীদের মোকাবেলায় তার অবস্থানকে
'চাক্ষুষ' এবং
অন্যের অবস্থানকে ‘অন্ধ’ শব্দে আখ্যায়িত করল, তখন তার ভাষিক আচরণ ও ব্যাখ্যার প্রকৃতিও অনেকটা
স্পষ্ট হল। সে তার
এই বৈশিষ্ট্যই সর্বত্র
প্রকাশ করবে, তার
ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে এর রূপায়ন ঘটাবে। এমন লোক বিশ্বাসযোগ্য নয়। যাকে সে অন্ধ বলছে, সে তার নিজ ‘বিশ্বাসের’ আলোকে তা করেছে,
এটা তার নিজের দেখা ব্যাখ্যা,
কিন্তু তার বক্তব্যের বাইরে বাস্তবতা ভিন্ন। অধিকন্তু, সে অপরকে তার নিজ-মতো সংজ্ঞায়িত করছে, হীন করছে। তার বিশ্বাসের প্রচারের জন্য ‘মুক্ত’
শব্দটি বেছে নিয়ে অপরকে 'অন্ধ' আখ্যায়িত করছে। সে যা করছে, সেটা তার "ধর্মীয়" কাজ। সে
আরেক ধরণের "ধর্ম-ব্যবসায়ী"।
সে মূলত পদ্মলোচন। শাব্দিক ব্যবহারের নব্য-ম্যাজিক দেখিয়ে তার ধাপ্পাবাজি প্রতিষ্ঠা করছে।
ভাষার শব্দ সম্ভার থেকে যেগুলো
পজিটিভ সেগুলো তার নিজের জন্য এবং যেগুলো নেগেটিভ সেগুলো
প্রতিপক্ষের জন্য নির্ধারণ
করছে। প্রতিপক্ষের বিশ্বাস “অন্ধ”, আর তার নিজের বিশ্বাস চাক্ষুষ (আলোকিত)! হায় চাতুর্য! কী যে তার খেলা!
লক্ষ্য রাখতে হবে, সে
কীভাবে arbitrarily “অন্ধ” বিশেষণটি অপরের সাথে জুড়ে দিয়েছে। “খোদা নাই”
– এটাও তো
যুক্তিতে প্রমাণিত নয়, empirically-ও
প্রমাণিত নয়, তাহলে নাস্তিক্যবাদও
তো সাক্ষাৎ “অন্ধ” হতে পারে।
নতুন বোতলে আরেক ধর্ম
মুক্তমনারা তাদের নতুন ধর্মকে পুরাতন
ধর্মের মোকাবেলায় ভাষার মারপ্যাঁচ
ও রূপকথায় সাজাচ্ছে: বোতলটা নতুন। মানুষকে এভাবে তাদের
নব্য-ধর্মে ‘শিকার’ করতে চায়। মুক্তমনা হতে হলে নাকি বংশ
পরম্পরায় যা আসে তাকে অস্বীকার
করতেই হবে। কোথাও যদি কোন আপ্তবাক্য থাকে যেমন,
আল্লাহ ছাড়া কোন
উপাস্য নেই, তা
অমনিই উড়িয়ে দিতে হবে। কেননা এটা বংশ পরম্পরায় চলে এসেছে। কিন্তু কথা হল কোন আপ্তবাক্যিক
ধারণা/বিশ্বাস যদি বংশ-পরম্পরায় এসে
গিয়ে থাকে, তাহলে
সেটাকে কী অবলীলায় পরিত্যাগ করতেই হবে?
এক শ্রেণীর
ধারণা পরিত্যাগ করে অন্য শ্রেণীর ধারণা গ্রহণ করাতে, অথবা এক গ্রুপের বিশ্বাস ও আদর্শ বর্জন করে অন্য গ্রুপের
বিশ্বাস ও আদর্শ গ্রহণ করাতে “মুক্ত-ধারণা” আসে কীভাবে? কোন 'স্বাধীন
ব্যক্তি' খোদাতে
বিশ্বাস করলেই তার ব্যক্তি
স্বাধীনতা হারিয়ে বসে? এটা
তো নীরেট ধাপ্পাবাজি।
মুক্তমনারা কম্পিউটারের উপমা দিয়ে বলতে
চায় বিশ্বাসীদের মাথায় নাকি
ভাইরাস ঢুকেছে,
কিন্তু এই স্থানেও তারা তাদের ইচ্ছেমত অপরের উপর নিজেদের নির্বাচিত
‘শব্দ’ আরোপন করছে। তারা নিজেরাই যে ভাইরাসে
আক্রান্ত হয়ে গিয়েছে তাদের
প্রতিপক্ষও তাই বলতে পারে এবং এর পিছনে যুক্তিও থাকতে পারে। বলা যেতে
পারে যে প্রচলিত হাজার হাজার বছরের সামাজিক প্রথায় তারাই ভাইরাস।
এই মুক্তমনাদের আরেকটি হাস্যকর বক্তব্য
হচ্ছে তারা নাকি “বিজ্ঞানমনষ্ক”। অন্যরাও
বিজ্ঞানমনষ্ক হয়ে, “সংশয়ী” দৃষ্টিকোণ দিয়ে, মিথ ও অতিকথাকে বিশ্লেষণ করতে হবে। কিন্তু বিশ্লেষণের
পরে কেউ খোদায় বিশ্বাসে উপনীত হতে
পারবে না, কেননা
সেই সিদ্ধান্তের বিপরীতে গেলেই সর্বনাশ –
আপনি মুক্তমনা
থাকতে পারবেন না! বলতে হয়,
হায়রে ঢেঁকি! তুমিও কি ‘অনার্য’?
যুক্তি বটে, মুক্তমনা বটে!
বঙ্গাল মুক্তমনারা নিজেদের জন্য
সংজ্ঞাগত কিছু প্রশস্ততা খুঁজছে। তাদের
সংজ্ঞাতে, “নাস্তিক
(atheist), অজ্ঞেয়বাদী
(agnostic), সংশয়বাদী (skeptic), মানবতাবাদীদের (humanist) সবাইকে সাধারণভাবে ‘মুক্তমনা সদস্য’ হিসেবে গণ্য করা হয়।” [১]
এখানে যাদেরকে সাধারণভাবে (generally) ‘মুক্তমনা’ ধারণার সাথে সংযুক্ত করা
হয়েছে তারা (অজ্ঞেয়বাদী/সন্দেহবাদী ও নাস্তিক মহল), ‘সাধারণভাবে’ মুক্তমনার প্রত্যয় ও দাবীতে নেই। ফুকোঁ
(Michel Foucault), লিয়োটার্ড, (Jean-François Lyotard), হাইডেগার
(Martin Heidegger), রোরটি
(Richard Rorty), ডেরিডা
(Jacques Derrida) এবং
এমন আরও অনেক পোস্টমডার্ন দার্শনিক
রয়েছেন যাদের কেউ অজ্ঞেয়বাদী,
কেউ নাস্তিক কিন্তু ওরা এনলাইটনম্যান্টের (বিজ্ঞানবাদ ও যুক্তিবাদের মাধ্যমে মানব
জাতির সব সমস্যার সমাধানের চিন্তা,
বা তাদের যুক্তিতেই মুক্তি,
বিশ্বাসীরা যুক্তিহীন,
ভাইরাস-মস্তিষ্কসম্পন্ন
ইত্যাদি) metanarrative
থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ফুকোঁ মুক্তিবাদের (emancipation) বক্তব্যে বিশ্বাসই
করতেন না, বরং
প্রত্যেক emancipatory বক্তব্যকে
এক ধরণের শৃঙ্খল থেকে আরেক ধরণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হওয়ার আহবান মনে করতেন।
রোরটি এগুলোকে ভাষার খেলা মনে করতেন (দেখুন Contingency,
Irony, and Solidarity)। তার কাছে এগুলো এক শ্রেণীর শব্দমালার
মোকাবেলায় আরেক শ্রেণীর
শাব্দিক ব্যবহারের যুদ্ধ। সুতরাং এখানে সাধারণভাবে অজ্ঞেয়বাদী ও নাস্তিক্যবাদীদের
‘মুক্তমনা’র দর্শনে টানাো এক ধাপ্পাবাজি। কেননা, সবাই কিন্তু এই মুক্তমনাবাদী সপ্তদশ/অষ্টাদশ
শতাব্দীর এনলাইটনম্যান্টের চিন্তায়
নেই, সেই
মেটানেরেটিভ এখন
মৃত। (তবে এক গোষ্ঠী যে এটাকে ধরে রাখতে চাইবে না,
তা নয়)।
এখন একদল গোঁড়াপন্থি-নাস্তিক অপরের
ধর্ম নিয়ে ক্যাট-ক্যাট, ঘ্যাঁট-ধ্যাঁটেই
আবদ্ধ, যারা
বিশ্বের প্রচলিত ধর্মগুলোকে উড়িয়ে দিয়ে এই জগতে মানব-স্বর্গ রচনা করতে চায় এবং এই
উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব/বিদ্বেষ
ছড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের মিলিট্যান্ট কর্মকাণ্ডে বিষ্শ্বের সকল নাস্তিক ও অজ্ঞেয়বাদী
জড়িত নন। আমাদের অনেক শিক্ষক, সহপাটি ছাত্র, কর্মজীবনে অনেক লোকের মধ্যে নাস্তিক ও
অজ্ঞেয়বাদী দেখেছি কিন্তু
তাদের কাউকে মুক্তমনা প্রত্যয় ও কর্মে দেখিনি, কোন উগ্রতাও দেখিনি। সুতরাং ‘উগ্র-বঙ্গাল-গোঁড়া-নাস্তিকরা’ সকল অজ্ঞেয়বাদী ও নাস্তিককে এক ভাবা তাদের
চিন্তার সীমাবদ্ধতা নির্দেশ করে। এই মুক্তমনা নামের উগ্রপন্থিরা সমাজে যতটুকু
সাম্প্রদায়িক সু-সম্পর্ক রয়েছে, সেই
অবশিষ্ট শান্তিটুকু নস্যাৎ
করে দিতেই ধর্ম-বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। এরা নাস্তিক মৌলবাদী।
ধার্মিক কি মুক্তমনা
হতে পারে?
ধার্মিক কি মুক্তমনা হতে পারে? না,
এটাই মুক্তমনাদের উত্তর। তাদের দৃষ্টিতে যে ব্যক্তি আল্লাহতে বিশ্বাস
করবে সে মুক্তমনা হতে পারবে না। কেন?
এই প্রশ্নটির উত্তর দিতে তারা যে যুক্তির কসরত করে, (হাসি সম্বরণ করে) সেই কসরত
দেখা যাক। এই নিচের “যুক্তিটি” মুক্তমনা সাইটের পরিচিতি থেকে গৃহীত [1] )। বিষয়টি স্পষ্ট করতে স্কয়ার বন্ধনীর
ভিতরে নীল রঙের লেখায় আমার নিজের কথা সংযোগ করেছি ও আন্ডারলাইনিং ব্যবহার করেছি।
কোন ধার্মিক যদি মুক্তমনে তাঁর
ধর্মবিশ্বাসকে বিশ্লেষণ করতে পারেন,
তবে তাঁর নিজেকে মুক্তমনা বলতে আপত্তি
থাকার কথা নয়। [লক্ষ্য করুন
বিশ্বাসকে ‘বিশ্লেষণ করতে পারাকেই’ ‘মুক্তমনা’ বলা
হচ্ছে। বিশ্লেষণের ক্ষমতাই কি সঠিক যুক্তি? তারপর এখান থেকেই পরবর্তী
কুযুক্তি লক্ষ্য করুন]
কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই
তাঁরা তা না করে নিজের ধর্মটিকেই আরাধ্য মনে করেন,
কোন কিছু
চিন্তা না করেই
নিজের ধর্মগ্রন্থকে
‘ঈশ্বর-প্রেরিত’ বলে ভেবে নেন [এখানে অন্যদের উপর নিজ ধারণা প্রক্ষেপণ করা হচ্ছে। ওপিনিয়ন এবং
প্রেজুডিস প্রকাশ পাচ্ছে।
তারপর, তারা বুঝি কোনো চিন্তা ভাবনা
ছাড়াই নিজ ধর্মকে ঈশ্বর প্রেরিত মনে করেন? কীরে পণ্ডিত! কী হচ্ছে এসব? তারপর, বিশ্বাসীর
চিন্তা-ভাবনা যে কোনো
যৌক্তিক, ভাষিক ও দার্শনিক পথ অতিক্রম
করে আসেনি – এটা কিভাবে জানা হল?
কী হচ্ছে ? এখানে
শুধু হেয়ালিভাবে বাক্য রচনা হচ্ছে!]
স্রেফ ঘটনাচক্রে
[?] পৈত্রিক-সূত্রে
পাওয়া যে ধর্মটিকে ‘নিজের’ বলে মনে করেন সেটাকেই ঈশ্বরের মনোনীত
একমাত্র ধর্ম বলে বিশ্বাস করেন।
[স্রেফ? তারপর, পৈত্রিক সূত্রে কিছু পেলেই কী তা বর্জনীয় হতে হবে? নাস্তিকতাবাদের ধারণা কী মুক্তমনারা নিজেরাই প্রবর্তন করেছে, না তারা
অন্যের সূত্রে তা পেয়েছে? এখানে মুক্তমানাদের যুক্তিহীনতাই প্রকাশ পাচ্ছে। এখন কথা হচ্ছে, বিশ্বাসকে
‘বিশ্লেষণ করতে পারার
পরও তা ত্যাগ করতে হবে! এখানে
তাদের নিজ খোঁড়া যুক্তিই বড় সমস্যা।] আমাদের মতে কোন ব্যক্তি শুধুমাত্র শোনা [শুধুমাত্র শোনা কথা?] কথার ভিত্তিতে বাইবেল, কোরান বা বেদকে অন্ধভাবে [অন্ধভাবে!] অনুসরণ
করে, বা নবী-রসুল-পয়গম্বর-মেসীয়তে
বিশ্বাস করে নিজেকে কখনোই ‘ফ্রি
থিঙ্কার’ বা মুক্তমনা
বলে দাবি করতে পারেন না।
[কিন্তু অন্ধভাবে খোদা-নাই বললে সে মুক্তমনাই থেকে যাবে?] মুক্তমনাদের আস্থা
তাই বিশ্বাসে নয়, বরং
যুক্তিতে [১]। [এখানে যুক্তিহীনতা দারুণভাবে
প্রকাশ পেয়েছে। এই প্রকৃতির লোকই হচ্ছে যুক্তির দাবীদার!]
এই প্যারাগ্রাফটি মুক্তমনাদের যুক্তির
একটা নমুনা হিসেবে নেয়া যেতে
পারে। প্রথমে “কোন
ধার্মিক যদি মুক্তমনে তাঁর ধর্মবিশ্বাসকে বিশ্লেষণ করতে পারেন,
তবে তাঁর নিজেকে মুক্তমনা বলতে আপত্তি থাকার কথা নয়” কিন্তু
“মুক্তমনাদের আস্থা তাই বিশ্বাসে নয়, বরং যুক্তিতে।” একজন যুক্তিবাদী কিভাবে এই প্যারাগ্রাফ তৈরি করতে পারে
এবং নিজের যৌক্তিক দুর্বলতা দেখতে
পায়না, সেটাই
হয় যৌক্তিক প্রশ্ন। এত ধানাই পানাই কেন?
এক ব্যক্তি তার
বিশ্বাসের যৌক্তিক justification
কার কাছ থেকে গ্রহণ করবে?
(প্রোপাগাণ্ডিস্ট ইসলাম-বিদ্বেষী নাস্তিকদের কাছ থেকে?) বড় বড় দার্শনিকদের অনেকে বিশ্বাসী ছিলেন এবং
অনেকে ছিলেন না। এই justification এর জন্য
কি কোনো স্ট্যান্ডার্ড অথরিটি রয়েছে যে এর মধ্যে arbitration
করবেন, না
উপরের বাক্যটি যে মুক্তমনা তৈরি করেছেন তার ‘যুক্তিই’ হবে শেষ কথা? এই প্যারাগ্রাফে উগ্র নাস্তিকরা যে অন্ধমনা, মৌলবাদী এবং ধাপ্পাবাজ – তা নিজেরাই প্রমাণ করে।
এই তথাকথিত মুক্তমনাদের দৃষ্টিতে আজন্ম
লালিত ধর্মীয় ও সামাজিক বিবর্তনমূলক
সকল সংস্কৃতি 'অপসংস্কৃতি'। তাদের জিহাদও তাদেরই যুক্তিপ্রসূত “অপসংস্কৃতির” বিরুদ্ধে!
এখানেও তারা অপরের সংস্কৃতিকে ‘অপসংস্কৃতি’ বলছে,
ইতিবাচক শব্দ তাদের,
এবং নেতিবাচক শব্দ ওদের। এবারেই হয়তো স্পষ্ট যে কেন তারা
নিজেদের জন্য এক শব্দ-শ্রেণী
ব্যবহার করে এবং প্রতিপক্ষের জন্য আরেক ধরণের শব্দ-শ্রেণী (নিজেরা মুক্তমনা, যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনষ্ক ইত্যাদি আর প্রতিপক্ষ ধর্মান্ধ, যুক্তিহীন, বিজ্ঞানবিমুখ) ব্যবহার করে। এটাই তাদের
নতুন ধর্ম। এই ধর্ম
এতই অন্তঃসারশূন্য যে অপরের বিপক্ষে প্রোপাগাণ্ডা ছাড়া নিজের ধর্মে এমন
কিছু নেই যা দিয়ে তাদের প্রচারণা কার্য চালাতে পারে।
মুক্তমনারা কি
ধর্ম-বিরোধী?
মুক্তমনাদের ধাপ্পাবাজির নমুনা আরেকটি
প্যারাগ্রাফ থেকে নেয়া যাক।
এখানেও তাদের শব্দ চয়ন,
বাক্য গঠন ও প্যারাগ্রাফের প্রথমাংশ, মধ্যাংশ এবং শেষাংশের দিকে কী হচ্ছে তা খেয়ালে
রাখবেন। আগের মতো, স্কয়ার
বন্ধনীর নীল রঙের
লেখায় আমাদের কথা এবং বোল্ডিং ও আন্ডারলাইনিং আমাদের, উৎস প্রাগুক্ত।
মুক্ত-মনারা ধর্ম-বিরোধী নয়, বলা
যায় অনেক মুক্তমনাই
ধর্মের কঠোর সমালোচক। কারণ তাঁরা মনে করেন ধর্ম জিনিসটা পুরোটাই মিথ্যার
উপর প্রতিষ্ঠিত। মুক্তমনারা সর্বদা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির [বরং সপ্ত/অষ্টাদশ শতাব্দীর selective দৃষ্টিভঙ্গি!] প্রতি
আস্থাশীল, আজন্ম
লালিত কুসংস্কারে নয়। কুসংস্কারের কাছে আত্মসমর্পণ আসলে নিজের সাথে প্রতারণা
ছাড়া কিছু নয়। তবে মুক্তমনাদের
ধর্ম-বিরোধী হওয়ার
[আগের আন্ডারলাইনিংটা স্মরণ করুন এবং হাসি সামলিয়ে পরের generalised প্রোপাগাণ্ডামূলক বাক্য রচনা দেখুন!] একটা
বড় কারণ হল, ধর্মগুলোর
মধ্যে বিরাজমান নিষ্ঠুরতা। প্রতিটি ধর্মগ্রন্থের বিভিন্ন আয়াত এবং
শ্লোকে বিধর্মীদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করা হয়েছে ঢালাওভাবে, কখনো দেয়া হয়েছে হত্যার নির্দেশ। ইতিহাস সাক্ষ্য
দেয়, ধর্ম
আসলে জ্বিহাদ, দাসত্ব, জাতিভেদ,
সাম্প্রদায়িকতা,
হোমোফোবিয়া, অ-সহিষ্ণুতা, সংখ্যালঘু নির্যাতন, নারী নির্যাতন এবং সমঅধিকার হরণের মূল
চাবিকাঠি হিসেবে প্রতিটি যুগেই
ব্যবহৃত হয়েছে।
‘মুক্ত-মনারা
ধর্ম-বিরোধী নয় … তবে
মুক্তমনাদের ধর্ম-বিরোধী হওয়ার’ কারণ
আছে। কেননা ধর্ম মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত,
ধর্ম কুসংস্কার,
আর মুক্তমনারা
‘বৈজ্ঞানিক
দৃষ্টিভঙ্গির’ অধিকারী!
নিজেদের ব্যাপারে সুন্দর সুন্দর
বাক্য রচনা, ইতিবাচক
শব্দ চয়ন এবং প্রতিপক্ষের ব্যাপারে বিপরীত
ধরণের বাক্য ও শব্দ নির্বাচন –
এগুলো হচ্ছে এই ধাপ্পাবাজদের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি। যারা একটি প্যারাগ্রাফের
সীমানায় যুক্তি টিকিয়ে রাখতে পারে
না, তারাই
অপরকে যুক্তি শিখাতে চায়, যে
নিজেই বিদ্বেষ ছড়ায় সে’ই
আবার অপরের
বিদ্বেষ নিয়ে সংগীত রচনা করে, নিজের
prejudice অন্যের
উপর ধারণ করে। এটাই
হচ্ছে উগ্র-পন্থি নাস্তিকদের আলোকিত পথ,
এনলাইটনম্যান্ট।
মানব জাতির ইতিহাসে মানুষ অনেক পথ
অতিক্রম করেছে এবং এখনো করছে। অতীতে
যেমন মানুষে মানুষে হানাহানি
করেছে, তেমনি
আজও করছে। আগেও যুদ্ধ হয়েছে, এখনো
হয়। সকল
দ্বন্দ্ব সংঘাতে অনেক ধরণের উপাদান কাজ করতে দেখা
যায়। এসবের
মধ্যে স্থানভেদে ধর্মও ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। কিন্তু দ্বন্দ্ব-সংঘাতে মানুষের লোভ-লালসা, তাদের প্রকৃতিজাত হিংস্রতা, আমিত্বের-প্রভাব, সমঝের ভিন্নতা, গোত্রীয় স্বার্থ, রাজকীয় স্বার্থ, রাজ্য বিস্তৃতি,
অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব ইত্যাদি অনেক কিছু কাজ করত এবং এখনো করে। কিন্তু
ধাপ্পাবাজ অজ্ঞতাবশত অথবা তার নিজ নাস্তিক্যধর্ম প্রচারের জন্য দুনিয়ার
(অতীত-বর্তমানের) সব দাঙ্গা-হাঙ্গামাকে ধর্মের সাথে সংযুক্ত করে, এবং জোড়াতালি দিয়ে ধর্মের বিপক্ষে
প্রোপাগাণ্ডা করে। মানুষের বিশ্বাস ও
আবেগের স্থানে আক্রমণ করে।
কোন নাস্তিক ব্যক্তি যদি ভাবে যে “কুসংস্কারের কাছে আত্মসমর্পণ আসলে নিজের
সাথে প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়”, তবে
এটা তার নিজের বেলায় গ্রহণ
করাতে কারও আপত্তি নেই। কিন্তু তার নিজ ব্যাখ্যার আলোকে অপরের
বিশ্বাস ও প্রথাকে
অপসংস্কৃতি সাব্যস্ত করে, তাদের
উপর চড়াও হওয়া সভ্য সমাজের কাজ
হতে পারে না, এই
অধিকার তার নেই। আবার এক ব্যক্তি যদি তার নিজ অযৌক্তিকতাকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি মনে
করে, তবে
সে স্বাধীনতা তার আছে, কিন্তু অন্যের
উপর চড়াও হওয়ার স্বাধীনতা তার নেই। এটা সভ্য নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারে।
উগ্র-নাস্তিকতাকে এক ধরণের হিটলার-মানসিকতার সাথে তুলনা করলে হয়তো অত্যুক্তি হবে
না। প্রয়াত মিলিট্যান্ট নাস্তিক
হিচেন্স ছিলেন ইরাক আক্রমণের প্রবক্তা, স্যাম হ্যারিস শুধু সে যুদ্ধের পক্ষেরই
নন বরং বোমা ফুটিয়ে গোটা আরব-ভূখণ্ডের সকল আরব মুসলমানদেরকে উড়িয়ে দেয়ার পক্ষেও। এই হচ্ছে তাদের
মানসিকতা।
ওদের যুদ্ধ, ওদের প্রোপাগাণ্ডা, ওদের মিথ্যাচার হচ্ছে ধর্মের বিরুদ্ধে – এটা তাদের নিজ কথাতেই প্রতিষ্ঠিত। তাদের
থলের বিড়ালটি তারা বেশিক্ষণ
লুকিয়ে রাখতে পারেন না। তাদের প্যারাগ্রাফের শুরুতে এককথা, মধ্যখানে এককথা এবং শেষাংশে আরেক কথা – কিন্তু তবুও বিজ্ঞান-মনস্ক, যুক্তিবাদী!
শেষ কথা
আমাদের শেষ কথা হল এই যে আজকের বিশ্ব
সভ্যতার মূলে রয়েছে ধর্মীয়
সংস্কৃতির রূপায়ণ। প্রত্যেক ব্যক্তিই তার সমাজের সন্তান। তার
সভ্যতা তার ভাষাকে
যেভাবে সাজিয়েছে, সে
বাল্যকালে ভাষায় প্রবেশ করার সাথে সাথে সেই ভাষাই তার সজ্ঞাকে সচেতন করে, তাকে ‘আমিত্বের’ চেতনায় আনে। সে ভাষা ও সংস্কৃতিতে
সৃষ্ট চৈতন্যময়ী সত্তা। তার যুক্তির ব্যবহার ভাষিক,
কিন্তু
ভাষা বস্তুর আয়না নয়,
বস্তুর প্রতিনিধিও নয়, যুক্তির ভাষিক ব্যবহারে সে যে
‘সত্য/অর্থ’ উপস্থাপন করে, সেই সত্যের আয়না হয়ে ব্যবহৃত শব্দমালা
কাজ করে
না। সে যে বস্তুকে তার যুক্তিতে ‘সত্য’ ভাবে,
সঠিক ভাবে, তার
সত্যের definition-কে
পুনরায় যুক্তির scaffolding-এ
তুলে ধরলে (এবং পরতে পরতে
বিশ্লেষণ শুরু করলে) তার ধারণার ভিন্নতার ভিন্ন ভিন্ন দিক
দেখতে পারবে। যুক্তি
ও বিজ্ঞানবাদের ধর্মীয়রূপ অনেক পুরাতন। [এ বিষয়ে দু'টি লেখা এখানে [২]
এবং এখানে [৩] দেখা যেতে পারে]। এই মুক্তমনারা
সপ্ত/অষ্টদশ শতাব্দীর এনলাইটনম্যান্টের ‘ধর্মের-মতো’ প্রত্যয়ে নিমজ্জিত।
অনেকক্ষণ যারা লেখাটি পড়েছেন, তারা এই প্রসঙ্গের সাথে মিল-রাখা একটি ভিডিও
দেখে শেষ করতে পারেন, যদি
সে ধৈর্য্য থেকে গিয়ে থাকে। [৪]
________________________
[১]
মুক্তমনা এডমিন, (২০০৮) মুক্তমনা
কী?
মুক্তমনা [অনলাইন] available
at: http://mukto-mona.com/bangla_blog/?page_id=519 [Accessed 10 Oct 2012]
[২]
এই বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত লেখা (উপরে লিঙ্ক করা) হল, “যুক্তি,
বিশ্বাস ও কোরান” লেখাটি দেখা যেতে পারে এবং সাথে করে মন্তব্য
সেকশন – মন্তব্য
4.1, দ্বিতীয়
আলোচনাঃ যৌক্তিক সমস্যা
[৪]
videonation. (2008). Hedges Vs.
Hitchens. [Online Video]. Feb 22, 2008. [Accessed: 13 October 2012]. (URL
Address দিলে ভিডিও লিঙ্ক ডবল হয়ে
যায়, তাই
এখানে repeate করা
হল না)
No comments:
Post a Comment