Friday, February 28, 2020

আন্দালুস হারানোর ৫২৭ বছর #আন্দালুস_সপ্তাহ, ২০১৯ (১ম অংশ)

পুরো বইটি পড়ুন এখান থেকে-
 https://justpaste.it/andalus527









মুহতারাম আতিক উল্লাহ সাহেবের “খিলাফাহ রাশিদাহ” গ্রুপ থেকে ২রা জানুয়ারি, ২০১৯ তারিখে আন্দালুস হারানোর ৫২৭ বছর উপলক্ষে আন্দালুসের স্মৃতি চারণ, আন্দালুসের স্মরণ, আর আন্দালুস নিয়ে ক্রন্দনের নিমিত্তে পালিত হয় ‘আন্দালুস সপ্তাহ’। এক সপ্তাহ যাবত এ গ্রুপের মেম্বারগণ আন্দালুস সম্পর্কে জেনেছে, জানিয়েছে, ভেবেছে, ভাবিয়েছে, কেঁদেছে এবং কাঁদিয়েছে। সেই ভাবনা, সেই কান্না, সেই স্মৃতিচারণ এবং সেই জানা-অজানা ইতিহাসের নানা গলি ঘুপজি ভ্রমণকে তুলে এনেছি উক্ত সংকলনে। সকলকে আল্লাহ্‌ জাযায়ে খায়ের দান করুন।








আল-আন্দালুস: আমাদের হারানো ফিরাদওস!
আতিক উল্লাহ

প্রথম পর্ব
দিনলিপি-১৭৯
(০২-০৫-২০১৫)
*** আন্দালুস। নামটার মধ্যেই কেমন যেন আপন আপন ভাব আছে। সাথে সাথে কেমন যেন বিরহ বিরহ ভাবও আছে। সবই হয়তো মনের কল্পনা। তবুও মনের কল্পনা তো ভালোবাসা থেকেই তৈরী হয়।
.
মূল পর্বে যাওয়ার আগে, সামান্য একটু ভূমিকা:
= আল্লাহ তা‘আলার রীতিনীতিতে কোনও পরিবর্তন নেই। আমাদের প্রয়োজনেই, এই রীতিনীতিগুলো জানা জরুরী। তাহলে জীবনটা সহজ হয়ে যায়, সুন্দর হয়ে ওঠে।
.
আল্লাহ তা‘আলার স্বীকৃত নীতি হলো, একশ ডিগ্রী গরম হলে পানি টগবগ করে ফুটতে থাকবে। এই নীতি কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে। এর কমবেশ হবে না। যদি এমন হতো, আজ ত্রিশ ডিগ্রীতে পানি ফুটতে শুরু করেছে। কাল চল্লিশ ডিগ্রী। পরশু পঞ্চাশ ডিগ্রী
তাহলে জীবনটা কেমন হতো? টিকে থাকাই দায় হয়ে যেতো।
.
আগুনের ধর্ম হলো পোড়ানো। কেয়ামম পর্যন্ত আগুন এই ধর্মের ওপরই বহাল থাকবে। এর ব্যত্যয় ঘটবে না। ব্যতিক্রম হবে না। এটাই চিরাচরিত বিধান। ইব্রাহীম (আ.) আগুনে পোড়েন নি, সেটা মু’জিযা। একজন মুমিন মু’জিযার তালাশে থাকবে না,বস্তুর স্বাভাবিক যা ধর্ম সেটা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে।
.
খাবার ছাড়া কোনও প্রাণী বাঁচতে পারে না। কোনও মানুষ যদি খাবার ছাড়া কয়েক দিন থাকে, সে মারা যাবে এটাই আল্লাহর বিধান।
.
বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও আল্লাহর বিধান হলো, একটি জাতি একসময় সবল থাকবে, তারপর আস্তে আস্তে দুর্বল হতে থাকবে। আবার দুর্বলতা থেকে আস্তে আস্তে সবলতার দিকে যাবে। এটা মুসলিম-অমুসলিম সবার ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য।
.
ইতিহাসের আশ্চর্যজনক একটা বিষয় হলো, অদ্ভুতভাবেই সেটার পুনরাবৃত্তি ঘটে। সে হিশেবে বলা যায়, আমরা যখন অতীতের কোনও ইতিহাস পড়ি, প্রকৃতপক্ষে সেটা শুধু অতীত নয়, ভবিষ্যতেরও ইতিহাস। কারণ অতীতে যা ঘটেছে, মোটা দাগে সেটা ভবিষ্যতেও ঘটবে।
.
একজন মুমিন কিভাবে ইতিহাস পাঠ করবে?
= তার ইতিহাস পাঠের ধরন হবে, অতীতের ভাল মানুষেরা কিভাবে কাজ করেছেন, কোন পথে হেঁটেছেন, সেটা যাচাই করা। সে অনুযায়ী নিজে চলার পাথেয় সংগ্রহ করা।
.
আন্দালুসের ইতিহাসটাও আমাদের জন্যে এক জীবন্ত শিক্ষা। এর ইতিহাসে আল্লাহর বিধান এতটা স্পষ্ট হয়ে আছে, অন্য কোনও ইতিহাসে এতটা নেই। উত্থান-শিখর আরোহণ-পতন।
= তবে আমি শেষ পর্যায়কে পতন বলতে চাই না। বলতে চাই পুনরুত্থানের প্রস্তুতি ও প্রেরণা ও শিক্ষাগ্রহণ পর্ব।
.
আন্দালুসের ক্ষেত্রে একটা ব্যতিক্রমধর্মী বিষয় আছে। অন্য জাতিগুলোর ইতিহাসে উত্থান-শিখরছোঁয়া-পতনপর্বটা একবারই ঘটে। কিন্তু আন্দালুসে এই পর্বটা বেশ কয়েক বার ঘটেছে। এই বিষয়টা নিয়ে আমি প্রায়ই ভাবি, আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে বেশ কয়েক বার সতর্ক করেছেন। সহজে তিনি আমাদের থেকে এই ‘আলফিরদাওসুল মাফকুদ’ (হারানো স্বর্গ) ছিনিয়ে নিতে চান নি। তিনি হয়তো চেয়েছিলেন, এই স্বর্গ আমাদের হাতেই থেকে যাক, কিন্তু আমরা তার এই নেয়ামতের কদর করতে পারিনি।
.
.
আমরা কেন আন্দালুসকে পড়বো?
------------
আন্দালুসের ইতিহাস আটশ বছরের। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, হিজরী সন হিশেবে আটশত পাঁচ বছরের। ৯২-৮৯৭ হিজরী। আর ঈসায়ী সন হিসাবে ৭৮১ বছর হয়। ৭১১-১৪৯২।
এই দীর্ঘ সময়ের ইতিহাসে কিছু অংশ আছে, অনালোচিত, কিছু অংশ আছে বহুল আলোচিত। কিছু অংশের ওপর ধূলোর আস্তর জমেছে। কিছু অংশকে কুচক্রীরা বিকৃত করে উপস্থাপন করেছে। তারা কিছু সত্যকে মিথ্যার মতো করে পরিবেশন করেছে আর কিছু মিথ্যা কে সত্যের প্রলেপ দিয়ে আমাদেরকে গিলিয়েছে। এটা অত্যন্ত ভয়ংকর একটা কাজ। আমাদের উচিত এর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়া। ধুলো-ময়লা সরিয়ে আসল সত্যকে বের করে আনা।
.
আন্দালুসের দীর্ঘ ইতিহাস পরিক্রমায়, অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। অফুরন্ত গল্প তৈরী হয়েছে। অগুনতি বাঁক সৃষ্টি হয়েছে। বেশুমার গাঁথার জন্ম হয়েছে। অনেক মুজাহিদের জন্ম হয়েছে। অনেক ভীরু-কাপুরষও আত্মপ্রকাশ করেছে। অনেক মুত্তাকী-পরহেযগারের উন্মেষ ঘটেছে। অনেক শরীয়তবিরোধী নাস্তিক ব্যঙের ছাতার মতো গজিয়েছে। অনেক দ্বীনের রক্ষক মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। অসংখ্য বিশ্বাসঘাতক ফনা তুলেছে। এজন্য আমাদেরকে আন্দালুস জানা দরকার।
.
.
আন্দালুসের যা না জানলেই নয়
------------
আমাদের জানা দরকার ‘বারবাত প্রান্তরের’ ঘটনা। এটা এমন ঘটনা, গুরুত্বের দিক থেকে ইসলামের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গুরুত্বপ্রাপ্ত যুদ্ধগুলোর একটি হওয়ার মর্যাদা রাখে। এই বারবাত কোনও অংশে ইয়ারমুক-কাদেসিয়া থেকে কম নয়। এই বারবাতের মাধ্যমে শুধু আন্দালুস নয়, বিশ্ব ইতিহাসের বিরাট একটা অর্জনকে মুসলমানরা জয় করেছে।
= কিন্তু এতদসত্ত্বেও মুসলমানদের কাছে এই বারবাত উপত্যকা বিস্মৃত। বিলুপ্ত। বিযুক্ত।
.
আমাদের জানা দরকার ‘জাহাজ পোড়ানো’র ঘটনা। তারিক বিন যিয়াদ (রহ.) আসলেই কি জাহাজ পুড়িয়েছিলেন? পোড়ালে কেন পুড়িয়েছিলেন? পাশ্চাত্যের সমালোচকদের কাছে এই ঘটনা এত প্রিয় কেন?
.
আমাদের জানা দরকার আবদুর রহমান দাখিল (রহ.) কে ছিলেন? ঐতিহাসিকরা বলে থাকেন, আবদুর রহমান দাখিল না হলে, আন্দালুসে ইসলাম অনেক আগেই সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যেতো।
.
আমাদের জানা দরকার আবদুর রহমান নাসের কে ছিলেন? তিনি তো ছিলেন মধ্যযুগে ইউরোপের সবচেয়ে বড় বাদশাহ। আমাদের জানা আবশ্যক, তিনি কিভাবে এত উঁচু স্তরে আরোহণ করতে পারলেন। কিভাবে তিনি তার যুগের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন।
.
আমাদের জানা দরকার, ইউসুফ বিন তাশাফীন কে ছিলেন? তিনি কেমন সেনাপতি ছিলেন, কেমন খোদাভীরু ছিলেন। কতটা শরীয়তের পাবন্দ ছিলেন। তিনি সুদূর আফ্রিকার গহীনতম কোনে থেকেও, এমন অসাধারণভাবে বেড়ে উঠেছিলেন? এই কালো মানিকের মনে জিহাদের প্রতি এমন প্রবল ভালোবাসা-ই-বা কিভাবে তৈরী হলো?
.
আমাদের জানা দরকার অবিস্মরণীয় ‘যাল্লাকাহ’ প্রান্তরের লড়াইয়ের কথা। এই লড়াইয়ে হেরে গেলে মুসলমানদেরকে আরও কয়েক শত বছর আগেই আন্দালুস থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতে হতো।
.
আমাদের জানা দরকার আবু বকর উমার লামতুনীর কথা। এই মহান মুজাহিদের হাত ধরে আফ্রিকার পনেরটারও বেশি দেশ ইসলামের ছায়াতলে এসেছিল।
.
আমাদের জানা দরকার আবু ইউসুফ ইয়াকুব মানসুরকে। যিনি চির অম্লান ‘আরাক’ যুদ্ধের মূল নায়ক। মুসলমানদেরকে অতুলনীয় বিজয় এনে দেয়া বীর। খ্রিস্টানদের বিষদাঁত ভেঙে দেয়া সিপাহসালার।
.
আমাদের জানা আবশ্যক মুরাবিতীনদের কথা। তাদের ইসলামী রাষ্ট্রের কথা। কিভাবে সেটা শূন্য থেকে পুণ্যতে পৌঁছল?
.
আমাদের জানা আবশ্যক মুয়াহহিদীনদের কথা। তাদের প্রতিষ্ঠিত ‘দাওলাহ’র কথা।
.
আমাদের জানা দরকার মসজিদে কুরতুবার কথা। যেটাকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মসজিদ হিশেবে বিবেচনা করা হতো। কিভাবে মুসলমানদের এই মহান নিদর্শনকে গীর্জায় রূপান্তরিত করা হলো?
.
আমাদের জানা দরকার ইসাবেলিয়ার অনুপম মসজিদটির কথা।
.
আমাদের জানা থাকা দরকার কুরতুবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। পুরো বিশ্ব থেকে ভেঙে পড়া জ্ঞানার্থীদের কথা।
.
আমাদের জানা দরকার উমাইয়া পাঠাগারের কথা। এতবড় পাঠাগার কিভাবে গড়ে উঠলো?
.
আমাদের জানা দরকার যাহরা প্রাসাদের কথা। জানা দরকার যাহরা শহরের কথা।
.
আমাদের জানা দরকার হামরা প্রাসাদের কথা। তার অনিন্দ্য সৌন্দর্যের কথা।
.
পাশাপাশি জানা দরকার ‘ইকাব’ যুদ্ধের কথা। এই যুদ্ধে মুসলমানদের সংখ্যা-শক্তি বেশি থাকা সত্ত্বেও পরাজিত হয়েছিল। যেন হুনাইনের খন্ডচিত্র ক্ষণিকের জন্যে ফিরে এসেছিল। ঐতিহাসিকরা লিখেছেন:
-ইকাব যুদ্ধের পর আন্দালুসে যুদ্ধ করতে সক্ষম কোনও যুবকের দেখা মিলত না। এতটা বিপর্যয় ঘটেছিল।
.
আমাদের জানা আবশ্যক কিভাবে আন্দালুসের পতন হয়েছিল। পতনের কারণগুলো কী কী?
.
এটাও জানা দরকার, আন্দালুসে ইসলামের সূর্য ডোবার পর কোথায় উদিত হয়েছিল? জানা দরকার আন্দালুসে সেই অপসৃত সূর্য একই সময়ে কিভাবে ‘কনস্টান্টিনোপল’ বিজয়ের মধ্য দিয়ে উসমানি খিলাফতে উদিত হয়েছিল?
.
আমাদের জানা দরকার ‘ভ্যালেনসিয়া’ শহরের সেই রোমহর্ষক গণহত্যার কথা। যেখানে এক দিনেই ষাট হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছিল।
.
আমাদের জানা দরকার ‘উব্বাযাহ’ হত্যকান্ডের কথা। যেখানে ভ্যালেনসিয়ার মতো মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। একদিনেই ষাট হাজার নিরীহ মুসলমানকে শহীদ করে দেয়া হয়েছিল।
.
আমাদের জানা দরকার ‘বারবুশতার’ গণহত্যার কথা। যেখানে এক দিনেই চল্লিশ হাজার বনী আদমকে শহীদ করে দেয়া হয়েছিল। কিভাবে সাত হাজার মুসলিম কুমারীকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
= ইতিহাস একই ভাবে আবার ফিরে আসে। আমাদের জানা দরকার কিভাবে বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটলো?
.
আমরা যদি এসব ইতিহাস জানি, মুসলমানদের কোমরভাঙ্গা অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর কথাও জানি, তাহলে আজ, বর্তমানেও কিভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হবে, সেটা জেনে যাব।
.
আমরা চেষ্টা করবো, প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে দেখতে। রাব্বে কারীম আমাদেরকে তাওফীক দান করলে কিছুই অসম্ভব নয়। ইনশাআল্লাহ।


দ্বিতীয় পর্ব
দিনলিপি-১৮৬
(১০-০৫-২০১৫)
স্পেনের ইহুদি
স্পেন সম্পর্কে ছয়টা কথা:
এক: বর্তমান স্পেন রাষ্ট্রটির ভিত দাঁড়িয়ে আছে একটি ‘শহীদ’ মুসলিম খিলাফাহর ওপর। একটি জান্নাতের ওপর। একটি হারানো স্বর্গের ওপর। সেই বাগানটির নাম ছিল আন্দালুস।
.
দুই: স্পেন আমাদের শহীদ সালতানাত দখল করে আছে। কিন্তু আরেকটি মুসলিম দেশও দখল করে আছে, যা আমাদের অজানা। দেশটির নাম মরক্কো। মরক্কোর বড় বড় তিনটা দ্বীপ তারা দখল করে রেখেছে। সাবতা, মালীলিয়াহ আর জা‘ফরীয়াহ।
.
তিন: স্পেনেই সবার আগে ক্রুশেডের আগুন জ্বলে উঠেছে। ইসলাম ও মুসলমানের বিরুদ্ধে তারাই প্রথম খ্রিস্টবাদের ধ্বজা তুলে ধরে।
.
চার: স্পেন এমন একটা দেশ, যার প্রায় প্রতিটি গীর্জাই কোনও কোনও মসজিদের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। অসংখ্য শহীদ মসজিদের ওপর বাজে আজ চার্চের ঘণ্টা।
.
পাঁচ: স্পেনই বিশ্বে প্রথম ‘এথনিক ক্লিনজিং’ (জাতিশুদ্ধি) আবিষ্কার করে। পুরো মুসলিম উম্মাহকে তারা নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চালায়। প্রায় দুই শতক ধরে। ধারাবাহিক ভাবে।
.
ছয়: স্পেনের প্রাচীন অধিবাসীরা ছিল ‘আইবেরীয় জাতি’র অন্তুর্ভুক্ত। ইসলাম স্পেনে আসার পর, আইবেরীয়রা সবাই ইসলাম গ্রহণ করেছিল। বর্তমানে স্পেনে কোনও স্থানীয় অধিবাসী নেই। এখানকার অধিবাসীদেরকে নিমূল করে দেয়া হয়েছে। মুসলিম হওয়ার অপরাধে। যারা এখন স্পেনে আছে, তারা ইউরোপের বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা সংকর একটা জাতি।
= আইনত এদের স্পেনে থাকার কোনও অধিকার নেই। এরা বহিরাগত।
--------------------------------------------
ড. খালিদ ইউনুস। তিনি একজন বিশিষ্ট গবেষক। তার একটা কিতাব আছে। স্পেনে মুসলিম শাসনাধীনে ইহুদি।
ড. খালিদ চমৎকার লিখেছেন। তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন, ইহুদীরা কত আরামে, কত আয়েশে আন্দালুসে থাকতো। সামান্য কয়েকটা দিক তুলে ধরা যাক:
এক: স্পেনে বসবাস কালে ইহুদিরা তাদের স্বকীয় চেতনার বহিঃপ্রকাশ করার সুযোগ লাভ করেছিল। স্বাধীনভাবে জ্ঞানচর্চার পরিবেশ পেয়েছিল। পরম নিশ্চিন্তে বসবার করার যাবতীয় উপায়-উপকরণ হাতের নাগালেই ছিল। ইহুদীদের জ্ঞানচর্চা বিশেষ করে দর্শন ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে তারা অত্যন্ত দক্ষতা অর্জন করেছিল।
.
ইহুদীরা শুধু যে তাদের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই দর্শনচর্চা করতো তা নয়, তারা মুসলিম দর্শন দ্বারাও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিল। ইয়াহুদা হালিফী ছিলেন এমন একজন দার্শনিক। তিনি তার বিখ্যাত রচনা কিতাবুল হুজ্জাহ-তে ইমাম গাজ্জালীর রীতি অনুসরণ করেই দার্শনিকদের অনেক ভুলত্রুটির সমালোচনা করেছিলেন।
.
আন্দালুসে প্রায়ই বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক হতো। সে বিতর্কে সব ধর্মের পন্ডিতগনই অংশগ্রহণ করতেন। স্বাধীনভাবে যে যার ধর্মের স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরতেন। এসব বিতর্ক আরবী ভাষাতেই হতো। সব ধর্মাবলম্বীরাই আরবী ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করতেন।
মুসলমানদের সাথে ইহুদিদের এই উন্মক্ত বাহাস করা থেকেই প্রমাণ হয়, তারা কতোটা চিন্তার স্বাধীনতা ভোগ করতো।
এমনি এক বিখ্যাত মুনাযারা হয়েছিল ইবনে হাযম (৯৯৪-১০৬৩) এবং ইসমাঈল বিন নাগদিলার মধ্যে। ইবনে হাযম (রহ.) সে বিতর্কে ইহুদি ধর্মের অসারতা স্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরেছিলেন।
পরে একটা স্বতন্ত্র কিতাবও রচনা করেছিলেন। সেখানেও ইহুদি ধর্মের ভ্রান্তির বিভিন্ন দিক ও ইসমাঈল বিন নাগদিলার সাথে হওয়া মুনাযারার বিবরণও ছিল।
.
আন্দালুসের ইহুদিরা চিকিৎসাবিদ্যাকে বেশি গুরুত্ব দিতো। কারণ এটাই ছিল সে সময় শাসক এবং ক্ষমতাবাণদের কাছাকাছি যাওয়ার সংক্ষিপ্ত পথ। এর সাহায্যে তারা বড় বড় সরকারী পদেও আসীন হতো।
= আসলে ইহুদিরা সব সময় বেশ সংঘবদ্ধভাবেই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করে এসেছে। তাদের ষড়যন্ত্র প্রকাশ পেয়ে গেলে তারা চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আর প্রকাশ না পেলে অন্যদের মাথায় চেপে বসেছে।
এটা আমরা সেই প্রাচীন কাল থেকেই দেখে আসছি। নবীজি (সা.) এর যুগেও এমনটা ছিল।
.
আন্দালুসে ইসলাম প্রবেশের সময় হিব্রু ভাষা ছিল অত্যন্ত অবহেলিত। বেশিরভাগ ইহুদীই তাওরাতের ভাষ্য বুঝতে পারতো না। তাদের সিনাগগে মূল তাওরাতের বদলে আরামীয় ভাষায় অনূদিত তাওরাত পড়া হতো।
আন্দালুসে ইসলামের আগমনের পর, ইহুদীরা মুসলমানদের সংস্পর্শে এল। আরবী ভাষার সংস্পর্ষে এল। আরবী ভাষার ব্যাকরণ (নাহু-সরফ) শিখল। তারা দেখল মুসলমানরা কিভাবে আরবী চর্চা করে। আরবরা তাদের ভাষাকে কতোটা ভালোবাসে। তাদের কুরআনকে কী পরিমাণে শ্রদ্ধা করে।
.
তারাও উদ্বুদ্ধ হলো। হিব্রু ভাষাচর্চা শুরু করলো। আরবী ব্যাকরণের মতো হ্রিব্রু ভাষার জন্যেও ব্যাকরণ প্রণয়ন করলো।
অবশ্য হিব্রু ভাষার ব্যাকরণের উৎপত্তি ঘটে ইরাকে। সা‘দিয়া বিন ইউসুফ (৮৯২ খি:) এর মাধ্যমে। তবে হিব্রু ভাষার বিকাশ ও উৎকর্ষতা আসে আন্দালুসে।
মানাহীম বিন সারূক (৯১০-৯৬০ খি:)। ইনিই সর্বপ্রথম হিব্রু অভিধান প্রণয়ন করেন। মুহাবরীত। এই অভিধানে বাইবেলের সমস্ত শব্দই আনা হয়েছিল। মধ্যযুগে ইউরোপের ইহুদীরা এই অভিধানের সাহায্যেই হিব্রুচর্চা করতো।
.
স্পেনে অষ্টম উমাইয়া খলীফা ছিলেন আবদুর রাহমান নাসির (তয়)। তার একজন উযীর ছিলেন হাসদাই বিন শাবরূত। মানাহিম বিন সারূক এই উযীরের প্রধান সেক্রেটারী ছিলেন।
.
মুসলমানদের আশ্রয়ে বেড়ে ওঠে, মুসলমানদের খেয়ে পরে, আজ মুসলমানদের নিধনে সর্বশক্তি ব্যয় করেছে এই অভিশপ্ত জাতিটা। বাংলা প্রবাদবাক্যই ওদের জন্যে শতভাগ উপযুক্ত:
= তোমারে বধিবে যে, গোকূলে বাড়িছে সে।
.
কোনও ক্ষমতাই চিরদিন থাকে না। টেকে না। স্থায়ী হয় না। সেটা বাংলাদেশে হোক আর রাশিয়াতে হোক আর আমেরিকায় হোক আর ইসরাঈলেই হোক।
.
ইসরাঈলের পতন আর বেশিদিন নেই। ঘনিয়ে এসেছে। সন্নিকটে। অতি নিকটে। একটা হিশেব কষি:
= আমরা যদি অতীত পানে তাকাই, দেখবো, মিসরের শী‘আ সালতানাত উবাইদী (ফাতেমী) বিলুপ্ত হয়েছিল শাম (সূরিয়া)-এর দিক থেকে আসা মুজাহিদ (সালাহুদ্দীন আইয়ুবী)-এর মাধ্যমে।
= বায়তুল মাকদিস মুক্তির সূচনা হয়েছিল শামে।
= এ থেকে বোঝা যায়, বায়তুল মুকাদ্দাসের নাড়ী ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে শাম (সূরিয়া)-এর সাথে।
= সুতরাং দিমাশক জয় না হলে, আলকুদস জয় হবে না।
= জামে‘ উমাবী জয় না করলে আল-আকসা জয় করা যাবে না।
= বর্তমান ও অতীতের সিরীয় শাসকদের হাতে যত ফিলিস্তীনি মুহাজির শহীদ হয়েছে, তার সংখ্যা ইসরাঈলের ইহুদিদের হাতে শহীদ হওয়া ফিলিস্তীনিদের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়।
= এজন্যই দিমাশক জয় করলে শুধু বায়তুল মুকাদ্দাস নয়, নিরীহ উদ্বাস্তু ফিলিস্তীনিরাও মুক্তি পাবে।
------------------------------------------
আর এটা কি বলে দিতে হবে:
= কালিমাখচিত কালো পতাকা তিনদিক থেকে দিমাশকের ঘাড়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলছে!
= ইয়া আকসা! আমরা আসছি। দিমাশকের পরপরই। আর বেশিদিন নেই।
= সাবরান ইয়া আকসা! নাহনু হাদিরূন।
= লাব্বাইক ইয়া আকসা! লাব্বাইক! লাব্বাইক!


তৃতীয় পর্ব
দিনলিপি-১৯০
(১৪-০৫-২০১৫)

ইসলামপূর্ব আন্দালুসের অবস্থা।
নামকরণ:
-----------------
তখনকার স্পেনে কিছু বর্বর গোত্র বাস করতো। এরা মূলত স্পেনে এসেছিল উত্তরের স্ক্যান্ডেনিভিয় দেশ সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে ইত্যাদি দেশ থেকে।
এরা বর্বরের মতো এসে, স্পেনের ভূমি দখল করে বাস করতে শুরু করেছিল। কারো কারো মতে এরা এসেছিল জার্মানি থেকে।
এই উদ্বাস্তু নব আগন্তুক অভিবাসীদেরকে ভ্যান্ডাল নামে ডাকা হতো। এদের নামের সাথে মিলিয়েই স্পেন ‘ভ্যান্ডালেসিয়া’ নামে পরিচিতি পেতে থাকে। আস্তে আস্তে পরিবর্তিত রূপ দাঁড়ায় আন্দুলীসিয়া তারপরে আন্দালুস।
.
এ ভ্যান্ডাল গোত্রগুলো ছিলে অত্যন্ত অসভ্য-বর্বর। ইংরেজিতে ভ্যান্ডাল শব্দের অর্থও তাই। ভ্যান্ডালরা ছিল যাযাবর। এক জায়গায় বেশিদিন স্থির হয়ে থাকতো না। তারা আন্দালুস ছেড়ে চলে গেলো। তাদের পরে অন্য খ্রিস্টান জাতি স্পেনের শাসনক্ষমতায় এল, তাদেরকে বলা হতো গথ। মুসলমাদের সাথে এই গথিকদেরই য্দ্ধু হয়েছে।
.
আমরা আন্দালুস হিশেবে যে দেশকে চিনি-জানি, সেটা শুধু আজকের স্পেনই নয়, বর্তমানের পর্তুগালও আন্দালুসের অন্তুর্ভূক্ত ছিল। পুরো অঞ্চলটাকেই বলা হতো: আইবেরীয় উপদ্বীপ। আয়তন প্রায় ছয় লক্ষ বর্গকিলোমিটার।
আইবেরিয় উপদ্বীপ ইউরোপের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। অনেকটা ত্রিভূজাকৃতির। পূর্বদিকে ক্রমশ সংকীর্ণ হতে হতে কোণের সৃষ্টি হয়েছে। পশ্চিম দিকে ক্রমশ প্রশস্ত।
মরক্কো থেকে বার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। দুই দেশের মধ্যে ছোট্ট একটা প্রাণালী। জিব্রাল্টার প্রণালী। যার মূল উচ্চারণ হলো: জাবালুত তারিক। তারিক বিন যিয়াদ (রহ.) নামে।
পিরেনিজ পর্বতমালা আন্দালুস এবং ফ্রান্সের মাঝে অন্তরায় হয়ে আছে। এই পর্বতশ্রেণী পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় তিনশত মাইল বিস্তৃত।
আন্দালুসের ভূমধ্যসাগর পূর্ব এবং দক্ষিণ পূর্ব দিক থেকে বেষ্টন করে আছে। দক্ষিণ পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিকে বেষ্টন করে আছে আটলান্টিক মহাসাগর। অর্থাৎ তিনদিক থেকেই আন্দালুস পানি দিয়ে বেষ্টিত। আরব ঐতিহাসিকগণ এজন্য আন্দালুসকে জাযীরায়ে আন্দালুস বলতো।
.
পিরেনিজ পর্বতমালার কারণে, ওপর থেকে দেখলে মনে হয়, আন্দালুস ইউরোপ থেকে মুখ ফিরিয়ে আছে আর মরক্কোর দিকে মুখ করে আছে। এজন্য আরব ভূগোগবিদগন আন্দালুসকে আফ্রিকা মহাদেশের একটি বর্ধিতাংশ বলেই ধরে এসেছেন। তদুপরি, আন্দালুসের ভৈৗগলিক অবকাঠামো, প্রাণীবৈচিত্র্য, উদ্ভিদরাজি বাহ্যিকভাবে অনেকটাই আফ্রিকার মতো।
.
দু’টি প্রশ্ন মনে আসে:
এক: মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে স্পেনের অবস্থা কেমন ছিল?
দ্ইু: মুসলমানরা কেন স্পেনে অভিযান পরিচালনা করলেন?
.
প্রথমে দেখা যাক স্পেনের অবস্থাটা। আমরা চারটা দৃষ্টিকোন থেকে অবস্থাটা বিবেচনা করি:
ক: সামাজিক
খ: রাজনৈতিক
গ: অর্থনৈতিক
ঘ: ধর্মীয়
.
সামাজিক অবস্থা: মুসলমানদের আগমনের পূর্বে, স্পেনের বেশ কিছু শ্রেণী ছিল। মূলত ছিল দুইটা শ্রেণী। ক্ষমতাবান আর ক্ষমতাহীন। এছাড়া বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে:
১: শাসকশ্রেণী। এরা বলতে গেলে, দেশ ও দশের জানমালের মালিক ছিল। গীর্জা ছাড়া অন্য কারও তাদের সামনে মুখ খোলার সাহস হতো না।
২: যাজক সম্প্রদায়। তারা ছিল খুবই শক্তিশালী। নাগরিক নানা সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত। গথ রাজারা ছিল ধার্মিক। তাদের ওপর পুরোহিতশ্রেণীর বেশ প্রভাব ছিল। রাজাদের বদান্যতায় যাজক সম্প্রদায় অঢেল ধন-সম্পদের মালিক ছিল।
৩: সামন্ত রাজা বা জমিদারশ্রেণী। এদের কাজ ছিল রাজার ভোগ-বিলাসের উপায়-উপকরণ যোগান দেয়া।
৪: মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীরা ছিল মূলত ভূস্বামী। তারা অনূর্ধ্ব এক একর জমির মালিক হতে পারত। এই জমি ছিল হাস্তান্তরের অযোগ্য। অন্য কাউকে দান করতে পারতো না। বিক্রী করতে পারত না।
খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টির কারণে শস্য উৎপন্ন না হলেও নিয়মিত কর ঠিকই আদায় করতে হতো।
৫: ভূমিদাস ও ক্রীতদাস। এরা ছিল সমাজের সবচেয়ে নি¤œশ্রেণী। ভূমিদাসকেরকে বলা হতো সার্ফ। এরা ঠিক দাস নয়, তবে এরা হলো মধ্যবিত্ত ও জমিদারদের মালিকানাধীন জমি-জিরেতের বাঁধা চাষী। এই শ্রেণী বিয়েশাদী করতে পারতো।
আর দাসেরা ছিল পুরো বন্দী। তাদের স্বাধীন কোনও জীবন ছিল না। বিয়েশাদীও নিজ থেকে করতে পারত না।
রাজনৈতিক অবস্থা:
----------------
১: রাজপরিবারের অন্তর্কোন্দল: তখন শাসক পরিবারে ছিল প্রচন্ড অন্তর্কোন্দল। রাজা ছিল রডারিক। সে তার পূর্ববর্তী রাজা উইটিজাকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে। উইটিজার পুত্র ওয়াচিলাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তখন থেকেই দেশের মধ্যে চাপা অসন্তোষ শুরু হয়।
২: রাজাদের কাজ ছিল একটা, প্রজাদের কাছ থেকে কর সংগ্রহ করা। তাদের করভারে প্রজারা পর্যুদস্ত। প্রজারা মনে মনে রাজাদের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠছিল।
৩: স্পেনে একটা প্রথা ছিল, সামন্ত রাজা ও জমিদারদের পুত্র-কন্যাদেরকে রাজার কাছে জিম্মী হিশেবে রাখা হতো। এ নিয়েও ক্রমে ক্রমে চাপা ক্ষোভ জমছিল।
এমনি এক রাজা উইটজার-এর কন্য ফ্লোরিন্ডা ছিল রাজা রডারিকের কাছে জিম্মী। রডারিক তার সাথে দুর্ব্যবহার করে। এটা নিয়েও একটা বিক্ষোভ সৃষ্টি হয়।
৪: গথিক রাজারা ছিল অনেক ক্ষেত্রে যাজক দ্বারা প্রভাবিত। গীর্জার স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে অনেক সময় রাজারা যাজকদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়ে পড়তেন।
৫: দক্ষ সেনাবাহিনীরও অভাব ছিল। বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্যে রাজার পর্যাপ্ত সামরিক শক্তি ছিল না।
অর্থনৈতিক অবস্থা:
-------------
১: রাজাদের মূল আয়ই ছিল প্রজাদের কর। নানাভাবে শোষণ করেই কর আদায় করা হতো।
২: সেচ ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ার কারণে কৃষিকাজও অতটা সবল-সচল ছিল না। রাজাদের উদাসীনতাই মূলত দায়ী।
৩: পশুপালনও ছিল অনেকের জীবিকার অন্যতম ভিত্তি।
৪: যাতায়াত ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে মারাত্মক মন্দাভাব নেমে আসে। নিরাপত্তার অভাবে কেউ ব্যবসার প্রতি আগ্রহ বোধ করতো না।
ধর্মীয় অবস্থা:
---------
১: স্পেনে ছিল খ্রিস্ট ধর্মেরই প্রাবল্য। ইহুদিরা ছিল চরম অবহেলিত। নির্যাতিত। ৬৯৪ সালের দিকে পরিচালিত এক গণহত্যায় বিপুল সংখ্যক ইহুদিকে হত্যা করা হয়।
গথিক রাজা সিসিবুথ প্রায় নব্বই হাজার ইহুদিকে খ্রিস্টধর্মে জোরপূর্বক দাখিল করে।
মোটকথা পুরো স্পেনই ছিল ধর্মীয় জবরদস্তি আর অত্যাচারের দেশ।
.
পুরো অবস্থা ও পরিস্থিতি বিবেচনা করলে দেখা যায় ও বোঝা যায়, স্পেন তখন নতুন কিছুর অপেক্ষায় প্রস্তুত। পরিবর্তনের জন্যে উন্মুখ। অধীর। একটু নাড়া দিলেই হবে, টুপ করে পাকা ফল এসে কোলে পড়বে। জনগন সাড়া দিবে।
.
আমাদের পরের বিষয় হলো:
--- মুসলমারা স্পেনে কেন গেলেন?


চতুর্থ পর্ব
দিনলিপি-৩১০                                                                                      (০৭-০৯-২০১৫)

মরিস্ক-সিরিয়ান
------
ইউরোপ হঠাৎ দয়ালু হয়ে উঠেছে। ব্যাপারটা সুবিধের ঠেকছে না। তাদের মানবতাবোধ হঠাৎ করে চড়চড় করে বেড়ে গেল?
= ইরাক, আফগানিস্তান, বসনিয়া-হার্জেগোভিনাতে যখন লাখ-লাখ শিশুকে হত্যা করা হয়েছিল তখন তাদের মানবতার এই ‘ফেক আইডি’ কোথায় ছিল?
.
= ইরাকে-আফগানিস্তানে- বসনিয়াতে যখন হাজার-হাজার পরিবার উদ্বাস্তু হয়েছিল, তখন তাদের মানবিকতা কোথায় ছিল?
.
= তারা যখন মুসলিম দেশসমূহে আগ্রাসন চালায়, শহরকে শহর বিধ্বস্ত করে দেয়, তখন তাদের দয়াবোধ কোথায় থাকে?
.
= ন্যাটো জোট দিয়ে যখন নির্বিচারে বোমা বর্ষণ করা হয়, মুসলিম জনপদগুলোতে, তখন তাদের সভ্যতা কোথায় থাকে?
.
= তারা বলে, প্রতিবেশিরা সিরিয়ানদেরকে জায়গা দিচ্ছে না। এটা চরম মিথ্যা। তারা এটা কেন ভুলে যায়, অসংখ্য সিরিয়ান মিসরে আশ্রয় নিয়েছে, সৌদিতে আশ্রয় না নিলেও, তারা শুরু থেকেই সাহায্য করে আসছে সেই কবে থেকে, যদিও বিষয়টা স্বার্থের কারণেই করছে। জর্দান-মরক্কো-সুদান-তূনিস-জাযায়ের-লুবনান-মিসর-তুরস্কেও অগণিত সিরিয়ান আশ্রয় নিয়েছে।
.
তবে হ্যাঁ, একটা কথা বলা যায়, তেলসমৃদ্ধ একটা দেশও উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিতে এগিয়ে আসে নি। সৌদি, আবুধাবি-দুবাই, কুয়েত, কাতার এদের কেউই সরাসরি এগিয়ে আসেনি।
.
ইউরোপ যেভাবে বলছে, মুসলিম শাসকরা সিরিয়ানদেরকে মোটেও আশ্রয় দেয়নি, এটা ডাহা মিথ্যা। তবে হাঁ, আরব রাষ্ট্রগুলো চাইলে, বিশেষ করে সৌদি চাইলে, একাই সিরিয়ানদের সমস্যা সমাধান করতে পারে। তাদেরকে আশ্রয় দিতে পারে। তারা এটা করে নি। তারা তাদের কল্পিত সীমাকে নিজেদের দেশ বলে ধরে নিয়েছে।
.
ইউরোপ যতই দরদ দেখাক,তারা আদতেই ইসলাম ও মুসলমানকে পছন্দ করে না। তারা মূলত খ্রিস্টান বানানোর জন্যেই এটা করছে। এবং প্রাপ্ত খবরে দেখা গেছে, তারা ইতিমধ্যে উদ্বাস্তুদেরকে খ্রিস্টান বানানোর কাজ শুরুও করে দিয়েছে।
.
স্লোভাকিয়া তো সরাসরি ঘোষণাই দিয়ে বসেছে, তাদের দেশে শুধু খ্রিস্টানরাই আশ্রয় নিতে পারবে।
.
.
কেমন হতো, এবার হাজীরা যারা নফল কুরবানী করবেন, তাদের টাকাটা সংগ্রহ করে, সিরিয়ানদের জন্যে ব্যয় করা হলে!
.
কেমন হতো, যদি আরব দেশগুলো তাদের খালি পড়ে থাকা বিরান মরুভূমিতে সিরিয়ানদের আশ্রয় দিতো। সারা বিশ্ব থেকে সাহায্য নিয়ে, সিরিয়ানদের মাঝে বিলিয়ে দিতো।
.
কেমন হতো, আরব দেশগুলো তাদের দেশ থেকে অমুসলিম প্রবাসী শ্রমিকদের বের করে, সিরিয়ানদেরকে চাকুরি দিতো?
.
.
ইউরোপের এত অভিনয় না করে, শুধু একটা কাজ করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। নিমেষেই। তারা বাশশার আসাদকে গোপন সমর্থন দান বন্ধ করে দিলেই হয়।
.
বাশশার সুন্নী মুসলমানদের ওপর যে অকথ্য নির্যাতন চালাচ্ছে, তার সামনে ইসরাঈলের এরিয়েল শ্যারন, মোশে দায়ান, নেতানিয়াহুর সম্মিলিত পাপও নস্যি।
.
.
আজকের সিরিয়া আর অতীতের আন্দালুসের মাঝে খুব একটা পার্থক্য নেই।
.
মরিস্ক মুসলমান:
তারা অতীতে স্পেন থেকে কোনও রকমে জান নিয়ে পালিয়ে এসেছিল। ক্যথলিক ধর্মান্ধদের ইনকুইজিশন (ধর্মীয় আদালত) থেকে বাঁচতে।
.
সিরিয়ান:
আজ সিরিয়ানরা আরব শাসকদের থেকে পালিয়ে ইউরোপে যাচ্ছে।
.
= দুইটা অদ্ভুত মিল লক্ষ্যণীয়:
ক: মরিস্ক ও সিরিয়ান, উভয়দলকেই কিন্তু জীবন বাঁচানোর জন্যে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে হয়েছে। মরিস্করা ইউরোপ থেকে পাড়ি দিয়ে আরবে এসেছিল, আর সিরিয়ানরা আরব থেকে পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাচ্ছে।
.
খ: আগেও মুসলিম শাসকরা কার্যকরভাবে মরিস্ক মুসলমানদের বাঁচাতে এগিয়ে আসে নি। এখনো মুসলিম শাসকরা সিরিয়ানদেরকে বাঁচাতে এগিয়ে আসছে না।
জীবনের প্রয়োজন!
--
.
বিজেতা/আশ্রিতা
---
= মুসলমানরা ছিলো ইউরোপের বিজেতা। এখন হয়ে পড়েছে ইউরোপের আশ্রিতা। কেন এমন হলো?
.
= মুসলমানরা ইউরোপ বিজয়ের সূচনা করেছিল, সেকালের সিরিয়া থেকে। আজ আবার সেই সিরিয়ানরাই ইউরোপে আশ্রয় নিতে হচ্ছে। কেন এমন হলো?
.
= আন্দালুসের পতন হয়েছে ১৪৯২ সালে। এটা শুধু একটা ঘটনা ছিল না। সাথে সাথে জন্ম দিয়েছিল অসংখ্য ঘটনার:
(১): আন্দালুস পতনের সাথে সাথে পতন হয়েছিল, মুসলমানদের স্বর্ণযুগের।
.
(২): আইবেরীয় উপসাগর, ভূমধ্যসাগরের একচ্ছত্র মুসলিম আধিপত্য শেষ হয়ে গিয়েছিল।
.
(৩): বিশ্বে ছিল একটাই পরাশক্তি। এখন শক্তি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আগে শুধু মুসলানরাই বিশ্বশক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। এখন স্পেন-পর্তুগালকে ঘিরে ক্যাথলিকদের একটা শক্তিজোট, আরেকটা উসমানী খলীফাগনের শক্তিজোট।
.
(৪): বিশ্বে নতুন একটা পরিভাষ চালু হয়েছিল। মরিস্ক। স্পেনের বাকী থাকা মুসলিম বা ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদেরকে মরিস্ক বলা হতো। ১৬০৯ সালে স্পেনস¤্রাট তৃতীয় ফিলিপ ঘোষনা দিয়েছিল:
-দেশ থেকে সমস্ত মরিস্ককে তাড়াতে হবে। তাদেরকে এদেশে থাকতে দেয়া হবে না।
.
(৫): পাশাপাশি ‘আধুনিক যুগ’ পরিভাষাটাও তখন থেকে প্রবর্তিত হয়েছিল।
.
(৬): ইউরোপ ব্যাপক হারে,তাদের দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে খ্রিস্টান বানাতে শুরু করে।
.
(৭): ছিল একটা মুসলিম খিলাফাহ। সেখান থেকে মুসলমানদেরকে উৎখাত করার পর, পোপ একটা রাষ্ট্রকে দুই ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছিল: স্পেন ও পর্তুগাল।
.
(৮): স্পেনের কাশতালা রাজ্যের খ্রিস্টান শাসক প্রথম বারের মতো মুসলিম বিতাড়ন ও ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুতার রাজনীতি শুরু করেছিল, কালক্রমে সেটা বড় বড় হতে ১৯৪৮ সালে ফিলাস্তীনে ইহুদিদের হাতে এসে পূর্ণতা পেয়েছে।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, তখন কিন্তু স্পেন থেকে মুসলমানদের পাশাপাশি ইহুদিদেরকেও তাড়ানো হয়েছিল। তারাও চরম নির্যাতন সয়ে বিতাড়িত হয়েছিল। সেই তারাই আরেকটা দেশের জবরদখল নিয়ে ভূমিপুত্রদেরকে ভিটেমাটিছাড়া করেছিল।
.
(৯): স্পেনের মতো হুবহু ঘটনা ঘটেছে ২০০৩ সালে ইরাকে। সুন্নী মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল সেখানে। বাগদাদে। মার্কিন আগ্রাসনের পর, সুন্নীরা সেখানে হয়ে পড়েছে দুর্বল। এখন অবশ্য আবার অবস্থা পাল্টাচ্ছে। সিরিয়াতেও সুন্নীরা ছিল শক্তিশালী। হাফেজ আল আসাদ ক্ষমতা দখল করে, সুন্নীদেরকে বানিয়ে দিয়েছিল দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক।
.
(১০): ২০১১ সালে আবার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো। যেমনটা ঘটেছিল স্পেনে। দামেশকে সুন্নীদের ওপর নেমে এল চরম নির্যাতন। তারা ঘরবাড়ি ছেয়ে সরে পড়তে শুরু করলো। প্রতিষ্ঠিত হলো ইরানি-সাফাভি আধিপত্য। আলাভী শী‘আদের অভয়ারণ্য।
.
(১১): আন্দালুসের মুসলমানরা শিকার হয়েছিল নির্যাতন আর খ্রিস্টানকরনের, আর এখন সুন্নীরা শিকার হচ্ছে, শী‘আকরনের।
.
(১২): আন্দালুসের মুসলমান আর সিরিয়ানদের মধ্যে বড় একটা পার্থক্যও আছে, আন্দালুসীয়রা সাগর পেরোলেই একটা নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছিল। কিন্তু এখনকার সিরিয়ানরা সাগর তো দূরের কথা, সামান্য হেঁটে সীমান্ত পার হয়েও কোনও আশ্রয় পাচ্ছে না।
.
.
ওলামায়ে সূ:
-----------
এত কিছুর পরও, কিছু কিছু সিরিয়ান ও আরবের পোষা আলেম, ফতোয়া দিয়ে থাকেন, শাসক যেমনই হোক, তাদের বিরুদ্ধে বের হওয়া ঠিক নয়। তারা স্বপক্ষে উদ্ধৃতি দেয় ইমাম আহমাদ বিন হাম্মলের (রহ.)। তিনি নাকি শাসকের বিরুদ্ধে বের না হওয়ার ব্যাপারে ফতোয়া দিয়েছিলেন।
.
আমরা বলবো:
এক: ইমাম আহমাদ (রহ.) এর সব কথা কি আমরা মানি? নাকি যারা উদ্ধৃতি দিচ্ছে তারা মানে? তিনি ছাড়াও তো আরও ইমাম আছেন!
.
দুই: হুসাইন (রা.) ইয়াযিদ বিন মু‘আবিয়ার বিরুদ্ধে বের হন নি?
.
তিন: আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.) ইয়াযিদের বিরুদ্ধে বের হন নি? তিনি ইয়াযিদকে বাইয়াত দিতেও অস্বীকার করেছিলেন।
.
চার: সায়ীদ ইবনে জুবায়ের (রহ.) উমাইয়াদের বিরুদ্ধে বের হয়েছেন। ইবনে আস‘আসকে বাইয়াত দিয়েছেন।
.
পাঁচ: বলা হয়ে থাকে, ইমাম আ‘যম আবু হানীফা (রহ.)ও আব্বাসী খলীফা আবু জা‘ফর মনসুরের বিপরীতে বাইয়াত দিয়েছিলেন মুহাম্মাদ নাফসে যাকিয়্যাহ (পবিত্র আত্মা)কে।
.
ছয়: যায়েদ বিন আলি বিন যায়নুল আবেদীন (রহ.) বের হয়েছিলেন উমাইয়া খলীফা হিশাম বিন আব্দুল মালিকের বিরুদ্ধে।
.
সাত: আর আব্বাসীরাও তো উমাইয়াদেরকে হটিয়েই, নির্মমভাবে নির্মূল করে ক্ষমতায় বসেছিলেন?
.
যারা সিরিয়ান উদ্বাস্তুদেরকে জায়গা দিচ্ছে না। সেসব শাসককে বাঁচানোর জন্যে যে আলিমরা ফতোয়া দিচ্ছেন, তাদের হিদায়াতের জন্যে দু‘আ করা ছাড়া আর কিইবা করার আছে?












পঞ্চম পর্ব

দিনলিপি-৩৩১
(২৮-০৯-২০১৫)


আশা ও নিরাশা
------
আজ থেকে আটশ বছরেরও আগে, মুসলিম ইতিহাসে একটা চরম লজ্জা ও দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। সেটা বলার আগে, আমরা একটু গৌরবময় অধ্যায়কে জানি। তাহলে শোকটা গায়ে কম লাগবে।
-
ইংল্যান্ডের রাজা তাকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন:
-আমি আপনার অনুগত সেবক।
.
তার আমলেই বিশ্ব প্রথমবারের মতো দেখে, বয়স্কদের জন্যে বিশেষ রাষ্ট্রীয় সুবিধা।
.
তিনি ইউরোপীয় ইতিহাসের গতিপথটাই বদলে দিয়েছিলেন।
.
মুসলমানরা তখন শতধা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। দলাদলি-হানাহানিতে লিপ্ত ছিল। তাদের পতন ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। এমন নাযুক পরিস্থিতিতে ক্ষমতা নিজ হাতে তুলে নিলেন। বয়েস তখন একুশ। বদলে গেল দৃশ্যপট। উল্টে গেল আন্দালুসের গতিপথ। তিনি হলেন আবদুর রাহমান আননাসির। সপ্তম খলীফা। ৯১২-৯৬১ ঈসায়ী।
.
তিনি দায়িত্ব নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন:
এক: জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাকে ব্যাপকতর করে তুলেছিলেন। কর্ডোভাকে পরিণত করেছিলেন জ্ঞানের শহরে। পুরো ইউরোপ থেকে জ্ঞানপিপাসুরা দলে দলে এ-শহরে আসতো। আগত প্রতিটি ছাত্রের জন্যেই থাকতো নিয়মিত মাসোহারা।
.
দুই: নিরক্ষরতা দূরীকরনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন।
.
তিন: কর্ডোভা মসজিদকে সম্প্রসারিত করেছিলেন। সেটা পরিণত হয়েছিল সেকালের সর্ববৃহৎ মসজিদে।
.
চার: জনসংখ্যার বিচারে, কর্ডোভা স্বীকৃতি পেয়েছিল দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরে। প্রথম স্থান ছিল বাগদাদের। তিনি কর্ডোভাতে তিন হাজার মসজিদ নির্মান করেছিলেন।
.
পাঁচ: তার আমলে বিশ্বে প্রথম বারের মতো রাতের বেলা, রাস্তাগুলোতে আলোকায়নের ব্যবস্থা করা হয়।
.
ছয়: তার আমলে, ইউরোপে প্রথমবারের মতো উন্মুক্ত হাসপাতাল, উন্মুক্ত পাঠাগার, বিনামূল্যে চিকিৎসা, বিনমূল্যে শিক্ষার প্রথা চালু করা হয়।
.
সাত: ইউরোপে তিনিই প্রথম বৃদ্ধাশ্রম নির্মান করেন। পশুপাখির জন্যে অভয়ারণ্য তৈরী করেন। এসব কাজ তদারক করার জন্য দক্ষ লোকবল নিয়োগ করেন।
.
আট: যুদ্ধাস্ত্রনির্মাণ কারখানা স্থাপন করেন। সামুদ্রিক বন্দন নির্মান করেন। ইউরোপের সর্ববৃহত সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। পুরো ইউরোপ থেকেই তার দরবারে উপহার-উপঢৌকন আসতেই থাকতো।
.
নয়: গড়ে তোলেন ‘মদীনাতুয যাহরা’বিশ্নের সুন্দরতম শহর। তিনটা স্তরবিশিষ্ট। সর্বোচ্চ স্তরে ছিল প্রাসাদ। দ্বিতীয় স্তরে ছিল বাগ-বাগিচা। তৃতীয় স্তরে ছিল বাজার-মসজিদ।
.
দশ: নির্মান জগদ্বিখ্যাত কর্ডোভা-সেতু। যা আজো বিদ্যমান আছে।
.
তিনি ছিলেন মুত্তাকী। পরহেযগার। মুজাহিদ। দক্ষপ্রশাসক।
.
.
আন্দালুসে ‘ইমারাহ’ নামে শাসন শুরু করেছিলেন আবদুর রাহমান আদদাখিল। ৭৭৫ সালে। নানা চারাই উৎরাই পেরিয়ে সেটা শেষ হয়েছিল ১০৩১ সাল পর্যন্ত।
শেষের দিকে আন্দালুস ভাগ হয়ে গিয়েছিল ২২টা নগর রাষ্ট্রে। মজার ব্যাপার হলো, উসমানি খিলাফাহ ভেঙে তৈরী হওয়া আরব রাষ্ট্রও বর্তমানে ২২টা।
বাইশটা নগর রাষ্ট্রের যুগকে বলা হয় তাওয়ায়েফ যুগ। শাসকদেরকে বলা হয় ‘মুলূকুত তাওয়ায়িফ’এমনই একটা শহর ছিল ‘ভ্যালেনসিয়া’১২৩৮ সালে এ-সুন্দর শহর মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যায়।
এর বেশি লেখা সম্ভব হলো না। কষ্ট আর কষ্ট!।



প্রশ্নোত্তরে আন্দালুস

১/ মুসলিমরা স্পেন কত বছর শাসন করে?
উত্তরঃ ৭৮১ বছর।
২/ কত সালে মুসলিমরা স্পেন বিজয় করে এবং কত সালে পতন ঘটে?
উত্তরঃ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর ৮০ বছরের মাথায় ৭১১ সালে মুসলিমরা স্পেন বিজয় করে।
১৪৯২ সালে মুসলিমদের আন্দালুসের পতন ঘটে।
৩/ আন্দালুসের প্রথম শাসক কারা?
উত্তরঃ উমাইয়া খলীফাদের অধীনে স্পেন বিজয় হয়। (৭১১-৭৫৬) তাদের ওয়ালি বা গভর্নররা স্পেন শাসন করতেন। ৭৫৬ সালে আব্দুর রহমান নিজেকে স্বাধীন আমীর ঘোষণা করেন।
৪/ কত বছর আন্দালুস উমাইয়া খিলাফাতের প্রদেশ ছিল?
উত্তরঃ ৩৯ বছর। (৭১১-৭৫০)
৫/ উমাইয়া খিলাফাতের অধীনে আন্দালুসের ওয়ালি বা গভর্নরদের তালিকা দাও?           উত্তরঃ ৭১১ থেকে ৭৫৬ সাল পর্যন্ত দারুল খিলাফাহর অধীনে ওয়ালিগণ দ্বারা আন্দালুস শাসিত হয়। নিম্নে ওয়ালিদের তালিকা প্রদান করা হলঃ
তারিক বিন জিয়াদ (৭১১-৭১২)
মুসা বিন নুসাইর (৭১২-৭১৪)
আব্দুল আজিজ বিন মুসা (৭১৪-৭১৬)
আইয়ুব বিন হাবিব আল-লাখমী (৭১৬)
আল হুর বিন আব্দুর রহমান সাকাফি (৭১৬-৭১৮)
সামহ বিন মালিক খাওলানী (৭১৯-৭২১)
আব্দুর রহমান আল গাফিকি (৭২১-৭২২) (৭৩০-৭৩২)
আনবাসা বিন সুহাইম কালবী (৭২১-৭২৬)
উযরা বিন আব্দুল্লাহ আল ফিহরী (৭২৬)
ইয়াহিয়া বিন সালমান কালবী (৭২৬-৭২৮)
হুযাইফা বিন আহওয়াস কায়সী (৭২৮)
উসমান বিন আবি নিস'আ আল কাস'আমী (৭২৮-৭২৯)
হায়সাম বিন উবাইদ কিলাবি (৭২৯-৭৩০)
মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ আশযায়ী (৭৩০)
আব্দুর রহমান আল গাফিকি (৭৩০-৭৩২)
আব্দুল মালিক বিন কাতান ফিহরী (৭৩২-৭৩৪)
উকবা বিন হাজ্জাজী (৭৩৪-৭৪০)
আব্দুল মালিক বিন কাতান ফিহরী (৭৪০-৭৪২)
বালজ বিন বিশর কুশাইরী (৭৪১-৭৪২)
ছালাবা বিন সালামা আমিলী (৭৪২-৭৪৩)
আবুল খাত্তার আল হুসাম বিন দারার কালবী (৭৪৩-৭৪৫)
ছুওয়াবা বিন সালামা গুদামি (৭৪৫-৭৪৬)
আব্দুর রহমান বিন কাতির লাহমী (৭৪৬-৭৪৭)
ইউসুফ বিন আব্দুর রহমান ফিহরি (৭৪৭-৭৫৬)

৬/ কোন খলীফার আমলে স্পেন বিজিত হয়?
উত্তরঃ উমাইয়া খলীফা প্রথম ওয়ালিদের আমলে (৭১১ সালে) ।
৭/ স্পেন বিজয়ের নায়কদ্বয় কারা?
উত্তরঃ তারিক বিন জিয়াদ এবং মুসা বিন নুসাইর।
৮/ তারিক বিন জিয়াদ কে ছিলেন?
উত্তরঃ ইফ্রিকিয়ার গভর্নর মুসা বিন নুসাইরের মুক্তদাস।
৯/ কে স্পেনের দুঃশাসন থেকে মুক্তি দিতে মুসলিমদেরকে আহবান জানিয়েছিল?
উত্তরঃ রাজা রডেরিক কর্তৃক জুলিয়ানের কন্যা ধর্ষিতা হলে জুলিয়ান মুসলিমদেরকে স্পেনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।
১০/ তারিক বিন জিয়াদের বাহিনীটি কাদের নিয়ে গঠিত ছিল?
উত্তরঃ নওমুসলিমদের নিয়ে।
১১/ তারিকের বাহিনীতে কত সেনা ছিল?
উত্তরঃ ৭ হাজার। মুসা পরে আরো ৫ হাজার পাঠিয়েছিলেন।
১২/ রডেরিকের বাহিনীতে কত সেনা ছিল?
উত্তরঃ ১ লক্ষ।
১২/ তারিক কর্তৃক কোন কোন অঞ্চল বিজিত হয়?
উত্তরঃ কর্ডোবা, গ্রানাডা, টলেডো ও গুয়াদালাজারা প্রভৃতি অঞ্চল।
১৩/ কে আন্দালুসের প্রথম গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন?
উত্তরঃ তারিক বিন জিয়াদ(৭১১-৭১২)।
১৪/ কাকে কুরাইশদের বাজপাখি (ফ্যালকন অব দ্যা কুরাইশ) বলা হয়?
উত্তরঃ আন্দালুসের প্রথম আমীর আব্দুর রহমান আদ-দাখিলকে।
১৫/ আব্দুর রহমানকে কুরাইশদের বাজপাখি উপাধি কে দিয়েছিলেন?
উত্তরঃ আব্বাসীয় খলীফা আল-মানসুর
১৬/ আব্দুর রহমান কত বছর শাসন করেন?
উত্তরঃ ৩২ বছর (৭৫৬-৭৮৮)
১৭/ ইউরোপের কোন প্রতাপশালী রাজা আমীর আব্দুর রহমানের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার ভয়ে সন্ধি করেন?
উত্তরঃ শার্লিমেন
১৮/ আব্দুর রহমানের আমলে কোন শহর সমৃদ্ধি লাভ করে?
উত্তরঃ কর্ডোভা
১৯/ কত সাল পর্যন্ত তিনি আব্বাসীয় খলীফাদের নামে খুৎবা পাঠ জারি রাখেন?
উত্তরঃ ৭৭৩ সাল পর্যন্ত।
২০/ আব্দুর রহমানের মৃত্যুর পর কে আন্দালুসের আমীর হন?
উত্তরঃ তার পুত্র প্রথম হিশাম (৭৮৮ সালে)।
২১/ প্রথম হিশাম কোন মাযহাবকে রাষ্ট্রীয় মাযহাব হিসেবে ঘোষণা করেন?
উত্তরঃ মালিকী মাযহাব।
২২/ প্রথম হিশাম তার আমলে কোন কোন বিদ্রোহ দমন করে আমিরাতকে সুরক্ষিত রাখেন?
উত্তরঃ সারাগোসা, বার্সেলোনা, নারবোন, সেপ্টিমেনিয়া, গ্যালেসিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে খ্রিস্টানদের বিদ্রোহ দমন করেন।
২৩/ প্রথম হিশাম কত বছর শাসন করেন?
উত্তরঃ ৮ বছর (৭৮৮-৭৯৬)
২৪/ প্রথম হিশামের মৃত্যুর পর কে আন্দালুসের আমীর হন?
উত্তরঃ হিশামের পুত্র প্রথম হাকাম (৭৯৬ সালে)।
২৫/ প্রথম হাকাম তার আমলে কোন কোন বিদ্রোহ দমন করেন?
উত্তরঃ দুই চাচা আব্দুল্লাহ ও সুলাইমানের বিদ্রোহ, ফকীহদের বিদ্রোহ, টলেডো ও কর্ডোভার বিদ্রোহ এবং ফ্রাঙ্কদের টলেডো থেকে বিতাড়ন করেন।
২৬/ প্রথম হাকাম কত বছর শাসন করেন?
উত্তরঃ ২৬ বছর (৭৯৬-৮২২)।
২৭/ আন্দালুস আমিরাতের প্রথম তিন যোগ্য শাসক কে কে ছিলেন?
উত্তরঃ আব্দুর রহমান আদ-দাখিল, প্রথম হিশাম এবং প্রথম হাকাম।
২৮/ কার আমলে আন্দালুস ধীরে ধীরে বিলাসিতা ও গান-বাদ্যে প্রবেশ করে?
উত্তরঃ দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের আমলে। (৮২২-৮৫২)।
২৯/ দ্বিতীয় আব্দুর রহমান কে ছিলেন?
উত্তরঃ প্রথম হাকামের পুত্র।
৩০/ দ্বিতীয় আব্দুর রহমান কোন ৪ জন দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন?
উত্তরঃ স্ত্রী সুলতানা তারাবা, বাগদাদ থেকে আগত এক গায়ক জিরিয়াব, নাসর নামের এক হাজিব, ফকীহদের নেতা ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়া।
৩১/ যেসকল খ্রিস্টান বাসিন্দা মুসলিম ও ইসলামের প্রতি মুগ্ধ হয়ে ইসলামে দীক্ষিত হয় তাদের কি বলা হতো?
উত্তরঃ মুজারাব
৩২/ কট্টর খ্রিস্টানরা কেন বিদ্রোহের ডাক দেয়?
উত্তরঃ মুজারাবদের ইসলাম ও মুসলিমদের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি মুগ্ধতার কারণে।
৩৩/ দ্বিতীয় আব্দুর রহমান কত বছর শাসন করেন?
উত্তরঃ ৩০ বছর (৮২২-৮৫২)
৩৪/ দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের মৃত্যুর পর কে শাসন করেন এবং কত বছর?
উত্তরঃ তার পুত্র মুহাম্মাদ এবং তিনি ৩৪ বছর শাসন করেন (৮৫২-৮৮৬)
৩৫/ মুহাম্মাদের কৃতিত্ব কি ছিল?
উত্তরঃ পূর্বপুরুষের ন্যায় বহু বিদ্রোহ দমন করে আমিরাতের সুরক্ষা নিশ্চিত করেন।
৩৬/ মুহাম্মাদের পর কারা আন্দালুস শাসন করেন?
উত্তরঃ তার পুত্র মুনজির (৮৮৬-৮৮৮) এবং মুনজিরের পুত্র আব্দুল্লাহ (৮৮৮-৯১২)
৩৭/ কার আমলে আন্দালুসের আমিরাত থেকে সেভিল ও আরাগন পৃথক হয়ে যায়?
উত্তরঃ আব্দুল্লাহর আমলে (৮৮৮-৯১২)
৩৮/ আব্দুল্লাহর পরে কে আন্দালুসের আমীর হন?
উত্তরঃ তৃতীয় আব্দুর রহমান (৯১২ সালে)।
৩৯/ নাসির বা স্পেনের ত্রাণকর্তা কার উপাধি ছিল?
উত্তরঃ তৃতীয় আব্দুর রহমানের।
৪০/ আব্দুর রহমান আদ-দাখিলের পর কে আন্দালুসের শ্রেষ্ঠ আমীর ছিলেন?
উত্তরঃ তৃতীয় আব্দুর রহমান।
৪১/ তৃতীয় আব্দুর রহমান কত বছর শাসন করেন?
উত্তরঃ প্রায় ৫০ বছর। (৯১২-৯৬১)
৪২/ কত সালে আব্দুর রহমান নিজেকে খলীফা বলে ঘোষণা করেন?
উত্তরঃ ৯২৯ সালে।
৪৩/ কার শাসনামলে আন্দালুসিয়া ইউরোপের সবচেয়ে উন্নত ও সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়?
উত্তরঃ তৃতীয় আব্দুর রহমানের আমলে।
৪৪/ তিনি রাজধানী কর্ডোভা ব্যাতীত সমগ্র স্পেনকে কয়টি প্রদেশে বিভক্ত করেন?
উত্তরঃ ৮ টি।
৪৫/ ইতিহাসের অন্যতম সুন্দর জোহরা প্রাসাদ কার নামে এবং কত সালে নির্মাণ করেন?
উত্তরঃ স্ত্রীর নামে, ৯৩৬ সালে।
৪৬/ জোহরা প্রাসাদে কক্ষের সংখ্যা কত ছিল?
উত্তরঃ প্রায় ৪০০ টি।
৪৭/ কত টাকা ব্যয় করে জোহরা প্রাসাদ নির্মাণ করেন?
উত্তরঃ ৫ লক্ষ দিনার (স্বর্ণমুদ্রা)।
৪৮/ তার আমলে কর্ডোভা শহর কিরুপ ছিল?
উত্তরঃ ৩০০ মাসজিদ, ১০০ প্রাসাদ, ৩০০ হাম্মামখানা, ১৩০০ টি বাড়ি ও ৫ লক্ষ লোক বাস করতো।
৪৯/ তার আমলে রাজস্ব আয় কত ছিল?
উত্তরঃ ৬২ লক্ষ ৪৫ হাজার দিনার (স্বর্ণমুদ্রা)।
৫০/ তৎকালীন কালের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও শক্তিশালী নৌবহর কার ছিল?
উত্তরঃ তৃতীয় আব্দুর রহমানের।
৫১/ তৃতীয় আব্দুর রহমানের মৃত্যুর পর কে খলীফা হন?
উত্তরঃ পুত্র দ্বিতীয় হাকাম (৯৬১ সালে)।
৫২/ কার আমলে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বিদ্যা শিক্ষায় আন্দালুস পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম স্থান হিসেবে পরিচিত পায়?
উত্তরঃ দ্বিতীয় হাকামের আমলে (৯৬১-৯৬৭)।
৫৩/ কার মৃত্যুর পর আন্দালুসে উমাইয়া বংশের পতন শুরু হয়?
উত্তরঃ দ্বিতীয় হাকাম ৯৬৭ সালে মৃত্যুবরণ করলে নাবালক পুত্র দ্বিতীয় হিশামের আমল থেকে উমাইয়া বংশের পতন শুরু হয়।
৫৪/ কে গ্রানাডার আল-হামরা প্রাসাদ নির্মাণ করেন?
উত্তরঃ দ্বিতীয় হিশামের আমলে তার কর্মচারী মুহাম্মাদ বিন আবি আমির।
৫৫/ কত সালে উমাইয়াদের চূড়ান্ত পতন ঘটে?
উত্তরঃ ১০৩১ সালে তৃতীয় হিশামের আমলে।
৫৫/ দ্বিতীয় হিশামের অযোগ্যতার সুযোগে কে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে?
উত্তরঃ হাজিব আল মানসুর।
৫৬/ কাকে দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার জন্য ১০ম শতাব্দীর বিসমার্ক বলা হতো?
উত্তরঃ হাজিব আল-মানসুরকে।
৫৭/ কর্ডোবা খিলাফাহ পতনের পর আন্দালুসের কি অবস্থা হয়?
উত্তরঃ আন্দালুস কয়েকটি তাইফাতে বিভক্ত হয় যেমন তাইফা কর্ডোভা, তাইফা সারাগোসা, তাইফা সেভিল।
৫৮/ আন্দালুসের বিখ্যাত কয়েকজন আলিমের নাম উল্লেখ কর?
উত্তরঃ কুরতুবি, ইবনে আব্দুর বার, ইবনে জুজাই, তুরতুশি প্রমুখ।
৫৯/ আন্দালুসের পৃথিবীখ্যাত কয়েকজন ব্যক্তির নাম উল্লেখ কর?
উত্তরঃ বিখ্যাত সুফি দার্শনিক ইবনে আরাবী, বিজ্ঞানী ইবনে রুশদ, ইবনে হাযম, বিজ্ঞানী আব্বাস ইবনে ফিরনাস, গায়ক জিরইয়াব, সমাজতত্ত্ববিদ ইবনে খালদুন প্রমুখ।
৬০/ স্পেনে মুসলমানদের পতনের পর আনুমানিক কত বই-পুস্তক পান্ডুলিপির ধ্বংস সাধন করা হয়?
উত্তরঃ অসংখ্য অগণিত।
৬১/ ধ্বংস থেকে রক্ষা পাওয়া আরবি পাণ্ডুলিপির নাম উল্লেখ কর?
উত্তরঃ ধ্বংস সাধনের একাধিক প্রচেষ্টার কয়েকশ' বছর পর অরক্ষিত অবস্থায় মাত্র ১৮৫০ টি পাণ্ডুলিপি খুঁজে পাওয়া যায়। এর মধ্যে কয়েকটি হলঃ
তারিখে ফতেহাতুল আন্দালুস - ইবনুল কুতিয়া (মৃ ৭৯৯ ঈসায়ী)। স্পেনে মুসলিম শাসনের প্রাথমিক পর্যায়ের ইতিহাস নিয়ে।
তারিখে ফাতহুল মিসর - ইবন আব্দুল হাকাম। পঞ্চম অধ্যায়ের শেষে স্পেন বিজয়ের বর্ণনাকে আলাদা করে উর্দু অনুবাদ যিকরে ফাতহুল উন্দুলুস বের হয়েছে।
তৃতীয় আব্দুর রহমান আল নাসিরের জীবনী - ইবনুল আহমার
আখবার মাজমুয়া - অজ্ঞাত লেখক। স্পেনের মুসলিম শাসনের প্রাথমিক যুগের ইতিহাস।
আল মুকতাবিস ফি তারিখে রিজালুল আন্দালুস - আবু মারওয়ান হাইয়ান ইবনে খালাফ। ১০ খণ্ডের বৃহৎ গ্রন্থ।
আল মুজিব ফি তালখিসে আখবার আল মাগরিব - আব্দুল ওয়াহাব আল মারাকুশি। ইংরেজি অনুবাদ -হিস্টোরি অব আল-মোহেদস।
আল ইহাতা ফি তারিখে গারনাতা - লিসানুদ্দীন আল খতীব
নাফহুত তীব - আল মাক্কারি
আল বায়ানুল মাগরিব ফি আখবারিল আন্দালুস ওয়াল মাগরিব - ইবনে ইজারী
কিতাবুল কুযাত ফি কুরতুবাহ - খুশানী
তারিখ উলামাইল আন্দালুস - ইবনুল ফারাজি
তাকমিলাহ লি কিতাবু সিলাহ - ইবনুল আকবর আল কুজা
আল খাজিরা ফি মাহাসিনিল জাহিরা - ইবনে বাসাম। ইত্যাদি।
৬২/ আন্দালুসের বৃহৎ মাসজিদসমূহের নাম উল্লেখ কর?
উত্তরঃ নিম্নে উল্লেখিত একটা মাসজিদও আজ আর নাই। সকল বৃহৎ মাসজিদ খ্রিস্টানরা ধ্বংস করে দিয়েছে, কিছু মাসজিদকে গির্জা বানানো হয়েছে। কিছু মাসজিদ একেবারে ভবনসহ ধ্বংস করা হয়েছে।
কর্ডোভা মাসজিদ,
টলেডোর বিখ্যাত বাব-আল-মারদুম মাসজিদ,
সেভিলের বৃহৎ মাসজিদ,
টলেডোর আল মুসতিমিম মাসজিদ,
কর্ডোভার মাদিনাতুয যাহরা আল-জামে মাসজিদ,
টলেডোর আল দাব্বাগিন মাসজিদ,
মাসজিদ আল-তা'ইবিন,
সারাগোসা আল জামে মাসজিদ,
মাদ্রিদ আল জামে মাসজিদ,
গ্রানাডার বৃহৎ নাসরীয় মাসজিদ,
আল-হামা মাসজিদ ইত্যাদি।






আন্দালুসে উমাইয়া খেলাফতের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা কুরাইশি ঈগল খ্যাত আবদুর রহমান আদ-দাখিল
অনুবাদ ও সংযোজন : আল-জাইদি

প্রত্যেক যামানাতেই এমন কতক মহা মানবের আবির্ভাব ঘটে যারা ইসলামের প্রভাব প্রতিপত্তি, মর্যাদা ও গৌরব পুনঃরায় ফিরিয়ে আনেন।
যখনই মুসলিম দেশসমূহ কুয়াচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, তাদের অধিকারসমূহ কেড়ে নেয়া হয়, এমনকি তাদের পরিবার-পরিজনকেও বিতাড়িত করা হয় তখনই মুসলিমভূমে বীরত্ব ও বাহাদুরী মূর্ত হয়ে উঠে।
এ-সময়েই দয়াময় আল্লাহ ঘুনে ধরা এই উম্মাহর জন্য এমন ব্যক্তিকে প্রেরণ করে থাকেন যিনি মুমিনদেরকে একই সুতোয় আবদ্ধ করে ইসলামের অস্তিত্বকে নতুন রূপে বিনির্মাণের মহান লক্ষ্যে উম্মাহর দাপট ও ক্ষমতা পুনঃরায় ফিরিয়ে আনবেন।
ইসলামের হারানো গৌরব ও মর্যাদা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে যে-সকল মহান ব্যক্তিবর্গ কাজ থাকেন, তাদের মাধ্যমে এভাবেই মুসলিম ভূমির সীমান্ত প্রাচীর সুরক্ষিত থাকত।
আব্বাসি সাম্রাজ্য তাদের প্রতিষ্ঠার শুরুলগ্নে বনু উমাইয়ার এমন সকল পুরুষদের হত্যা করেছে যারা খেলাফতের দাবি করতে পারে বলে তাদের সন্দেহ হয়েছে। নিজেদের ক্ষমতা পোখতা করার মানসে তাদের রক্তকে তারা হালাল মনে করেছে। তখন তাদের হত্যাযজ্ঞের নরক থেকে আত্মরক্ষা করে একজনই কেবল পালিয়ে বেঁচে আসতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি হলেন আবদুর রহমান আদ-দাখিল রহ.। অথচ তাঁর ভাই হিশাম বিন মুআবিয়াকে তাঁর চোখের সামনেই নির্মমভবে হত্যা করা হয়েছিল। তিনি পালিয়ে একাকী আন্দালুসে প্রবেশ করেন। এসেই তিনি সেখানকার সকল দলকে এক পতাকাতলে সমবেত করলেন। ফলে তাঁর আমলে আন্দালুসের মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা দাঁড়ায় এক লক্ষ অশ্বারোহীতে। এই বিশার বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে তিনি মুসলিম আন্দালুসের উত্তর ও পশ্চিম সীমান্তকে খৃস্টান রাষ্ট্রগুলোর আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছেন। বিশেষত লিওন রাষ্ট্রের হামলা থেকে সুরক্ষিত রেখেছেন।
যখন আন্দালুসের মুসলিম শাসকগণ পারস্পরিক খুনখারাবিতে চরমভাবে লিপ্ত, প্রত্যেকেই নিজের জন্য একচেটিয়া রাজত্ব ও শাসন ক্ষমতা অধিকার করতে চাচ্ছিলো, ফলে লাঞ্চনা, অপমান ও দুর্বলতা তাদেরকে এমনভাবে পেয়ে বসেছে যে, ইউরোপের খৃস্টান শাসকরা পর্যন্ত তাদের উপর দুঃসাহস প্রদর্শন করে আন্দালুসের অনেক শহর দখল করে নিয়েছে, এমনকি যেই ইউরোপের শাসকরা এক সময় মুসলিম শাসকদের জিযয়া-কর প্রদান করত, এখন তারাই মুসলিম শাসকদের থেকে কর নিতে আরম্ভ করে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে, তখন কেউ কেউ ধারণা করতে লাগল, এই বুঝি আন্দালুস থেকে ইসলাম বিদায় নিল। পরিস্থিতি যখন এতটাই ভয়বহ, অবস্থা যখন চরম সংকটাপন্ন, ঠিক সেই মূহুর্তে আন্দালুসের হাল ধরলেন বনু উমাইয়ার বিচক্ষণ, ধীমান ও বুদ্ধিদীপ্ত ও যৌবনোচ্ছল এক বীর যোদ্ধা আবদুর রহমান আদ-দাখিল। রহমাতুল্লাহি আলাইহি। তিনি এসে আন্দালুসের চিত্র এতটাই পাল্টে দিয়েছেন যে, ইতিহাসবেত্তাগণ তাঁর সম্পর্কে এই মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছেন-- "যদি আবদুর রহমান আদ-দাখিল না আসতেন, তাহলে আন্দালুস থেকে ইসলামের নাম নিশানা চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যেত।"
আরব উপদ্বীপ থেকে হিজরত করে মুসলিম আন্দালুসে পৌঁছার পর তিনি এমন অনেক সংকট ও বিপদাপদের সম্মুখীন হয়েছেন যা আন্দালুসে উমাইয়াদের ইসলামি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে অন্তরায় সৃষ্টি করে এবং কুদৃষ্টি নিক্ষেপকারী ও লোভীদের প্রতিহত করে ইসলামি সাম্রাজ্যের ভিত্তি মজবুত ও সুদৃঢ় করতে বাধার সৃষ্টি করে। তাই তো আমরা দেখতে পাই যে, আব্বাসি খেলাফতের শাসকগণ এবং আন্দালুসের অন্যান্য দুর্বলমনা শাসকগণ তাঁর প্রতি বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। তাঁর বিরুদ্ধে গড়ে উঠা বিদ্রোহের সংখ্যা পঁচিশ ছাড়িয়ে গেছে। আব্বাসি সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে উস্কে দেয়া বিদ্রোহটিই সবচে' ভয়াবহ ও বড় বিদ্রোহ ছিলো। কিন্তু সবকটি বিদ্রোহেরই তিনি সফল মোকবেলা করে বিজয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন।
যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে আবদুর রহমান আদ-দাখিল যখন একাকী আন্দালুসে প্রবেশ করেন, তখন তাঁর চারপাশে একে একে জড়ো হতে থাকে বনু উমাইয়ার শাসকগোষ্ঠী, আমাজিগ সম্প্রদায় ও তৎকালীন আন্দালুস-প্রশাসক ইউসুফ আল-ফিহরির প্রতিপক্ষ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজন। তিনি মূলত আন্দালুসে প্রবেশ করেছেন ইয়ামানীদের কৃত চুক্তির কারণে। সে-সময় তাদের নেতৃত্বে ছিলেন আবুস্ সাবাহ আল-ইয়াহসাবি। তাদের মূল ঘাটি ছিলো সেকালের মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রধান ও বৃহৎ নগরী সেভিল। আবুস্ সাবাহের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকের পর তিনি আবদুর রহমানের আনুগত্য স্বীকার করে নেন। কিন্তু আন্দালুস-প্রশাসক আল-ফিহরি তাঁর আনুগত্যের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তাঁর সহযোগী ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি আরম্ভ করে দেন। ১৩৮ হিজরিতে ঐতিহাসিক মাসারা প্রান্তরে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে তিনি বিজয় লাভ করেন।
যুদ্ধ শুরুর পূর্বে আবদুর রহমান আদ-দাখিল জানতে পারলেন, তাঁর সহযোগী সৈন্যরা পরস্পর বলাবলি করছে, যুদ্ধে আমরা হেরে গেলে তিনি তাঁর তেজোদীপ্ত ধূসর বর্ণের ঘোড়া নিয়ে পালিয়ে বেড়াবেন। আর আমাদের রেখে যাবেন আল-ফিহরির নির্যাতের হাতে সোপর্দ করে। আত্মমর্যাদবোধে উদ্দিপ্ত ও তারুন্য দীপ্তিতে উদ্ভাসিত এই বীর মুজাহিদ আর সহ্য করতে পারলেন না। তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁর তেজী ঘোড়া আবুস্ সাবাহকে দিয়ে বললেন, আমার এই ঘোড়াটি অতি দ্রুতগামী। তাতে আরোহন করে তরবারী চালনো আমার পক্ষে দুষ্কর হবে। তাই তুমি আমার ঘোড়াটি নিয়ে যাও। আর আমাকে তোমার খচ্চরটি দাও। এরপর তিনি খচ্চরে চড়ে সামনে অগ্রসর হতে থাকেন। এ চিত্র দেখে তাঁর ব্যাপারে শঙ্কিত লোকজন বলতে লাগল, এতো কোন পলাতক যোদ্ধার আচরণ হতে পারে না। এ আচরণ তো এমন বীর যোদ্ধাকেই মানায় যনি রনাঙ্গনে মৃত্যুকে খোঁজে ফিরেন।
সে যুগের রীতি অনুযায়ী ইয়ামেনি সৈন্যরা পরাজিত আল-ফিহরির পলায়নপর সৈন্যদের পশ্চাদাবন করলে আবদুর রহমান আদ-দাখিল তাদের নিবৃত্ত করে এমন এক জ্ঞানগর্ভ বাণী উচ্চারণ করেছেন যা আজো ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করছে। ঐতিহাসিক বাণীটি আজো তাঁর বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সঠিক বিবেচনাবোধ কাজে লাগিয়ে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণের যোগ্যতার স্বাক্ষী হয়ে আছে। তিনি বলেছিলেন, এমন শত্রুর শিকড় উপড়ে ফেল না ভবিষ্যতে যার হৃদ্যতা প্রত্যাশা। তুলনামূলক কঠিন শত্রুর (মোকাবেলার সময় সহায়তা লাভের জন্য) তাকে টিকিয়ে রাখ।
আব্বাসি খলিফা আবু জাফর আল-মানসুর আলা ইবনে মুগিস আল হাজরামিকে আন্দালুস ভূমিতে পাঠিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিলো, তিনি আবদুর রহমান বিন মুআবিয়াকে হত্যা করে আন্দালুসকেও খেলাফতে আব্বাসিয়ার অধীন করবেন। কিন্তু যুদ্ধে আলা আল-হাজরামি নিহত হন এবং তাঁর বাহিনী শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। আব্বাসি খলিফা আবু জাফর আল-মানসুরের কাছে এই সংবাদ পৌঁছলে তিনি আবদুর রহমান আদ-দাখিলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরিকল্পনা মাথা একদম ঝেড়ে ফেলে দেন। এ-সময় খলিফা তাঁকে কুরাইশি ঈগল উপাধিতে অভিহিত করেন।
হ্যাঁ, এই আন্দালুস সম্পর্কেই জোস্ট্যাফ লুবোন তার তারিখুল আরব নামক গ্রন্থে এভাবেই গুণগান গেয়েছেন, "দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে বিশ মাইলেরও অধিক প্রশস্ত কর্ডোবার সড়কগুলো আলোতে ঝলমল করত, ঠিক সে-সময় প্যারিস ও লণ্ডনের সড়কগুলো ছিলো মাটির। এবড়োথেবড়ো। মানুষ রাতের বেলায় গাঢ় অন্ধকারে খুব কষ্টে চলাচল করত। আর প্রচণ্ড বৃষ্টি হলে তো পথচারিরা গভীর কাদায় ডুবে যেত।" এ-ছাড়া গ্রানাডা, ইসবেলিয়া, জারাগোজা ও টলেডো; এগুলো ছিলো সে-সব শহর যা নিষ্প্রাণ অন্ধকার ইউরোপকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে তুলেছে। উক্ত শহরগুলো মুসলিম আন্দালুসের এমনসব ঘাটি যেখান থেকে মুসলিম বাহিনী সর্বগ্রাসী অন্ধকারে আচ্ছন্ন ইউরোপের প্রাণ কেন্দ্রে পৌঁছত।
হে আল্লাহ, এই সঙ্কটময় পরিস্থিতে আমাদের মাঝে আবারো প্রেরণ করুন এই জাতীয় মহা মানবদের। এরাই হলেন সে-সব মহাবীর যাদের আবারো ফিরে আসবে আমাদের হারানো জন্নাতুল ফেরদৌস। আমিন ইয়া রব।
এই মহাবীরে ৫৯ বছর জীবিত ছিলেন। ১৯ বছর কেটেছে উমাইয়া খেলাফতের বিলুপ্তির পূর্বে দামেশক ও ইরাকে। ৬ বছর অতিবাহিত হয়েছে আব্বাসিয় বরবরতা থেকে পলায়ন করে আন্দালুসে প্রবেশ করতে। আর বাকি ৩৪ বছর আন্দালুসের সিংহাসন আলোকিত রেখেছেন। অবশেষে জুমাদাল উলা১৭২ হিজরি=৭৮৮ খৃস্টাব্দে কর্ডোবায় সাফল্য মণ্ডিত কর্মময় জীবনের আলোকধারা চিরতরে বিলীন হয়ে যায়। আন্দালুস হারায় তাঁর গর্বের অভিবাবক। কর্ডোবাতেই তিনি সমাধিস্থ হন।
০৭ জুমাদাল উখরা ১৪৩৮হিজরি=২৪শে ফেব্রুয়ারি২০১৮ শনিবার
منقول عن صفحة "محمد أبو صهيب"



















আলিম ও ঈমানি অবিচলতা!
আতিক উল্লাহ

দিনলিপি-১৪৩৯
(০৭-১০-২০১৮)

প্রথমে তিনটি সালতানাতের কথা সংক্ষেপে জেনে নেই। তাহলে পরিস্থিতি সহজে বোঝা যাবে।
১: দাওলাতুল মুরাবিতীন (الدولة المرابطية)।
মুরাবিতীনের সালতানাত (১০৫৬-১১৭৪)। ইয়াহয়া বিন ইবরাহীম ছিলেন ছোটখাট একজন আমীর। ইনি মুরাবিতীন সালতানাতের মূল বীজ। তাঁর উস্তাদ শায়খ আবু ইমরান ফাসী রহ. ছিলেন তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু। সেনেগাল নদীর দক্ষিণ তীরবর্তী অঞ্চলে শুরু হয়েছিল এই সালতানাতের কার্যক্রম। তবে মুরাবিতীন সালতানাতের মূল সূচনা হয় আবদুল্লাহ বিন ইয়াসীন রহ.-কে দিয়ে। আর উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করে, ইউসুফ বিন তাশাফীন রহ.-এর হাত ধরে।
.
২: দাওলাতুল মুয়াহহিদীন (الدولة الموحدية)।
মুয়াহহিদীন সালতানাত (১১২১-১২৬৯)। মুহাম্মাদ বিন তাওয়ামরুত (১০৭৭-১১৩০)-এর ভাবাদর্শে বিশ^াসীদের হাতে এই সালতানাতের গোড়পত্তন হয়। মূল ভিত অবশ্য ইবনে তাওয়ামরুতই গড়ে দিয়ে যায়। তবে রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে কার্যক্রম শুরু হয় ইবনে তাওয়ামরুতের হাতেগড়া শিষ্য আবদুল মুমিন বিন আলি (১১৩৩-১১৬৩)-কে দিয়ে। এরপর আসে আবু ইয়া‘কুব ইউসুফ বিন আবদুল মুমিন (১১৬৩-১১৮৪)। তারপর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন আবু ইউসুফ ইয়া‘কূব বিন ইউসুফ (১১৮৪-১১৯৯)। তিনি মনসুর মুয়াহহেদী নামেও প্রসিদ্ধ। মুয়াহহেদী সালতানাতের তৃতীয় শাসক। তার আমলেই মুয়াহহেদীদের আকীদাগত্র ভ্রান্তিগুলো সংশোধিত হয়। তিনি ইবনে তাওয়ামরুতের মাহদি হওয়াকে নাকচ করে দেন। তার নিষ্পাপ হওয়ার আকীদাও বাতিল করেন।
.
৩: দাওলাতুল মেরিনী (الدولة المرينية)।
মেরিনী সালতানাত (১২৪৪-১৪৬৫)। এই রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয় আবু মুহাম্মাদ আবদুল হকের উদ্যোগে। প্রথম দুই সালতানাতের ভিত্তি ছিল দ্বীন। কিন্তু এই দাওলা প্রাথমিকভাবে কোনও দ্বীনি তাকিদ থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। গোত্রীয় উদ্দীপনা থেকে রাষ্ট্রে সূচনা হয়েছিল।
উপরোক্ত তিনটি সালতানাতেরই অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, তারা সবাই কমবেশ আন্দালুসকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। আন্দালুসের মুসলমানদের সাহায্য করেছে। আন্দালুসের দুর্দিনে পাশে থেকেছে।
.
এবার মূল প্রসঙ্গে যাওয়া যেতে পারে।
৪:ইয়ায বিন মুসা (১০৮৩-১১৪৯)। তবে তিনি (القاضي عياض) কাযি ইয়ায ৪৭৬-৫৪৪ হিঃ নামেই প্রসিদ্ধ। সাবতা দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্বপুরুষ ইয়ামানের কাহতানী বংশের ছিল। আন্দালুসে গ্রানাডার ‘বাসতায়’ হিজরত করেছিলেন তারা। তারপর সেখান থেকে মরক্কোর ফাস নগরীতে। সেখান থেকে দাদা ‘আমরুন’ হিজরত করে ‘সাবতায়’ আসেন। ৮৯৩ সালে। সাবতা আগে মরক্কোর অংশ ছিল। কিন্তু স্পেন এই দ্বীপকে জোরপূর্বক দখল করে রেখেছে।
৫: কাযি ইয়ায পড়াশোনা করেন এই সাবতাতেই। তারপর উচ্চতর পড়াশোনার উদ্দেশ্যে আন্দালুস গমন করেন। ফিরে আসনে ১১১৪ সালে। বত্রিশ বছর বয়েসে শিক্ষাদান কাজে নিয়োজিত হন।
৬: ১১২১ সালে সাবতার কাযি (প্রধান বিচারক) নিযুক্ত হন। একটানা ১৬ বছর এই দায়িত্ব পালন করেন এখানে। ১১৩৬ সালে বদলি হয়ে গ্রানাডার বিচারপতি নিযুক্ত হন। ১১৪৪ সালে ফের সাবতার প্রধান বিচারপতি হন।
৭: তখন মুরাবিতীনের শাসনামল চলছিল। সাবতা দ্বীপ মুরাবিতীনের অধীনে ছিল। মাগরিব (মরক্কো-তিউনিসিয়া-আলজেরিয়া ইত্যাদি) অঞ্চলে ইসলামের ইতিহাসে যত সালতানাতের উদ্ভব ঘটেছিল, মুরাবিতীন সালতানাত ছিল সবচেয়ে বড় ও মহান। ঈসমাঈলি শী‘আদের ভ্রান্ত আকীদা ও নানামুখি কুসংস্কারে আচ্ছন্ন দক্ষিণ আফ্রিকাকে বিশুদ্ধ সুন্নী আকীদায় দীক্ষিত করার জন্যে, এই দাওলার জন্ম হয়েছিল।
৮: প্রাথমিক অবস্থায় এই দাওলার সূচনা হয়েছিল, সংস্কার আন্দোলন হিশেবে। পরে আস্তে আস্তে রাষ্ট্রীয় কাঠামো পরিগ্রহ করেছে। প্রতিষ্ঠাতাদের সবাই ছিলেন হক্কানী রব্বানী আলেম। ইমাম মালেক রহ.-এর একনিষ্ঠ অনুসারী। সেনেগাল নদীর দক্ষিণ তীর থেকে শুরু করে, তারা একে একে দখল করে নিলেন পুরো মাগরিব। তারপরে আন্দালুস। বাইয়াত দিলেন আব্বাসী খিলাফাহকে। এই একটা ব্যাপার, যেখানেই কোনও সুন্নী দাওলা প্রতিষ্ঠা হয়েছে, আব্বাসী খিলাফার কাছে বায়আত দিয়েছে।
৯: দাওলা মুরাবিতীন আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়েছিল নাইজার থেকে ক্যামেরুন ও নাইজেরিয়া পর্যন্ত। দাওলার প্রতিটি সদস্য ছিলেন অনাড়ম্বর জীবনের অধিকারী। বেদুইনদের মতো সাদামাটা জীবন ছিল তাদের। কৃচ্ছ্রতাপূর্ণ জীবন ছিল। প্রাচুর্য বা বিত্তের প্রতি সম্পূর্ণ নির্মোহ ছিলেন তারা। দাওলার প্রতিটি খাত ছিল অপচয়মুক্ত। উর্ধতন থেকে শুরু করে নিন্মতম পর্যন্ত সবাই প্রথম যুগের মতো রাতজাগা রুহবান আর দিনমানা ফুরসান ছিলেন।
১০: মুরাবিতীন সালতানাতে আলিম ওলামার যথাযথ কদর হত। শেষের দিকে এসব গুণ হারিয়ে বসার কারণেই মুরাবিত সালতানাতের পতন ঘটে। এই মুজাহিদ সালতানাতেই কাযি আয়ায বেড়ে ওঠেন। শিক্ষা ও দীক্ষা লাভ করেন। উম্মাহর ইতিহাসে যে কয়জন বিশ^কোষধর্মী জ্ঞানের অধিকারী হিশেবে পরিচিত, কাযি ইয়ায তার অন্যতম। দ্বীনি ইলমের প্রায় প্রতিটি শাখাতেই তিনি গভীর ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। আজীবন শিক্ষাদান কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। কুরআন হাদীস ফিকহসহ নানা শাখায়, অসংখ্য কিতাব রচনা করেছেন। তবে হাদীস শাস্ত্রেই তার বেশি দখল ছিল।
১১: তিনি যখন পরিণত বয়েসে উপনীত হলেন, তখন দাওলার পতনের আলামত প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। বাল্যে ও যৌবনে যে দাওলাকে উন্নতির চরম শিখরে দেখেছেন, পরিণত বয়েসে সে দাওলাকে আস্তে আস্তে পতনের দিকে ধাবিত হতেও দেখেছেন।
১২: পরিণত বয়েসে তিনি ছিলেন তার যুগে, নিজ দেশের সেরা আলিম। সেরা ফকীহ, সেটা মুহাদ্দিস। মালেকী মাযহাব ছাড়া, আব্বাসী খিলাফাহর পুরো অঞ্চল জুড়েও তার মতো সর্ববিদ্যায় পারদর্শী আলিমের জুড়ি মেলা ভার ছিল। মুরাবিতীন সালতানাত ভোগ বিলাসে লিপ্ত হয়ে পড়ল। রাষ্ট্রীয় কাঠামো দুর্বল হয়ে এল। দাওলার বিভিন্ন বিভাগে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ল। আগের মতো জিহাদ ও মুজাহাদা না থাকাতে, সামরিক ও প্রতিরোধ বিভাগ দুর্বল হয়ে পড়ল। এই সুযোগে আরেকটি সালতানাত মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। দাওলাতুল মুয়াহহিদীন।
১৩: মুয়াহহিদীন সালতানাত ছিল মুরাবিতীনের সম্পূর্ণ বিপরীত। এর প্রতিষ্ঠাতা ইবনে তাওয়ামরুত নিজেকে মাহদী হিশেবে ঘোষণা দিয়েছিল। তার আকীদা গড়ে উঠেছিল মুতাযেলা ও জাহমিয়াদের আকীদার সংমিশ্রণে। ইবনে তাওয়ামরুত ও তার অনুসারীরা, ক্ষমতা সুসংহত করতে গিয়ে, তাদের পূর্বসুরী মুরাবিতীনের উপর অত্যন্ত নৃশংস গণহত্যা চালিয়েছিল। শুধু সেনা বা সরকারী কর্মকর্তাদের উপরই নয়, মুরাবিতীন শাসনে থাকা শহরের নাগরিকদের উপরও নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। বিরোধীপক্ষের শহরগুলোকে গুঁড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। নারীদেরকে বন্দী করে বাঁদী বানিয়েছে। এহেন বর্বর-পাশবিক আচরণ আর রক্তবন্যার উপর দিয়ে মুয়াহহিদীন সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
১৪: কাযি ইয়ায এমন কল্পনাতীত নির্দয়তা দেখে, সাবতাবাসীর ব্যাপারেও এমন কিছুর আশংকা করলেন। তখনো মুয়াহহিদীনের কালো হাত সাবতা পর্যন্ত এসে পৌঁছেনি। তিনি শহরের প্রধান কাযি। সাবতার সকলে তাকে ভালোবাসে শ্রদ্ধা করে। ভালোবাসে। তার প্রতি আস্থা রাখে। তিনি এখানেরই সন্তান। সবাই তার কাছে বাড়তি কিছু আশাও করে। দুর্দিনে তাদের নেতৃত্বের স্থান দখল করে, তাদেরকে মুক্তির বন্দরে পৌঁছে দেবেন, এমন তামান্নাও রাখে সাবতাবাসী। একজন আলিমের কাছে আওয়ামের এমন চাহিদার মাঝে কোনও ভুল নেই। অতিরঞ্জন নেই। বাড়াবাড়ি নেই। সত্যিকার আলিম তো জনমুখিই হবেন। তাদের সুখদুঃখে পাশে দাঁড়াবেন। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন।
১৫: ‘সালা’ নামের একটি শহর, মুয়াহহিদীন যোদ্ধাদের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা ঠেকাতে, প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। পাল্টা প্রতিশোধ হিশেবে, মুয়াহহিদীন যোদ্ধারা পুরো শহরকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল। কথিত আছে, তারা তাদের দাওলা কায়েম করতে প্রায় একমিলিয়ন মানুষ হত্যা করেছিল। সে যুগে দশ লক্ষ মানুষ যা তা ব্যাপার নয়। প্রতিপক্ষের পুরো অঞ্চলকে তারা প্রায় খালি করে ফেলেছিল।
১৬: সবদিক বিবেচনা করে, কাযি ইয়ায সাবতাবাসীর সাথে পরামর্শ করলেন। সবাই বহু চিন্তাভাবনার পর রায় দিল, বিনা প্রতিরোধে মুয়াহহিদীনের আনুগত্য মেনে নিবে। শহরের প্রতিরোধ শক্তি দুর্বল। আর মুয়াহহিদীনের গণজোয়ারের তোড়ে, ভঙ্গুর মুরাবিতীন সৈন্যরা টিকে থাকতে পারবে না। তার চেয়ে আপাতত হত্যাযজ্ঞ এড়াতে, আপোষ করে নেয়াই শ্রেয়।
১৭: কাযি ইয়াযকে পূর্বের পদে বহাল রাখা হল। তিনি সবার কাছেই তখন একবাক্যে বরিত ছিলেন। তার আনুগত্যের সম্মানেই তাকে অপসারণ করা হল না। কাযি সাহেব আগের মতোই শহর পরিচালনা করে যেতে লাগলেন। মুয়াহহিদীনের অধীনতা মেনে নিলেও, কাযি সাহেব দাজ্জালের আনুগত্য করে মনে স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। ইবনে তাওয়ামরুতের বর্বরতা দেখে তাকে দাজ্জাল ছাড়া আর কিছু ভাবা যাচ্ছিল না।
১৮: মুরাবিতীনের রাজধানী ছিল মারাকেশ। শহরটা দখল করার পর, মুয়াহহিদীন সেনারা শহরের প্রতিটি মানুষকে হত্যা করল। নারীদেরকে বেছে বেছে দাসী বানানো হল। কোনও ঘরকে আস্ত রাখল না। মসজিদ-মাদরাসা-খানকা কিছুই বাদ পড়ল না। মুয়াহহিদীনের যুক্তি হল, মুরাবিতীনরা মুশরিক। তারা মুজাসসিমা আকীদা পোষণ করে। আল্লাহর জন্যে মানুষের মতো শরীর সাব্যস্ত করে। তার শিরকে লিপ্ত ছিল এতদিন। তাই গোটা শহর নাপাক হয়ে আছে। পাক করতে হবে। সালা, মারাকেশ ও ওয়াহরান শহর দখলের পর, মুয়াহহিদীনের হত্যাযজ্ঞ দেখে, কাযি ইয়ায সংশয়ে পড়ে গেলেন। আত্মসমর্পন করা সত্ত্বেও সাবতার উপরও এমন কেয়ামত নেমে আসে কি না! এখন হয়তো কিছু বলছে না। পরে সবদিক গুছিয়ে যদি এদিকে আসে? সাবতাওতো মুরাবিতীনের মতো হুবহু একই মানহাজ মেনে চলে? এই শহরের নাপাকিও যদি মুয়াহহিদীনরা পবিত্র করার খাহেশ মনে মনে পোষণ করে?
১৯: কাযি ইয়ায গোপনে ইয়াহয়া বিন গানিয়ার সাথে যোগাযোগ করলেন। ইয়াহয়া ছিলেন মুরাবিতীনের নিয়োগকৃত, ক্ষমতায় থাকা সর্বশেষ গভর্নর। তিনি ছিলেন মুরাবিতীন সমর্থকদের সর্বশেষ আশা-ভরসার স্থল। তার শাসনাধীনে ছিল আন্দালুসের পূর্বদিককার ‘মায়ুরকা’ দ্বীপপুঞ্জ। তিনি মায়াহহিদীনের হাত থেকে মাগরিব অঞ্চল পুনঃদখলের প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন। কাযি আয়াযের যোগাযোগকে তিনি সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। কাযি সাহেবের মতো আলিমের সমর্থন পেয়ে, তার মনোবল আরও তুঙ্গে উঠল। নিজে হকের উপর আছেন, এই বিশ^াস আরও দৃঢ় হল।
২০: ইয়াহয়া বিন গানিমের সমর্থন পাওয়ার পর, সাবতাবাসী ঘোষণা দিয়ে, মুয়াহহিদীনের বাইআত ভেঙে ফেলল। ঘটনার বিবরণ শুনে মুয়াহহিদীন নেতারা রীতিমতো ক্ষেপে গেল। তারা সাবতা দখলের প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। সাবতাবাসী অবস্থা বেগতিক দেখে, ইয়াহয়া গানেমের সাথে যোগাযোগ করল। কিন্তু ইয়াহয়ার পক্ষ থেকে আশানুরূ সাড়া পাওয়া গেল না। নিজেও এল না, অন্য কাউকে দিয়ে সেনাসাহায্যও প্রেরণ করল না।
২১: মুয়াহহিদীনরা প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পর, সাবতার দিকে পঙ্গপালের মতো ধেয়ে আসতে শুরু করল। কাযি ইয়ায দেখলেন সাবতাবাসীর উপর গণহত্যার খড়গ নেমে আসছে। উপায়ান্তর না দেখে, একা একা শহর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। নিজেকে মুয়াহহিদীনের হাতে সোপর্দ করলেন। কাযি সাহেবকে গ্রেফতার করে প্রধান নেতা আবদুল মুমিন বিন আলি কাছে নিয়ে যাওয়া হল। কাযি সাহেব বললেন,
-সাবতাবাসীর কোনও দোষ নেই। বায়আত ভঙ্গ করার সমস্ত দায়-দায়িত্ব আমার। আমার প্ররোচনাতেই তারা এ-কাজে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। তাদের কোনও দোষ নেই। আমিই দোষী।
সবকিছু শোনার পর, আবদুল মুমিন ক্ষমার ঘোষণা দিল। তবে একটা শর্ত দিল,
-আপনি আপনাকে ক্ষমা করব একটা শর্তে! আপনাকে কষ্ট করে, কয়েকটা কাজ করতে হবে,
ক: ইবনে তাওয়ামরুতকে নিষ্পাপ ঘোষণা করে ফতোয়া দিতে হবে।
খ: তাকে মাহদী বলে স্বীকার করতে হবে।
গ: এ ব্যাপারে একটা কিতাব লিখে দিতে হবে। যাতে সবার মাঝে বিতরণ করা যায়।
২২: কাযি সাহেব বুঝতে পারলেন, তাকে ব্যবহার করে, মুয়াহহিদীনরা সবার কাছে সমাদৃত হতে চাচ্ছে। তার কিতাব ব্যবহার করে, এতদিনের কালিমা মোচন করার প্রয়াস পাবে। শুধু তাই নয়, একজন ভ-কে মাহদী বানানোটা প্রতিষ্ঠিত সত্যে পরিণত হবে। মিথ্যাকে প্রশ্রয় দিয়ে, নিজের জীবন বাঁচাবেন নাকি, সত্য বলে লাখো মানুষকে গোমরাহীর পথ থেকে সরিয়ে নিজের জীবনকে জেনেশুনে হুমকির দিকে ঠেলে দেবেন?
২৩: সত্যিকারের আলিমগন এমন পরিস্থিতিতেও হক বেছে নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না। কাযি সাহেবও কালবিলম্ব না করে মুখের উপরই বলে দিলেন,
-ইবনে তাওয়ামরুত একজন ভণ্ড। সে কিভাবে নিষ্পাপ হবে? মাহদী হওয়া দূরের কথা সে তো দাজ্জালের মতো আচরণ করেছে। লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ মানুষের রক্তে তার হাত রঞ্জিত হয়ে আছে।
২৪: মুয়াহহিদীনরা কাযি সাহেবের বক্তব্য শুনে তেলেবেগুনে জ¦লে উঠল। বর্শার আঘাতে আঘাতে তার শরীর ঝাঁজরা করে ফেলল। এতেই তাদের অন্ধ আর বিকৃত আক্রোশ চরিতার্থ হল না, তারা কাযি সাহেবকে টুকরো টুকরো করে কাটল। তারপর ছিন্নভিন্ন টুকরাগুলো একত্র করে মারাকেশের এক অজ্ঞাত স্থান দাফন করে ফেলা হল। গোসল দেয়া হল না। জানাযা পড়া হল না। শুধু তাই নয়, সে অঞ্চলটি খ্রিস্টানদেরকে বন্দোবস্তি দেয়া হল। খ্রিস্টানরা কবরের পাশে গীর্জা আর অনেক মঠ তৈরী করেছিল।
২৫: হক হোক বাতিল হোক, কোনও দলকেই আল্লাহ তা‘আলা চিরদিন ক্ষমতার শীর্ষে থাকতে দেন না। একসময় মুয়াহহিদীনদেরও পতন হল। বিজয়ীবেশে এল মেরিনীরা। মেরিনী সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, ৭১২ হিজরীতে কাযি ইয়াযের কবরকে খ্রিস্টানদের থেকে উদ্ধার করা হল।
----
(কাযি আয়াযের মৃত্যু সম্পর্কে ভিন্নমতও প্রচলিত আছে। তার তাকীদা নিয়েও টানা হ্যাঁচড়া আছে। আশআরীরা বলে তিনি আশ‘আরী ছিলেন। হাম্বলীরা বলে তিনি হাম্বলী ছিলেন। তবে আশ‘আরী হওয়াটাই বেশি গ্রহণযোগ্য। কারণ সেকালে মালেকীগণ এবং এ যুগে, সাধারণত আশআরী হয়ে থাকেন)।
--
কিছু ভাবনা:
১: প্রকৃত আলিম যারা, তারা কখনো বাতিলের সামনে মাথা নত করেন না। দ্বীনের কোনও বিধানের ক্ষেত্রে তাগুতের সামনে আপোষ করেন না। হক্কানী ওলামায়ে কেরামগণ সাধারণত আযীমতের উপর আমল করেন। রুখসত গ্রহণ করেন না। বিশেষ করে ঈমান ও কুফরের ক্ষেত্রে।
২: রব্বানী ওলামায়ে কেরাম, হকের পতাকা বুলন্দ রাখতে, আমৃত্য হকেরও উপর অবিচল থাকতে পিছপা হন না। জেল-জুলুমকে ভয় পান না। যালিম তাগুত শাসকের সামান্য ‘মুলো’ দেখে ঝুলে পড়েন না। ফাঁসির কাষ্ঠ বেছে নেয়াকে প্রাধান্য দেন,
مِّنَ الْمُؤْمِنِينَ رِجَالٌ صَدَقُوا مَا عَاهَدُوا اللَّهَ عَلَيْهِ ۖ فَمِنْهُم مَّن قَضَىٰ نَحْبَهُ وَمِنْهُم مَّن يَنتَظِرُ ۖ وَمَا بَدَّلُوا تَبْدِيلًا
এই ঈমানদারদের মধ্যেই এমন লোকও আছে, যারা আল্লাহর সঙ্গে কৃত প্রতিশ্রুতিকে সত্যে পরিণত করেছে এবং তাদের মধ্যে এমন লোকও আছে, যারা তাদের নজরানা আদায় করেছে এবং আছে এমন কিছু লোক, যারা এখনও প্রতীক্ষায় আছে, আর তারা (তাদের ইচ্ছর ভেতর) কিছুমাত্র পরিবর্তন ঘটায়নি (আহযাব ২৩)।
৩: যখন দেখেন তার নমনীয় আচরণে, হকপন্থী মানুষ বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তিনি পাহাড়ের মতো অনঢ় অবস্থানে চলে যান। সরকারী বরাদ্দ, বিপুল উপহার-উপঢৌকন তাকে বিচ্যুত করতে পারে না।
৪: আর একজন আলিম যখন, অনেক মানুষের আস্থার প্রতীকে পরিণত হন, এমতাবস্থায় সেই আলিমের জন্যে উচিত নয়, রুখসত তথা শরীয়তের ছাড় গ্রহণ করা। হিম্মত থাকলে আযীমত গ্রহণ করে নির্যাতনের পথ বেছে নেয়া উচিত। তাহলে মানুষও হিম্মত পাবে। হকের সত্যিকার রূপ বুঝতে পারবে। তবে যদি মনে হয়, আযীমতের পথে গেলে, নির্যাতনের ভার সহ্য করা যাবে না, তখন ছাড় করা যেতে পারে। তবে ফিতনার আশংকা থাকলে, নিজেকে নেতৃত্বের আসন থেকেও সরিয়ে নেয়া কাম্য।
৫: নবীজি সা. সবসময় দু’টি পথের সহজতর পথ গ্রহণ করতেন। এমনটা অনেকে বলে, যুক্তি দিতে চান। তাদের জানা থাকা দরকার, ঈমান কুফরের প্রশ্নে নবীজি সা. কখনোই কঠিন পথ বেছে নিতে তিলেক দ্বিধা করেননি।
৬: ফাঁসির রায় হওয়ার পর, সাইয়েদ কুতুব রহ.-কে বলা হয়েছিল, সরকারের সাথে আপোষ করে নিতে। তিনি এই প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন,
-উম্মত যাদেরকে আদর্শ মনে করে, তাদের উচিত নয়, যালিমের কাছে মাথানত করা। তাদের সাথে আপোষ করে নেয়া।
৭: ইসলামের শুরুর দিকে দেখা গেছে, যালিম শাসকের বিরুদ্ধে, একদল আলিম সবসময় সোচ্চার থাকতেন। জেল-যুলুমেও পিছপা হতেন না। ভয়ে দমে যেতেন না।
৮: এখন কেন যেন উল্টো, যিনি যত বেশি ইলমের অধিকারী, তিনি তত বেশি চুপ থাকেন। ততবেশি হিকমত অবলম্বন করেন।
৯: বর্তমানের বড় আলিমগন, তাগুত-কুফর-যুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে হয়রানির শিকার হওয়ার চেয়ে, চুপ থেকে মাদরাসা টিকিয়ে রাখার মেহনতে শামিল থাকাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।
১০: যাদেরকে আদর্শ বলে মানি, যাদের থেকে ইলম শিখি, যাদেরকে ইলমে বড় বলে মনে করি, এমন কয়েকজন যদি হিম্মত করে সামনে বাড়তে পারতেন, তাহলে আমাদের মতো অসংখ্য ‘কাপুরুষ’ ‘বীরপুরুষে’ রূপান্তরিত হওয়া সহজ হয়ে যেত।



















সাবতার ইদরীসী!
আতিক উল্লাহ
দিনলিপি-৪৯৯
(১৬-০৩-২০১৬)

--
সাবতা। একটি বর্ণিল শহরের নাম। দেশ বললেও কি ভুল হবে? জিব্রাল্টার প্রণালীর কোল ঘেঁষে দুটি আছে। সাবতা ও মালীলিয়াহ। দু’টোই শহরই ছিল মাগরিব (মরক্কো)-এর অন্তভূক্ত। কিন্তু গ্রানাডার পতনের পর থেকেই স্পেনীশরা এ শহর দু’টিকে জবর দখল করে রেখেছে।
.
খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে সাবতা ছিল কার্থেজিয়ানদের দখলে। খ্রিস্টপূর্ব চল্লিশ সালের দিকে রোমান স¤্রাট কালিগুলা সাবতাকে তার সা¤্রাজ্যের অধীনে নিয়ে আসে। ৪২৯ খ্রিস্টাব্দে এই ছোট্ট শহরকে দখল করে নেয় ভ্যান্ডালরা। বলাবাহুল্য আরবরা স্পেনকে আন্দালুস বলে। আর আন্দালুস শব্দটা এসেছে ‘ভ্যান্ডাল’ শব্দ থেকে। ৯৩১ সালে সাবতা আন্দালুসের উমাইয়াা খলীফা আবদুর রহমান আন-নাসিরের অধীনে আসে। অবশ্য তার আগে শহরটা আরো দুইবার হাত বদল হয়: একবার গথিকরা দখল করে, তাদের থেকে ছিনিয়ে নেয় রোমানরা।
.
১০৬১ সালে সিউতা দখল করে বারবাররা। ১০৮৪ সালে এখানে আসেন মহান মুজাহিদ ইউসুফ বিন তাশাফীন রহ.। ১১৪৭ সালে এই শহর করায়ত্ত করে মরক্কোর মুয়াহহিদরা। ১৪৯২ সালে গ্রানাডার পতন হয়। তারপর আবার সাবতা হাতবদল হয়। ১৪৯৭ সালে সাবতা দখল করে নেয় পুর্তগীজরা। ১৫৮০ সালে পুর্তগাল অধীনস্থ হয় স্পেনের। সাথে সাথে সাবতাও স্পেনের অধীনে আসে।
.
১৭৭৪ সালে মরক্কোর খলীফা মাওলা মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ সাবতা দখল করার অভিযান পরিচালনা করে। তবে সফল হতে পারেনি। একের পর এক অব্যাহত চেষ্টা সত্ত্বেও মুসলমানরা সফল হতে পারেনি। এমনকি অবিস্মরণীয় মুজাহিদ আবদুল করীম খাত্তবী রহ.ও চেষ্টা করেছিলেন। প্রায় বিজয়ের কাছাকাছিও চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারেননি।
.
মরক্কো কখনই সাবতার দাবি ছাড়েনি। জাতিসংঘে পর্যন্ত দাবি তুলেছে। বাদশাহ হাসান ২য় পীড়াপীড়ি দেখে, স্পেন কৌশল করে সাবতা ও মালীলিয়াহকে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে দেয়। ১৯৯৫ সালে। পুরো নিয়ন্ত্রণ অবশ্য স্পেনের হাতেই থাকে।
.
এতো পুরান দিনের কথা। ড. ইউনুস নোবেল পুরস্কার পেলেন। তারপর থেকে বিভিন্ন দেশ থেকেও একের পর এক পুরষ্কার পেতে থাকলেন। এরমধ্যে একটা সম্মাননা পেলেন সাবতা থেকে। ইংরেজীতে যাকে বলা হয় সিউতা। অন্যদের কাছে পুরষ্কারটা হয়তো অন্য আর দশটা পুরস্কারের মতোই ছিল। আবার কারো কারো কাছে বিষ্ময়ও জাগিয়েছিল। কারণ ছোট্ট একটা শহর হয়েও ভিনদেশী এক কুসিদজীবিকে পুরস্কৃত করেছে।
.
সিউতা একটা ছোট্ট শহর। বড়জোড় ২৯ কিলোমিটার আয়তন। কিন্তু ছোট হলে কী হবে, তার অনেক বৈশিষ্ট্য। এই একটা শহরেইগাদগাদি করে বাস করে: খ্রিস্টান। মুসলমান। ইহুদি। হিন্দু। বৌদ্ধ। আধুনিক পরিভাষায় যাকে বলে ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চূড়ান্ত’ নমুনা এ-শহরে পাওয়া যায়।
.
এতটাই সম্প্রীতি, এক ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানে আরেক ধর্মের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। গান গায়। অনেক পরিবার এমন আছে, মা খ্রিস্টান কিন্তু বাবা ও সন্তানেরা মুসলমান। উল্টোটাও আছে। একটা ডকুমেন্টারিতে দেখলাম খ্রিস্টান মা তার মুসলমান কন্যার হিফয শুনছে। মেয়েকে মাদরাসায় পৌঁছে দিচ্ছে। তারা বিশ্বকে কী বার্তা দিতে চাচ্ছে, আল্লাহই জানে।
.
আরও অবাক করা ব্যাপার হলো সাবতার প্রধান মসজিদের নাম হলো কাদেরিয়া মসজিদ। আর্কিটেক্টের নাম: হিশাম মুহাম্মাদ আবদুস সালাম। এই একই ব্যক্তি আবার সেখানকার একমাত্র হিন্দু মন্দিরেরও আর্কিটেক্ট। প্রশ্ন জাগে:
= সাবতাবাসীদের মধ্যে এই বিরল মানসিকতা কোত্থেকে এল?
-শরীফ ইদরীসি থেকে!
-তিনি কে?
-তিনি সাবতার প্রাণ!
.
আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ ইদরীসি। তিনি কুরাইশ বংশের মানুষ। সাইয়েদও বটে। বংশধারা আলী রা.-এর সাথে গিয়ে মিশেছে। রাজবংশেরও বটে। গ্রানাডা শাসন করতো ‘হাম্মুদ’ বংশ। তিনি ছিলেন এই পরিবারের সন্তান।
তার জন্ম হয় এই শহরে। ১১০০ সালে। মৃত্যু ১১৬৬ সালে। অসাধারণ প্রতিভাবান মানুষ ছিলেন তিনি। বহু শাস্ত্রে ছিল তার অগাধ পান্ডিত্য। তবে তিনি বেশি বিখ্যাত হয়েছে ‘ভূগোলবিদ’ হিশেবে।
.
এখনকার সিসিলি দ্বীপের শাসক ছিলেন কিং রজার (২য়) । ১০৯৫-১১৫৪। পরম বিদ্যোৎসাহী। জ্ঞানানুরাগী। প্রজাবৎসল। পুরো স্পেনে মুসলিম হত্যাযজ্ঞ চললেও, তিনি একশ ভাগ না হলেও, নিজের স্বার্থে মুসলমানদের প্রতি কিছুটা নমনীয়তা দেখিয়েছিলেন। তার আবেদনের প্রেক্ষিতেই সাবতাও মালীলিয়ার মুসলমানদেরকে বিতাড়িত করা হয়নি।
.
কিং রজারের অনেক দিনের ইচ্ছে, পুরো পৃথিবীর একটা মানচিত্র আঁকানোর। সেটাতে তার সিসিলি রাজ্যও পরিষ্কারভাবে দেখানো হবে। খোঁজ-খবর করে জানতে পারলেন আল-ইদরীসির কথা। দরবারে ডেকে নিয়ে দায়িত্ব দিলেন। ইদরীসি নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করলেন।
.
সেটাই ছিল বিশ্ব-ইতিহাসে সর্বপ্রথম অনেকটা পরিপূর্ণ মানচিত্র। ৭০টা চিত্র সম্বলিত একটা বৃহদায়তন বই রাজাকে উপহার দেন ইদরীসি। ১৬১৯ সালে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয় বইটা। রোম থেকে।
.
এই মানচিত্রের উপর নির্ভর করেই পরবর্তীতে ইউরোপের বিশ্ব অভিযান পরিচালিত হয়। পুর্তগীজরা বিশ্বজয়ে বের হয়। উসমানী খিলাফার বড় বড় জয়ে, আরেক মহান সমুদ্রবিদ পীরি রঈসও এই মানচিত্রের সাহায্য নিয়ে আরও পরিপূর্ণ মানচিত্র আঁকতে সক্ষম হন।
.
এখনকার মানচিত্রগুলোর একটা বৈশিষ্ট্য হলো: তাকালে দেখা যাবে, ইউরোপকে সারা বিশ্বের কেন্দ্রস্থল হিশেবে দেখানো হয়। কিন্তু ইদরীসির মানচিত্রে ‘কা‘বা’ ছিল বিশ্বের কেন্দ্রে।
.
ইদরীসির ঘটনা দেখে কয়েকটা বিষয় পরিষ্কার হয়:
এক: ইউরোপ জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের মুখাপেক্ষী ছিল। পরে আস্তে আস্তে অবস্থা সম্পূর্ণ উল্টে গিয়েছে।
.
দুই: ইউরোপ মুসলিম সভ্যতার জাগতিক দিকের পুরো নির্যাসটা আত্মস্থ করতে সক্ষম হয়েছিল।
.
তিন: ইউরোপ এখনো মুসলিম হামলা আশংকা করে এজন্য আজো জিব্রাল্টার প্রণালী, সাবতা-মালীলিয়া দ্বীপগুলো দখল করে রেখেছে।
.
চার: সাবতার এই সাম্প্রাদায়িক সম্প্রীতি বাহ্যিকভাবে দেখতে যতই চকচকে মনে হোক, ভেতরের অবস্থা অতটা সুখকর নয়। পুরো ইউরোপের মধ্যে সাবতায় বেকারত্বের হার বেশি।
.
পাঁচ: ইউরোপে যেতে হলে মরক্কো দিয়েই যেতে হবে। সোনালী অতীতে উকবা বিন নাফে যেভাবে এগিয়েছিলেন। যায়েদ-মুসা রহ. যেভাবে গিয়েছিলেন। মরক্কোতে অবশ্য মেহনত শুরু হয়েছে। অবশ্য আমার মনে হয়, মরক্কো থেকে ইউরোপে যেতে হলে, বর্তমানের মেহনতকারীরা ইউসুফ বিন তাশাফীনের পরিকল্পনা ধরে অগ্রসর হলে, ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে।
.
ছয়: সাবতার মুসলিম যুবকদের অভিযোগ, তাদেরকে শহরের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পদায়ন করা হয় না। স্পশকাতর অফিস আদালতে চাকরি জোটে না। ভিন্নমতও আছে। এই যুবকরা বেশ কাজে আসতে পারে।
.
পরিশেষে বলা যায়: শরীফ আলইদরীসি রহ. নিজের জন্মভূমিকে, নিজের স্বকীয়তাকে যেভাবে স্বতন্ত্র রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন, এখনকার মুসলিমরা ততোটা পারছে না। তাদের মধ্যে একটা আফিম ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে:
-উদারতার আফিম। সুন্দর সহাবস্থান।
শব্দগুলো শুনতে মজাদার। চটকদার। কিন্তু একজন মুসলমান কখনোই এই আফিমে মজতে পারে না। আমরাও সুন্দর সহাবস্থান চাই। তাই বলে এক পরিবারে কেউ খ্রিস্টান, কেউ হিন্দু, কেউ বৌদ্ধ:এটা মেনে নেয়া যায়? সাবতার অধিবাসীদের মধ্যে একটা স্লোগান জোরালোভাবে চালু করে দেয়া হয়েছে:
= ধর্ম যার যার, দেশ সবার।
কথা সত্য, মতলব খারাপ।
কালিমাতু হাক্কিন উরীদা বিহাল বাতিল (আলি রা.)।





আন্দালুস
আতিক উল্লাহ

আন্দালুস হাতছাড়া হয়েছে ১৪৯২ সালে। অনেক মুসলিম ইতিহাসবিদই মনে করে, ইসলামের ইতিহাসে, আন্দালুস হারানো ইসলামী ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি।
কিন্তু এর চেয়েও বড় ট্রাজেডী ইসলামের ইতিহাসে বিদ্যমান। কাদেসিয়ার ময়দানে সাহাবায়ে কেরাম, পারস্যবাহিনীকে পরাজিত করেন। তারপর থেকে পারস্য ধীরে ধীরে মুসলমানদের অধীনে আসতে থাকে। উমাইয়া খেলাফতকালে পুরো পারস্যই খিলাফাহর অধীনে চলে আসে। আব্বাসী খিলাফতকালেও কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, আগের অবস্থা বিরাজমান থাকে। তারপর আসে, বর্বর মোঙ্গলরা। তাদের অধীনে (১২৫৬-১৫০৮) ইরানের আহলে সুন্নাত শুরুতে নির্যাতনের শিকার হলেও, পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে।
মোঙ্গলদের শাসন ধীরে ধীর দুর্বল হয়ে আসে। এই সুযোগে রক্তপিপাসু শী‘আ ইসমাইল সাফাভী শক্তি সঞ্চয় করে ইরান দখল করে। ১৫০১ সালে। ইসমাইল সাফাভী আহলে সুন্নাতের উপর গণহত্যা চালিয়ে ইরানকে শীআগরিষ্ঠ অঞ্চলে পরিণত করে।
ইসমাইল সাফাভীর আগে, ইরান ছিল শতভাগ সুন্নী মুসলমানের দেশ। ইসমাইল সাফাভী শুরু করে দিয়ে গেছে। আজ খোমেনী-বাশশার-হাসান নাসরুল্লাহরা সে কাজকে সমাপ্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
আন্দালুস হাতছাড়া হওয়ার পর, মুসলমানরা ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে, গণহত্যার শিকার হয়েছে। কিন্তু তার জের বা রেশ এখন আর নেই। ইরানের ক্ষেত্রে বিষয়টা সম্পূর্ণ উল্টো। তারা শুরু থেকেই আহলে সুন্নাতের উপর গণহত্যা চালিয়ে আসছে। আজো ইরাকে, শামে তারা তাদের আক্রোশ চরিতার্থ করেই চলেছে।
আন্দালুস তাবেয়ীগনের বিজিত অঞ্চল।
পারস্য সাহাবায়ে কেরামেরবিজিত অঞ্চল।
দুটির মূল্য এক হতে পারে না।
আজ সময় এসেছে, দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর।
আন্দালুসের পাশাপাশি আমাদেরকে পারস্যউদ্ধারের ফিকিরও করতে হবে। মানচিত্রকে সাহাবা যুগে নিয়ে যেতে হবে।


এক চুমুকে ইতিহাস: ৬৮
আতিক উল্লাহ
---
আন্দালুসের পুরোটাই জয় হয়েছিল মাত্র দুইটা সেনাদলের মাধ্যমে।
প্রথম দল: তারেক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে। সেনাসংখ্যা ছিল ১২ হাজার। এ-স্বল্পসংখ্যক সেনা নিয়েই তারা মধ্য আন্দালুস পর্যন্ত জয় করে ফেলেছিলেন। কর্ডোভা-ইশবীলিয়া-তৎকালীন রাজধানীঃ টলেডোও এর মধ্যে ছিল।
.
দ্বিতীয় দল: মূসা বিন নুসাইর ও তার পুত্র আব্দুল আযীযের নেতৃত্বে বাকি অংশ বিজিত হয়েছিল।
.
প্রতিপক্ষ গথির রাজার সেনাসংখ্যা ছিল লক্ষাধিক। মূসা বিন নুসাইর পুরো ইউরোপ জয় করার ছক কষে ফেলেছিলেন। কিন্তু বিনামেঘে বজ্রাঘাতের মতো এলো, খলীফা ওয়ালিদ বিন আবদুল মালিকের ফরমান:
-বিজয়াভিযান বন্ধ করো। দিমাশকে ফিরে এসো শিঘ্রী।
.
মুসলিম ইতিহাসের এক ট্রাজেডী। মুসা বিন নুসাইর আর মুহাম্মাদ বিন কাসিমকে রাজ্যজয়ের সর্বোচ্চ গতিতে থাকাবস্থায় ডেকে পাঠানোটা।





এক চুমুকে ইতিহাস: ২০৫
আতিক উল্লাহ
ওলীদ বিন আবদুল মালিক রহ. (৭০৫-৭১৫)। উমাইয়া খিলাফাহর ষষ্ঠ খলীফা ছিলেন। তিনি অত্যন্ত সমরকুশলী ছিলেন। একসাথে চারটা সেনাবাহিনী পাঠিয়েছিলেন:
প্রথম বাহিনী: ভারতজয়ের লক্ষ্যে।
দ্বিতীয় বাহিনী: মধ্যএশিয়া জয়ের লক্ষ্যে।
তৃতীয় বাহিনী: আন্দালুস জয়ের লক্ষ্যে।
চতুর্থ বাহিনী: কনস্টান্টিনোপল জয়ের লক্ষ্যে।
প্রায় পুরো বিশ্বের বিরুদ্ধে একাই যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এবং আল্লাহর খাস নুসরতে সফলও হয়েছিলেন। এটাই খিলাফতের বরকত। সারা বিশ্ব এক হলেও কিছুই করতে পারবে না। ইনশাআল্লাহ।














একটি ঝাড়বাতির গল্প শোনো.....
আইনুল হক কাসিমী

গ্রানাডার একজন সম্রাট। তার শাহজাদাকে বিয়ে করাবেন। রাজকীয় আড়ম্বরে, বিয়ের শানাই বাজিয়ে, কোনো ললনাকে পুত্রবধূ বানিয়ে প্রাসাদে তুলবেন। এজন্য হন্যে হয়ে পাত্রী খুঁজে চলছেন। তবে যেনতেন পাত্রী হলে চলবে না; রাজপরিবারের উপযুক্ত হতে হবে। এর জন্য পাত্রীকে অবশ্যই কুরআনে কারিমের হাফেজা হতে হবে। পাশাপাশি হাদিসের জ্ঞান থাকা লাগবে। এরকম কোনো মেয়ে পাওয়া গেলে, সে-ই হবে রাজপরিবারের বউ হবার উপযুক্ত। কিন্তু মুশকিল দেখা দিলো যে, এরকম গুণবতী মেয়ে পাওয়া যাবে কীভাবে! আর কে-ই বা হদিস দেবে এরকম কোনো মেয়ের!
শেষমেশ এক অভিনব পন্থা অবলম্বন করলেন সম্রাট। ঘোষক পাঠিয়ে শাহি এলান করিয়ে দিলেন যে, গ্রানাডা শহরের যে বাড়িতে বিয়ের উপযুক্ত এমন পাত্রী রয়েছে, যে পাত্রী একদিকে পুরো কুরআনের হাফেজা, পাশাপাশি হাদিসেরও জ্ঞান রাখে; সেরকম পাত্রীর অভিভাবকরা যেন রাতের বেলা নিজ নিজ বাড়ির বারান্দার সামনে উজ্জ্বল একটা ঝাড়বাতি টানিয়ে রাখে।
কেবল সুলতানকেই নয়; পুরো গ্রানাডাবাসীকে অবাক করে দিয়ে সে রাতে শহরের প্রায় প্রতিটি বাড়ির বারান্দার সামনে ঝাড়বাতি টানানো হয়েছিল! বুঝা গেল, প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই এমন যুবতী মেয়ে আছে, যে কুরআনের পাক্কা হাফেজা, এবং হাদিসের জ্ঞান রাখে!
এরপর থেকেই গোটা আন্দালুসে এই রেওয়াজ পড়ে গেল, যে বাড়িতেই একজন মেয়ে কুরআনের হাফেজা হতো, রাতের বেলা সে বাড়ির সামনে একটি ঝাড়বাতি টানিয়ে দেওয়া হতো। সন্ধ্যার আঁধার নামতেই যে বাড়ির সামনে দপ করে জ্বলে উঠত ঝাড়বাতি, বুঝা যেত, সে বাড়িতে একজন কুরআনের হাফেজা মেয়ে রয়েছে!
আহ, কোন সে জান্নাত হারালাম আমরা!
এই আন্দালুস, আমাদের হারানো ফিরদাউস!
আবারও কি আসবে ফিরে?
---------
সূত্র: টুইটার


বালাতুশ শুহাদা বেদনার্ত আখ্যান!
আইনুল হক কাসিমী

বালাতুশ শুহাদা। ইসলামি ইতিহাসের এক রক্তস্নাত যুদ্ধের নাম। সাধারণ ইতিহাসে এটি টুরসের যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১১৪ হিজরির পবিত্র রমজানুল মুবারক, ৭৩২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ অক্টোবর, রোজ শনিবার এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুসলিম বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল ৫০ হাজার। খ্রিষ্টান বাহিনী ছিল চারলাখ! মুসলিমদের সেনাপতি ছিলেন আন্দালুসের উমাইয়া গভর্নর, ইসলামি ইতিহাসের অমিততেজা বীর আবদুর রহমান আল গাফিকি। খ্রিষ্টানদের সেনাপতি ছিলেন শার্ল মার্তেল। আরবিতে 'বালাত' অর্থ প্রাসাদ। 'শুহাদা' শব্দটি 'শহিদ' এর বহুবচন। এ যুদ্ধে মুসলমানদের এত লাশ পড়েছিল যে, এগুলোকে একত্রিত করলে একটি প্রাসাদ হয়ে যেত! কারও কারও মতে, সে প্রান্তরে একটি পাকা রাস্তা ছিল বলে, এ-কে বালাতুশ শুহাদা যুদ্ধ বলা হয়।
চার্লসের পর্বতসম বাহিনীর কিছু ছিল ঘোড়সওয়ার আর কিছু ছিল পদাতিক। এদের শরীরে ছিল নেকড়ের পোশাক। ঘাড় পর্যন্ত লম্বিত চুল। যা জট পাকানো ছিল। এদের ভাবমূর্তি দেখলেই পিলে চমকে যাবার মতো ছিল! চার্লস লয়ার নদী পার হয়ে, নদীকে পেছনে রেখে অবস্থান নিলেন। যুদ্ধের প্রথম আটদিন উভয়পক্ষে হালকা সংঘর্ষ হয়। এতে মুসলমানদের পাল্লা ভারি ছিল। কিন্তু নবম দিনে সংঘটিত হয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। দিনভর যুদ্ধ চলে। অবশেষে রাতের আঁধার নেমে এল। এবারও মুসলমানদের পাল্লা ভারি ছিল। দু'পক্ষ পৃথক হয়ে গেল। আরও একটু সময় যুদ্ধ স্থায়ী হলে মুসলমানরাই জেতার সমূহ সম্ভাবনা ছিল।
পরদিন শনিবার। যুদ্ধের দশম দিন। আবারও যুদ্ধ শুরু হলো। বিজয় মুসলমানদের পদচুম্বন করতে যাবে, ঠিক তখনই শোরগোল উঠল যে, গনিমতের মালসহ মুসলমানদের সেনাছাউনি বিপদের সম্মুখীন! দুশমনেরা সেখানে হামলা করেছে! এতে দুর্বলচিত্তের বার্বারি মুসলিম সেনারা গনিমতের মাল রক্ষার্থে ময়দান ছেড়ে ছাউনি অভিমুখে ছুটল। মুসলিম বাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়ে গেল। আবদুর রহমান আল-গাফিকি সেনাদের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সব প্রচেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এতক্ষণে মুসলিম বাহিনীর অবস্থা একেবারে শোচনীয় আকার ধারণ করেছে। বীরের মতো লড়াই করে যেতে লাগলেন গাফিকি। তবুও অস্ত্র সমর্পণ করতে রাজি নন তিনি। হঠাৎ করে শাঁ করে এসে দুশমনের একটা তীর তাঁর গায়ে বিদ্ধ হয়। ঘোড়ার পিঠ থেকে তিনি ছিটকে পড়েন। সেখানেই শাহাদাত বরণ করেন।
দুটি বিপদের সম্মুখীন হয় মুসলিম বাহিনী। এক. নিজেদের বিশৃঙ্খলা। দুই.সেনাপতির শাহাদাত। ব্যস, তাদের মনোবল ভেঙে যায়। এই সুযোগে খ্রিষ্টান বাহিনী হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। মুসলমানদের লাশের পর লাশ ফেলে সামনে এগোতে থাকে। তবে এত বিপদের মধ্যেও কিছু দৃঢ়চিত্তের মুজাহিদ নিজেদের তরবারির নৈপুণ্য দেখান। চরম বিপদের মুহূর্তেও মুসলমানদের বাহুবল কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারে খ্রিষ্টানরা। একসময় রাতের অন্ধকার নেমে আসে। উভয়পক্ষ ছাউনিতে ফিরে যায়।
মুসলিম বাহিনী ছাউনিতে পৌঁছে একে অন্যের ওপর দোষারোপ করতে লাগল। এমনকি একে অন্যের দিকে হাতিয়ার পর্যন্ত উঠিয়ে নিল! ফরাসিদের ওপর এখন বিজয়ের আশা সম্পূর্ণ দুরাশায় পরিণত হলো। এখন নিরাপদে সরে পড়াই একমাত্র বিকল্প রাস্তা। তাই সে রাতের অাঁধারেই মুসলিম বাহিনী সেপটিমানিয়ার দিকে পথ ধরল।
সকাল হলে মুসলিম ছাউনিতে সব চুপচাপ দেখে চার্লস ও তার মিত্র ইউডিস মুসলমানদের কোনো নতুন কৌশল মনে করে সন্দিহান হয়ে পড়লেন। তারা সন্তর্পণে জানতে পারলেন যে, মুসলিম বাহিনী সরে গেছে, আর কিছু আহত সাথিদের ফেলে রেখে গেছে সেখানে। কালবিলম্ব না করে তারা মুসলিম বাহিনীর ছাউনিতে পৌঁছে আহত সেনাদের হত্যা করে ছাড়ে। এভাবেই সমাপ্তি ঘটে বালাতুশ শুহাদা যুদ্ধের!
ফ্রান্সের কলিজায় সংঘটিত 'বালাতুশ শুহাদা' যুদ্ধে অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় আন্দালুসের আরব ও বার্বারি মুসলিম বাহিনী। কিন্তু সে যুদ্ধে মুসলমানরা জিতলে কী হতো? জানেন না? তাহলে শুনুন-
বালাতুশ শুহাদা যুদ্ধে মুসলমানরা জিতলে আজ ইউরোপের ইতিহাস ভিন্নভাবে রচিত হতো। ইউরোপিয়ান ঐতিহাসিক গিবন ও লেনপুলদের মতে, সে যুদ্ধে মুসলমানরা জিতলে প্যারিস ও লন্ডনে, ক্যাথলিক গির্জার পরিবর্তে গড়ে উঠত মসজিদ। অক্সফোর্ড ও অন্যান্য শিক্ষাকেন্দ্রে বাইবেলের পরিবর্তে শোনা যেত কুরআনের বাণী!
পুনশ্চ: টুরস ফ্রান্সের বেশ বড়সড় একটি শহর। ফ্রান্সে যাওয়ার পথে এ শহরটা। ফ্রান্সের সীমান্ত থেকে প্রায় পাঁচশ কিলোমিটার দূরে।
পুনঃপুনশ্চ: পিকচারে দৃশ্যমান হাজার হাজার মুসলিম মুজাহিদের রক্তস্নাত প্রান্তরেই সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক বালাতুশ শুহাদা বা টুরসের যুদ্ধ। যা আজও নীরবে মাতম করে যায়!
---------
সূত্রাবলি:
১- فجر الأندلس-২২৭, ড. হুসাইন মুআন্নিস
২- التاريخ الأندلسي-১৯৭, ড. আবদুর রহমান আল-হাজি
৩- بلاط الشهداء-৪৪, শাওকি আবু খলিল

No comments:

Post a Comment