Friday, February 28, 2020

আন্দালুস হারানোর ৫২৭ বছর #আন্দালুস_সপ্তাহ, ২০১৯ (২য় অংশ)



দুটি প্রশ্ন!
আতিক উল্লাহ
দিনলিপি-১৪৮
(১১-০৩-২০১৫)
-
*** দুইটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি আজ বহুদিন ধরে। বহু ক্রোশ ঘুরে। যেখানে যাকেই যোগ্য পেয়েছি, পড়াশুনো করা পেয়েছি-প্রশ্নবাণটা ছুঁড়ে দিয়েছি। সর্বশেষ প্রশ্ন করেছিলাম প্রবাসী এক ভাইকে। তিনি খুবই প্রাঞ্জল ভাষায়, সহজ করে একটা সমাধান দিয়েছিলেন। তার মতো পড়ুয়া-মুতালি‘ হতে পারলে, কথা ছিল না।
*** প্রশ্নদুটো ছিল:
(এক) স্পেনের (ও মরক্কোর) মুসলমানরা কেন মালেকি মাযহাব গ্রহণ করেছিল? অন্য মাযহাব কেন গ্রহণ করেনি? এ দুই অঞ্চলে, আগাগোড়া মালেকি মাযহাবেরই প্রাধান্য ছিল। অন্য মাযহাবও ছিল, কিন্তু অতটা সুবিধে করতে পারে নি। আঁটঘাঁট বেঁধে ঝাঁকিয়ে বসতে পারনি। অন্য মাযহাবগুলো মালেকি মাযহাবের বিজয়দন্ডের সামনে সারাক্ষণই কৃশকায় ক্ষীণকায় লঘুবপু হয়ে জড়োসড়ো হয়ে থেকেছে। এমনকি যখন ইনকুইজিশ চলছিল, তখনও স্পেনের মরিস্করা মালেকি মাযহাব আঁকড়ে ধরে ছিল।
(দুই) স্পেনে মুসলমানদের পতনের কারণ কী? এই পতনের পেছনে মাযহাবের কোনও প্রভাব ছিল কি?
*** স্পেনে লিখিত সর্বশেষ ফিকহের কিতাবের নাম ‘শরীয়াতুল ইসলাম’। লিখেছেন ঈসা বিন জাবের। কিতাবটা লেখা হয়েছে স্পেনিশ ভাষায়। কাসতালার অধিবাসীদের জন্যে। কারণ ততদিনে তারা আরবী ভাষা ভুলে গিয়েছিল। এই কিতাবটাও মালেকি মাযহাবের ওপর ভিত্তি করেই লেখা হয়েছিল।
*** অনবরত-নিরন্তর খুঁজে ফিরছিলাম। কোনও লেখা বা ভাষ্যে আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া যায় কিনা। যাক আপাতত সংগ্রহ যা দাঁড়াল, তা হলো; ইবনে খুলদুনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল:
-স্পেনে মালেকি মাযহাব এতটা আসনপিঁড়ি হয়ে কিভাবে বসতে পারল?।
তিনি উত্তর দিয়েছিলেন:
-স্পেনের অধিবাসীদের বেশির ভাগ সফরই হতো হেজাযের দিকে। মক্কা-মদীনাই হতো তাদের চূড়ান্ত গন্তব্য। মদীনা ছিল তখনকার সময়ে ‘ইলমের প্রাণকেন্দ্র’। আরেকটি কেন্দ্র ছিল ইরাক। কিন্তু তাদের ইরাক তাদের চলার পথে পড়তো না। স্পেনবাসী মদীনা থেকেই ইলম অর্জন করতো। মদীনায় থাকতেন ইমাম মালিক (রহ.)। ইমামের ইন্তেকালের পর তার শাগরিদগন। মদীনা থেকেই স্পেনে মালেকি মাযহাবটা গিয়েছে।
আরেকটা কারণও হতে পারে:
-মরক্কো ও আন্দালুসের মুসলমানরা ছিল মরু জীবনে অভ্যস্ত। ইরাকের মুসলামনরা ছিলে শহুরে জীবনে অভ্যস্ত। জীবনযাত্রার মিল-অমিল হিশেবে মদীনার পরিবেশে মরুজীবনের প্রভাব বেশি ছিল। যেটা ছিল না ইরাকে। স্বাভাবিকভাবেই আন্দালুসীয়রা মদীনার দিকেই বেশি ঝুঁকেছে।
আরেকটা কারণ কথা বলা যায়:
-সময়ের সাথে তার মিলিয়ে, মালেকি মাযহাবের খুব বেশি বিবর্তন হয়নি। অন্য মাযহাবগুলোর সাথে শহরের সংস্পর্শ থাকার কারণে, প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। সে সমস্যাগুলো সমাধানের জন্যে চিন্তা-ভাবনা করতে হয়েছে। আগের সমাধান করা মাসায়েলকে পুনর্বিবেচনা করতে হয়েছে। এসব বিবেচনা-গবেষণা করতে গিয়ে অন্য মাযহাবের মুজতাহিদদের যোগ্যতা বেড়েছে, চিন্তা শাণিত হয়েছে, তাদের ফিকাহটাও সমৃদ্ধ হয়েছে।
কিন্তু স্পেনের লোকেরা ইমাম মালেকের কথাকেই চূড়ান্ত ধরে বসে থাকার কারণে, চিন্তা ও ইজতিহাদ অন্য মাযহাবের মতো শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারে নি।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, সেখানকার লোকেরা অন্য মাযহাবকে জিব্রাল্টার প্রণালী পার হতে দিতে বেজায় নারাজ ছিলো। তারা খুবই শক্ত হাতে অন্য মাযহাবকে শাসাতো-বানাতো।
*** অবশ্য স্পেনে মালেকি মাযহাবই প্রথম গিয়েছে এমন নয়। স্পেনে প্রথম গিয়েছে সিরিয়ার ইমাম আওযায়ীর (রহ.) মাযহাব। তারপরে এসেছে মিসরি ইমাম লাইস বিন সা’দের (রহ.) মাযহাব। পরে আস্তে আস্তে শাফেয়ী, আহলে যাহের, অল্প পরিমাণে হানাফী মাযহাবও প্রচারিত হয়েছিল। কিন্তু কোনও মাযহাবই মালেকি মাযহাবের অপ্রতিরোধ্য অবস্থানের সামনে টিকতে পারেনি।
*** একটা কারণ এটাও উল্লেখ করা যায়, স্পেনের খ্রিস্টানরা শুরু থেকেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ ছিল। তারা সবাই ক্যাথলিক ছিল। খ্রিস্টবাদের অন্য কোনও রূপ স্পেনে জায়গা পায়নি। নিজেদের ঐক্যের স্বার্থের খ্রিস্টানরা ভিন্নমতকে স্থান দেয়নি। ধর্মীয় ঐক্যের কারণেই তাদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য অটুট ছিল। ক্যাথলিক পোপও সব সময় তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলেন।
মুসলমাদের মধ্যেও এমন একটা চিন্তা কাজ করে থাকতে পারে, তাদের প্রতিপক্ষ ধর্মের দিক থেকে একটা মতাবলম্বী। এখন তাদের মধ্যে যদি ধর্মীয় ঐক্য না থাকে, রাজনৈতিক ঐক্য সংহত হবে না। এই যুক্তিটা অবশ্য খাটে না, কারণ স্পেনের মুসলমানদের মধ্যে মাযহাবগত ঐক্য থাকলেও, রাজনৈতিক ঐক্য ছিল না বললেই চলে। শেষের দিকে, পুরো আন্দালুস অনেকগুলো রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল।
*** অবশ্য মালেকি মাযহাবের পথ একদম মসৃণ ছিল তা বলা যাবে না। অন্য মাযহাবের সাথে অনেক লড়াই করে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে হয়েছে। কখনো কখনো খলীফাকে পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করে মাযহাবগত ঝগড়া মেটাতে হয়েছে।
*** কাসিম বিন সাইয়ার (২৭৬ হি.)। তিনি ছিলেন শাফেয়ী মতাবলম্বী। তাকে অনেক যুদ্ধ করে স্পেনে টিকে থাকতে হয়েছিল। আমীর মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ (২৭৭ হি.) তার কাজে খুশি হয়ে, তাকে নকলনবিশ নিয়োগ দিয়েছিলেন। তখন অবস্থানটা মযবুত হয়েছিল।
*** বাকী বিন মুখাল্লাদ (২৭৬ হি)। তিনি ছিলেন ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের (রহ.) শাগরিদ। তার ব্যাপারটা ছিল অত্যন্ত নাযুক। তিনি সর্বপ্রথম স্পেনে মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা নিয়ে যান। ইমাশ শাফেয়ীর (রহ.) কিতাবাদিও তিনিই প্রথম স্পেনে নিয়ে যান।
মালেকি ওলামায়ে কেরাম বাকী বিন মুখাল্লাদের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগল। তাদের কাছে এসব কিতাব একদম অপরিচিত ছিল। বা পরিচিত থাকলেও শুধুমাত্র বিরোধিতার জন্যেই তারা কিতাবগুলোর বিরোধিতা করেছিল। ইবনে মুরতানীল (একজন স্পেনিশ আলিম) তো এমন কথাও বলেছিলেন:
-আমার বাক্সে ‘মুসান্নাফ’ থাকার চেয়ে শুকরের মাথা থাকাও অনেক ভাল।
*** বাকী বিন মুখাল্লাদের বিরোধিতা এমন পর্যায়ে পৌঁছল, মালেকিরা সাধারণ জনগনকে তার বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলেছিল। তিনি ভয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার সাহস করতেন না। এ ক্ষেত্রেও তাকে বাঁচাতে এগিয়ে এলেন আমীর মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ। তিনি উভয় পক্ষের মধ্যে মুনাযারার ব্যবস্থা করলেন। বাকী বিন মুখাল্লাদ প্রতিপক্ষকে বলতে গেলে একদম শুইয়ে দিলেন। আমীর মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা দেখে মুগ্ধ হয়ে বললেন:
-এমন কিতাব তো আমার ব্যক্তিগত পাঠাগারেও থাকা জরুরী। এটাকে জরুরীভিত্তিতে কপি করা হোক। আর হে বাকি! আপনি আপনার অর্জিত ইলম প্রচার করতে থাকুন।
আমীর এবার বিরোধীপক্ষকে তিনি শক্ত ভাষায় নিষেধ করে দিলেন, যেন বাকী বিন মুখাল্লাদের পেছনে আর না লাগে।
*** এ ঘটনা থেকেও বোঝা যায়, মাযহবগত বিরোধ থেকে রাজনৈতিক বিরোধ সৃষ্টি হওয়ার কোনও আশংকা ছিল না। না হলে আমীর এমন সিদ্ধান্ত দিতেন না।
*** একজন স্পেনিশ ঐতিহাসিকও চরম বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন:
-সেই যে হিজরি দ্বিতীয় শতকে মালেকি মাযহাব স্পেনে এসেছিল, এগারশ হিজরিতে (সতেরশ খ্রি) মুসলমানরা স্পেন থেকে সম্পূণ নির্মূল হওয়া পর্যন্ত এই মাযহাব টিকে ছিল। এটা এক আশ্চর্যের বিষয়।
***স্পেনের সমস্ত মালেকি উলামা কট্টর ছিলেন, এমন নয়। অত্যন্ত উদার উলামাও ছিলেন। যেমন আবুল ওয়ালীদ আল বাজী (৪৭৪হি), ইবনে রুশদ (৫২০ হি), ইবনুল মুকরি (৫৫৭ হি)।
*** একটা বিষয় মজার, তা হলো, স্পেনে কৃষিক্ষেত্রে কিন্তু ইমাম আওযায়ীর মাযহাবই মানা হতো। কারণ এ ক্ষেত্রে ইমাম মালিকের মাযহাব মানলে কৃষিক্ষেত্রে সমস্যা হতো। এ বিষয়টা নিয়ে দুই বছর আগে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। ওটা খুঁজে পেলে যোগ করে দেব ইনশাআল্লাহ
*** একটা প্রশ্ন উঠতে পারে:
= মালেকি মাযহাবের প্রচন্ড চাপ কি স্পেনে মুসলমানদের পতনের অন্যতম একটা কারণ হতে পারে?
কোনও কোনও ঐতিহাসিক এমন মত পোষণ করেছেন। কিন্তু কিভাবে? মাযহাবগত বিরোধের সাথে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিলুপ্তির কী সম্পর্ক?
এমন হতে পারে, বিজ্ঞান চর্চা এগিয়ে গেলেও, শৌর্যবীর্যের চর্চা কি কমে এসেছিল? তা হলেও, মাযহাবের সাথে তার কী সম্পর্ক?











বই রিভিউ
স্পেনে মুসলমানদের উত্থান ও পতন
রচনায়ঃ অধ্যাপক ফজলুর রহমান
প্রকাশনায়ঃ পাণ্ডলিপি প্রকাশন, সিলেট।
প্রকাশকালঃ অক্টোবর ২০১৬
২য় সংস্করণ ২১শে গ্রন্থমেলা ২০১৮
প্রচ্ছদঃ বায়েজিদ মাহমুদ
পৃষ্টা সংখ্যাঃ ১১২
ধরণঃ ইতিহাস
মুদ্রিত মূল্যঃ ৮০/=
রেটিং ১০/৭.৫
ইতিহাস জাতির দর্পণ।
যে জাতি তার পূর্বসূরীদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা অর্জন করতে পারেনা তারা সফলকাম হয় খুব কম।
একদা স্পেন তথা আন্দালুস ছিল আমাদের।
আল হামরা প্রাসাদ, জাবালে তারিক তথা জিব্রাল্টার প্রণালী এগুলো ছিল আমাদের ঐতিহ্যের নিদর্শন।
বহন করে বেড়ায় আমাদের সোনালী অতীতের সুন্দর সব প্রতিচ্ছবি।
পৃথিবী চারটি জিনিষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত- জ্ঞাণী গুণীদের জ্ঞান; মহান ব্যক্তিদের নিরপেক্ষ বিচার; ধর্মপ্রাণদের প্রার্থণা ও যোদ্ধাদের নির্ভিকতা।
গ্রানাডা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি উৎকীর্ণ শিলালিপিতে এই কথা গুলো লিখা ছিল।
বক্ষমান গ্রন্থটি আটটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত করে লেখক খরচ করেছেন মোট ১১২পৃষ্টা।
#প্রাথমিক_শিরোনামে রচিত প্রথম অধ্যায়ে সৃষ্টি জগতের রহস্য ও আল্লাহর প্রতিনিধি পাঠানোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন লিখক।
এ অধ্যায়ে আরো আলোচনা করেছেন সংক্ষিপ্তভাবে খোলাফায়ে রাশেদার শাসনামল ও উমাইয়া রাজ বংশের উত্তান-পতন।
১০ নং পৃষ্টার সংযুক্ত টিকায় লেখক বলেছেনঃ /"তাগুত কাফির থেকে মারাত্মক। কাফির আল্লাহকে অস্বীকার করে। আর তাগুত আল্লাহর আনুগত্যে বাধা দেয়।"/ কোট করা অংশটি দেখতে কেমন লাগলেও বাস্তবতা অনস্বীকার্য।
#মুসলমানদের_স্পেন_বিজয় নামে দ্বিতীয় অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন বর্তমান সময়ের স্পেন এর সার্বিক বিষয়ে।
ইতিহাস বর্ণনার ক্ষেত্রে সচেতনতা কাম্য।
এ অধ্যায়ের ২৭ নং পৃষ্টার প্রথম দিকে লিখক দাবী করেছেন অষ্টম শতাব্দির প্রথম দিকে আমি আবার লিখছি অষ্টম শতাব্দির প্রথম দিকে তৎকালীন স্পেনের রাজা উইটিয়াকে হত্যা করে ডিউক রডারিক স্পেন দখল করে নিজেকে রাজা হিসেবে দাবী করেন। সে সময়কার প্রথা অনুযায়ী রাজ্যের সম্ভ্রান্ত লোকদের
সন্তানরা রাজ দরবারে শিক্ষা-দীক্ষার জন্য পাঠানো হতো। সে সুবাধে গভর্ণর কাউন্ট জুলিয়ানের কন্যাকেও পাঠানো হলো। কিন্তু জুলিয়ানের কন্যা ফ্লোরিন্ডার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে রাজা রডারিক তার শ্লীলতাহানি করেন। এ ঘটনায় আঘাত প্রাপ্ত হয়ে কাউন্ট জুলিয়ান তখনকার খেলাফতের দায়িত্বশীল ওয়ালিদের উত্তর আফ্রিকার গভর্ণর মুসা বিন নুসাইরকে স্পেন আক্রমণের আবেদন জানান।
অতঃপর আবেদনে সাড়া দিয়ে খলিফার অনুমতি নিয়ে সেনাপতি তারেক বিন যিয়াদকে ১২হাজার সৈন্যসহ ৭১১খ্রিস্টাব্দে জলযান যোগে স্পেনে প্রেরণ করেন।
এখন বুঝার বিষয় হলো অষ্টম শতাব্দির প্রথম দিকের কোন কাহিনীর দরুণ যদি তারিক বিন যিয়াদ অভিযান পরিচালনা করে থাকেন তাহলে তো অভিযানের তারিখ হওয়া উচিত ছিল ৮১১ খ্রিস্টাব্দ। কিন্তু সঠিক তথ্য হলো ৭ম খ্রিস্টাব্দ এর প্রথম দিকে। আসলে বিষয়টা টাইপ মিসিং না কি ভূল ইতিহাস উপস্থাপন তা আমার বোধগম্য না।
#অধীনস্ত_আরব_আমিরাত নামে রচিত ৩য় অধ্যায়ে ৭১৪ থেকে ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্পেনে মুসলিম শাসকদের ব্যাপারে আলোকপাত করেছেন।
/"খ্রীষ্ট বাহিনী ধর্ম ও আধ্যাত্মিক রাজধানী রক্ষার্থে যুদ্ধ করে। আর মুসলিম বাহিনী যুদ্ধ করে ধন-সম্পদ আহরণের উদ্দেশ্যে। এই যুদ্ধ সম্পর্কে ইউরোপীয়ান ঐতিহাসিক পি.কে হিট্রি মন্তব্য করেনঃ খ্রীষ্টানদের নিকট তাদের চির শত্রু মুসলানদের বিরুদ্ধে এটি একটি যুগান্তকারী সাফল্য। যদি আরবগন যুদ্ধে জয়লাভ করত, তাহলে গীবন ও অন্যান্য ঐতিহাসিকদের মতে প্যারিস ও লন্ডনের যেখানে গীর্জা রয়েছে সেখানে মসজিদ হতো"/।
কোট করা অংশ বক্ষমান গ্রন্থের ৩২ নং পৃষ্টার প্রথমাংশ। লেখক মুসলিম বাহিনীকে আগ্রাসী দাবী করেছেন উনার লেখায়। আদতে তা আদৌ সত্য নয়। আবার পরবর্তী অংশে এযুদ্ধে মুসলমানদের জয়লাভ হলে অনেক সফলতার সম্ভাবনা দেখেছেন স্বয়ং ইউরোপিয়ান ঐতিহাসিকরা।
আবার এদিকে ঐতিহাসিকরা খ্রীষ্টিয় শক্তির শত্রু হিসেবে দেখছেন মুসলমান জাতিকে অথচ পরের অংশেই লেখক জাতি হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন আরব জাতীয়বাদকে।
এবং ইতিহাস বর্ণনার ক্ষেত্রে তথ্য পঞ্জি উল্লেখ করা যেখানে আবশ্যক একটি বিষয় সেখানে তিনিও এগুলোও এড়িয়ে গেছেন নির্বিঘ্নে।
( এবিষয়ে আরো বিস্তারিত এ সঠিক তথ্য জানতে ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ইসলামের ইতিহাস ৩য় খন্ডের ৫৩-৫৪ পৃষ্টা দেখুন।)
চতুর্থ অধ্যায় #স্বাধীন_আমিরাত
পঞ্চম অধ্যায় #স্পেনের_ক্ষুদ্র_ক্ষুদ্র_রাষ্ট্রসমূহ
ষষ্ট অধ্যায় #স্পেন ও ইউরোপের সভ্যতার বিকাশে মুসলমানদের অবদান
সপ্তম অধ্যায় #স্পেনে_মুসলিম_শাসনের_অবসান,মুসলিম নিধন, বিতারণ নির্যাতন।
অষ্টম অধ্যায় #স্পেনে_মুসলমানদের_পতনের_কারণ হিসেবে প্রায় ২৩টি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন।
-বইটি কেন পড়বেন!
বইটি বেশ প্রাঞ্জল ছিল।
তবে ইতিহাস জানার জন্য আশাব্যঞ্জক উপস্থাপনার মাধ্যমে তা হয়না। আপনি একটা জাতির দীর্ঘকালের ইতিহাস নিয়ে লিখবেন আর তাতে সাফল্য বলে কিছু ছিলনা বললে ভূল হবে।
তবে আত্মসমালোচনা হিসেবে নিলে বইটি আপনার খোরাক যোগাবে বেশ।












খলিফা যখন কিতাবের কীট!
আইনুল হক কাসিমী

খলিফা হাকাম আল-মুসতানসির এর ইলমের হাতেখড়ি হয়েছিল তাঁর পিতা খলিফা আবদুর রহমান আন-নাসিরের হাতে। হাকাম আল-মুসতানসির সে যুগের উল্লেখযোগ্য আলেমদের কাছে ইলম হাসিল করেন। আরবিভাষা, সাহিত্য, নাহু ও অংকশাস্ত্র হাসিল করেন মুহাম্মাদ আল-কুরতুবির কাছ থেকে। কুরআন-হাদিসের ইলম হাসিল করেন আল্লামা ইবনে আসবাগ থেকে। ইতিহাসের ইলম হাসিল করেন আলি আর-রুয়াইনি থেকে।
উলুমে ইসলামিয়া ও উলামাদের সংস্রবে লেগে থাকার কারণে তিনি ইলমের প্রতি চরম আসক্ত হয়ে পড়েন। এজন্য তিনি এমন একজন ইলমি ব্যক্তিত্বে পরিণত হন যে, উলামা ও ইতিহাসবেত্তারা তাঁর কথা ও মতকে সাদরে গ্রহণ করে নিতেন। তাঁকে 'দলিল' হিসেবে মানতেন। এমনকি 'আল-হাকাম' শব্দটাই দলিল হিসেবে যথেষ্ট হয়ে যেত! ইবনে আবদে রাব্বিহির জীবনি লিখতে গিয়ে মুহাম্মাদ ইবনে ফুতুহ আল-হুমাইদি লিখেন, 'এটাই আমার দেখা আল-হাকামের হাতে লিখিত সর্বশেষ লিপি। তাঁর লিপি আহলে ইলমের কাছে দলিল। কেননা তিনি একজন নির্ভরযোগ্য আলেম।'
তিনি কিতাবের পোকা ছিলেন। কিতাব সংগ্রহ করা তাঁর নেশা ছিল। আন্দালুসের সম্রাট হওয়ার পাশাপাশি কিতাব জগতেরও সম্রাট ছিলেন। তৎকালীন সময়ের ইলমের স্বর্গরাজ্য কায়রো, দামেশক, বাগদাদ ও অন্যান্য শহরে প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে চড়া মূল্য দিয়ে কিতাব খরিদ করাতেন। এভাবে তিনি তাঁর কুতুবখানায় চারলাখ কিতাব দিয়ে ঠেসে ফেলেছিলেন। কিতাব কিনতে কিনতে তাঁর কোষাগার উজাড় হয়ে এই কিতাবগুলো স্থানান্তরিত করতে ছয়মাস সময় লেগেছিল! তাঁর কুতুবখানার কিতাবাদির দাগনম্বরে জন্য ৪৪ টি রেজিস্টার খাতা ছিল। প্রতিটি রেজিস্টারে ৫০ টি পাতা ছিল!
তিনি শুধু কিতাব সংগ্রহ করে অধ্যয়নই করেননি; এসব কিতাবের ওপর তিনি নিজ হাতে অত্যন্ত মূল্যবান সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম টীকা সংযোজিত করেছিলেন। কিতাবে উল্লেখিত ব্যক্তিদের নাম, বংশ তালিকা, মৃত্যুসনসহ জরুরি বিষয়াবলি। এমনকি আজ-জাহরা শহরে কিতাব অনুলিখন করার একটি প্রকাশনালয় পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার কুতুবখানা ও প্রকাশনালয়ের কর্মচারীরা পর্যন্ত সেসময় সমাজে খুবই সম্মান পেত। এমনকি মোটা অংকের ভাতা পেয়ে এরা অনেকেই পয়সাওয়ালা হয়ে গিয়েছিল!
তাঁর শাসনামলে শুধুমাত্র কর্ডোভায় মাদরাসার সংখ্যা ২৭- গিয়ে পৌঁছায়। এগুলোতে বিনা পয়সায় শিক্ষাদান করা হতো। এসব মাদরাসার মধ্য থেকে তিনটি মাদরাসা ছিল মসজিদভিত্তিক এবং বাকি ২৪ টি ছিল কর্ডোভার বিভিন্ন জনপদে। সবগুলোর সাথে কুতুবখানা ছিল। সবগুলো মাদরাসায় বেতনভোগী আলেমদের অবস্থান ছিল। তিনি মুসলিমদের শিশুশিক্ষায় খুব বেশি গুরুত্বারোপ কর‍তেন।
উল্লেখ্য, হাকাম আল-মুসতানসির (৯৬১-৯৭৬ খ্রি.) ছিলেন আন্দালুসের কর্ডোভা খিলাফতের দ্বিতীয় খলিফা। আন্দালুসি ইতিহাসে তিনি দ্বিতীয় হাকাম নামে পরিচিত। তৃতীয় আবদুর রহমান এর পুত্র। ইলমের প্রতি আসক্তির কারণে খ্রিষ্টানদের সাথে জিহাদ ও বিজয় অর্জনে ভাটা পড়েছিল বলে কোনো কোনো হিংসুক প্রাচ্যবিদ মিথ্যাচার চালিয়েছে। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো যে, রোমকদের সাথে তাঁর নিয়মিত যুদ্ধ লেগেই থাকত। তাঁর ভয়ে অনেক ক্রুসেডার সম্রাট ও শাসক শান্তিচুক্তি করে রাখত। তাঁকে সমীহ করে চলত।
------
সূত্রাবলি:
১- في التاريخ العباسي والأندلسي-৪২০, আহমাদ মুখতার আব্বাদি
২- نفح الطيب في غصن الأندلس الرطيب ১/৩৯৫, আহমদ আল মাক্কারি
৩- جذوة المقتبس في ذكر ولاة الأندلس-১০১, মুহাম্মদ আল হুমাইদি
৪- الحلة السيراء ১/২০১, ইবনুল আবার
৫- الحلة السيراء ১/৪৪, ইবনে হাজাম










আন্দালুসি ললনার গল্প শোনো ........
আইনুল হক কাসিমী

মারাম্মাহ। আন্দালুসের ঐতিহ্যবাহী একটি সুঁইয়ের নাম। আন্দালুসি ললনারা এই মারাম্মাহ দিয়েই কাপড়ের গায়ে, মনের মাধুরী মিশিয়ে এঁকে দিত আল্পনা। প্রস্তুত হয়ে যেত নকশিকাঁথা, রঙিন রুমাল, বাহারি আল্পনার কাপড়। যে ঘরে এরকম সুঁই পাওয়া যেত, সে ঘরকে বলা হত- মারাম্মাহ কুটির। আন্দালুসের গ্রামীণ ঘরগুলোর অন্যতম একটি উপাদান ছিল এই মারাম্মাহ। আন্দালুসের একটি প্রবাদবাক্য ছিল- 'খাতাবতাল মারআহ ওয়াল মারাম্মাহ'। ওই পুরুষকে বলা হত, যে সুঁই দিয়ে ভালো করে সেলাই করতে পারদর্শী কোনো ললনাকে বিয়ের পয়গাম দেয়ার সৌভাগ্য অর্জন করত!
আন্দালুস থেকে বিতাড়িত হয়ে মরক্কোয় আশ্রয় নেয় আন্দালুসি মুসলমান। সাথে এই মারাম্মাহও নিয়ে আসে। এজন্য আজও দক্ষিণ মরক্কোর গ্রাম, গঞ্জ, শহর, নগর ও বন্দরে এই মারাম্মাহ পাওয়া যায়। আজও দক্ষিণ মরক্কোর ললনারা এই মারাম্মাহ দিয়ে নকশিকাপড় সেলাই করে তাদের প্রাচীন আন্দালুসি ঐতিহ্য জীবন্ত করে রেখেছে। আন্দালুসের প্রাচীন ওই প্রবাদবাক্য এখনও দক্ষিণ মরক্কোয় লোকমুখে শোনা যায়।
এই মারাম্মাহর উল্লেখ পাওয়া যায় প্রাচীন কিতাবাদিতে। বিশ্বপর্যটক ইবনে বতুতার সফরনামায় মারাম্মাহর আলোচনা উঠে এসেছে। তিনি বলেছেন, ওয়াল্লাতাহ ও মালির রাস্তার মধ্যে তিনি একটি বটগাছের অভ্যন্তরে একজন দর্জি দেখতে পেয়েছেন, যে তার মারাম্মাহ দিয়ে কাপড় বুনন করে চলছে! আরেক পর্যটক ইবনে জুযা গ্রানাডি বলেছেন, 'আন্দালুসে দুটি বটগাছ আছে। যার অভ্যন্তরে দুজন দর্জি রয়েছে। যারা সেখানে কাপড় বুনন করে। একটি আশ উপত্যকায়। আরেকটি গ্রানাডার বুশাররায়।
ওহ আরেকটি মজার কথা রয়েছে। সেটি হলো, যখন কোনো আন্দালুসি ললনার বিয়ের শানাই বেজে উঠত, তখন যৌতুকসামগ্রীর মধ্যে একটি অন্যতম সামগ্রী থাকত, রেশম, মখমল ও উলের নকশিকরা রঙিন চাদর। ডোরাকাটা গাঢ় পরদা। এগুলো ছাড়া তাদের বিয়েই হত না। এমনকি কোনো ললনা দরিদ্র হলে, গ্রামের বুড়িরা সাহায্য করত। তবুও ওই দরিদ্র ললনার বিয়েতে নকশিকরা চাদর ও পরদার কাপড় উপহার প্রদান করত!
-----------
সূত্র: تحفة النظار في غرائب الأمصار وعجائب الأسفار, ইবনে বতুতা রহ.
বিদায়ী বিলাপ!
আইনুল হক কাসিমী

শাহজাদি মারয়ামা (১৪৬৭-১৪৯৩)। ইবরাহিম বিন আলি আল আত্তারের আদুরে কন্যা। ইবরাহিম বিন আলি আল আত্তার ছিলেন কেস্টিলের খ্রিষ্টানদের সাথে আন্দালুসের শেষকালের লড়াকুদের এক অন্যতম লড়াকু সৈনিক। ১৪৮২ খ্রিষ্টাব্দে কেস্টিলের খ্রিষ্টানরা যখন লোজা শহরে আক্রমন করে, তখন তিনিই ছিলেন মুসলিম বাহিনীর কমান্ডার। সেই হিসেবে শাহজাদি মারয়ামার দেহের শিরা-উপশিরায় বহমান ছিল আত্মমর্যাদাশীল পিতার শোনিত রক্তকণিকা।
কিন্তু ভাগ্যের কী লিখন, এই শাহজাদি মারয়ামাকে হতে হয়েছিল এক ভীরু সম্রাটের ঘরণী! গ্রানাডার শেষ মুসলিম সম্রাট আবু আবদুল্লাহর স্ত্রী। ১৪৯২ সালে আবু আবদুল্লাহ কেস্টিল সম্রাট ফার্ডিনেন্ড ও রাণী ইসাবেলার হাতে গ্রানাডার চাবি তোলে দিয়ে আটশ বছর ধরে আন্দালুসে মুসলিমদের শাসনের কবর রচনা করেন। এরপর মারয়ামা স্বামী, সন্তান, শাশুড়ি ও ননদের সাথে লোজা শহরে বসবাস করেন।
পরের বছর ১৪৯৩ সালের অক্টোবরে ভীরু আবু আবদুল্লাহ আন্দালুস ছেড়ে চিরতরের জন্য মরক্কোর দিকে পাড়ি জমানোর প্রস্তুতি শুরু করেন। আন্দালুস হারানোর শোকে শাহজাদি মারয়ামা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। দিনদিন তার অসুস্থতা বাড়তে থাকে। একসময় শয্যাশায়িনী হয়ে পড়েন। স্বামীর আন্দালুস ছেড়ে পাড়ি জমানোর প্রস্তুতির প্রাক্ষালে ২৬ বছর বয়সে তিনি লোজা শহরে মারা যান!
পরবর্তীকালে স্প্যানিশরা লোজা শহরে, আন্দালুস হারানোর শোকে মুহ্যমানা ও স্বামীর পরিণতি চিন্তা করে বিলাপরত শাহজাদি মারয়ামার ভাস্কর্য তৈরি করে। এটা তৈরি করে তারা শাহজাদি মারয়ামার লোজা শহর ছেড়ে যাওয়ার বিদায়ী বিলাপ ও দুঃসহ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখে! ভাস্কর্যটি তৈরি করে প্রসিদ্ধ স্প্যানিশ শিল্পী ফ্রান্সিসকো মারটিনেজ ডে লা রোসা। ভাস্কর্যটি আজও স্পেনের লোজা শহরে কালের নীরব সাক্ষী হয়ে আছে।
------
সূত্র: دولة الإسلام في الأندلس- ২৭৮, আবদুল্লাহ আনান


| এক ঐতিহাসিক মিথ্যার অবসানঃ ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকার আবিষ্কারক নয়.........|
আইনুল হক কাসিমী

ঐতিহাসিক তথ্যানুযায়ী, দক্ষিণ আমেরিকার অধিবাসীরা দীর্ঘদিন থেকে, এই দাবি করে আসছিল যে, ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকার আবিষ্কারক নয়। বরং তার আগমনের আগে থেকেই দক্ষিণ আমেরিকায় আদী লোকের বসবাস ছিল। বরং সে একজন জলদস্যু। চরম অপরাধী। দক্ষিণ আমেরিকার মূল অধিবাসীদের হন্তক! সুতরাং লস এঞ্জেলসে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলতে হবে।
দক্ষিণ আমেরিকার জনগণের দাবি অনুযায়ী আদালত এই রায় দেয় যে, ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকার আবিষ্কারক নয়। সে একজন জলদস্যু ও অপরাধী। সেই হিসেবে লস এঞ্জেলস থেকে আমেরিকার কথিত আবিষ্কারক ক্রিস্টোফার কলম্বাসের ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলা হলো! উল্লেখ্য, পোস্টের শেষে টুইটার লিংক থেকে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলার এবং আমেরিকান আন্দোলনরত জনগণের হৈহুল্লোড়ের ভিডিওটেপ দেখতে পারেন।
আমেরিকানরা আজ স্বীকার করছে, অথচ আমরা সেই কখন বলেছি যে, আমেরিকার আবিষ্কারক ক্রিস্টোফার কলম্বাস নয়; আমেরিকার আবিষ্কারক মুসলমান! কলম্বাসের ৬০০ বছর আগে নবম শতাব্দীতে আজকে যে দেশ আমেরিকা, সে অঞ্চলে অবতরণ করেন আন্দালুসের একদল ভ্রমণবিলাসী মুসলিম। তারা স্পেন থেকে আটলান্টিক মহাসাগর হয়ে যাত্রা করেন আমেরিকার উদ্দেশে। আবিষ্কার করেন এক নতুন পৃথিবী। যা আজকের আমেরিকা। এটা খলিফা আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মদের (৮৮৮-৯১২) শাসনামলে।
প্রসিদ্ধ মুসলিম ঐতিহাসিক আলি ইবনুল হাসান আল মাসউদি তাঁর অমর গ্রন্থ 'মুরুজ জাহাব' এর মধ্যে বলেন, ‘কর্ডোভার মুসলিম নাবিক খাশখাশ ইবনে সাইদ ইবনে আসওয়াদ ২৭৬ হিজরি, মুতাবেক ৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনের ডেলভা (বর্তমান প্যালস) থেকে জাহাজে পাল তুলে, অন্ধকার সাগর তথা আটলান্টিক পার হয়ে ‘আরজে মজহুল’ বা অজানা দুনিয়ায় গিয়ে পৌঁছেন। এরপর ফিরে আসেন আশ্চর্যজনক সব ধনরত্ন নিয়ে।' এই অজানা দুনিয়াই হলো আজকের আমেরিকা!
আন্দালুসে সংরক্ষিত এসব মানচিত্র ও দলিলপত্র উদ্ধার করে রাজা ফার্ডিনান্ড ও রাণী ঈসাবেলার শাসনামলে ১৪৯২ অথবা ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকায় যাত্র করেন। আর এখান থেকেই পশ্চিমা মিথ্যুক ঐতিহাসিকরা নতুন পৃথিবী বা আমেরিকা আবিষ্কারের ক্রেডিট তাদের পকেটে নিয়ে নেয়! কিন্তু সত্য একদিন না একদিন উদ্ভাসিত হয়। আজ তা হয়েই গেল!
-------
ভিডিওটেপের লিংক- https://twitter.com/Amirhqatif/status/1064891568061145088
ঐতিহাসিক তথ্যসূত্র:مجلة آفاق الثقافة والتراث الإماراتية, সংখ্যা- ৬৯, মে, ২০১০ ঈসায়ি



















স্বর্ণখচিত জবাব!
আইনুল হক কাসিমী

৪২২ হিজরি মুতাবেক ১০৩১ খ্রিষ্টাব্দে কর্ডোভায় উমাইয়া খিলাফতের পতন ঘটে। এরপর থেকে আন্দালুসের সুবিশাল মুসলিম সাম্রাজ্য বিভিন্ন ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে আগের সেই শৌর্যবীর্য বাকি থাকেনি। রাজত্ব আর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে মুসলিমরা লড়া শুরু করে একে অপরের বিরুদ্ধে। ভাইয়ের রক্তে ভাইয়ের হাত রঞ্জিত হতে থাকে। আর এই সুযোগ গ্রহণ করতে লাগে পার্শ্ববর্তী খ্রিষ্টান রাজ্যগুলো। ক্যাষ্টেলের খ্রিষ্টান সম্রাট ফার্ডিনান্ড কয়েকটি মুসলিম রাজ্য দখল করে নেন। তারপর ক্ষমতায় আসেন ষষ্ঠ আলফানসো। ৪৭৮ হিজরিতে ষষ্ঠ আলফানসোর হাতে পতন হয় টলেডোর। এরপর আর কখনই টলেডোতে ইসলামি নিশান পতপত করে ওড়তে দেখা যায়নি!
সেভিলের শাসক ছিলেন মু'তামিদ বিন আব্বাদ (১০৬৯-১০৯১)। তিনি ছিলেন বনি আব্বাদ শাসকদের মধ্যে তৃতীয় ও শেষ শাসক। ষষ্ট আলফানসো এবার সেভিল অবরোধ করেন। তিনি মু'তামিদ বিন আব্বাদের সাথে পত্রালাপ করেন। চাইলে মু'তামিদ বিন আব্বাদ অন্যান্য মুসলিম রাজ্যগুলোর মতো টেক্স দিয়ে আলফানসোর বশ্যতা স্বীকার করতে পারতেন। কিন্তু তিনি ছিলেন আত্মমর্যাদাবান একজন শাসক। তিনি আলফানসোর প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। অবরোধ চলতে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে। আলফানসো মু'তামিদ বিন আব্বাদের কাছে পত্র লিখে বলেন- 'অবরোধ দীর্ঘ হচ্ছে। এখানে গরম বড় তীব্র, আর মাছির উপদ্রব খুবই বেশি! আমার জন্য একটি পাখা পাঠান। যেন বাতাসে করতে পারি এবং মাছি তাড়াতে পারি।'
আলফানসো বুঝাতে চাচ্ছিলেন- অবরোধ করতে তার আপত্তি নেই। মুসলিম বাহিনী নিয়েও তিনি চিন্তিত নন। বরং এ মুহূর্তে মাছিই তাকে বেশি পেরেশান করছে। পত্রটি হস্তগত হলো মু'তামিদ বিন আব্বাদের। তিনি পত্রের উলটো পিঠে লিখে দিলেন- 'তোমার পত্র পেয়েছি। শীঘ্রই আমি তোমার জন্য লামতি চামড়ার পাখা পাঠাব। এ পাখা থাকবে মুরাবিত সৈন্যদের হাতে। এ পাখার বাতাস আমাদেরকে তোমার হাত থেকে স্বস্তি দেবে, কিন্তু তোমাকে কোনো স্বস্তি দেবে না!'
মুরাবিতরা তখন উত্তর আফ্রিকা শাসন করছিলেন। তাদের মহামান্য আমির ছিলেন উম্মাহর শিংহশাবক ইউসুফ বিন তাশফিন। তাঁর শক্তিমত্তা, দাপট আর শৌর্যবীর্যের গল্প শোনা যায় সুদূর আন্দালুস থেকেও! মু'তামিদ বিন আব্বাদ সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি ইউসুফ বিন তাশফিনকে পত্র লিখবেন। তাঁকে বলবেন, একবার অন্তত আন্দালুসে এসে মুসলিম ভাইদের সাহায্য করতে। মু'তামিদ তাঁর সভাসদদের নিজের সিদ্ধান্ত জানালেন। কিন্তু কেউ কেউ তাঁর সিদ্ধান্ত স্বাগত জানালেও অনেকেই প্রতিবাদ করল। বিশেষ করে বিভক্ত রাজ্যসমূহের শাসকরা তাঁর সিদ্ধান্ত শুনে নাখোশ হলো। তারা বারবার তাঁর সাথে দেখা করে তাঁকে বুঝাতে লাগল যে, তিনি যেন ইউসুফ বিন তাশফিনের সাহায্য না চান।
যুবরাজ আবুল হাসান উবাইদুল্লাহ ছিলেন মু'তামিদ বিন আব্বাদের ছেলে। তিনিও এ বিষয়ে পিতার ঘোর বিরোধী ছিলেন। বিভক্ত রাজ্যের মুসলিম শাসকদের সুরে সুর মিলিয়ে তিনিও পিতাকে বুঝাতে লাগলেন। কিন্তু ইউসুফ বিন তাশফিনকে ডেকে আনতে মু'তামিদ বিন আব্বাদ ছিলেন অনড়। পুত্রের আপত্তির প্রতিউত্তরে তিনি এমন একটি স্বর্ণখচিত জবাব দিয়েছিলেন, যা আজও ইতিহাসে সুবাস ছড়িয়ে যাচ্ছে। আবুল হাসান উবাইদুল্লাহ বলেছিলেন-
-আপনি যে মুরাবিতদেরকে ডেকে আনছেন, তারা তো একসময় আপনার ক্ষমতাও ছিনিয়ে নেবে! তখন কী করবেন?!
-বেটা! আমি তো ইসলামের এই ভূমিকে কুফুরের ভূমিতে পরিণত হতে দিতে পারি না। আমি এ ভূমিকে খ্রিষ্টানদের হাতেও ছেড়ে দিতে পারি না। এমনটা যদি হতে দিই, কিয়ামত পর্যন্ত মুসলমানরা আমার ওপর কি অভিশাপ দিতে থাকবে না?! খোদার কসম, মারাকেশের সুলতানের উট চরানো আমার কাছে অধিক প্রিয়, খ্রিষ্টানদের শুকর চরানোর চেয়ে!
মু'তামিদ বিন আব্বাদের ডাকে লাব্বাইক বলে আগমন করেন সুদূর উত্তর আফ্রিকা থেকে মুরাবিত নেতা ইউসুফ বিন তাশফিন। ৪৭৯ হিজরি, মুতাবেক ১০৮৬ খিষ্টাব্দের ২৩ অক্টোবর, শুক্রবার সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক যাল্লাকার যুদ্ধ। মু‘তামিদ বিন আব্বাদ সে যুদ্ধে অত্যন্ত বীরদর্পে জিহাদ করেন। ইউসুফ বিন তাশফিনের রণকৌশলে মৃত্যুঞ্জয়ী নির্ভীক মুজাহিদরা অল্পক্ষণের মধ্যেই ক্রুশের পূজারি ষষ্ট আলফানসোর সৈন্যদের চোখে শর্ষেফুল দেখাতে লাগেন। অবশেষে বিজয় এসে পদচুম্বন করে ইউসুফ বিন তাশফিনের।
-------------
সূত্রাবলি:
১- فجر الأندلس, ১৩৯-২৮০, ড. হুসাইন মুআন্নিস
২- قصة الأندلس من الفتح الى السقوط, ১/৩৬৫, ড. রাগিব সারজানি
৩- نفح الطيب في غصن أندلس الرطيب ১/৫৬৬, ইমাম আহমদ বিন মুহাম্মাদ বিন আহমাদ মাক্কারি



ও! আন্দালুস
- তানভীর মাহমুদ

৫২৭ বছর
দীর্ঘ অপেক্ষা;
সেই পুরনো রাস্তা
সেই পুরনো দেওয়াল।
.
বিমূর্ত হৃদয়
ছুঁয়ে যায় আক্ষেপ,
দূরত্ব রাড়ে ধীরে
শেষে বিচ্ছেদ।
.
অস্থাবর আবাসে
খুঁজেছি স্থবিরতা,
হঠাৎ সুনামির আঘাত
আঙুলটাও ধরে রাখিনি।
.
আকাশ্চুম্বী মিনার নিচে
বসে জ্ঞানের আলাপ,
সন্তুষ চিত্তে ছিলাম
আমি বেখেয়াল।
.
জিয়াদ প্রণালির মুগ্ধতা;
চারদিকে উষ্ণ বিছানা,
সময়ের পালায় তাই
ভুলতে বসেছি তোমায়।
.
সবুজ আর কারুকার্য
সবার জন্য উন্মুক্ত;
প্রাচীর বসাইনি সামনে পিছনে
যা ছিল সবই প্রকৃতির।
.
ঝড়ের আগে বহু বিবাধ
অপরের বিরুদ্ধে হাঁকডাক;
জমা তুষারে একটু গরম
সেই তো শুরু অধঃপতন।
.
মনে পড়ছে সেই গিরিপথ
শিক্ষায় বুনা সভ্যতা,
মাটিতে চাষাবাদ
আহ! বড় দুর্দিন আজ।
.
প্রবল বেগে হানা দিল
পাহাড়সম ঢেউ,
ঈমান তলানিতে; নেতৃত্বে গোলযোগ
ভূমিতে মিলল না ঠাই।
.
কোনমতে দিলাম পাড়ি
সাগরে তরী; ভিড়লাম মাগরেব,
সাহস হয়নি ফিরে তাকানোর
স্মৃতিও ভুলে গেছে সিন্দাবাদ।
.
বজ্রের শব্দে আজ
মনে পড়ল সব,
চারদিক থেকে ধ্বনি শুনি
ভোগ করতে আমার মাংস।
.
তোমায় অনুভব করি
আমি দুর্ভাগা,
আশেপাশে তাকিয়ে দেখি
নর-নারী,শিশু বাহারি সুখে।
.
সবাই ভুলে গেছে
মনে করতেও লাগে ভয়,
যদি এ স্থান ছেড়ে মাঝপথে
কারাগারে জায়গা হয়।
.
পচা হৃদয় নিয়ে বেড়েয়েছি
মরিচীকার খবর জানি,
খুব সুন্দর টোপ
তবুও সতর্ক ইঁদুর।
.
একটি ঘোড়া,একটি তরবারি
একা মুসাফির বড্ড ক্লান্ত;
যে মরুপথ ধরে আসা
সে পথে ফেরার বাসনা।
.
তবুও সেই ঘ্রাণ আসে
নাকে লাগে হালকা,
হয়ে উঠব সজাগ
সময় ঘনিয়ে আসছে।
.
অপেক্ষায় রেখেছি তোমারে
দেখবে আমি আসব,
ধ্বংস গড়ার মধ্যদিয়ে
তোমার কাছে ফিরব।

২৫-১২-২০১৮
প্রথম হিশাম ও প্রথম হাকাম

আন্দালুসের প্রথম আমীর আব্দুর রহমান আদ-দাখিল এবং তার পুত্র হিশাম খুবই ধর্মপরায়ণ ছিলেন। হিশাম ছিলেন পিতার কনিষ্ঠ পুত্র, তবু তার পিতা তাকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন কারণ হিশাম ছিলেন বিচক্ষণ, ধার্মিক এবং অন্যান্য ভাইদের চেয়ে বেশি যোগ্য।

কোথা থেকে হিশাম এক ভবিষ্যদ্বাণী শুনেছিলেন তিনি মাত্র ৮ বছর রাজত্ব করবেন, এই ভবিষ্যদ্বাণী তার জীবনের উপর বিরাট প্রভাব ফেলে। হিশাম সত্যই মাত্র ৮ বছর শাসন করে ৪০ বছর বয়সে ইনতেকাল করেন। এই ৮ বছর তিনি ইহকালীন লাভের চেয়ে পরকালীন লাভকে বেশি প্রাধান্য দেন।

তিনি ইমাম মালিকের ভক্ত ছিলেন মতান্তরে শিষ্য। হিশাম ইমাম মালিকের মাযহাবকে রাষ্ট্রীয় মাযহাব হিসেবে গ্রহণ করেন। হিশাম যখন ৭৮৮ সালে ক্ষমতায় বসেন তখনও ইমাম মালিক জীবিত। ইমাম মালিক মারা যান ৭৯৫ সালে। এর পরের বছর ৭৯৬ সালে হিশাম মারা যান।

ইমাম মালিকের মাযহাব টিকে থাকা ৪ মাযহাবের মধ্যে অন্যতম হওয়ার পেছনে হিশামের ভূমিকা অনেক বেশি, ইমাম আবু ইউসুফের কারণে যেমন হানাফি মাযহাব প্রসিদ্ধি পেয়েছে, হিশামের কারণে মালিকী মাযহাব।

হিশামকে মুঘল সাম্রাজ্যের হুমায়ূনের সাথে তুলনা করা যায়। হুমায়ূন যেমন পিতা বাবুরের রেখে যাওয়া সাম্রাজ্যকে ধরে রেখেছিলেন, বৃদ্ধি ও সুসংহত করেছিলেন, হিশামও তেমনি পিতা আব্দুর রহমানের আমিরাতকে শক্তিশালী করেছিলেন। হুমায়ূনের ভাইয়েরা যেমন হুমায়ূনের বিরোধিতা ও বিদ্রোহ করেছিলেন তেমনি হিশামের ভাইয়েরাও তার বিরোধিতা ও বিদ্রোহ করেছিলেন।

হিশামের ৮ বছরের শাসনামলে অনেকগুলো বিদ্রোহ হয়, আর হিশাম সেগুলো দমন করে আমিরাতকে রক্ষা করেন। হিশামকে উমাইয়া খলীফা উমার বিন আব্দুল আজিজের সাথে তুলনা করা হয়। উমারের মত তিনিও শরঈ শাসনকে সুদৃঢ় করেন। আলিম ফুকাহাদের প্রাধান্য দিতেন। আলিম ও ফকীহদের মত নিয়েই দেশ চালাতেন।

কিন্তু হিশামের মৃত্যুর পর তার পুত্র হাকাম ক্ষমতায় বসে সব পাল্টে দেন। মদাসক্ত হাকাম নিজের ইচ্ছেমত দেশ পরিচালনা শুরু করেন, ফকীহদের ক্ষমতা কেড়ে নেন। ফলে আমিরাত হয়ে উঠে স্রেফ রাজতান্ত্রিক স্বৈরাচারী রাষ্ট্র, আলিম ও ফকীহরা এর বিরোধিতা করলে তাদের উপর অত্যাচার শুরু হয়। ফকীহরা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। কিন্তু হাকাম তা শক্ত হাতে দমন করে। এভাবেই শুরু হয় আলিম ও ফকীহদের বাদ দিয়ে স্পেনে রাজতান্ত্রিক শাসন। হিশামকে যদি হুমায়ূনের সাথে তুলনা করা যায় তাহলে হাকামকে আকবরের সাথে, যদিও হাকাম আকবরের মত মুরতাদ ছিল না।

হাকাম দীর্ঘ ২৬ বছর রাজত্ব করেন ফলে এর প্রভাব পরবর্তীতে বজায় থাকে। হাকামের মাধ্যমেই প্রথম আন্দালুসের মুসলিম শাসন তার অবস্থানচ্যুত হয় যা পরবর্তীতেও তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি।








আন্দালুসের পতন ও উসমানীয় খিলাফাহ

১৪৯২ সালে স্পেনে মুসলমানদের পতন হয় তখন উসমানীয় সুলতান ২য় বায়েজিদ ইনকুইজিশনের হাত থেকে স্পেনের মুসলিম ও ইহুদীদের বাঁচাতে কামাল রেইসকে পাঠান এবং তাদের নিয়ে এসে আশ্রয় দেন। এটা অবশ্যই প্রশংসনীয়, কিন্তু আন্দালুসকে আবার জয় করার ব্যাপারে বায়েজিদ কিংবা তার পরবর্তী বংশধরদের কোনো চিন্তা ভাবনা ছিল না।
বায়েজিদ একজন বীরের সন্তান ছিলেন, কনস্টান্টিনোপল-বিজেতা মুহাম্মাদ আল ফাতিহের পুত্র ছিলেন বায়েজিদ। কিন্তু নিজের দায়িত্ববোধ স্পেনের মুসলিমদের আশ্রয় দেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। বায়েজিদের পুত্রও একজন বীর ছিলেন, ইয়াভুজ সেলিম। সেলিম ছিলেন উসমানীয় প্রথম খলীফা। তিনি ১৫১৭ সালে মিশর বিজয় করে মামলুকদের পরাজিত করেন, নিজেকে খলীফা ঘোষণা করেন, মক্কা মদিনার খাদেম হয়ে গর্বিত হন। আর ওদিকে পারস্যে মাথা তুলে দাঁড়ায় এক শিয়া সাম্রাজ্য, সাফাভি সাম্রাজ্য। আবার মধ্য এশিয়া থেকে গিয়ে ভারতে বাবুর গড়ে তুলেন মুঘল সাম্রাজ্য। চারিদিকে এতো মুসলিম সাম্রাজ্য, তবু হারানো আন্দালুস নিয়ে কারোই মাথাব্যথা ছিল না। প্রত্যেকেই নিজ নিজ সাম্রাজ্য বিস্তারে মুসলমান প্রতিপক্ষকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু খ্রিস্টান ইউরোপ ছিল ঐক্যবদ্ধ।
কনস্টান্টিনোপল-বিজেতা মুহাম্মাদের স্বপ্ন ছিল খ্রিস্টানদের সবচেয়ে বড় আস্তানা রুমকেও বিজয় করবেন, কিন্তু তার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়, তিনি রুম বিজয় করার আগেই মারা যান। মুহাম্মাদের স্বপ্ন পূরণে বায়েজিদ বা তার পুত্র সেলিমের আগ্রহ বা পরিকল্পনা ছিল না। মুহাম্মাদের স্বপ্ন আবার জেগে উঠে তার প্র-পৌত্রের মধ্যে। ১৫২০ সনে সুলাইমান হন উসমানীয় সুলতান। উসমানীয় দ্বিতীয় খলীফা।
রুম বিজিত হলে অবশ্য আন্দালুস বিজয় আরও সহজ হয়ে যেতো। কিন্তু রুম বাদ দিয়ে আন্দালুস বিজয় সম্ভব ছিল না। কারণ ইউরোপের এক মাথায় তুরস্ক, অন্য মাথায় স্পেন। উমাইয়ারা স্পেনে ঢুকেছিল মরক্কো দিয়ে, অর্থাৎ আফ্রিকা দিয়ে। আর তুরস্কে উসমানীয়রা এসেছিল মধ্য এশিয়া থেকে।
যাই হোক, সুলাইমান রুম বিজয়ের স্বপ্ন লালন করতেন, তাই বারবার হানা দিতেন ইউরোপে। হাঙ্গেরি পর্যন্ত বিজয় করতে পেরেছিলেন। এরপর আগে বাড়তে পারেন নি। তার রুম বিজয়ে পানি ঢেলে দেয় সাফাভীরা। সাফাভিদের সাথে অপ্রয়োজনীয় অনেক যুদ্ধ হয়, সময় নষ্ট হয়, আর ওদিকে ইউরোপ শক্তিশালী হয় নিজেদের হারানো অঞ্চলগুলো দখল নিত।
এছাড়াও সুলাইমানের রুম বিজয় হয়নি প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কারণে। সাম্রাজ্য ছিল বিশাল, তাই বিদ্রোহও হতো বেশি, ঐক্যের চেয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ছিল বেশি। সুলাইমানের এই স্বপ্ন তার যোগ্য পুত্র মুস্তাফার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল। কিন্তু প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মারপ্যাঁচে মারা পড়ে পার্গালি, মুস্তাফা, বায়েজিদের মত রুম বিজয়ের স্বাপ্নিকরা। এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সুলাইমান অজ্ঞাত থাকলেও হত্যাগুলোর জন্য তাকেই দায়ি করা হয়, সুলাইমান নিজেই নিজেকে পঙ্গু করেছিলেন, নিজের শ্রেষ্ঠ সম্পদকে নিজেই শেষ করে দিয়েছিলেন।
সুলাইমান শেষ বয়সে ইউরোপেও ভালো অবস্থান ধরে রাখতে পারেন নি, যার ফলে অযোগ্য পরবর্তী বংশধরদের হাতে হারিয়ে যায় বিশাল সাম্রাজ্য। রুম যদি সত্যিই জয় করতে পারতেন তবে আজ ইউরোপ থাকতো আমাদের। এক কথায় পুরো পৃথিবী থাকতো মুসলমানদের। রুম বিজিত হলে আন্দালুসও ফিরে পেতাম আমরা।
রুম একদিন অবশ্যই মুসলমানদের হবে ইনশাআল্লাহ্‌, সাথে আন্দালুসও। কিন্তু সেই বিজয়ী কাফেলায় আমরা থাকবো কি?













জে সুইস বালাতুশ শুহাদা!
আতিক উল্লাহ
দিনলিপি-৩৭৯
(১৫-১১-২০১৫)

--
কোনটা ছেড়ে কোনটা দিয়ে শুরু করি! তাই একক শিরোণাম দেয়া সম্ভব হলো না। আরও কয়েকটা শিরোণাম বাদও পড়ে গেছে:
ক: আবদুর রহমান গাফেকী: আনসাঙ হিরো!
খ: টুরস: মুসলিম-ফরাসি সংঘাত!
গ: ফ্রান্সের বর্বর হত্যাকান্ডে আমদের ‘কনডোলেন্স’!
ঘ: মুসলিম বিশ্বে ফরাসী আগ্রাসন!
ঙ: ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক সূত্র!
--
শুধু শিরোণাম দিয়েই বিশাল পোষ্ট সাজিয়ে ফেলা যাবে। তবুও আবেগের বেগ ফুরোবার নয়। কিছু কষ্ট আছে সারাক্ষণ মনের মধ্যে খচখচ করে। চোরা কাঁটার মতো। ‘বালাতুশ শুহাদা’ শব্দটাও এমনি এক ‘চোরাকাঁটা’।
.
উমার বিন আবদুল আযীয (রহ.)এর খিলাফতকাল হলো ৭১৭ থেকে ৭১৯ সাল। তিনি দায়িত্ব নিয়েই একটা অসাধারণ সিদ্ধান্ত নেন। সামাহ বিন মালিককে আন্দালুসের গভর্নর নিয়োগ করেন। এর আগে আন্দালুস সাধারণত আফ্রিকার অধীনে থাকতো। উমার বিন আবদুল আযীযের আগের খলীফারাও আন্দালুসে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতেন। কিন্তু উমার প্রথমেই আন্দালুসকে সরাসরি কেন্দ্রের অধীনে নিয়ে আসেন।
.
মুসা বিন নুসাইর (রহ.)। তিনি আন্দালুসে অভিযান চালিয়ে যেতে যেতে ফ্রান্সের অভ্যন্তর ভাগে পৌঁছে গিয়েছিলেন। উত্তর-পশ্চিমের ‘উরবুনা’ শহর পর্যন্ত দখল করেছিলেন। সামাহ বিন মালিক দায়িত্ব পেয়ে আবার অভিযান শুরু করলেন। তিনি ফ্রান্সের পুরো উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল দখল করে ফেলেন।
.
পাশাপাশি ইসলামের প্রচারও চালিয়ে যেতে থাকেন। দিকে দিকে দায়ী প্রেরণ অব্যাহত রাখেন। ৭২১ সালে তুলসের ময়দানে সামাহ শহীদ হন।
---------------
আবদুর রাহমান:
তিনি ছিলেন ইয়ামনের মানুষ। পড়াশোনা করেছেন আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা.)-এর কাছে। একজন তাবেয়ীর যা যা গুণাবলী থাকা দরকার তার মধ্যে সবই ছিল।
.
আবদুর রাহমান এক প্রতিনিধি দলের সাথে, উমাইয়া খলীফা সুলাইমান বিন আবদুল মালিক (৭১৪-৭১৭)-এর দরবারে, দিমাশকে আসেন। কিছুদিন সেখানেই অবস্থান করেন। পরে মরক্কোতে চলে আসেন। মুসা বিন নুসাইর ও মুসার ছেলে আবদুল আযীযের সাথে মুজাহিদ বাহিনীর সাথে যোগ দেন। কিছুদিন আন্দালুসের পূর্ব-উপকূলীয় এলাকার শাসনের দায়িত্বও পালন করেন।
.
সামাহ বিন মালিকের বাহিনীর সাথে তিনিও ছিলেন। সামাহ শহীদ হওয়ার পর, সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। সবাই মিলে আবদুর রহমানকে নেতা নির্বাচন করে। দায়িত্ব পেয়েই তিনি সব সৈন্যকে একত্র করেন। নিরাপদে ফিরে আসেন। ফিরে আসার কাজটা ছিল তার অনন্য কৃতিত্ব। কারণ, খ্রিস্টান বাহিনী পদে পদে ওঁৎ পেতে বসে ছিল।
.
মাত্র দু’মাস সময় পেয়েছিলেন। এ-স্বল্প সময়ে তিনি আন্দালুসে শান্তি-শৃক্সখলা ফিরিয়ে এনেছিলেন। ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়া সেনাদেরকে একত্র করেছিলেন। পুরো দেশকে পুনর্গঠন করেছিলেন।
.
দুইমাস পর, আনবাসাহ বিন সুহাইমকে আন্দালুসের গভর্নর করে পাঠানো হয়। আনবাসাহও ছিলেন অত্যন্ত যোগ্য সেনাপতি। আবার নতুন করে অভিযান শুরু হয়। তিনি যেতে যেতে প্যারিসের ৩০ কিলোমিটার দূরত্বে পৌঁছে যান। অর্থাৎ ফ্রান্সের ৭০% এলাকা মুসলিম শাসনাধীনে চলে আসে। ৭২৫ সালে আনবাসাও শহীদ হয়ে গেলেন।
.
তারপরে পাঁচবছরে ছয়জন গভর্নর রদবদল হয়। পুরো দেশে বিশৃক্সখলা ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ জিহাদবিমুখ হয়ে যায়। আরব ও বারবার গোত্রগুলো পরস্পর কলহে লিপ্ত হয়।
.
দিমাশকে খলীফা হলে হিশাম বিন আবদুল মালিক। ৭২৩-৭৪২। তিনি আন্দালুসের অবস্থা দেখে, যাচাই-বাছাই করে, আবদুর রাহমানকে পুনরায় গভর্নর হিশেবে নিয়োগ দেন।
.
তার মধ্যে দু’টো গুণের চমৎকার সমাবেশ ঘটেছিল:
ক: দৃঢ়তা।
খ: দয়া।
দুটো গুণকেই তিনি চমৎকারভাবে প্রয়োগ করতে পারতেন। পাশাপাশি তিনি ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শাসক। ছিলেন সংস্কৃতমন। কর্ডোভার বহু স্থাপনা তার হাতেই নির্মিত হয়। বিখ্যাত কর্ডোভা-সেতুও তার হাতে নির্মিত হয়। আজো সেটা জনসাধারণের পরাপারে ব্যবহৃত হয়। সেতু নির্মাণের কাজটা কারো কারো মতে সামাহ বিন মালিকেরও বলে থাকে।
.
দায়িত্বভার পাওয়ার পর, প্রথম কিছুদিন গোত্রীয় দ্বন্দ্ব-বিবাদ মেটানোর পেছনে সময় ব্যয় করেন। একটানা দুই বছর প্রস্তুতি নেন। তারপর বিশাল বাহিনী নিয়ে রওয়ানা দেন ফ্রান্স সীমান্তের দিকে। আগের দখল করা এলাকা পুনর্দখল করেন। আবার পিরেনিজ পর্বতমালা পার হয়ে, প্যারিসের ত্রিশ কিলোমিটার দূরত্বে পৌছেন।
.
আবদুর রাহমান সব সময় একটা কথাই মনে রাখতেন। সেটাই তাকে এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে প্রেরণা যুগিয়েছে। কথাটা তৃতীয় খলীফা উসমান রা.-এর:
-কনস্টান্টিনোপল বিজিত হবে আন্দালুসের পথ ধরে। আন্দালুস বিজিত হলে, কনস্টান্টিনোপলও বিজিত হবে।
তাই আবদুর রাহমান চাচ্ছিলেন এদিকে যতোটা সম্ভব এগিয়ে যাওয়া যায়।
---
বালাতুশ শুহাদা:
আমরা আজ অতি সংক্ষেপে কাজ সারবো। ইনশাআল্লাহ পরে বিস্তারিত বিশ্লেষণসহ লেখা আসবে।
আবদুর রাহমানকে এগিয়ে আসতে দেখে, ফ্রান্স উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো। পোপও তৎপর হয়ে উঠলো। সেনাপতি শার্ল মার্টেলকে দায়িত্ব দেয়া হলো। দুই দল মুখোমুখি হলো ‘টুরস’এর ময়দানে।
.
যুদ্ধ চললো একটানা ছয়-সাতদিন যুদ্ধ চললো। কোনও পক্ষই একক সুবিধা করে উঠতে পারছিল না। অষ্টম বা নবম দিনে একটা ঘটনা ঘটলো। কিছু খ্রিস্টান অশ্বারোহী উল্টো দিক থেকে মুসলিম তাঁবুতে অতর্কিতে হামলা করলো। বারবার সৈন্যরা সাথে করে স্ত্রী-পুত্রও নিয়ে যেতো। তারা এ-হামলার সংবাদে বিচলিত হয়ে পড়লো।
তারা তাঁবু বাঁচাতে, পরিবার বাঁচাতে ছুটলো। মুসলিম বাহিনীতে বিশৃক্সখলা দেখা দিল। সেনাপতি গাফেকী অনেক চেষ্টা করলেন শৃক্সখলা ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু সফল হলেন না। তিনি এর মধ্যেই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। বীর বিক্রমে। হঠাৎ একটা তীর এসে তার গায়ে বিঁধলো। তিনি ময়দানেই শহীদ হয়ে গেলেন।
.
এবার মুসলিমর পুরোপুরি দিশেহারা হয়ে পড়লো। এই সুযোগে খ্রিস্টানরা মুসলমানদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেললো। তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো। রাত নেমে এলো। অসমাপ্ত অবস্থায় উভয় দল নিজ নিজ শিবিরে ফিরে গেলো। রাতের বেলা মুসলমানরা নিরাপদ স্থানে সরে আসতে সক্ষম হয়েছিল।
.
এ-যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের কারণে, সামনে ইউরোপের দিকে আগে বাড়ার পথ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী প্রতাপশালী উমাইয়া শাসকরাও কেন যেন সেদিকে আর পা বাড়াননি।
.
.
------------
ফরাসী কুকীর্তি:
এক: আন্দালুসে প্রথম অভিযান পরিচালনাকারী হলো ফরাসী স¤্রাট শার্লাম্যান।
-
দুই: বার্সেলোনাকে মুসলমানদের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলো ফরাসীরা।
-
তিন: ষষ্ঠ আলফেঞ্চো টলেডো দখল করেছিল। তাকে সাহায্য করেছিল ফরাসিরা।
-
চার: টলেডো শহর দখল করলো ষষ্ঠ আলফেঞ্চো। শহর হস্তান্তর করার সময় একটা শর্ত ছিল, শহরের বড় মসজিদটা চিরকাল মসজিদ হিশেবে থেকে যাবে। সেখানে মুসলমানরা ¯^াধীনভাবে ধর্ম পালন করতে পারবে। দুই মাস পরে আলফেঞ্চো বিশপ বারনারকে শহরের ধর্মীয় দায়িত্ব দেয়। বিশপ মসজিদকে গীজায় রূপান্তরিত করেছিল। সে ছিল ফরাসী। ১০৮৫ সালে মসজিদ গীর্জায় রূপান্তরিত হয়।
১২২৬ সালে তৃতীয় ফার্ডিন্যান্ড মসজিদটিকে পুরোপুরি গুঁড়িয়ে দিতে বলে। পরে সেখানে নির্মাণ করা হয় গথিক গীর্জা। ১৪৯৩ সালে আবার সংস্কার করা হয়।
আর টলেডো শহর দখলে আলফেঞ্চোকে ফরাসী সৈন্যরাও সাহায্য করেছিল। পরে মুরাবিতদের বিরুদ্ধেও তাকে ফরাসীরা সাহায্য করেছিল।
ইউসুফ বিন তাশাফীনের বিরুদ্ধে যাল্লাকার যুদ্ধেও তাকে ফরাসীরা সাহায্য করেছিল।
-
পাঁচ: আরাগন রাজ্য মুসলমানদের থেকে সারাকুস্তা শহর দখল করে নিয়েছিল। তখন খ্রিস্টান আরাগনকে সাহায্য করেছিল ফরাসীরা।
-
ছয়: তুরতুশা শহর দখলেও ফরাসীদের সহযোগিতা ছিল।
-
সাত: উকাব যুদ্ধে অষ্টম আলফেঞ্চোকে ৫০ হাজার সৈন্য দিয়ে ফরাসিরা সাহায্য করেছিল।
-
আট: বিভিন্ন ক্রুশেড হামলা বের হয়েছিল ফ্রান্সের ক্লেরমন্ট শহর থেকে।
-
নয়: আরবরা ইউরোপীয় খ্রিস্টানদেরকে ‘ফারানজা’ বলতো। এখনো বলে। কারণ, ক্রুশেড যুদ্ধে আগত বেশির ভার যোদ্ধাই ছিল ফরাসী।
-
দশ: আরনল্ড যে হজযাত্রীদেরকে উত্যক্ত করতো। ধরে ধরে হত্যা করতো, নবিজী (সা.)কে অশালীন ভাষায় গালি দিতো। এ নরাধম ছিল ফরাসী। সালাহুদ্দীন আইয়ুবী রহ. তাকে নিজ হাতে হত্যা করেছিলেন।
-
এগার: বর্তমানের স্পেনে রাজা চার্লল। তার মূলও ফরাসী। মনসুরার যুদ্ধে বন্দী হয়েছিল ফরাসী সম্রাট নবম লুইস। রাজা চার্লস তারই বংশধর।
-
বারো: মিসরের মনসুরার যুদ্ধে নবম লুইস বন্দী হয়েছিল। তার সাথে একজন ঐতিহাসিকও বন্দী হয়েছিল। তার নাম গুয়ানফেল। সে লিখেছে:
-সম্রাট যুদ্ধে পরাজয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করেছিল। শেষে কয়েকটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল:
ক: সামরিক ক্রুশেডের পাশাপাশি ‘শান্তিময় ক্রুশেডও চালাতে হবে। দুটোর লক্ষ্য হবে এক, কিন্তু অস্ত্র হবে ভিন্ন।
খ: পাশ্চাত্যের ধর্মপ্রচারকদেরকে ব্যবহার করতে হবে। তারাই শান্তি ক্রুশেডে নেতৃত্ব দিবে। তারা ইসলামি শিক্ষার বিরুদ্ধে লড়াই করবে। তার অগ্রগতি ঠেকাবে। তাদেরকে আত্মিকভাবে নিঃসাড় করবে।
গ: পাশ্চাত্যের লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রাচ্যের খ্রিস্টানদেরকে ব্যবহার করতে হবে।
ঘ: প্রাচ্যের ভেতরেই পাশ্চাত্যের জন্যে ঘাঁটি তৈরী করতে হবে।
কারণ মুসলমানদের সাথে শুধু যুদ্ধ করে পেরে ওঠা যাবে না। তাদের ধর্মে এক প্রচন্ড প্রতিরোধ শক্তি আছে। তারা এ শক্তিবলে বলীয়ান হয়ে জিহাদ করে। আত্মত্যাগ করে। সম্মান ও নিজেদের ভূমি রক্ষা করে।
তাদের মধ্যে এ-চেতনা থাকলে, হারানো মুশকিল। তাদের এই আত্মিক শক্তিকে নষ্ট করে দিতে হবে। বিকৃত করে দিতে হবে।
.
তেরো: সম্রাট নেপোলিয়ন মিসরে প্রবেশ করে জামে আযহারের মসজিদে ঘোড়াসহ ঢুকেছিল। মসজিদকে অপবিত্র করেছিল। কুরআন কারীমের বড় বেশি অবমাননা করেছিল। মসজিদের পেশাব-পায়খানা পর্যন্ত করেছিল। ছাত্রদের কিতাবপত্র-সামান সব তছনছ করে ফেলা হয়েছিল। জামে আযহারকে মদ্যপানের আখড়া বানিয়েছিল। তিন বছরে মিসরের এক তৃতীয়াংশ জণগনকে শহীদ করেছিল। শায়খুল আযহার শারকাবী-কে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল।
.
চৌদ্দ: ফ্রান্স আলজেরিয়াতে ১০ মিলিয়ন মুসলমানদেরকে শহীদ করেছিল।
.
পনের: ফরাসি পত্রিকা শার্লি এবদো। নবিজী (সা.)কে ব্যঙ্গ করে কার্টুট ছাপিয়েছিল। প্রতিবাদ করার পর, তারা দম্ভভরে ঘোষণা দিয়ে আরও ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ফরাসি সরকার ও জণগন এটাকে স্বাগত জানিয়েছিল।
.
ষোল: ফরাসীরা গণহত্যা চালিয়েছিল লিবিয়ায়। সিরিয়ায়। তিউনিসিয়ায়। আফ্রিকার অনেক দেশে। বর্তমানে মালিতে। ইরাকে। সিরিয়াতে। এখনো প্রতিদিন হত্যা করছে।
.
সতের: ফ্রান্সের আনফালিদ (আরবী উচ্চারণ) জাদুঘরে দুইটা মাথার খুলি উপর-নীচ করে রাখা হয়েছে। উপরেরটার নাম জেনারেল ক্লেয়ার। তাকে হত্যা করা হয়েছিল মিসরে। লক্ষ্য ছিল নেপোলিয়ন। ভুলে ক্লেয়ার মরেছে। মুজাহিদের নাম সুলাইমান হালাবী। মিসরবাসীর প্রতি অপমান সহ্য হয়নি তার। প্রতিশোধ নিতেই এটা করেছিলেন। তার ডানহাতকে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। তারপর সূচালো দন্ডেরও ওপর রেখে শহীদ করা হয়েছে। সে জাদুঘরে নিচের তাকে রাখা খুলিটা এ মহান মুজাহিদের। পাশে নেমপ্লেটে লেখা: কুখ্যাত খুনি সুলাইমান হালাবী।
.
আঠার: ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চল অর্ধশতাব্দীরও বেশি মুসলমানদের শাসনে ছিল। ফ্রান্সের ‘রন’ নদীর তীর এক সময় মুসলিম মুজাহিদদের পদভারে প্রকম্পিত থাকতো।
.
উনিশ: ১৯৩৮ সালের আগস্ট মাসে, আলজেরিয়ার আওরাস অঞ্চলে ‘কুরআনি মাদরাসা’গুলো এক সরকারী ঘোষণায় বন্ধ করে
দেয়। প্রায় ৮ লাখ শিশুকে ধর্মীয় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার গভীর ষড়যন্ত্র রচনা করা হয়েছিল।
.
বিশ: ১৯৫২ সালে ফরাসি পররাষ্ট্র দফতরের এক কর্মী বলেছিল:
-সমাজতন্ত্র পাশ্চাত্যের জন্যে কোনও হুমকি নয়। ইসলাম ও মুসলমানরাই প্রকৃত হুমকি। তারা স্বতন্ত্র একটা সভ্যতার দাবীদার। আমাদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের রয়েছে আলাদা ঐতিহ্য। মৌলিক ও যৌক্তিক। তারা নিজেরাই স্বতন্ত্র বিশ্ব গঠন করতে সক্ষম। নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখেই তারা এটা পারবে। পাশ্চাত্য সভ্যতার বিন্দুমাত্র সাহায্য না নিয়েই। আর তারা যখন শিল্প-উৎপাদনে স্বতন্ত্র হয়ে পড়বে, তাদের ঐতিহ্যটাকে তারা অন্যদিকে ছড়িয়ে দিতে তৎপর হয়ে উঠবে। বিলুপ্ত করে দিবে পাশ্চাত্য সভ্যতার মূল ভিত। সেটাকে ছুঁড়ে ফেলবে ইতিহাসের জাদুঘরে।
.
একুশ: ২০১৩ সালের কথা। মধ্য আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসো বুযিযি ফ্রান্সের কাছে সাহায্যের আবেদন করলো। বিদ্রোহীরা তার রাজধানী দখল করে নিচ্ছে। ফ্রান্স ২৫০ সৈন্য পাঠাল। শুধু বিমানবন্দর রক্ষা করার জন্যে। কারণ ওখানে ফরাসী স্বার্থ জড়িত।
ঠিক একই দিন জানুয়ারির ১১ তারিখ ২০১৩ সালে, ফ্রান্স মালিতে ২৫০০ সৈন্য পাঠিয়েছিল। কারণ সেখানে ইসলামি দল ক্ষমতা দখল করতে এগিয়ে আসছে।
এখন প্রশ্ন হলো: দুটি রাষ্ট্রই ফ্রান্সের সাবেক উপনিবেশ। দুই দেশের খনিজ সম্পদও সমান। কিন্তু দুই নীতি কেন?
.
বাইশ: ১৯৬৭ সালে ইহুদি সৈন্যরা কুদসে অনুপ্রবেশ করে। প্যারিসে বসবাসরত ইহুদি ও খ্রিস্টানরা আনন্দ মিছিল বের করেছিল। তাদের হাতে ছিল ইসরাঈলের জন্যে দানবাক্স। ওপরে লেখা ছিল:
-মুসলমানদেরকে হত্যা করো।
মাত্র চারদিনে চাঁদা উঠেছিল এক হাজার মিলিয়ন ফ্রাংক।
ইসরাঈল থেকেও কার্ড ছাপানো হয়েছিল। লেখা ছিল ‘চাঁদের পরাজয়’। এসব কার্ড বিক্রির জন্যে পাঠানো হয়েছিল ফ্রান্সে। সংগৃহীত হয়েছিল আরও মিলিয়ন মিলিয়ন ফ্রাংক।
.
তেইশ: ১৭ অক্টোবর, ১৯৬১ সাল। প্যারিসে শান্তিপূর্ণ মিছিল বের হলো। আলজেরিয়ান অভিবাসী মুসলমানরা ছিল উদ্যোক্ত। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে। ৩০০রও বেশি মুসলিমকে সেদিন শহীদ করে দেয়া হয়েছিল। আর অগণিত আহতকে জীবিত অবস্থায় সীন নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছিল। নদীর পানি লাল হয়ে গিয়েছিল। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ভেসে ওঠা লাশ দেখা গিয়েছিল।
.
চব্বিশ: ১৯২৯ সাল। এক ফরাসি পত্রিকা একটা অঙ্কিত কাল্পনিক ছবি ছাপলো। তাতে দেখানো হয়েছে, ফিলাস্তীনে একদল মুসলমান ইহুদিদেরকে তলোয়ার দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করছে। অথচ তখন এমন কোনও ঘটনাই ঘটেনি।
.
পঁচিশ: ১৮১৮ সালে দাই হাসান পাশা আলজেরিয়ার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি খুবই যোগ্য লোক ছিলেন। যে কোনও উৎসব উপলক্ষে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা তার সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হতো।
২৯ এপ্রিল, ১৮২৭ সালে, ঈদুল ফিতরের দিন। সবাই এসেছে। ফরাসি দূতও উপস্থিত। এক পর্যায়ে ফরাসি দূতের কথাগুলো অপমানজনক মনে হলো পাশার কাছে। তিনি ফরাসী দূতকে দরবার ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বললেন। দূর বৈঠক থেকে নড়লো না। পাশা তাকে রুমাল উঁচিয়ে চূড়ান্ত হুমকি দিলো।
দূর সেখান থেকে বের হয়ে, বানিয়ে-ফেনিয়ে দেশে দেশে একটা চরমপত্র লিখলো। চিঠির সূত্র ধরে ফরাসী সৈন্য এসে আলজেরিয়া দখল করে নিল। ১৩০ বছর সে দখল স্থায়ী হয়েছিল।
.
ছাব্বিশ: নেপোলিয়ন মিসরে আসার পর মিসরবাসী বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তখন অসংখ্য আলিম-ওলামা ও নেতাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। বড় বড় ব্যক্তিদেরকেও অত্যন্ত অপমানজনকভাবে হত্যা করা হয়। সে বিদ্রোহ দমনে ২৫০০-রও বেশি মানুষতে হত্যা করা হয়।
নেপোলিয়ন এক চিঠিতে ফরাসী দার্শনিক ‘রেনে’-কে গর্বভরে লিখেছিল:
-প্রতি রাতেই ৩০ জন নেতার শিরোশ্চেদ করি। আশা করি তাদের উচিত শিক্ষা হবে।
.
সাতাশ: ১৭৯৮ সালে মিসরীরা নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। অক্টোবরে। ফরাসী সেনার যতভাবে নিরীহ মানুষকে দমন করা সম্ভব, সব পন্থা অবলম্বন করলো।
অসহায় মানুষগুলো জামে আযহাবে আশ্রয় নিলো। নেপোলিয়ন আদেশ দিলো, দুর্গের ওপর কামান রেখে, জামে আযহার উড়িয়ে দিতে। ভেতরে যারা আছে তাদেরকে হত্যা করতে।
কামানের আঘাতে শুধু আযহার নয়, আশেপাশের ঘরগুলোও নষ্ট হয়ে গেলো। নেপোলিয়ন জানতো, মিসরীরা আযহারকে সম্মানের চোখে দেখে। সে সম্মান ধূলোয় মিশিয়ে দিলে, তাদের মনোবল ভেঙে যাবে। আর আন্দোলনের নেতাগুলো আযহার থেকেই বের হয়।
.
আঠাশ: ক্রুশেড হামলা শুরু হয়েছিল ১০৯৬ সালে। শেষ হয়েছে ১২৭০ সালে। প্রথম ক্রুশেড পরিচালনা করেছিল বুতরুস। সে ছিল এক মিথ্যাবাদী ফরাসী। চরমভাবে পরাজিত হয়েছিল।
শেষ দুই ক্রুশেডও চালিয়েছিল নবম লুইস। প্রথমটাতে বন্দী হয়েছিল মিসরে। পরে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছিল।
পরে আবার ১২৭০ সালে ক্রুশেডে এসেছিল। আক্রমণ করেছিল তিউনিসিয়ায়। সেটা দখল করা সহজ বিধায়। কিরতাজ এলাকার বীরসা নামক পাহাড়ের কাছে সে এবং তার সৈন্যরা মহামারীতে আক্রান্ত হয়। সবাই মারা পড়ে। লুইসকে পুড়িয়ে দেয়া হয়। তখনকার রীতি অনুযায়ী।
১৮৮১ সালে যখন ফরাসীরা তিউনিসিয়া দখল করতে এল, তখন তারা বীরসা পাহাড়ে একটা স্মৃতিস্তম্ভ তৈরী করলো।
ফরাসীর তাদের ক্রুশেডীয় চিন্তা নিয়েই লিপ্ত ছিল। ১৯৩০ সালে তারা ক্রুশ উঁচিয়ে ঘোষণা তারা বায়তুল মুকাদ্দাসে অভিযান চালাবে!
.
উনত্রিশ: ১৯৩০ সালে ফরাসীরা তাদের আলজেরিয়া দখলের একশ বছর পূর্তি উৎসব পালন করে। সেখানে ফরাসি প্রেসিডেন্ট গুস্তাভ দূমার্গ বলেছিল:
-এসব অনুষ্ঠান উদযাপনের মূল রহস্য হলো, আলজেরিয়াতে ইসলামের জানাযার আয়োজন করা।
.
ত্রিশ: ১৯৪৫ সালে মিত্র বাহিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভ করে। আলজেরিয়ার অধিবাসীরাও এর আনন্দে বিজয়মিছিল বের করে। পাশাপাশি তারাও স্বাধীনতার স্লোগান দেয়। ফরাসীরা বিষয়টাকে গুরুতরভাবে গ্রহণ করলো।
তারা সাথে সাথে ভারী অস্ত্র, কামান, ট্যাংক, সজোঁয়া যান, বিমান নিয়ে মিছিলের ওপর হামলা করলো। ফ্রান্স দাবী করলো: তিনশ লোক নিহত হয়েছে।
একদিন পর অবস্থা বেগতিক দেখে স্বীকার করতে বাধ্য হলো: ১০০০ লোক নিহত।
একমাস পর স্বীকার করলো: দুই হাজার লোক নিহত।
বিশ বছর পর ফ্রান্স স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে: ৪৫ হাজার নিরপরাধ মানুষকে তারা হত্যা করেছে।
কিন্তু আলজেরিয়ার স্থানীয় পরিসংখ্যান হিশেব করে বের করেছে: নিহতের সংখ্যা ৭০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
.
একত্রিশ: আলজেরিয়ায় নারীদের সবচেয়ে নিম্নতম শাস্তি ছিল: ট্রাকের পেছনে রশি দিয়ে বেঁধে, অনেক দূর পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া।
.
বত্রিশ: ফরাসীরা মরক্কোতে, মুসলমানদের হত্যা করে রাস্তার পাশে লাশ বা কর্তিত খুলি ঝুলিয়ে রাখতো। একেকটা শাল-খুলি চল্লিশ বছর থাকার নজিরও আছে।
.
তেত্রিশ: ১৯১৭ সাল। ফ্রান্স আফ্রিকার চাদে আক্রমণ করেছে। এক পর্যায়ে ৪০০ আলিমকে জড়ো করলো। সবার মাথা গিলোটিকে কেটে ফেলা হয়েছিল।
.
চৌত্রিশ: ১৮৫২ সালে ফ্রান্স আলজেরিয়ার আগওয়াত শহরে প্রবেশ করেছিল। একরাতেই তারা আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছিল শহরের দুই তৃতীয়াংশ মানুষকে।
.
পঁয়ত্রিশ: ১৯৬০ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ফ্রান্স সর্বমোট ১৭ বার আণবিক বোমা পরীক্ষা করেছে আলজেরিয়াতে। এর রাসায়নিক তেজক্রিয়ায় নিহতের সংখ্যা ফ্রান্স কখনোই প্রকাশ করেনি। ধারণা করা হয় ২৭ হাজার হতে পারে। কারো কারো মতে একলাখের কম নয়।
.
ছত্রিশ: ফ্রান্স ১৯৬২ সালে আলজেরিয়া ছাড়তে বাধ্য হয়। আসার আগে তারা সেখানে অসংখ্য মাইন পুঁতে রেখে আসে। বলা হয়, মাইনের প্রকৃত সংখ্য মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। প্রায় ১১ মিলিয়ন মাইন। বিষয়টা অবিশ্বাস্য মনে হলেও, সত্যি। ফরাসিরা স্রেফ জানোয়ার।
.
সায়ত্রিশ: ফ্রান্স আলজেরিয়াতে ছিল ১৩২ বছর। প্রথম সাত বছরেই তারা শহীদ করেছিল এক মিলিয়ন মুসলমান। শেষ সাত বছরে শহীদ করেছিল দেড় মিলিয়ন।
.
আটত্রিশ: ফ্রান্স তিউনিসিয়াতে ছিল ৭৫ বছর। মরক্কোতে ছিল ৪৪ বছর। মৌরিতানিয়ায় ছিল ৬০ বছর। সেনেগালে ছিল তিনশ বছর।
----
----
ফ্রান্স সিরিয়া ও ইরাকে নৃশংস বিমান হামলা চালিয়ে আসছে। তাদের এ-হামলার খরচ যোগাচ্ছে ফরাসী জনগন। হামলায় সহায়তা করছে তাদের ট্যাক্স। তাদের ভ্যাট। তাদের ভোট। হত্যা করা ও হত্যায় সহযোগিতা করা সমান অপরাধ। ফ্রান্সে তো মুসলমানরা আছে, তারাওতো ভ্যাট-ভোট দেয়। তবে?
= আর হ্যাঁ, আমরা নিরপরাধ মানুষের হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা জানাই। মাযলুম ও মাযলুমের পক্ষের মহান মানুষগুলোর জন্যে রইলো আমাদের অন্তরিক দু‘আ। রাব্বে কারীম তাদেরকে জান্নাত নসীব করুন। আমীন।
--
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা কথা থেকে গেল। পাশ্চাত্যের নাগরিকদের প্রকারভেদ নিয়ে। কাফিরদের দুযোগে আনন্দ বা শোক প্রকাশ নিয়ে! পরে ইনশাআল্লাহ।
--
--
জে সুইস আবদুর রাহমান গাফেকী।
আমরা সবাই আবদুর রাহমান গাফেকী।
রাহিমাহুল্লাহু তা‘আলা।
.
একটা আয়াত পড়েই শেষ করি?
ومن يتولهم منكم فانه منهم
আর যে তাদের (কুফফারের) সাথে একাত্মতা পোষণ করবে, তাহলে সে অবশ্যই তাদের দলভূক্ত বলে গণ্য হবে?
= তাহলে শোক, ছিঁচকাঁদুনি, প্রোফাইল পিক?



















হারিয়ে যাওয়া জান্নাত : বীরদের আখ্যান

বাহাদুরির প্রতিদান :
হিজরি সপ্তম শতাব্দী মোতাবেক ত্রৌদশ খ্রিষ্টাব্দের কথা। খাওয়ারিজম শাহিদের প্রতাপ তখন মধ্যগগনে। ইরান, ইরাক, খোরাসান এবং শাম কব্জা শেষে পুরো মধ্য-এশিয়ার মুসলিম সাম্রাজ্যগুলো নিজেদের আয়ত্বে নিয়ে আসার পথে। অতুল ক্ষমতা বলে তারা যখন এ ইচ্ছে বাস্তবায়নের একেবারে দ্বারপ্রান্তে, ঠিক সে মুহূর্তে শুরু হয়ে যায় তাতারি ফেতনা। চেঙ্গিস খান তার হিংস্র বর্বরতা নিয়ে আছড়ে পড়ে উজাড় করে ফেলে বিশাল খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য। যদিও খাওয়ারিজমি তুর্করা বীরত্বের দিক দিয়ে একেবারে সাধারণমানের ছিল না, তথাপি তাদের পক্ষে চেঙ্গিসি ঝড়ের মোকাবিলা করা সম্ভব হয়নি। ধ্বংসের সে তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়া খাওয়ারিজমিরা বাঁচার তাগিদে হয়ে যায় একেবারে ছন্নছাড়া।
খাওয়ারিজমিরা বংশগতভাবে ছিল তুর্ক। এমনি এক তুর্ক গোত্রের সরদার উরতুগরুল জন্মভূমি ছেড়ে আশ্রয়ের আশায় হিজরত করছিলেন সুলতান আলাউদ্দিন সালজুকির রাজধানী কোনিয়ার দিকে। সাথে ছিল গোত্রের প্রায় ৪০০ পরিবারের ছোটখাটো একটা দল। আঙ্গুরার পাশে পৌঁছতেই এক অস্বাভাবিক ঘটনার মুখোমুখি হয়ে সেখানেই থামিয়ে দেন কাফেলা। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখেন দুটি বাহিনী পরস্পর লড়াই করছে। একটি বাহিনী দুর্বলতার দরুন পরাজয়ের মুখোমুখি; আর সবল বাহিনী ক্রমশ চেপে ধরছে দুর্বল বাহিনীটিকে।
আজন্ম যোদ্ধাজাতির নেতা উরতুগরুলের পক্ষে দৃশ্যটা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তিনি মনে মনে দুর্বল দলটিকে সহায়তাদানের স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন এবং প্রায় সাথে সাথে গোত্রের সশস্ত্র যুবকদের নিয়ে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁর বাহিনীতে ছিল মাত্র ৪৪০ জন জওয়ান। ওরা ছিল বিভিন্ন মাঠের পোড়খাওয়া সৈনিক। কালের আবর্তে পড়ে যদিও আজ ওরা আশ্রয়ের খোঁজে; কিন্তু ওদের প্রত্যেকের ধমনীতে বইছিল দিগ্বিজয়ীদের রক্ত। ওরা বিপক্ষ শক্তির উপর এমন টর্নেডো হয়ে আছড়ে পড়ে যে, খানিক পরেই সম্পূর্ণরূপে পালটে যায় যুদ্ধের পট। একসময় যারা ছিল বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এখন তারাই জীবন বাঁচানোর লক্ষ্যে পলায়নপর। লড়াই সমাপ্তির পর উরতুগরুল জানতে পারেন; যাদের তারা সহযোগিতা দিয়েছেন, তারা হচ্ছেন সুলতান আলাউদ্দিন সালজুকির বাহিনী। পরাজিত হয়ে যারা পালিয়ে যাচ্ছিল, তারা হচ্ছে তাদের অস্তিত্বের শত্রু তাতার বাহিনী। সরদার উরতুগরুল মহানুভবতা দেখিয়ে পরিচয় না-জানার পরও যে অসামান্য সহায়তা দেন, এর কৃতজ্ঞতায় আলাউদ্দিন আঙ্গুরার পাশে তাদেরকে বিশাল ভূসম্পত্তির জায়গির দান করে বসবাসের সুযোগ করে দেন। সে উর্বর ভূখণ্ডটি বর্তমান ইস্তাম্বুলের একেবারে নিকটেই। ভূখণ্ডটি ছিল রোম সাম্রাজ্যের সীমান্তের পাশে; এশিয়া ও ইউরোপের সঙ্গমস্থলে।
অভিজাত সর্দার :
সুলতান আলাউদ্দিন কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ সরদার উরতুগরুলকে যে ভূখণ্ড দান করেছিলেন সেখানে বসবাস করতে গিয়ে তাঁকে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কারণ, পাশেই ছিল রোমান বাইজেন্টাইনদের উপস্থিতি। ফলে প্রায়ই তাদেরকে ইউরোপের বিভিন্ন দুর্গ অধিপতিদের সাথে লড়াই করতে হতো। তবে এটা প্রবীণ তুর্ক সরদারের জন্য উটকো কোনো ঝামেলা মনে হয়নি; বরং এটা তাঁর জিহাদি জজবাকে আরও জাগিয়ে তুলে। তিনি স্বভাবজাত বীরত্ব প্রদর্শন করে অল্প কিছুদিনের ভেতরেই খ্রিষ্টানদের মধ্যে এমন ত্রাসের জন্ম দেন যে, তারা এদিকে আর উঁকি দেওয়ারও সাহস রাখেনি। তাঁর একের পর এক বিজয়ের ফলে তাদের অন্তরে মারাত্মক ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে উরতুগরুলের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে আরও অনেক তুর্ক গোত্র তাঁর পতাকাতলে এসে তাঁর হাতকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
একবার তাঁর নেতৃত্বে মুসলমানরা তাতার এবং ইউরোপীয় খ্রিষ্টানদের যৌথবাহিনীকে কুকুরতাড়া করেন। এটা ছিল ওই এলাকার জন্য একটা স্মরণীয় ঘটনা। উরতুগরুলের এ মহান কর্মযজ্ঞে সন্তুষ্ট হয়ে মুগ্ধ সুলতান তাঁকে আরও বিপুল জায়গির প্রদানের পাশাপাশি নিজ সেনাবাহিনীর অগ্রবর্তী দলের সেনাপতি বানিয়ে নেন।
সুলতান আলাউদ্দিনের পতাকা ছিল চন্দ্রখচিত। উরতুগরুল সুলতানের প্রতিনিধি হিসেবে ওই প্রতীক ব্যবহার করতেন। আজ অবধি তুর্কিদের কাছে এ প্রতীকটা তাদের জাতীয় প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
৯৮৭ হিজরি মোতাবেক ১২৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ৯০ বছর বয়সে উরতুগরুল মারা যাবার পর ৩০ বছর বয়সী তাঁর বড় ছেলে গাজি উসমান খান গোত্রের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন। তিনিই ছিলেন উসমানি খেলাফতের ভিত রচনাকারী ও প্রথম মুকুটধারী। ছিলেন বিস্ময়কর কিছু গুণের অধিকারী। সরলতা, বীরত্ব, দীনদারি ও খোদাভীরুতায় ছিলেন ইসলামের সোনালি যুগের শাসকদের বাস্তব প্রতিচ্ছবি।
সুলতান আলাউদ্দিন সালজুকি সাম্রাজ্যের জন্য উসমান খানের ত্যাগ ও সেবায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় উপাধি প্রদানের পাশাপাশি নিজ নামে মুদ্রা প্রচলন এবং জুমআর খুতবায় নিজের নাম উচ্চারণের অনুমতি দিয়ে দেন। সুলতানের অপরাপর আমিরগণ বিদ্রোহী হয়ে স্বায়ত্বশাসিত রাজ্য গঠন করে চললেও উসমান খান সে-পথে হাঁটেননি। তিনি তাদেরচে বহুগুণ শক্তিশালী হবার পরও সুলতানের জীবৎকাল পর্যন্ত পিতার মতোই একনিষ্ঠ অনুগত থেকে যান এবং অসংখ্য বিজয়ের মাধ্যমে সুলতানের প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধিতে নিবেদিত থাকেন।
বিশ্বস্ততার পুরস্কার :
তাঁর মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলমানদের বিশেষ সেবা নেওয়া আল্লাহর ইচ্ছা ছিল; বিধায় বিশ্বস্ততার পুরস্কারস্বরূপ আল্লাহ তাঁকে সালজুক সাম্রাজ্যের কর্ণধার বানিয়ে দেন। কোনো প্রকার নিমকহারামি ব্যতীত এমনিতেই সাম্রাজ্য তাঁর কব্জায় চলে আসে।
ঘটনা হচ্ছে, ৬৯৯ হিজরি মোতাবেক ১৩০০ খ্রিষ্টাব্দে তাতারিদের সাথে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সুলতান আলাউদ্দিন এবং যুবরাজ গিয়াসুদ্দিন শাহাদত বরণ করলে নিবে যায় সালজুক সাম্রাজ্যের শেষ প্রদীপ। তখন সালজুক তুর্কসহ অপরাপর তুর্ক গোত্রগুলো ঐকমত্যের ভিত্তিতে উসমান খানকে কোনিয়ার রাজমসনদে আসীন করিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তাঁর হাতে শপথ গ্রহণ করে। এভাবেই সে মহান সাম্রাজ্য অস্তিত্বে আসে, যা কয়েক শতাব্দীব্যাপী ইউরোপে দাপট এবং মর্যাদার সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করে। যে সাম্রাজ্যের দিগ্বিজয়ীরা কুসতুনতুনিয়া জয় করে পালটে দেন ইতিহাসের মোড়। যারা হন রাসুল সা.-এর সুসংবাদ বাস্তবায়নের গৌরবের অধিকারী। যদি নিজেদের লোক তাঁদের পিঠে ছুরি না হানতো, তাহলে আজ হয়তো ইউরোপে খ্রিষ্টবাদের চিহ্নটুকুও থাকত না। এশিয়ার মতো ইউরোপও হতো মুসলিমপ্রধান মহাদেশ। খেলাফতে আব্বাসিয়া-উত্তর তাঁদের খেলাফতই বিশ্বে ইসলামের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পেয়ে আসছিল। এই খেলাফতের শাসকরা এমনসব কাজ আঞ্জাম দিয়ে গেছেন, যার উপর অনাগত ভবিষ্যতের মুসলমানরাও গর্ব করতে পারে।
গাজি উসমান খানের বংশধারায় আল্লাহ বড় বড় অনেক বিজেতার জন্ম দিয়েছিলেন। কারণ বোধহয় এটাই যে, সুলতান ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু, দানবীর এবং খোদাভীরু। তাঁর বিয়ে হয়েছিল এমন এক আল্লাহওয়ালা বুজুর্গকন্যার সাথে, যে নিজে ছিল তাকওয়া এবং পবিত্রতার উঁচু অবস্থানে।
এখানে আমরা প্রথমে উসমান খানের কিছু উন্নত গুণাবলির আলোচনা করব; অতঃপর আলোচনা করব তাঁর বিয়ের কাহিনি। আশা করি তখন উপলব্ধি করতে পারবেন, কেন আল্লাহ তাঁর সন্তানদের মাধ্যমে ইসলামের এ বিশাল খেদমত নিয়েছেন। আকা
ব্যক্তিগত গুলাবলি :
একজন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতার মধ্যে যেসব গুণাবলি থাকার প্রয়োজন, উসমান খানের মধ্যে সবগুলোই ছিল পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। তাঁর সাহস ও বীরত্ব ছিল প্রায় অতিলৌকিক। নেতৃত্বদানের যোগ্যতা ছিল সহজাত। লড়াইয়ের ময়দানে ব্যক্তিগত বীরত্ব সৈন্যদের অন্তরে জন্ম দিত দুর্জয় বিজয়াকাঙ্ক্ষার। তাঁর রাষ্ট্রনীতি তাঁকে করে তুলছিল জনগণের আপনজন। ন্যায়পরায়ণতা ছিল প্রবাদপ্রতীম। তাঁর বিচারিক আদালতে তুর্ক, তাতার, মুসলিম ও খ্রিষ্টানের কোনো ভেদাভেদ ছিল না। জনগণের কল্যাণই ছিল রাষ্ট্রচিন্তার মুখ্য উদ্দেশ্য। রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি ছিল পরম ধ্যান-জ্ঞান। প্রথমযুগের মুজাহিদদের মতো তাঁর জীবনাচার ছিল সম্পূর্ণ লৌকিকতামুক্ত ও সাধাসিধে। সম্পদ সঞ্চয় তাঁর ধাতে ছিল না। গনিমতের মালে মুজাহিদদের অংশ প্রদানের পর যা থাকত, তা গরিব-মিসকিনদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন। যে ঘরে বসবাস করতেন, ইনতেকালের পরে সেখানে আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও তিল পরিমাণ সোনারোপা কিংবা হিরে-জহরত পাওয়া যায়নি। পাওয়া গিয়েছিল মাত্র একটি সুতি-পাগড়ি, কাঠের তৈরি একটা চামচ আর একটি লবণদানি। উত্তরাধিকার সম্পদের মধ্যে রেখে যান কয়েকটা আরবি ঘোড়া, কৃষিকাজের জন্য কয়েক জোড়া ষাঁড় এবং একপাল ভেড়া। এ ছাড়া ছিল কয়েকটি পতাকা ও কিছু অস্ত্র। তিনি ছিলেন জনসাধারণের হৃদয়ের মধ্যমণি। পরবর্তীতে তাঁর বংশের যিনি উত্তরাধিকার হতেন, তার অভিষেক অনুষ্ঠানে কোমরে তাঁর এই তলোয়ার বেঁধে দেওয়া হতো এবং তাকে এ দুআ দেওয়া হতো—আল্লাহ যেন তোমার মধ্যে উসমানের মতো কল্যাণ দান করেন।
অদৃশ্য ইশারা :
সুলতানের বিয়ের কাহিনি নিম্নরূপ : রাজধানী শহরের পাশেই ছিল আবতারুনি নামক একটা গ্রাম। সেখানে বসবাস করতেন একজন খোদাভীরু দরবেশ আলেম। যৌবনের প্রারম্ভকাল থেকেই তাঁর দরবারে ছিল উসমান খানের যাতায়াত। বুজুর্গের ছিল এক কন্যা। সে ছিল সৌন্দর্য, উত্তম আচরণ এবং খোদাভীরুতায় নিজেই নিজের উদাহরণ। উসমান খান একদিন দরবেশের কাছে তাঁর মেয়র সাথে বিয়ের আবেদন নিয়ে যান। কিন্তু সামাজিক স্ট্যাটাসের তফাৎ বিবেচনায় দরবেশ উসমানের আবেদন ফিরিয়ে দেন। উসমান ছাড়া আরও বেশ ক’জন আমিরপুত্রের পক্ষ থেকে দরবেশ বরাবরে তাঁর মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব গিয়েছিল। দরবেশ তাদের প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
এক রাতে উসমান খান এক বিস্ময়কর স্বপ্ন দেখেন। দেখতে পান একটা নতুন চাঁদ দরবেশের বুক থেকে বের হয়ে ধীরে ধীরে চতুর্দশীর চাঁদের রূপ ধারণ করে তাঁর বুকে এসে ঠাই নিচ্ছে। এরপর তার বাহু থেকে একটা বৃক্ষ গজিয়ে উঠে তা ক্রমশ মহিরুহের রূপ ধারণ করছে। একপর্যায়ে বৃক্ষটির শাখা-প্রশাখা জলে-স্থলে ছেয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া সে বৃক্ষের মূল থেকে পৃথিবীর বড় চারটি নদী তথা দজলা, ফুরাত, নীল এবং দানিয়ুব উৎসারিত হয়ে আপন গতিতে বয়ে চলছে। অনুরূপ পৃথিবীর চারটি বড় পর্বত তথা ককেশাস, বলকান, তুর ও এটলাস এই বৃক্ষের কাণ্ডগুলোর ভার বহন করে চলছে। হঠাৎ দমকা বাতাস বইতে শুরু করলে তলোয়ার আকৃতির বৃক্ষপত্রগুলো এমন একটি শহরের দিকে উড়ে যেতে থাকে, যেটি দুই নদী ও দুই মহাদেশের সঙ্গমস্থলে অবস্থিত। শহরটিকে এমন একটি আংটিবৃত্তের মতো দেখাচ্ছিল, যার উপর রয়েছে দুটি করে নীলকান্তমণি ও পান্না পথর। উসমান আংটিটি হাতে পরবার জন্য হাত বাড়াতেই তাঁর ঘুম টুটে যায়। জাগ্রত হবার পর দ্রুত দরবেশের খেদমতে উপস্থিত হয়ে স্বপ্নবৃত্তান্ত খুলে বলেন। দরবেশ স্বপ্নটিকে একটা অদৃশ্য ইঙ্গিত মনে করে তাঁর মেয়েকে উসমানের হাতে তুলে দেন।
এভাবেই ঘটিত হয় সে মহান বংশের ভিত্তি, যার উত্তরপুরুষদের সাম্রাজ্য এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা তথা তিনটি মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। যে বংশের বীরদের ঘোড়ার খুরের আঘাতে কেঁপে উঠছিল ইউরোপের প্রতিটি রাজধানী।
বই : স্পেন টু আমেরিকা
আবু লুবাবা শাহ মানসুর
আবদুর রশীদ তারাপাশী অনূদিত







এক চুমুকে ইতিহাস: ৪১
আতিক উল্লাহ

ইউসূফ বিন তাশাফীন (রহ.) যখন আন্দালুসে আসেন, সেখানে ছিল কবি-কবিতা, মদ-সুরার সমারোহ। আনন্দ-বিনোদন আর জাঁক-জৌলুসের ঠাট-ঠমক।
.
ইউসূফ বিন তাশাফীন এসেই এসব বন্ধ করেছেন। কবিদেরকে শহর ছাড়া করেছেন। নর্তকীদেরকে বোরখা দিয়ে ঢেকেছেন। পানশালা-হাম্মামগুলোতে চলে আসা পাপাচার বন্ধ করেছেন।
.
সবাই মুতামিদ বিন আব্বাদকে গালি দিতে শুরু করলো। এ কোন আপদ নিয়ে এল! কবিতা পছন্দ করে না! নাচ-গান জানে না! মোটা পশমের কাপড় পরে থাকে। গায়ের রঙ কালো!
.
ইউসূফ বিন তাশাফীন যদি একালে এমন করতেন, তাহলে প্রচারমাধ্যমের লোকেরা তার সম্পর্কে কী বলতো?
= এক কথায় ‘খারেজী’সন্ত্রাসী। বর্বর। চরমপন্থী।
.
এমনকি ততকালীন আন্দালুসের বড় আলিমরা পর্যন্ত এ-মহান বীরকে বর্বর-অশিক্ষিত-ইসলামের উদারতা সম্পর্কে অজ্ঞ বলে আখ্যায়িত করতে পিছপা হয়নি!
.
এ-যুগের আলিমরাও তাই করতো! ইসলাম শান্তির ধর্ম! উদারতার ধর্ম! ক্ষমার ধর্ম!
আরও কত কী যে বলতো!


ফিরে ফিরে আসে এই দিন
ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী

আন্দালুস। কেউ বলেন মুসলিম স্পেন। হারিয়ে যাওয়া এই জান্নাত আজই (02/01/1492) হারিয়ে গিয়েছিলো।
খুব স্বাভাবিক, এই আন্দালুস নিয়েই আজ কথা বলা। কিন্তু মন বলছে—কোন্ আন্দালুস নিয়ে তুমি কথা বলবে? তোমার পাশে তো অনেক আন্দালুস! আমিও দেখলাম—আসলেই তো আমি অ নে ক আন্দালুসের অশ্রু ও রক্তে ভাসছি! এ অশ্রুর কোনো শেষ নেই! মুছি আর প্লাবিত হই! শুকোয় আর সব ভেসে-ভেসে যায়!
গতকাল এক বন্ধু আন্দালুস নিয়ে লেখা চাইলেন। তিনি পোর্টালে ছাড়বেন। পৃথিবীকে জানাবেন নতুন করে—আমাদের একটি আন্দালুস ছিলো। আমাদের একটি জান্নাত ছিলো।
ও-ও-ও হ! আর কতো! এসবের ভেতরে সান্ত্বনা খুঁজতে খুঁজতেই আমরা কাপুরুষ হয়ে বসে আছি! ২ তারিখ এলেই জানান দিই—এই যে আমি আছি—আবু আবদিল্লাহর বন্ধু!
আসলেই আমরা ওই কাপুরুষের বন্ধু!
গ্রানাডার শেষ বীরের কথা আমাদের মনে পড়ে না!
বিজয়ী তারিকের অমিত সাহসিকতাও আমাদের রক্তে ‘সুনামি’ আনে না!
বারবার শুধু ভেসে ওঠে—আবু আবদিল্লাহ!
বন্ধু, খুঁজে পাচ্ছো না আন্দালুস? ...
তাকাও—
আফগানিস্তান একটি আন্দালুস!
ইরাকে আজম একটি আন্দালুস!
শান্তি ও স্বস্তির দেশ—শামও আন্দালুস!
আলাদা করে বলবো কি—জর্দান-ফিলিস্তিনের কথা?
ইয়েমেন?
আরাকান?
পাকিস্তান?
কাশ্মির?
প্রিয় বাংলাদেশও তো হয়ে উঠছে আরেক আন্দালুস?
মিথ্যার কী জয়জয়কার!
অপশক্তির কী সাজসাজ রব!!
মাযলুমিয়াতের ত্রাহধ্বনিতে এই বুঝি বিদীর্ণ হলো আকাশ!
ইয়া রব!
মনে বল দাও!
কলমে কালি দাও!
লিখে যেতে চাই সব আন্দালুসের রক্তগাথা!





















সৌন্দর্য মানে কী?
সৌন্দর্য মানে: আন্দালুস। আমাদের হারানো ফিরদাওস।
তারা বলে:রয়্যাল প্যালেস। ইশবীলিয়া (সেভিল)।
আমরা বলি: আরূসুল আন্দালুস। স্পেনের কনে।
ইনশাআল্লাহ আমরা আর বেশিদিন ‘কনেহীন’ থাকবো না।
অামাদের বধূ আমাদের ঘরেই ফিরবে। - আতিক উল্লাহ




ইসাবেলা! তাড়িয়ে দিয়ে ভাবছো চিরদিনের জন্যে আন্দালুস তোমাদের হয়ে গেছে? ভুল সবই ভুল!
এই দেখ আজো আমরা নিজেদের ঘরের চাবি বয়ে বেড়াচ্ছি! বংশানুক্রমে! আমার মতো এমন অসংখ্য মানুষ, গোটা মাগরিব (মরক্কো-আলজেরিয়া) অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে! আমরা আসছি!
না না, আমাদের নেতা আবু আবদুল্লাহ (সগীর)-এর মতো ভীতু কেউ হবে না, ইউসুফ বিন তাশাফীনের মতোই কেউ হবে! ইনশাআল্লাহ!
ফার্ডিন্যান্ড! শুনিতে কি পাও! অশ্বখুরের টিগঢিগ টিগঢিগ ধ্বনি?
তাকবীর.......................!!!

-আতিক উল্লাহ






এক চুমুকে ইতিহাস: ২৮৩
আতিক উল্লাহ

খেলাফতে রাশেদার যুগে আমরা জয় করেছি:
-ইরাক। শাম (সিরিয়া-ফিলাস্তীন-জর্দান ইত্যাদি)। খোরাসান। মিসর। আফ্রিকা।
-
খেলাফতে বনি উমাইয়ার যুগে আমরা জয় করেছি:
-আন্দালুস। সিন্ধু অঞ্চল। ভারত।
-
আব্বাসী খিলাফতকালে আমরা জয় করেছি:
-আমুরিয়া (বায়যান্টাইন সারাজ্যের প্রবেশপথ)।
-
মামলুক যুগে আমরা পরাজিত করেছি:
-মোঙ্গলদেরকে। ক্রুশেডারদেরকে।
-
উসমানি সালতানাতের যুগে আমরা জয় করেছি:
-কনস্টান্টিনোপল। ইউরোপ।
-
সাইকো-পিকো ও পশ্চিমাদের ক্রীড়নক শাসকদের আমলে আমরা ‘ফাতহ’ (ফতেহ অর্থ খোলা ও দেশ জয় করা) করেছি, মানে খুলেছি ‘টুনা ও সার্ডিনের’ কৌটা। মদের বোতল।
-
আমরা ফাতাহ করেছি (খুলেছি) অসংখ্য জেলখানা। বলাবাহুল্য আরব বিশ্বের জেলখানা নির্মানের হার পুরো বিশ্বের যে কোনও দেশের চেয়ে অনেক বেশি!
-
আমরা ফাতহ করেছি: অসংখ্য শরণার্থী শিবির।
আমরা ফাতহ করের্ছি অসংখ্য গণকবর।
আমরা ফাতহ করেছি অসংখ্য গণিকালয়। মদের বার। নাইটক্লাব।
আমরা ফাতহ করে দিয়েছি: আমাদের নৌবন্দর ও বিমানবন্দরগুলো। পশ্চিমা যুদ্ধযানগুলোর জন্যে। তারা যেন এসব বন্দর ব্যবহার করে নিরীহ মুসলমানদের ওপর গণহত্যা চালাতে পারে।




স্পেন যখন মুসলিম শাসিত ছিল তখন স্পেনের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের মূল ফটকে এই বানীটি লেখা ছিলঃ
দুনিয়া চারটি স্তম্ভের উপরে দাড়িয়ে থাকে
১। আলেমদের হিকমাহ (العلم) ।
২। শাসকদের আদালত (ন্যায়বিচার)।
৩। আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের ইবাদত।
৪। বীরপুরুষদের বীরত্ব।
(সংগ্রহেঃ উত্তর ককেশিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা বিখ্যাত চিন্তাবিদ ও লেখক হায়দার বাম্মাত)
-
~
#ইসলামের_হারিয়ে_যাওয়া_ইতিহাস


১৪৯২ সালের ২রা জানুয়ারি ...
৫২৭ বছর আগে আজকের এই দিনে আল-আন্দালুসের শেষ মুসলিম শাসিত শহর 'গ্রানাডা' মুসলমানদের হাতছাড়া হয়েছিল।
আবু আব্দুল্লাহ যখন গ্রানাডা, তাঁর বিলাসি রাজপ্রাসাদ ‘আল হামরা’ ছেড়ে যাচ্ছিলেন, তখন বার বার পেছন ফিরে তাকাচ্ছিলেন। তাঁর চোখ দিয়ে দর দর করে অশ্রু ঝরে পড়ছিল। এই অবস্থা দেখে তাঁরই বৃদ্ধা মা আয়েশা ছেলেকে ভৎসর্না করে বলেছিলেন ‘আবু আব্দুল্লাহ, একজন পুরুষের মত যে শহরকে রক্ষা করতে পারনি, একজন নারীর মত তার জন্য কাঁদছ কেন!’
-
-
#ইসলামের_হারিয়ে_যাওয়া_ইতিহাস
#lost_islamic_history_dot_com

ফিলহাল-হালচাল-সমকাল:৫২
উদযাপন!

আতিক উল্লাহ
-

দুবাই, বাইরুত, কায়রো, আলজেরিয়া, কুয়েত, মানামা, দোহাসহ সমস্ত আরব দেশও মুসলিম দেশগুলোর রাজধানী বর্ষবরণ উৎসবের জন্যে মুখিয়ে আছে।
.
আতশবাজি নিয়ে অপেক্ষা করছে। কোটি কোটি ডলার অপচয় হওয়ার প্রতীক্ষায় আছে।
.
কিন্তু খ্রিষ্টান স্পেন ভিন্ন এক উদযাপনের জন্যে জন্যে ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রতিবছরই নিয়ে থাকে। জানুয়ারির দুই তারিখে।
.
তারা স্পেনের মসজিদগুলোকে গীর্জায় রূপান্তরিত করার ৫২৪ বছর উদযাপন করবে।
.
লাখ লাখ মুসলমানকে শহীদ করে দেয়ার ৫২৪ বছর উদযাপন করবে।
আর আমরা খ্রিস্টানদের বর্ষকে স্বীকৃতি দিয়ে উদযাপন করবো: থার্টি ফার্স্ট নাইট!
ওরা পরদিন উদযাপন করবে: ইসলাম এন্ড মুসলিম ক্লিনজিং ডে-নাইট!






ইশবিলিয়া (Sevilla)


আজকে সেভিল্লা শহর নামে পরিচিত শহরটির পূর্ব নাম ছিল ইশবিলিয়া। এটি ইসলামের একটি প্রাচীন নগরী ছিল। এই শহরটি ৫০০ বছর ধরে ইসলামের শহর ছিল। এই শহরে দীর্ঘ ৫০০ শত বছর আজানের ধ্বনি উচ্চারিত হয়েছে, যে ধ্বনি দীর্ঘ ৫০০ বছর ধরে আন্দোলিত করেছিল সেখানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে। আপনারা সকলেই জানেন যে, বিখ্যাত সেনাপতি তারেক বিন জিয়াদ ৯১ হিজরি (৭১১ সালে) সর্বপ্রথম স্পেনের ভূমিতে পা রাখেন। তারিক বিন জিয়াদ স্পেনে যাওয়ার এক বছর পরে অর্থাৎ ৯২ হিজরিতে মুসা ইবনে নুসাইর ইশবিলিয়া (Sevilla) নামক শহরে আসেন এবং এই শহরকে বিজয় করেন। কিছু দিনের জন্য এই শহরটি হাত ছাড়া হয়ে গেলে মুসা বিন নুসাইর তার ছেলে আব্দুর রহমানকে সেখানে পাঠান এবং পুনরায় নিজেদের নিয়ন্ত্রন কায়েম করেন। সেই দিন থেকে ৫০০ বছর এই শহরটি ইসলামের শহরে রূপান্তরিত হয়।
ইশবিলিয়া (Sevilla) কে বিজয় করার পর মুসলমানগণ এই শহরে তাদের বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ হল ইশবিলিয়া (Sevilla) উলু মসজিদ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আজকে এই মসজিদটিকে তারা গির্জায় রূপান্তরিত করেছে। মসজিদের মূল ফটক ভেঙ্গে ফেলেছে কিন্তু তারা মিনারকে ভেঙ্গে ফেলতে পারেনি। তবে মিনারের উপরে তারা তাদের ক্রুশকে ঝুলিয়ে দিয়েছে।
ইতিহাসে এই শহরটি জ্ঞান-বিজ্ঞান, সংস্কৃতি এবং বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। বর্তমানে জ্ঞান ও শিক্ষা সংস্কৃতির কোন কার্যক্রম না থাকলেও সিভেল্লা এখনো স্পেনের গুরত্ত্বপূর্ণ একটি বাণিজ্যকেন্দ্র। কিন্তু ইতিহাসের দিকে যদি আমরা তাকিয়ে দেখি তাহলে দেখতে পাই যে, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিতে এই শহরটি নিজেকে নিয়ে গিয়েছিল এক অনন্য উচ্চতায়। প্রখ্যাত আলেম আবুল খাইর এই শহরের, বোটানীর (উদ্ভিদবিদ্যার) ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উম্মোচনকারী ইবনে আওয়ামও এই শহরের। প্রখ্যাত আলেম আবু বকর ইবনে আরাবীও ছিলেন এই শহরের। এই সকল বিশ্ববিখ্যাত আলেম ছাড়াও আমরা যদি জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখি তাহলে আমরা দেখতে পাই যে, এই শহরে কত বড় বড় আলেম জন্মগ্রহণ করেছেন।
তবে আরেকটি বিষয় এখানে প্রনিধানযোগ্য, ১১ শতাব্দীতে এই শহরে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ কার্যক্রম শুরু হয়। তখনও মুসলমানদের মধ্যে খুব বেশী সমস্যা তৈরি হয়নি। কিন্তু এই অনুবাদের ক্ষেত্রে তথ্যসুত্রে বিভ্রান্তি ঘটায়। মুসলমানদের লেখা গ্রন্থগুলোকে তাদের নিজেদের নামে চালিয়ে দেওয়া শুরু করে। এটা নিয়ে অনেক বেশী গবেষণা হওয়া দরকার।
এই অঞ্চলে মুসলমানগণ জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা, মিউজিক, কৃষিসহ সকল ক্ষেত্রে এত উচ্চতায় পৌঁছেছিল যে, মুসলমানগণ যদি ইতিহাস থেকে ছিটকে না পড়ত তাহলে সমগ্র পৃথিবী হয়তবা আজ অন্য একটি অবস্থানে থাকত। আমরা সকলেই জানি যে, যখন কোন আদর্শ সফলতার চূড়ায় আরোহিত হয় তখন মানুষ সে আদর্শ বা সভ্যতাকে অনুকরণ করে থাকে। আজকে যেমন মুসলমানরা পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুকরণ করে। তাদের ভাষায় কথা বলে, তাদের মত করে পোশাক পরে, তাদের শহরের আলোকে নিজেদের শহরকে গড়ে তুলে। তেমনি ভাবে ঐসময়ে এই সেভিল্লা ও আন্দালুসিয়াও এমন এক অবস্থানে ছিল যে, পাশ্চাত্যে বসবাসকারী ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা মুসলমানদেরকে অনুসরণ ও অনুকরণ করত। তারা মুসলমানদের ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করত, তাদের পোশাক পরিধান করত, তাদের শহরের অনুকরণে নিজেদের শহর ও ঘরবাড়ি বানাত।
এটা দেখে তৎকালীন পোপরা এক মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। তাই তারা তাদের যুবসমাজকে মুসলমানদের আদর্শ থেকে রক্ষা করার জন্য অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারা বলেন, আমাদের যুবকরা মুসলমানদের অনুসরণ ও অনুকরণ করছে, তাদের ধর্মকে গ্রহণ করছে তাই আমাদেরকে এদেরকে রক্ষা করার জন্য কাজ করতে হবে।
মুসলমানগণও তাদের উচ্চতাকে ধরে রেখে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে এবং জ্ঞানকে অন্যদের সাথে ভাগাভাগি বা শেয়ার করতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি।
চারটি প্রতিষ্ঠানকে মুসলমানগণ বিশ্ববাসীর সামনে উম্মোক্ত করে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে মুসলমানগণ বিন্দুমাত্রও কার্পণ্য করেননি।
এগুলো হল,
১। হাসপাতাল, আমরাই মানুষকে হাসপাতাল শিক্ষা দিয়েছি।
২। বিশ্ববিদ্যালয়, আমরাই সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠা করে এর সাথে মানুষকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি।
৩। পর্যবেক্ষণকেন্দ্র (Observatory) এর সাথে মানুষকে আমরাই সর্বপ্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছি।
৪। উন্নত খাদ্য।
শুধু এগুলোই নয়, ইউরোপের খাবারের ক্ষেত্রেও আমাদের ভূমিকা অনেক বেশী। আমরা ইউরোপকে তাদের খাবার-দাবারকে উন্নত করার জন্য অনেক কিছু শিক্ষা দিয়েছি। যেমন চিনি। সর্বপ্রথম চিনি আবিষ্কার করে মুসলমানগণ। চিনির আবিষ্কার খাবার-দাবারের ক্ষেত্রে এক নব যুগের সূচনা করে। আজকের ইউরোপের অনেক খাবার দাবারের পেছনে ঐসময়ের পরিবর্তন অনেক বড় একটি জায়গা দখল করে আছে।
কৃষি ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিপ্লব করেছিল মুসলমানগণ। মাল্টা, কমলা, লেবু, গ্রেফ্রুট আন্দালুসিয়ার আলেমদের আবিষ্কার। আন্দালুসিয়ার যে সকল আলেম-উলামা কৃষি নিয়ে গবেষণা করতেন তারাই এই সকল কিছুর সাথে মানুষকে পরিচয় করিয়ে দেন।
যেমন, মাল্টা, তুরস্কে আসে ১৭৫০ সালের দিকে। প্যারিসে নিযুক্ত উসমানী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ২৮ তম চেলেবি মেহমেদ মাল্টা, টমেটোর বীজ নিয়ে আসেন। তখন তিনি এমন ভাবে নিয়ে আসেন যে, যেন এগুলা ফ্রান্সে আবিষ্কার!
এই সকল মাল্টা ও টমেটো দেখে যারা সেই সময়ে পাশ্চাত্যের মোহে অন্ধ ছিল তাদের মোহ আরও বেড়ে যায়। অথচ ফ্রান্স এগুলা শিখেছিল আন্দালুসিয়ার মুসলমানদের কাছ থেকে।
এই জন্য আমাদের উচিত হল আমাদের অতীতকে নিয়ে গবেষণা করা এবং আমাদের আত্মবিশ্বাসকে বৃদ্ধি করা। এগুলা জেনে বসে থাকলে চলবে না। কুরানের আহবানের আলোকে আমাদেরকে পুনরায় জ্ঞান-গবেষণায় মনোনিবেশ করতে হবে।
মূলঃ মুহাম্মেদ এমিন ইলদিরিম
অনুবাদঃ বুরহান উদ্দিন
-
কার্টেসীঃ ইসলামের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস













ইতিহাসের শিক্ষা:১২
মিসর ও স্পেন
আতিক উল্লাহ

প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে মিসরীয় সভ্যতা সবচেয়ে প্রাচীন। হাজার বছর ধরে এখানে বাস করে আসছিলো কিবতিরা (কপটিক)। এরা ছিলো ধর্মের দিক থেকে খৃস্টান। এদের অস্তিত্ব আজো দেখা মেলে। এই কপটিকরা খৃস্টান হলেও তাদের অনেক রিচুয়াল (ধর্মীয় কৃত্য) ইহুদিদের সাথে মিলে যায়। ধারণা করা হয়ে থাকে, এই কপটিকরা ইহুদি ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, মূসা (আ.) এর যুগ থেকে।
উমার (রা.) এর যুগে মিসর ইসলামী খিলাফতের অধীনে আসে। আমর ইবনুল আস মিসর জয় করেন। এরপর মিসরের পুরো কৃষ্টি-কালচারই বদলে যায়। ভাষা বদলে যায়। ধর্ম বদলে যায়। দলে দলে মিসরীয়রা খিস্টধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করে। এতটাই পরিবর্তন হয়েছে যে, দেশটা আফ্রিকার বলয়ে অবস্থিত হলেও, মধ্যপ্রাচ্যের অন্তুর্ভুক্ত মনে করা হয়।
পাশাপাশি খুলাফায়ে রাশেদীনের পর, সর্বপ্রথম যে বড় দেশটি মুসলিম সালতানাতের অধীনে আসে সেটা হলো স্পেন।
৯২ হিজরি, ৭১১খ্রিস্টাব্দে মুসলমানরা এই দেশ জয় করেন। ৮৯৬ হিজরি, ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আটশ বছরব্যাপী মুসলমানরা এই দেশ শাসন করেন।
এই দীর্ঘ সময়ে মুসলমানরা এই দেশে অনেক বড় বড় কীর্তির জন্ম দেন। সাহিত্য-দর্শন-বিজ্ঞান-কৃষি-চিকিৎসাবিজ্ঞান সহ জ্ঞানের আরো অসংখ্য শাখায় বিপুল অবদান রাখেন স্পেনের মুসলমানরা।
তখনকার স্পেন ছিলে বাকি অন্যান্য মুসলিম অঞ্চলগুলো থেকে অনেক দিক দিয়ে এগিয়ে। কিন্তু প্রশ্ন হলো স্পেন তখন মিসর থেকে এগিয়ে থাকার পরও কেন আজ মুসলমানদের হাতছাড়া? মিসর পিছিয়ে থেকেও আজ মুসলিম দেশ হিসেবে পরিচিত?
এর উত্তর একটা মূলনীতি দিয়ে দেয়া যায়। তা হলো:
-যে সব ভূখ- সাহাবায়ে কেরামের যুগে বিজিত হয়েছে, তার প্রায় পুরোটাই আজো মুসলিম দেশ হিসেবে পরিচিত।
আর যে সব ভূখ- সাহাবায়ে কেরামের পরে বিজিত হয়েছে, তার অনেক দেশই আজ অমুসলিম দেশের অন্তর্ভূক্ত।
এর কারণ কি?
কারণ হলো, সাহাবায়ে কেরাম প্রথমে ছিলেন ইসলামের দায়ী। তারপরে বিজেতা। তারা নিজেরা ক্ষমতা লাভের চেয়ে, বিজিত অঞ্চলের জনগণকে আল্লাহর ক্ষমতার অধীনে নিয়ে আনার প্রতিই বেশি আগ্রহী ছিলেন। তারা বিজিত জাতিকে নিজেদের শাসনাধীনে আনার চেয়ে ইসলামের শাসনাধীনের আনতেই বেশি মেহনত করতেন।
তার ফল এই দাড়িয়েছে, ইসলাম বিজিত জনগোষ্ঠীর কাছে বিজেতার ধর্ম না হয়ে নিজেদের ধর্মে পরিণত হয়েছে।













স্বৈরশাসক ফ্রাঙ্কো ১৯৬৭ সালে স্পেনিশ জনগণের ধর্মীয় স্বাধীনতার সুযোগ লাভের এক ডিক্রি জারী করে। ষোষণার পর প্রায় ৬০০ পরিবার নিজেদেরকে মুসলিম হিশেবে ঘোষণা করে। এদের কেউ কেউ নবমুসলিম, কেউ কেউ অভিবাসী মুসলিম তবে বড় একটি অংশ ছিল ‘সেই মুসলিম যুগ থেকে চলে আসা পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারকবাহী মুসলিম। গোপনে ইসলাম ধর্ম পালন করে আসছিল। এরা ‘মরিস্ক’ নামে পরিচিত ছিল। -আতিক উল্লাহ







অণুগল্প:২৪৮
মনে পড়ে!
-
আতিক উল্লাহ

স্পেনের একটা সাগরতীরবর্তী গ্রাম। ছেলে মাদ্রিদ থেকে ছুটিতে বেড়াতে এসেছে। মা দেখলেন ছেলে ঘরে কেমন করে ওঠবস করছে:
-কী করছিস রে হোসে!
-নামায পড়ছি!
-নামায কী?
-এটা মুসলমানদের প্রার্থনা। আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি! তাই আমি নিয়মিত এটা আদায় করি!
-মুসলমানরা বুঝি এভাবে ব্যায়াম করে প্রার্থনা করে?... তাহলে কি আমার দাদু মুসলমান ছিলেন?
-একথা কেন বলছ?
-আমার আবছা মনে পড়ে, একদম ছোট্টবেলায়, আমি দাদুকে এভাবে ওঠাবসা করতে দেখেছি। তার মৃত্যুর পর আর কাউকে ওটা করতে দেখিনি!








এই যায়তুন গাছগুলো স্পেনের গ্রানাডায়। আমরাই এগুলো রোপন করেছিলাম। প্রায় ১০০০ বছরেরও আগে। এখন আমাদের গাছের ফল তারা খাচ্ছে। শুধু কি গাছের ফল? ওদের বর্তমানের ভিতটাও তো অতীতে আমাদেরই গড়ে দিয়ে আসা!
হায় আন্দালুস! – আতিক উল্লাহ











এ-ফিরদাওস একদিন আমাদের ছিল।
এ-ফিরদাওস আবার আমাদের হবে।
ইনশাআল্লাহ।
কর্ডোভার মসজিদ ও বাগান











ফুল কার না ভাল লাগে!
ফুল দেখলে মনটা আনন্দে ভরপুর হয়ে ওঠে!
তবে কিছু ফুল আনন্দের বদলে বেদনা নিয়ে আসে!
একরাশ কষ্টের স্মৃতি বহন করে। জাগিয়ে তোলে দগদগে ঘা!
ছবির ফুলগুলোও জাগিয়ে তুলেছে সেই পুরনো ক্ষত!
বর্তমান কর্ডোভার একটি বাড়ির আঙ্গিনার বাগান!
প্রতিটি ফুলে লেপ্টে আছে আটশ বছরের ‘হাহাকার’!
ও কর্ডোভা! হায় কুরতুবা! আমাদের হারানো ফিরদাওস!
সেদিনের আন্দালুস! আজকের স্পেন!
আমাদের হবে! আন্দালুস পতনের পর থেকেই স্পেনকে উদ্ধার করা, মুসলিম উম্মাহর উপর ‘ফরযে ইন’ হয়ে আছে!
ইনশাআল্লাহ! আবার আমাদের হবে!
.
ইজাবেল্লা! ফার্ডিন্যান্ড!
ইরাক-সিরিয়ার ঝামেলাটা মিটলেই ইনশাআল্লাহ আমরা আসবো!
অবশ্যই আসবো! প্রস্তুত থেকো!

ইতিহাসের শিক্ষা:২৮
জিব্রাল্টার প্রণালী
-আতিক উল্লাহ

আহমাদ মুখতার। তিনি আন্দালুসের ইতিহাসের ওপর ডক্টরেট করেছেন। তিনি বললেন:
--- আমার ছোট বেলা থেকেই ইতিহাসের প্রতি ঝোঁক। বিশেষ করে আন্দালুসের ইতিহাস। সে সুবাদে আমি আন্দালুসের ইতিহাস সম্পর্কিত যত জায়গা আছে, সবখানে গিয়েছি। এখনো যাচ্ছি। এবার গেলাম মরক্কোতে। উপকূলীয় শহর তানজায়।
.
আমার ইচ্ছে ছিল জিব্রাল্টার প্রণালীটা স্বচক্ষে দেখবো। এই প্রণালীটা জাবালে তারেক ও সাবতা শহরের মাঝে অবস্থিত।
.
আইনত সাবতা শহরটা মরক্কোর অংশ। কিন্তু স্পেন শহরটা জোরপূর্বক দখল করে রেখেছে। ছোট্ট শহটাতে স্পেনিশ সেনাদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। আমি কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সাবতায় গেলাম।
.
গবেষণার কাজে গিয়েছি, তাই চেষ্টা করলাম সেখানকার উচ্চপদস্থ কোনও অফিসারের সাথে দেখা করতে। অনুমতি মিলল। জেনারেল মিগুয়েল আমাকে অনেকক্ষণ সময় দিলেন। কথা বলার এক পর্যায়ে অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে আমি জেনারেলকে প্রশ্ন করলাম:
-এই শহরটা তো আইনত মরক্কোর নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা?
-হাঁ, অনেকটা তাই।
-তাহলে আপনারা এটাকে জবরদখল করে রেখেছেন কেন?
.
আমার প্রশ্ন শুনে জেনারেল রাগ করলেন না। বরং হাসিতে ফেটে পড়ে বললেন:
-আমরা এই বিপদজনক স্থানটা অরক্ষিত রেখে নাকে তেল দিয়ে ঘুমুই, আর আপনারা আরেকজন তারেক পাঠিয়ে স্পেন দখল করে নেন আর কি!
..
.
আমরা কি আসলে ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি? কিন্তু প্রতিপক্ষ তো ইতিহাসের প্রতিটি বাঁক থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আসছে।
.
শত শত বছর পরও সে শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হচ্ছে না। পূর্ণ সচেতন থেকেই কাজ করে যাচ্ছে।
= আর আমরা?
আন্দলুসের একটুখানি সোনালি অতীত
 ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী
লেখক, গ্রন্থাকার-অনুবাদক ও মাদরাসাশিক্ষক

আন্দালুসের (মুসলিমদের হারানো স্পেন) ইতিহাস নিয়ে লিখতে বসলে চোখের আগে মন কাঁদে। (কাজি কবির ভাষায়) ‘সে কাঁদনে আঁসু আনে’ অভাগা চোখে! নিজের অজান্তেই বারবার দৃষ্টি ঝাঁপসা হয়ে আসে। ইতিহাসকে আশ্রয় করে লিখতে চাইলেও তখন তা আর হয়ে ওঠে না। ঐতিহ্য হারানোর বেদনায় মনের সব সত্তায় করুণ একটা সুর বাজতে থাকে। বাজতেই থাকে। এ সুর-ব্যঞ্জনায় যেনো বিশ্বমানবতা কেবলই বিলাপ করতে থাকে। অশ্রু ছলোছলো চোখে কলম ধরে বসে থাকি। বসেই থাকি। কলম কি চলবে না?
ভাঙা-ভাঙা শব্দে বেদনার নীলগাথা হোক না একটু লিখা!
ইতিহাসের নদী এখন হয়ে যাক বেদনার নীলবাহিত স্রোত!
সবুজে সবুজে ‘জান্নাতময়’ আন্দালুস হারানোর স্মৃতিচারণ হয়ে উঠুক এখন কোনো তাযিয়াতি জলসা!
আন্দালুসপ্রেমীর মনে বয়ে চলুক শোকের নদী।
চোখে নেমে আসুক পূঞ্জীভূত বেদনার শত হাহাকার।
নতুন আন্দালুসের দিকে মহাযাত্রার মহাঅভিলাষে―
মন গগণ-বিদারি চীৎকারে আবার হয়ে উঠুক দুর্বিনীত!
দুই.
৭৭১ সাল। হিজরি ৯২। উমাইয়া সালতানাতের আমীরুল মুমিনীন তখন ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক। ইসলামী সালতানাতের সবুজ মানচিত্রে যোগ হয়েছে ভূ-খণ্ডের পর ভূ-খণ্ড। সামরিক কৌশলগত কারণে এবং ভিতরগত জুলুম-নিপীড়ন ও অরাজকতার কারণে আন্দালুস বিজয় করা― সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছিলো। বিশেষ করে রাজা রডারিক কাউন্ট জুলিয়ানের মেয়ের শ্লীলতাহানি করার পর এবং মুসলমানদের কাছে জুলিয়ানের সাহায্য চেয়ে পাঠানোর পর অনিবার্য হয়ে উঠেছিলো আন্দালুস অভিযান।
তাই ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিকের কাছে অনুমতি চেয়ে পাঠালেন― আফ্রিকা বিজয়ের পর সেখানকার শাসনকর্তা―মূসা ইবনে নোসায়র। অনুমতি মিললে প্রথমে তিনি একটি ছোট অভিযান পরিচালনা করলেন ৫০০ সৈন্যের। তারা সীমান্ত এলাকায় বেশ কিছু সফল অভিযান পরিচালনা করে প্রচুর মালে গনিমত নিয়ে ফিরে আসে। এরপরই মূসা ইবনে নোসায়র মূল অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করে ৭ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী প্রস্তুত করেন আর নেতৃত্ব তুলে দেন তারিক বিন যিয়াদের কাঁধে। তারিক বিন যিয়াদ মূসা ইবনে নোসাইয়র-এর হাত ধরেই ইসলাম কবুল করেছিলেন এবং তার আস্থাভাজন সেনাপতিতে পরিণত হন। ‘তানজা’ বিজয়ের পর মূসা তাকে সেখানকার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন।
তিন.
যেতে হবে সমুদ্রপথে। জাহাজ লাগবে অনেক। কারো মতে তখন ব্যবস্থা ছিলো মাত্র ৪টি জাহাজের। তাও আবার ভাড়া করা। কেউ বলেন― না, তখন এ অভিযানকে সামনে রেখেই তৈরী করা হয়েছিলো অনেক জাহাজ। কিন্তু জাহাজ-যে কম ছিলো― এটিই ঐতিহাসিকভাবে বেশি নির্ভরযোগ্য মত। যাইহোক; সেই জাহাজে করেই শুরু হলো আন্দালুস অভিমুখে নৌ-অভিযান। সবাই একসঙ্গে যাওয়া সম্ভব হলো না। যেতে হলো দলে দলে। যারা গেলো তারা পাহাড়ে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় বেছে নিলো। আত্মগোপনের মতো করে অবস্থান করলো। সবাই আসার পর তারিক বিন যিয়াদ যুদ্ধের জন্যে ধীরে ধীরে সবাইকে প্রস্তুত করতে লাগলেন। রণকৌশলের অংশ হিসাবে প্রথমেই আশপাশের এলাকাগুলো তিনি বিজয় করে ফেললেন। আলজাযিরাতুল খাযরা বা ‘সবুজ দ্বীপ’ এলাকাটি ছিলো পাহাড়ের (জাবালুত তারিক-এর) মুখোমুখি। প্রথমেই তিনি এ সবুজ-শ্যামল এলাকাটি দখল করে ফেললেন। সেই সঙ্গে আশপাশের আরো কিছু এলাকা। এরমধ্যেই সম্রাট লডারিকের কাছে সংবাদ পৌঁছে গেলো যে, মুসলিম সৈন্যরা আন্দালুসে পা রেখেছে। লডারিক অবিলম্বে তাদেরকে মুকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নিলো। প্রথমেই পাঠালো একটি বিশেষ বাহিনী। কিন্তু সে বিশেষ বাহিনী শোচনীভাবে পরাস্ত হলো তারিক বাহিনীর কাছে। একজন মাত্র জানে বেঁচে পালিয়ে গিয়ে লডারিককে জানাতে পারলো শুধু নিজের বেঁচে-যাওয়ার আশ্চর্য কাহিনী!
এরপর লডারিক নিজেই যুদ্ধযাত্রার ঘোষণা দিলো। সাজসাজ রবে প্রস্তুত হলো এক লাখ সৈন্যের বিশাল বাহিনী। এক সময় যাত্রা হলো এ বাহিনীর। ওদের চোখে-মুখে দম্ভ ও অহমিকা ঠিকরে পড়ছিলো। লডারিকের নেতৃত্বে এগিয়ে আসছে খৃষ্টান বাহিনী― এ-খবর যথা সময়ে তারিক জানতে পারলেন। লডারিকের সাথে মহাযুদ্ধে নামার আগেই তারিক আরো সৈন্য চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন মূসা ইবনে নোসায়রের কাছে। যথা সময়ে সে সাহায্যও এসে গেলো। আরো ৫০০০ সৈন্য এসে যোগ দিলো মুসলিম শিবিরে। এখন মুসলমানদের সৈন্যসংখ্যা ১২ হাজার।
‘শাদূনা’ শহরের কাছে ‘ওয়াদি লাক্কা’য় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তারিক বাহিনী ও লডারিক বহর। মাত্র ১২ হাজার সৈন্য দেখে লডারিক বাহিনীর আনন্দের কোনো সীমা রইলো না। ওদের চোখে মুখে একটা ভাবই কেবল ফুটে উঠছিলো― তোমাদের যুদ্ধসাধ মিটিয়ে দেবো আমরা মাত্র কয়েকঘন্টায়!
একদিকে এক লাখ আরেকদিকে বার হাজার। ভীষণ অসম চিত্র। মুসলিম সৈন্যদের মনোবলে যেনো দুশমনের সংখ্যাধিক্য কোনো চির ধরাতে না পারে, সে জন্যে তারিক বিন যিয়াদ সৈন্যদের সামনে দাঁড়িয়ে ঈমান জাগানিয়া এক ভাষণ দিলেন― লডারিকের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার ঠিক আগে। একটু পরই শুরু হবে যুদ্ধ। কিন্তু তার আগে আমরা নজর দেবো একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে।
চার.
না! সে ভাষণের আগে কিংবা তারও আগে―জাহাজ থেকে নেমে তিনি সবগুলো জাহাজ কিংবা কোনো একটি জাহাজ পুড়িয়ে দেন নি! যারা এ জাহাজ পুড়ানোর ঘটনা প্রচার করে, না-জেনে .. না-বোঝেই প্রচার করে।
কেনো তিনি জাহাজ পুড়িয়ে দেবেন?
কার জাহাজ পুড়িয়ে দেবেন?
যদি ভাড়া করা হয়ে থাকে তাহলে তো এগুলো অন্যের সম্পদ! অন্যের সম্পদ কে পুড়িয়ে দেয়? আর যদি রাষ্ট্রীয় সম্পদ হয়, তাহলে কেনো তিনি এতো দামী জিনিস পুড়িয়ে নষ্ট করে দেবেন? অপচয় হবে না কি?
আর যদি শুধু এ-অজুহাতে তিনি সবগুলো জাহাজ পুড়িয়ে দিয়ে থাকেন যে, এতে মুসলিম সৈন্যরা আর পালিয়ে যেতে পারবে না, যুদ্ধ তাদেরকে করতেই হবে, ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়, তাহলে মুসলিম সৈনিকদের শিশিরশুভ্র চরিত্রে কি ছুরি চালানো হয় না?! এমন বাহিনীই কি তারিখ আন্দালুস বিজয়ের জন্যে নিয়ে এসেছিলেন― যারা পালিয়ে যেতে পারে সুযোগ পেলেই!
আস্তাগফিরুল্লাহ!
পাঁচ.
তারিক বিন জিয়াদের ভাষণে বুঝি যাদু ছিলো। ঈমানি চেতনায় ও সংগ্রামী জযবায় সৈন্যরা দ্যুতিময় বীরত্বের প্রহর গোনতে লাগলো। এরপর যুদ্ধ যখন শুরু হলো তখন সে চেতনা ও জযবা সত্যি সত্যি দ্যুতি ছড়াতে লাগলো। আটটি সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের পর মুসলিম শিবিরের পূব আকাশে মহাবিজয়ের লাল সূর্যটি যেনো হাসতে হাসতে উদিত হলো!
সঙ্গে সঙ্গে আন্দালুসের বুকে সূচিত হলো মহাবিজয়ের এক পুণ্যযাত্রা!
আগামী আটশত বছরে গড়ে ওঠবে যে-কালজয়ী গর্বিত সভ্যতা, এ বিজয়ের মধ্য দিয়ে শুরু হলো তার মুবারক সফর!
এ অসম লড়াইয়ে শহীদ হলেন তিনহাজার মুসলিম সৈন্য। আর লডারিক পালিয়ে গেলো এবং হারিয়ে গেলো। আর কখনো এ নামটা আন্দালুসের ইতিহাসে প্রবেশ করতে পারেনি। কেউ বলেন: যুদ্ধেই সে মারা গিয়েছিলো। কেউ বলেন পালিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু কিছুদূর যেতেই পানিতে ডুবে মারা গেলো।
বন্ধু!
যে-বাহিনীর প্রধান সেনাপতি ও বাদশার এ-করুণ পরিণতি, সে বাহিনীর অবস্থা ‘ঐ জিজ্ঞাসে কোন্ জন’? তা-যে আরো বেশি করুণ, তা না-বললেও তো বোঝা যায়!
তবুও অগভীর কৌতূহল মিটানোর জন্যে এক কথায় বলা যায়― ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলো তার বিশাল সৈন্যবাহিনী!
আন্দালুসের এই অশ্রু ও রক্তগল্প অনেক দীর্ঘ! পাঠক চাইলে আবার আসবো!


















এক চুমুকে ইতিহাস: ৬৯
---
বিজয় বনাম দখল
--
আতিক উল্লাহ

বিজয় মানে কী?
আমরা মিসরকে উদাহরণস্বরূপ নিতে পারি। ইসলামের পূর্বে মিসর ছিল রোমনদের দখলে। মিসরের জনগনকে জোরপূর্বক খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা হয়েছিল। তার প্রমাণ?
= যখন মিসরে ইসলাম প্রবেশ করলো, বিজয় সম্পন্ন হলো, মিসরবাসী ইসলামের উদারতা-ন্যায়পরায়নতা অবলোকন করলো, দলে দলে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিলো।
তারা যদি স্বেচ্ছায় খ্রিস্টবাদকে গ্রহণ করতো, এভাবে ধর্মবদলের হিড়িক পড়ে যেতো না।
.
ঠিক এর উল্টো একটা উদাহরণ দিয়েও বিষয়টা স্পষ্ট করা যেতে পারে:
= মুসলমানরা স্পেনে ছিল ৮০০বছর। তারপর এলো খ্রিস্টানরা। যদি মুসলমানরা স্পেনকে জবরদখলকারী হতো, তাহলে খ্রিস্টানরা আসার সাথে সাথেই পুরো স্পেন আবার খ্রিস্টান হয়ে যেতো।
কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে ভিন্ন। ইনকুইজিশনের মাধ্যমের তারা বাধ্য করে মুসলমানদেরকে খ্রিস্টান বানিয়েছে। লাখো মুসলমানকে শহীদ করেছে। দেশছাড়া করেছে।







ঐতিহাসিক গিবন লিখেছেন, “মুসা ইবনে নুসাইর একবার ফ্রান্সের এক পাহাড়ের চূড়ায় চড়ে পুরো ফ্রান্সকে পর্যবেক্ষণ করে বললেন, তিনি আরব সৈন্যদের তার বাহিনীকে শামিল করে ইউরোপকে বিজয় করে কন্সট্যান্টিপোল পৌঁছবেন এবং সেখান হতে নিজ দেশ সিরিয়াতে প্রবেশ করবেন।”
কিন্তু খলিফার নির্দেশে তাদের অগ্রাভিযান থামিয়ে দিতে হয়। তা না হলে হয়ত আজ ইউরোপের ইতিহাস অন্যভাবে লিখতে হত। তাইতো ঐতিহাসিক গীবন লিখেছেন, “যদি ঐ মুসলমান জেনারেল সম্মুখে অগ্রসর হবার সুযোগ পেতেন, তাহলে ইউরোপের স্কুলে ইঞ্জিলের পরিবর্তে কুরআন পড়ানো হতো এবং আল্লাহর একত্ববাদ ও মুহাম্মাদের রিসালাতের সবক দেওয়া হতো। আর আজকে রোমে পোপের পরিবর্তে শায়খুল ইসলামের হুকুম কার্যকর হতো।”












এক চুমুকে ইতিহাস: ১৪৫
আতিক উল্লাহ
-
ওয়াদি লাক্কার যুদ্ধ। এটা সেই বিখ্যাত যুদ্ধ, যেটাতে তারিক বিন যিয়াদ স্পেনের গথিক রাজ রডারিকের সাথে লড়েছিলেন। ৭১১ সালে।
মুসলিম সেনাসংখ্যা ছিল ১২ হাজার। খ্রিস্টানদের সেনাসংখ্যা ছিল এক লাখ সাতাশি হাজার।
তিন হাজার মুসলমান শহীদ হয়েছিলেন। আর পুরো খ্রিস্টান বাহিনী বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল।
এ-যুদ্ধের মাধ্যমেই মুসলমানরা স্পেনের মাটিতে পা রেখেছিল। শাম ও রোম বিজয়ের ক্ষেত্রে যেমন ইয়ারমুক ভূমিকা রেখেছিল, পারস্য বিজয়ের ক্ষেত্রে যেমন কাদেসিয়া মূল ভূমিকা পালন করেছিল, ওয়াদি লাক্কার যুদ্ধও তেমনি স্পেন জয়ে মূল ভূমিকা পালন করেছিল।











আমাদের ইশবীলিয়া।
আমাদের ‘কসরে মুরিক’।
-
তাদের সেভিল।
তাদের মুর প্যালেস।
-
আমরা আসছি। মরক্কো হয়ে। ইনশাআল্লাহ। -আতিক উল্লাহ





দিনলিপি-১৪৮৩
(
১৯-১১-১৮)
আন্দালুসিয়ান বারবারা’(১)!
আতিক উল্লাহ

-
বিদেশে, বিশেষ করে আরবে পড়তে এলে, গরীব দেশের বাবা-মায়ের প্রত্যাশা একটু বেশিই থাকে। ভার্সিটি থেকে যা মাসোহারা দেয়া হয়, তাতে সুন্দর দিন চলে যায়। বাড়িতেও কিছু পাঠানো যায়। তারপরও হজের মওসুমে বাড়তি আয়ের চেষ্টা অনেকেই করে থাকেন। ভার্সিটির ছাত্ররা নানাভাবে হাজি সাহেবানের খেদমত করেন। আমিও চেষ্টা করছিলাম কিছু করার। কিন্তু সুবিধামত খেদমত মিলছিল না। এদিকে হজের আর বেশি দেরী নেই। প্রতিদিন হারামের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করি। পাঁচওয়াক্ত নামাজই হারামে পড়ার চেষ্টা করি। না না, কাজের লোভে নয়। এমনিতেই ভাল লাগে। ভার্সিটি বন্ধ, তাই ক্লাসের চাপ নেই। কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া কিছু করা বৈধও নয়। কিন্তু গরজ বড় বালাই। আগের বছর হুইল চেয়ার চালিয়েছিলাম। অক্ষম বা বৃদ্ধদের হুইল চেয়ার। হারাম শরীফে পেশাদার হুইলচালক আছে। হুইলচেয়ারকে এখানে বলা হয় ‘আরাবিয়্যাহ’। পেশাদার চালকরা হজের মওসমে অনেক টাকা রোজগার করেন। তাদের একচ্ছত্র আধিপত্যে আমাদের মতো গরীব দেশের ছাত্ররা টিকে উঠতে পারে না।
.
আমাকে যেভাবেই হোক, কিছু টাকা আয় করতেই হবে। এখানে অনার্স প্রায় শেষ। অনেক দিনের ইচ্ছা, মাস্টার্স লেভেলের পড়াশোনা জামেয়া যায়তুনাতে করব। মানে মাগরিব অঞ্চলে কিছু সময় কাটানোর বহুদিনের লালিত স্বপ্ন। দাদার কাছে শুনেছি, আমাদের শরীরে ‘বারবার’ রক্ত আছে। মরক্কোর জামেয়া কারাভীনে পড়তে পারলেও হবে। আল্লাহর কাছে অনবরত দু‘আ করেই যাচ্ছি। দৃঢ়বিশ্বাস, তিনি আমার দু‘আ কবুল করবেনই। আমাদের সাথে তিউনিস ও মরক্কোর কয়েকজন ছাত্র পড়ে। তাদের সাথেও কথা বলেছি। তারা বলেছে যথাসাধ্য সহযোগিতা করবে। তারা কয়েকটা সুন্দর পরামর্শ দিয়েছে,
ক: যেসব হোটেলে তিউনিস বা মরক্কোর হাজী সাহেবান থাকেন, সেখানে গিয়ে খোঁজ-খবর করা।
খ: হোটেলের বয়-বেয়ারার সাথে পরিচয় গড়ে তোলার চেষ্টা করা।
গ: হারামে তারা সাধারণত, নিজ দেশের লোকেরা একসাথে থাকার চেষ্টা করে। তাদের আশেপাশে থাকলেও কিছু একটা হতে পারে।
.
তাদের পরামর্শ ধরে এগুবার চেষ্টা করছি। তবে কাজের সন্ধানেই হারামে আসি, এমনটা ভেবে নেয়া উচিত হবে না। হারামে এসেছি রাব্বে কা‘বার অনুগ্রহ চাইতে। বসে আছি। চোখ তুললেই ‘কা‘বা’ দেখা যায়। তিলাওয়াত করছি। একটু পরপর কাবার পানে তৃষিত নয়নে তাকাচ্ছি। হাতে আরেকটা কিতাব ছিল, তিলাওয়াতের পাশাপাশি ওটাতেও চোখ বুলাচ্ছি। কাওয়ায়েদুত তাফসীর। পাশেই এক ভদ্রলোক বসা ছিলেন। ভদ্রলোক না বলে, বলা ভাল ‘শায়খ’। সুন্দর শ্মশ্রুম-িত। সৌম্য চেহারা। পঞ্চশোর্ধ হবেন। আমাকে বারবার সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে কালোঘরের দিকে তাকাতে দেখে, বোধ হয় কিছুটা কৌতূহল বশতই জানতে চাইলেন,
-আফওয়ান, আপনার হাতের কিতাবটা একটু দেখতে পারি?
চোখ তুলে তাকালাম। একজন্য ব্যতিক্রমী তিউনিসিয়ান। মাথায় খেজুর আঁশ (মাসাদ)-এর গোলাকৃতির হ্যাট দেখেই বুঝতে পেরেছি, তিনি তিউনিসিয়া থেকে এসেছেন। কি নারী কি পুরুষ, বেশিরভাগ তিউনিসিয়ানের মাথাতেই ওই হ্যাট থাকে। তাদের জামার আলাদা ধরন আছে। পতাকা টকটকে লাল। তাদের জাতীয় পতাকাও আলাদা করে চোখে পড়ে। চাঁদ-তারাবিশিষ্ট। কিতাবটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলেন। চেহারায় কিছুটা বিস্ময় ফুটে উঠল। পরিচয় জানতে চাইলেন। যতটকু সম্ভব নিজের পরিচয় তুলে ধরলাম। মানুষটাকে দেখে শিক্ষিত মনে হয়েছে। কথাবার্তা বেশ মার্জিত। অনেক তিউনিসিয়ানের সাথে কথা বলেছি, তারা আরবী যেন বলতেই পারে না। আরবী বলতে গেলে, আগে ফরাসি চলে আসে। শায়খ নিজের কথা বলেছেন। আমিও ফাঁকে ফাঁকে আমার কথা বলেছি। হাশা লিল্লাহ (حَاشَ لِلَّهِ) আল্লাহর কী অদ্ভুত মহিমা! তিনি জামেয়া যায়তুনাতে অধ্যাপনা করেন। ইসলামি আকীদা ও দর্শন বিভাগে। তার বিবিও জামেয়া যায়তুনার ছাত্রী। তার বড় মেয়েও এই জামেয়াতে পড়ে। আল্লাহর রহমতের কথা বলে শেষ করা যাবে না। আমাদের কথা চলতে চলতেই মুয়াযযিন একামত দিলেন। নামায শেষ হল। সুন্নত পড়ে আবার গল্প শুরু হল। তিনি কৌতূহলভরে আকীদা বিষয়ক প্রশ্ন তুললেন। স্বাভাবিকভাবেই তিনি ধরে নিয়েছেন, আমি এখানকার আকীদা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি। আমাকে রীতিমতো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলেন। তার কথায় বুঝলাম তিনি কঠিন ‘আশআরী’। তার অধ্যাপনার বিষয়ও তাই। তাকে প্রস্তাব দিলাম, তার সাথে পরেও এ-বিষয়ে কথা বলতে পারবো কি না, যেহেতু তিনি বিষয়টাতে সুগভীর পান্ডিত্য রাখেন, তার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারব। সানন্দে রাজি হলেন। বিদায় নেয়ার আগে বললেন,
-তোমার পরিচিত কোনও গরীব ছাত্র আছে, যে হজের মওসুমে আমাদের সাথে থাকবে। আমার সাথে ‘আরাবিয়্যা’ চালানোর কাজে অংশ নিবে?
তার কথা শুনে আমি রীতিমতো নির্বাক হয়ে গেলাম। হাঁটতে হাঁটতে কথা হচ্ছিল। থমকে দাড়িয়ে গেলাম। কী হল? তিনি জানতে চাইলেন। কিছু না বলে আমি আবেগ সামলে ফের হাঁটা ধরলাম। একটু পর তাকে বললাম,
-আমি যদি আপনার খেদমতে থাকতে চাই, আপনার কোনও আপত্তি আছে? কথা দিচ্ছি, আমাকে ক্বভী ও আমীন পাবেন। ইনশাআল্লাহ।
-তাহলে তো কথাই নেই। তোমাকে সাথে পেলে, আমারও অনেক ভাল লাগবে। আচ্ছা, তুমি মুসা আ.-এর মতো নিজেকে ক্বভী দাবি করেছ। তার প্রমাণ দিতে পারবে?
-উপস্থিত প্রমাণ দেয়ার উপায় নেই। আরাবিয়্যা চালানোর কাজ আমি আগেও করেছি। কোনও সমস্যা নেই। আমি এ-ব্যাপারে অভিজ্ঞ।
-ঠিক আছে, মুমিনের মুখের কথাই যথেষ্ট। আমার প্রয়োজন ছিল একজন আমীনের। আশা করি তুমি আমীনও হবে।
-জি¦, ইনশাআল্লাহ। আমার দ্বারা আপনার কোনও খেয়ানত হবে না। আপনি চাইলে, আমি আমার ভার্সিটির কয়েকটা কাগজপত্রের ফটোকপিও দিতে পারি।
-না না, সেটা লাগবে না। শুধু নবীর ভাষায় বলব (وَاللَّهُ عَلَىٰ مَا نَقُولُ وَكِيلٌ) আমরা যা বলছি, আল্লাহই রক্ষাকর্তা। যে মানুষটির জন্য তোমার সহযোগিতা নিচ্ছি, সেও আমাকে পইপই করে বলে দিয়েছে,
يَا أَبَتِ إِنَّ خَيْرَ مَنِ اسْتَأْجَرْتَ الْقَوِيُّ الْأَمِينُ
আব্বাজী! আপনি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কারও থেকে কাজ নিতে চাইলে সেজন্য এমন ব্যক্তিই উত্তম, যে শক্তিশালী হবে এবং আমানতদারও।
-ইনশাআল্লাহ, আমি আপনাকে নিরাশ করব না। আমি কয়েকদিন যাবত দু‘আ করেই যাচ্ছি,
رَبِّ إِنِّي لِمَا أَنزَلْتَ إِلَيَّ مِنْ خَيْرٍ فَقِيرٌ
হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমার প্রতি যে কল্যাণ বর্ষণ করবেন, আমি তার ভিখারী।
.
হাঁটতে হাঁটতে ফাহদ গেট পার হলাম। জমজম টাওয়ারের সামনে দিয়ে হেঁটে দারুল ইত্তেহাদের পেছনে এলাম। ঈশা হয়ে গেছে। আল্লাহর ঘরের মেহমানগন যার যার হোটেলে ফিরছেন। ভীড় কমার অপেক্ষায় কিছুক্ষণ একপাশে দাঁড়ালেন শায়খ। কথা চলছে। একফাঁকে জানতে চাইলাম,
-আপনি কি জাতিতে বারবার?
-জি¦, একথা কেন জানতে চাইছ?
-আমার দাদাজি বলেছিলেন, আমাদের শরীরে বারবার রক্ত বইছে।
-কিভাবে? এক লম্বা ইতিহাস। বলতে সময় লাগবে। আরেকদিন বলব। শুধু এটুকু বলে রাখি, উসমানি খলীফা সুলাইমান কানূনী যখন ইউরোপ অভিযানে বের হয়েছিলেন, তখন তার সাথে আমার পরদাদাও জানেসারীন বাহিনীর সাথে জিহাদে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি এসেছিলেন আন্দালুস থেকে।
-সুবহানাল্লাহ! তারপর?
-আমার শরীরে দুই গোষ্ঠীর রক্তধারা বইছে। দাদার সুত্রে আমি বারবার। দাদীমার সূত্রে আমি প্রাচীন মিসরীয় কিবতী। আপনি জানেন নিশ্চয়ই, বলকান অঞ্চলে, তিন হাজার বছর ধরে মিসরীয়দের একটি জনগোষ্ঠী বাস করে আসছে?
-আল্লাহু আকবার! এমন কথা আমি জীবনেও শুনিনি। মিসরীয়রা বলকানে গেল কিভাবে?
-ফারাও দ্বিতীয় রামেসিস, পিরামিড নির্মাণের কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য বিপুল মিসরী কিবতীকে বলকানে পাঠিয়েছিল। সে শ্রমিকরা আর ফিরে আসেনি। ওখানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী বাস করে করে এসেছে। নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখেই। আমীরুল মুমিনীন সুলাইমান কানূনী ইউরোপ থেকে ফেরার পথে, বলকান হয়ে এসেছিলেন। পথিমধ্যে আমার দাদা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। পথ চলতে কষ্ট হচ্ছে দেখে, দাদা চিকিৎসার উদ্দেশ্যে পেছনে থেকে গেলেন। তার চিকিৎসার ভার নিয়েছিলেন বলকানী এক মিসরি পরিবার। দাদা আর ফেরেননি। খিলাফাহর অনুমতি সাপেক্ষে বিয়ে-থা করে ওখানেই স্থায়ী বসত গেড়েছিলেন। আমার পরিবারের দু’টি ধারার উৎস নিয়ে আমি একটি মাকালা (প্রবন্ধ) লিখেছি। আপনাকে কাল এনে দেব। ওখানে বিস্তারিত আছে।
-তোমার জীবনবৃত্তান্ত শুনে আমার এখনই মাকালাটা পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। সে যাক গে। আগামীকাল পড়ব। ইনশাআল্লাহ। আশা করি বিস্তারিত জানতে পারব। তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি, আমরা হজে এসেছি তিনজন। আমি আর আমার স্ত্রী। এবং আমার আম্মু।
-আম্মু খুব বৃদ্ধ হয়ে গেছেন বুঝি?
-কেমন সেটা সামনে গেলে বুঝতে পারবে। সামনে গেলে, তুমি চুপচাপ থেক। আমার আম্মুটা খুবই হাসসাস (স্পর্শকাতর)। অল্পতেই তার অনুভূতিতে আঘাত লাগে। আর বিশেষ কারণে আম্মুটা মানসিকভাবে একটু বিপর্যস্ত। বাইরের কোনও পুরুষকে সহ্য করতে পারে না। তুমি চুপচাপ থাকলে, আমি বাকি কাজ সেরে নেব। সে বলেছে, আরাবিয়্যা চালানোর জন্য মহিলা সহকারী নিতে। কিন্তু আমার মন বলছে, তোমার চেয়ে ভালো সহকারী আর কেউ হতে পারবে না। রাব্বে কা‘বাই তোমাকে মুসা বানিয়ে পাঠিয়েছেন।
.
ভীড় পাতলা হয়ে এল। গুটি পায়ে এগুতে থাকলাম। এত অল্প সময়েই কারো সাথে এমন হৃদ্যতা হয়ে যেতে পারে, জানা ছিল না। আরেকটু এগুতেই শায়খ হাতে চাপ দিয়ে ইশারা করে দেখালেন, অদূরে হুইল চেয়ারে যে বসে আছে, সেই আমাদের মা। আর পাশের জন আমার আহলিয়া।
.
ইয়া আল্লাহ! আমি ভেবেছিলাম শায়খের জন্মদাত্রী মায়ের আরাবিয়্যা চালাতে হবে। এ যে দেখি একটি মেয়ে। দূর থেকে দেখলাম, মা আর মেয়ে তন্ময় হয়ে কথা বলছে। ফ্লাডলাইটের আলোতে মা আর মেয়েকে অপার্থিব কোনও জগতের মানুষ মনে হচ্ছে। চোখ নামিয়ে নিলাম। অজান্তেই মুখ দিয়ে বের হয়ে এল, সুবহানাল্লাহ!





দিনলিপি-৪০৮
(
১৬-১২-২০১)
একমুঠো ভুয়া ইতিহাস!
-আতিক উল্লাহ

---
(এক) যিরয়াব। তিনি প্রথমে ছিলেন বাগদাদে। পরে আন্দালুসে গমন করেন। তাকে মুসলিম ইতিহাসের অন্যতম নায়ক মনে করা হয়। ফ্যাশন, বাদ্যি-বাজনাসহ বেশ কিছু যন্ত্রের আবিষ্কর্তা ছিলেন। বাস্ততে তিনি মোটেও নায়ক নন। বরং খলনায়ক। তিনি বহু মানুষের গোমরাহীর কারণ ছিলেন। তার হাত ধরেই আন্দালুসে পাপাচারের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছিল। যা পতনকেই তরান্বিত করেছিল।
.
(দুই) উমার রা. নাকি দুর্ভিক্ষের বছর ‘হদ’ কায়েম করা স্থগিত করেছিলেন। এটা একটা ভুল প্রচার। তিনি কিভাবে আল্লাহর দেয়া আইন স্থগিত করবেন?
.
(তিন) ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেন নি। তারও দুইশত বছর আগে মুসলমানরা আমেরিকা পৌঁছে গিয়েছিল।
.
(চার) মিসরের একটা ঐতিহাসিক চলচ্চিত্রে (ওয়া ইসলামাহতে) মামলুক সুলতান ইযযুদ্দীন আইবেককে দুশ্চরিত্ররূপে দেখানো হয়েছে। অথচ এটার কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। তিনি অত্যন্ত সবল ও অনুকরনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন।
.
(পাঁচ) আরও কিছু বিষয় আরবীয় চলচ্চিত্রে বেশ কিছুদিন থেকে প্রচার করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে:
ক: রাবেয়া আদাবিয়া মানে রাবেয়া বসরী নাকি আগে নর্তকী ছিলেন। চরম মিথ্যা একটা কথা।
খ: ঈসা বিন আউয়াম রহ.। তিনি ছিলেন সালাহুদ্দীন আইয়ুবী রহ.-এর একজন সেনাপতি। গোয়েন্দা। ডুবুরী। তার সম্পর্কে প্রচার করা হয় তিনি খ্রিস্টান ছিলেন। চরম ভূয়া খবর।
গ: বাজ্জাদ নামে একজন সাহাবীর নামও প্রচার করা হয়। অথচ কিতাবপত্রে বাজ্জাদ নামে কোনও সাহাবীর অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।
ঘ: নবীজি (সা.)-এর এক দুধবোনের নাম ছিল শীমা বিনতে হারেস। তিনি হাওয়াযেন গোত্রের সাথে বন্দী হয়েছিলেন। তার সম্পর্কে প্রচার করা হয়, তিনি যুবতী বয়েসে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ভুল। নবীজিই তো তখন পঞ্চশোর্ধ!
ঙ: নাজ্জাশী রহ. সম্পর্কে বলা হয়, তিনি প্রথমে ক্রুশের পূজো করতেন। ভূয়া। তিনি ইসলাম গ্রহণের আগে ‘একত্ববাদে বিশ্বাসী’ ছিলেন। মেসেজ চলচ্চিত্রে এটা দেখানো হয়েছে।
চ: কিছু কিছু ঐতিহাসিক ধারাবাহিকে দেখানো হয়েছে, ইংল্যান্ড অধিপতি রিচার্ড বন্দীদের প্রতি দয়ালু ছিলেন। তার হৃদয়ও ছিলো খুবই ভালো। এর চেয়ে জঘন্য মিথ্যাচার হতে পারে না।
.
(ছয়) ফরাসী স¤্রাট নেপোলিয়ন মিসরে একজন অত্যাচারী বর্বর দখলদার হিশেবেই আবির্ভূত হয়েছিলো। জ্ঞানের মশালবাহক হিশেবে নয়।
.
(সাত) উসমানি খিলাফাহকে আরবের মুক্তচিন্তার অনেক বুদ্ধিজীবী ‘দখলদার শক্তি’ হিশেবে চালিয়ে দিতে চান। সুষ্পষ্ট ইতিহাসবিকৃতি। অনেক খলীফা সারাজীবন জিহাদে কাটিয়েছেন। পরিপূর্ণ শরীয়ত মেনে শাসন করেছেন।
.
(আট) জাওহার সিকিল্লিকে অনেক বড় মুজাহিদ মনে করা হয়। অথচ এই ব্যাটা একজন খবীস ইসমাঈলি শী‘আ। আজীবন আহলে সুন্নাতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গেছে। পাশাপাশি মুইয লিদ্বীনিল্লাহও ছিলো একজন নিকৃষ্ট শী‘আ শাসক। আহলে সুন্নাতের বহু আলিমের রক্ত তার হাতে লেগে ছিল। ফাতেমী খিলাফাহটাই ছিলো ভূয়া নামে প্রচারিত। তাদের সাথে আহলে বাইতের দূরতম সম্পর্কও ছিলো না।
.
(নয়) মুহম্মাদ আলী পাশাকে মনে করা হয় মিসরের ত্রাতা। আধুনিক মিসরের জনক। বাস্তবে এই লোক ছিলো ওলামায়ে কেরামের হত্যাকারী। দ্বীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধকারী। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রচারকারী।
.
(দশ) মিসরের রাজা ফারুকও ছিলো সমান অপরাধী। তবে তার আমলে মিসরের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল। মিসরের এক জুনাইহের বিনিময়ে তিন মার্কিন ডলার পাওয়া যেতো। সামরিক শাসন এসে মিসরের অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে।
.
(এগার) ১৯৫২ সালে মিসরে সংঘটিত ঘটনা কোনও বিপ্লব ছিলো না। ছিল সামরিক অফিসারদের বিদ্রোহ। অথচ তারা প্রচার করেছিল বিপ্লব বলে। মুহাম্মাদ নজীবকে দুর্বল শাসকরূপে চিত্রিত করেছিল।
.
(বারো) অনেক ভুল হাদীসও আমাদের মাঝে প্রচলিত:
ক: আবু তালেবের সাথে, ডান হাতে সূর্য, বাম হাতে চন্দ্র দেয়ার যে ঘটনা প্রচলিত আছে,এটারও ভিত্তি নেই।
খ: হিজরতের পথে দুই কবুতরের ঘটনারও কোনও ভিত্তি নেই।
গ: নবীজির ঘরের সামনে এক ইহুদির ময়লা ফেলার ঘটনারও কোনও ভিত্তি নেই।
ঘ: মক্কা বিজয়ের দিন নবীজি বলেছিলেন: যাও তোমরা সবাই মুক্ত। এই হাদীসটা নিয়েও কোনও কোনও মুহাদ্দিস আপত্তি করেছেন।
ঙ: হিন্দা বিনতে উতবা (রা.) সম্পর্কেও প্রচলিত আছে: হামযা রা.এর কলিজা চিবিয়ে খাওয়ার কথা। বাস্তবে তিনি কলিজা খান নি।
















এক চুমুকে ইতিহাস: ৩১৭
জুরজি যায়দান!
-আতিক উল্লাহ

লেখকের যদি পাঠকপ্রিয়তা থাকে, আর গল্প-উপন্যাস যদি তার সাহিত্যচর্চার মাধ্যম হয়, তাহলে তিনি বেশ কিছু সুবিধা ভোগ করেন। তিনি সহজেই পাঠকের কাছাকাছি চলে যেতে পারেন। গল্পচ্ছলে ভাল কথা বলতে পারেন। অসৎ লেখক হলে, গল্পের মাঝে দুয়েকটা বিষাক্ত কথাও দিয়ে দিতে পারেন। পাঠক সরলমনে গরল গিলে ফেলে। বাংলাভাষায় মীর মশারফ হোসেনের ‘বিষাদসিন্ধু’র কথা ধরতে পারি। এই একটা বই, বাংলাভাষী মানুষকে কতটা বিভ্রান্ত করেছে, বলে শেষ করা যাবে না।
.
আরবী ভাষায় তেমনি একজন হলেন কট্টর খ্রিস্টান লেবানিজ লেখক ‘জুরজী যায়দান’ (১৮৬১-১৯১৪)। ইসলামের ইতিহাসচর্চায় যত বিকৃতি বর্তমানে ছড়িয়ে আছে, তার অধিকাংশই এই খ্রিস্টান ঔপন্যাসিকের ‘কারসাজি’। ইউরোপের ঐতিহাসিক তো বটেই, অনেক মুসলিমও তার ইতিহাস বিকৃতিকারী ‘অপন্যাসগুলোতে’ বিবৃত বিকৃত ইতিহাস দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে।
.
বাইরুতে বেড়ে উঠেছেন। বাবা খাবারের হোটেল চালাত। জুরজি মুচির কাজ শিখেছেন পেশা হিশেবে। পাশাপাশি পড়াশোনাও চলেছে। মিসরে এসে ইংরেজদের অধীনে অনুবাদকের কাজ করেছেন। ১৮৯৬ সালে ‘আলহেলাল’ পত্রিকা বের করা শুরু করেছেন। এই পত্রিকাকে ঘিরেই তার সাহিত্য সাধনা পুরোদমে শুরু হয়েছিল। আকর্ষণীয় ভাষায় বেশ কিছু ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা করেছেন। ইসলামি ইতিহাসের বিখ্যাত চরিত্রসমূহকে উপজীব্য করে। আরব জাতীয়তাবাদ আর আরবি ভাষা-সাহিত্য আন্দোলনের আড়ালে, আজীবন ইতিহাস বিকৃতির প্রহসন চালিয়ে গেছে। আল্লামা শিবলী নুমানী রহ.ও তার ভ্রান্তিগুলো নিয়ে লিখেছেন।
.
জুরজি যায়দানের মতো, চাতুর্যের সাথে সমকালীন আর কোনও লেখক ইসলামী ইতিহাসকে বিকৃত করতে পারেনি। জুরজির কাছ থেকেই অধিকাংশ ‘প্রাচ্যবিদরা’ ইতিহাস গ্রহণ করেছে। অথচ জুরজি লিখেছিলেন ইতিহাস। তার বিখ্যাত একটি বই হচ্ছে (تاريخ التمدن الإسلامي) ইসলামি সভ্যতার ইতিহাস। শিবলী নুমানী এই বইয়ের ভ্রান্তিগুলো নিয়েই লিখেছিলেন।
.
(১): গাসসানী ‘কইন্যা’ (فتاة غسان) বইয়ে, আল্লাহর রাসুল সা.-সহ ইসলামের প্রথম প্রজন্মের সেরা মানুষগুলোকে সুকৌশলে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রয়াস পেয়েছে। তারা প্রচ- দাপুটে, হত্যা ও লুণ্ঠনকারী, এমন একটি চিত্র আঁকার চেষ্টা করেছেন এই লেখক।
২: মিসরের আরমানুসা (أرمانوسة المصرية) বইয়ে, মহান সাহাবী আমর বিন আস রা.-এর জীবনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়েছে। মুসলমানদের দেখিয়েছে, সহজ সরল বোকা আর নির্বোধরূপে।
৩: কুরাইশকুমারী (عذراء قريش) বইয়ে, উসমান, আলি ও আয়েশা রা.-এর সীরাতবিকৃতির অপচেষ্টা করেছে।
৪: সতেরই রমযান (১৭ رمضان) বইয়ে, উমাইয়া খলীফাগনের চরিত্র হনন করার অপপ্রয়াস চালিয়েছে।
৫: আন্দালুস বিজয় (فتح الأندلس) বইয়ে, তারিক বিন যিয়াদ ও মুসা বিন নুসাইর রহ.-এর চরিত্র সীরাত বিকৃতির চেষ্টা চালিয়েছে।
৬: চার্লস ও আবদুর রহমান (شارل وعبد الرحمن) বইয়ে, মহান মুজাহিদ আবদুর রহমান গাফেকী রহ.-এর জীবনী বিকৃতির ঘৃন্য প্রয়াস চালিয়েছে।
৭: আবু মুসলিম খুরাসানী (أبي مسلم الخراساني) বইয়ে, দ্বিতীয় আব্বাসী খলীফা মনসুরের জীবনী বিকৃতির চেষ্টা চালিয়েছে।
৮: রশীদভ্রাত্রী আব্বাসাহ (العباسة أخت الرشيد) বইয়ে, মহান খলীফা হারুনুর রশীদ রহ.-এর জীবনী বিকৃতির হীন প্রয়াস চালিয়েছে।
৯: উসমানি বিপ্লব (الأنقلاب العثماني) বইয়ে, মাজলুম খলীফা আবদুল হামীদ (২য়) রহ-এর জীবনী বিকৃত করা হয়েছে। এই বইয়ের প্রভাবে অনেকেই এই খলীফার প্রতি অবিচার করেছে।
১০: এভাবে এই দুষ্ট লেখক একাধারে খলীফা মু‘তাসিম, মিসরের আহমাদ বিন তুলূন রহ., আন্দালুসের খলীফা আবদুর রহমান নাসির রহ., মহান মুজাহিদ আব্বাসী খিলাফাহর পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা সুলতান রুকনুদ্দীন বায়বার্স রহ., আইনে জালূতের বিজয়ী বীর সাইফুদ্দীন কুতুয রহ., সুদানের মুহাম্মাদ আহমাদ মাহদীসহ আরও অনেকের জীবনী বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছে।
.
মোটকথা, এই লোক একটা গোপন এজেন্ডা নিয়ে সাহিত্য চর্চায় নেমেছিল। এবং সফলও হয়েছিল। তার বিকৃত ইতিহাসের জঞ্জাল সরিয়ে, বিশুদ্ধ ইতিহাস প্রতিষ্ঠা করতে, মুসলিম ঐতিহাসিকদের বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। মুসলিম ঐতিহাসিকগনের অক্লান্ত প্রয়াস সত্ত্বেও জুরজি যায়দানের রেখে যাওয়া ‘ছাঁইপাশ’-এর প্রভাব পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সাহিত্যের মাধ্যমে, একবার কোনও ‘বিষ’ বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানে ছেড়ে দিতে পারলে, সহজে তা উপড়ানো যায় না। যুগের পর যুগ পার হয়ে যায়। সেই বিষের মাশুল গুনে যেতে হয়। বিষাদ সিন্ধুকেই দেখি না, এখনো বাংলাসাহিত্যের কোনও কোনও পাঠক, এ-বইয়ে সন্নিবেশিত তথ্যকে সঠিক বলে মনে করে। অন্তত সবটা না হলেও, কিছু কিছু সঠিক, এটা মনে করেই।
.
উপনিবেশিক আমলে, আমরা নানাদিক দিয়েই জুলুমের শিকার হয়েছি। সে জুলুমের রেশ আজও কাটেনি। আমরা সচেতন না হলে, এই রেশ কখনোই কাটবে না।

ফুটবল খেলাই এখন এই শহরগুলোর ধ্যান-জ্ঞান।ফুটবলাররাই শহরবাসীর অাইডল। বিশ্ব দরবারেও শহরগুলোর পরিচিতি এখন ফুটবলের স্বর্গরাজ্য হিসেবে।
অথচ একসময় এই গ্রানাডা, বার্সেলোনা, মাদ্রিদ ছিলো অামাদের।খিলাফার ঝাণ্ডা উড়তো শহরের প্রাচীরগুলোত।মানুষ ব্যস্ত থাকতো ঐশী গ্রন্থে।বলিয়ান থাকতো ঐশী শক্তিতে।
অাবার অামাদের ফিরিয়ে অানতে হবে এ শহরগুলো।যে শহরগুলো মুসলিম বরপুত্র তারিক বিন যিয়াদ অামাদের কাছে অামানত রেখে গেছে ।


No comments:

Post a Comment