Tuesday, March 3, 2020

লেখা সংকলন ২ (দ্বিতীয় অংশ)





জাহেলিয়্যাত
মিসবাহ মাহিন

ঢাকা কিংবা বড়ো শহরগুলোতে অবিবাহিত ব্যাচেলর পুরুষদের (ক্ষেত্র বিশেষে ব্যাচেলর মহিলারাও) মত দু:খে বোধ করি আর কেউ নেই। "ব্যাচেলরদের কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে চায় না"। ছেলেদের দাঁড়ি একটু বড় (এক মুষ্ঠি বা এর কাছাকাছি) থাকলে পটেনশিয়াল জঙ্গী, চাপদাঁড়ি থাকলে গাঁজাখোর বা ইয়াবা ব্যবসার ঢাকা শাখার নির্বাহী কর্মকর্তা অথবা ক্লিন শেইভড হলে মেয়েবাজ হিসেবে আগে থেকেই ধরে নেওয়া হয়।
.
এর সাথে তুলনা করলে "চাকুরীজীবি মহিলা অথবা ছোটো পরিবারের চাকুরীজীবী স্বামী- স্ত্রীর জন্যে ফ্ল্যাট ভাড়া" নামক একাধিক লিফলেট চোখে পড়বেই। এদের সাবলেটেও বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়। ব্যাচেলর মহিলারা স্বভাবতই কিছু ক্ষেত্রে নারী কৌটায় উৎরে যায়। এর প্রধান কারণ ছেলেরা নোংরা আর অগোছালো। বাড়ি ভাড়ার সময় বেশ ছিমছাম ঘর লিটারেলি ব্যবহৃত পায়ের মৌজা, র‍্যাক, জুতোজোড়া, পত্রিকা সব কিছু এলোমেলো করে বাসাটা ছাড়ে। এদিক দিয়ে বিবি হাওয়ার বেটিরা বেশ গুছানো।

সমাধান কিভাবে? বিবাহিত দম্পতিদের বাড়িওয়ালারা বাড়িভাড়া দিতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তাহলে ঢাকায় পড়তে কিংবা জব করতে আসা ছেলেগুলোকে বিয়ে দিয়ে দাও। বেকার/ মাত্র এ ক'টা টাকার জব ইত্যাদি অযুহাতে আবার বিয়েও দেবে না।
.
আর বিভিন্ন এনজিও থেকে শুরু করে বাইরের অনেকে ফান্ডিং করে যাচ্ছে দেশে যাতে বাল্যবিবাহ না হয়। অথচ নাইনথ গ্রেইডে পড়া মেয়েটা এর মধ্যে সকলের অজান্তে একবার কাঁচি- ছুড়ির নিচে গিয়ে নিজের ভেতর বেড়ে ওঠা ফিটাসটাকে ডাস্টবিনে ফেলে আসার সমস্ত বন্দোবস্ত করে এসেছে। তারপরেও হেইটার্সরা বলবে "These girls are still toddler enough to get hitched!"

আঠারো পার হবার পরে বিয়ে দিতে গেলেও নতুন ড্রামা। এখন নাকি পড়াশুনার বয়েস। আগে পাশ কর, ক্যারিয়ার গড়ো। তারপর, বরের সমানে সমান হয়ে বিয়ে করো।

ক্যারিয়ার পেয়ে সংসারের আমীর মানার জন্যে আর স্বামী কে। অফিসে বস কে মানতে পারে অথচ সংসারের আমীর কে মানা যায় না। এই হলো শিক্ষার নগদ ফল।

তাই ইয়াং জেনারেইশান এত্ত এত্ত "প্যারা" নিতে চায় না। এই যে ফ্রেন্ডস উইথ বেনিফিটস। ব্যাচেলর বাড়ি ভাড়া দেবে না। সমস্যা নেই। দু'জন জাস্ট ফ্রেন্ড অথবা বয়ফ্রেন্ড- গার্লফ্রেন্ড একসাথে স্বামী - স্ত্রীর ভান ধরে হাত ধরে এক বাসায় উঠে পড়ছে। কেউ বলছে লিভ টুগেদার, কেউ বলছে একে অপরকে জানতে একটু সময় নিচ্ছে, আবার কেউ বলছে এগুলো অত সিরিয়াস কিছু না - অল্প বয়েসের দুষ্টুমি।
বেশ চমৎকার একটা সোসাইটি আমরা বানিয়েছি। এই পিরামিডের সবচেয়ে উপরে আছে ডলার, বিয়ার, ওয়াইন, বার, এন্টারটেইনমেন্টের যাবতীয় ইলেমেন্টস আর সবার নিচে আছে সচ্চরিত, ইথিক্স, ধর্ম।
সহীহ বুট লিকার
হানিফ বিন সোহরাব

মাদখালী ও আহলে সৌদরা নিজেদেরকে পারফেক্ট সালাফী হিসেবে উপস্থাপন করে। তারা মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব (রাহি)-এর আকিদা ও ইবনে তাইমিয়্যা (রাহি.)-এর ফতোয়া গুলোর দিকে সবচেয়ে বেশি মনযোগ দেয়। এই এরাই উনাদের কাছ থেকে জ্বিহাদের মাসয়ালা গুলো নেয় না। তখন আবার বংশ পরম্পরায় প্রাপ্ত বাপ দাদাদের ঐতিহ্য মতো চাটুকার হয়ে যায়। সৌদ রাজ পরিবারের খাস দালাল হয়ে যায়।
.
এরা খারেজীদের বিপক্ষের হাদিস ও সালাফদের বক্তব্য গুলো মুজাহিদদের বিপক্ষে চালিয়ে দেয়। এরা মানুষকে ধোঁকা দেয় এই বলে যে “আলেম”দের কথা ছাড়া কিচ্ছু মানা যাবে নাএই “আলেম” বলতে তারা মাত্র ১৫-২০ জনকে বুঝায়। এর বাহিরের কেউ নাকি আলেম না।
.
ওদের ধোঁকা গুলো অনেক সুক্ষ্ম। তাই নতুন দ্বীনে আসা অনেকেই মনে করে এটাই বুঝি সালাফদের পথ। ওদেরকে চেনার সহজ কিছু উপায়—
১. ওরা আলেমদের সোহবতে থাকতে বলে (সত্যিকারার্থেই দ্বীন শিখার সর্বোত্তম মাধ্যম এটা)। তবে আলেম বলতে মাত্র ১৫-২০ জনকে বুঝায়। এরা কখনো এর বাহিরে যায় না। দুনিয়ার লক্ষ লক্ষ আলেমের কোন মূল্য নেই।
.
২. এরা বই পড়ার কথা বলবে অনেক। তবে সেটাও নির্দিষ্ট করে দিবে।
.
৩. এরা সারাজীবন মাক্কী সূরা গুলোর তাফসীর করে যাবে। এদের আলোচনায় মাদানী সূরা গুলো তেমন পাবেন না।
.
৪. সৌদ বংশের খাটি বুট লিকার এরা। কখনোই ওরা সৌদ বংশের দোষ গুলো দেখে না। আপনি দেখিয়ে দিলে আপনাকে পার্সোনাল এ্যটাক করবে।
.
৫. এদের আলেমরা অধিকাংশই দরবারী। তাদের এই ১৫-২০ জন ছাড়া সারা পৃথিবীর বাকীরা হয় খারেজী নয় বিদআতী অথবা অজ্ঞ
-
এদের মিষ্টি কথা ও সহীহ আক্বিদার কথা শুনে বিভ্রান্ত হবেন না যেন। এদের ফাঁদে পা দিলে আক্বিদা সহীহ না হলেও সহীহ দালালী বা সহীহ বুট লিকিং শিখতে পারবেন।
আরেকটা বিষয় হলো ওরা আদব আখলাকের কথা প্রচুর বলে। তবে ওদের আসল চেহারা দেখা যায় ওদের বিপক্ষে কিছু বললে ও ভিন্ন মত পোষণ করলে।


ইসলাম বিকৃতিকারী নব্য ফিৎনার নাম হেযবুত তাওহীদ

আলি আযম

কিয়ামত অতি নিকট এতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রকাশ আছে কিয়ামতের আগে মুসলিমরা বহুদলে বিভক্ত হয়ে পড়বে। এবং দিনেদিনে এই বিভক্তি ক্রমান্বয়ে বাড়তেই থাকবে। নিত্যনতুন ভয়াবহ ফিরকার আবির্ভাব ঘটবে। তারা নিজেদের খাটি মুসলমান দাবি করবে। অন্যদের বাতিল, কাফির, মুশরিক ইত্যাদি নামে অবহিত করবে। অথচ বাস্তবে তারা নিজেরাই ধর্মের নাম নিয়ে অধর্মের কাজ করবে। কোরআন,হাদীসের ভাষ্যমতে কিয়ামতের বেশকিছু আলামত রয়েছে। তার মধ্যে ফিরকাবৃত্তিটাও অন্যতম। সে ফিরকাবৃত্তিটা গুরুতরভাবে চলছে এখন। দেশেদেশে ইসলাম নামধারী অসংখ্য ফিরকার সয়লাব।
প্রকাশ আছে কিয়ামতের আগে ইসলাম তেহাত্তর দলে বিভক্ত হবে। সেখান থেকে শুধু একটিমাত্র দল জান্নাতি ।বাকিসব জাহান্নামি হবে। অথচ বর্তমানে ইসলাম কতো দলে বিভক্ত আল্লাহ ভালো জানেন। হাদিসের ভাষ্যমতে কিয়ামতের আগে ঈমান নিয়ে বেঁচে থাকা এতো কঠিন হবে, যতো কঠিন জ্বলন্ত আগুনের কয়লা হাতে রাখা । সেই সময়টাও আমাদের সামনে উপস্থিত। চারিদিকে ফিৎনার সয়লাব। বেশিরভাগ ফিৎনা ধর্মীয় মোড়কেই আত্মপ্রকাশ করছে।সেই ধারাবাহিতায় হেযবুত তাওহীদ নামের নব্য আরেক ফিৎনা আমাদের সামনে উপস্থিত। যা দিনদিন লাগামহীনভাবে বিস্তার লাভ করছে সর্বত্র।
এই ফিরকার বেশকিছু হাস্যকর বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তারা ইসলামকে অন্যভাবে প্রকাশ করতে মরিয়া। এই দলে রয়েছেন একজন এমাম (ইমাম)। তারা ইসলাম লিখে না। লিখে "এসলাম"। অর্থাৎ ধর্মীয় পরিভাষাগুলোকে এভাবে বিকৃত করে। একবার তাদের এক কর্মীকে শব্দ বিভ্রাট নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। বলেছিলাম আপনারা এভাবে এমাম, এসলাম, হেযবুত ইত্যাদি শব্দগুলোকে বিকৃতভাবে লিখেন কেনো? তিনি আমাকে কোথাকার এক বাংলা সাহিত্যিকের বরাত দিয়ে বললেন, বাংলা সাহিত্য অনুযায়ী নাকি শব্দগুলোকে এভাবে লিখতে হবে। অর্থাৎ সহীহভাবে লিখা যাবেনা। আজীব ব্যাপার!
তাকে অনেক বুঝালাম। বললাম ভাই আমি কোথাকার কোন সাহিত্যিকের কথাকে অগ্রাধিকার দিবো কেনো? আমি মুসলিম। আমার ভাষা হবে ধর্ম অনুযায়ী। অশুদ্ধ উচ্চারণ কেনো প্রচার করবো? তিনি তা মানতে নারাজ। কারণ ব্রেন ওয়াশ। তারা বলে ইসলাম দাড়ি, টুপি কিম্বা পাঞ্জাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। অন্তরে ঈমান থাকলে হয় । আচ্ছা, দাড়ি, টুপি, পাঞ্জাবি এসব মুসলিমের বাহ্যিক পরিচয় নয় কি? নাকি বিধর্মীদের কালচার? যদি বলেন মুসলিম হবার বাহ্যিক প্রমাণ।তাহলে প্রশ্ন থাকবে কেনো আপনাকে বাহ্যিক পরিচিতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে হবে? এটা তো সুবিধাবাদী চিন্তাধারা। মুনাফিক হবার লক্ষণ।
মুসলিম হবার বাহ্যিক কিছু পরিচিতি আছে। যেমনটা আছে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান কিম্বা অন্য ধর্মাবলম্বী হবার। তাহলে আপনি সে পরিচিতিকে এড়িয়ে চলবেন কেনো? কারণ হলো, আপনি যখন বলবেন, ইসলাম দেখানোর জিনিষ নয়। মানার জিনিষ। (যদিও আপনি মানলেন না) তখন আপনি হয়ে যাবেন নিরাপদ। অর্থাৎ আপনার কোনো শত্রু থাকবে না। বামপন্থী সরকার ও ভিনদেশী ইসলাম বিদ্বেষীরা আপনার পিছু নিবে না। আপনাকে টার্গেট করবেনা। বরং বাহবা দিবে। কারণ তারাও চায়, আপনি নামধারী মুসলিম হোন। মুখে মুসলিম পরিচয় দিলেও কাজেকর্মে অমুসলিমদের অনুসরণ করুন।
ইসলাম বিদ্বেষীরা এটা ভালো করে জানে যে, নামধারী মুসলিমে গোটা দুনিয়া ভরে গেলেও ইসলাম বিদ্বেষীদের কোনো সমস্যা নেই।বরং তাদের স্বার্থ উদ্ধার করা সহজ হবে। তাই তারা বর্তমানে দেশেদেশে মোডারেট মুসলিম তৈরির কাজ ভালোই এগিয়ে নিচ্ছে। সেই মোডারেটরা কখনো বলে জিহাদের নামে মানুষ হত্যা ইসলাম সমর্থন করে না। দাড়ি, টুপি, পাঞ্জাবির মধ্যে ইসলাম সীমাবদ্ধ নয়। নারীদের পর্দায় আবদ্ধ রাখার কথা ইসলাম বলে না ইত্যাদি.. এসব কথা যারা বলে তারা আসলে মুসলিম নাকি অন্যকিছু তা বলার প্রশ্ন রাখে না। আর সে কাজই বাধাহীনভাবে করে যাচ্ছে হেযবুত তাওহীদ নামধারীরা।
এই সংগঠনটির প্রধান যিনি তার মুখে সুন্নতি দাড়ি নেই। সিগারেট খেতে দেখা যায় প্রায়। আর যিনি এমাম তিনি স্পষ্ট দাড়ির বিরোধিতা করতেও তার এক লেকচারে শুনেছিলাম।তিনি জোর গলায় বলেছিলেন "আমি দাড়ি রাখবো না"।তাকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় বেপর্দা বেগানা নারিদের সামনে লেকচার দিতেও দেখা যায়। লুতুপুতু নারীদের গা-ঘেঁষা তার কিছু ছবিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল। জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় তাদের ভূমিকা নাকি উল্লেখযোগ্য। বয্রশক্তি নাকি কী নামে যেন তাদের একটা পত্রিকাও আছে। যার প্রচার করে যুবতি নারীরাই। তাদের কিছু এক্টিভ কর্মী আছে।
রাজধানী এবং উত্তরবঙ্গের বেশকিছু জায়গাতে তাদের অপতৎপরতা উল্লেখযোগ্য। সাধারণত ধর্মীয় জ্ঞানহীন ব্যক্তিদের তারা টার্গেট করে। তাদের টার্গেটে নারীরা প্রথমে। কারণ অশিক্ষিত ও নারীদের সহজে ব্রেন ওয়াশ করা যায়। তাদের এক্টিভ কর্মীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেবুতে রাতদিন তাদের তৎপরতা প্রচার করেই যাচ্ছে। তারা সবখানে সঙ্ঘবদ্ধ।কেউ তাদের বিরোধিতা করে ফেবুতে কিছু লিখলে সিক্রেট গ্রুপে তা শেয়ার করে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে পোস্টকারীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।ধর্মের নামে তাদের মনগড়া প্রচার দিনদিন বেড়েই চলেছে। এখনি সময় তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার।










লাব্বাইক
মোহাম্মদ তোয়াহা আকবর

পৃথিবী ঘুরছে। নিজের অক্ষে। এবং সূর্যের চারপাশে।
চাঁদ ঘুরছে। পৃথিবীর চারিদিকে, একইসাথে নিজের অক্ষেও।
সূর্যও ঘুরছে, সাঁতরাচ্ছে নিজের কক্ষপথে। ছায়াপথে।
সাঁতরে বেড়াচ্ছে অন্যান্য গ্রহগুলো। একইভাবে।
কীভাবে? কোনদিকে?
একইভাবে, ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে।
এন্টিক্লকওয়াইজ।
এ এক মহাজাগতিক ঘূর্ণণ। কসমিক রোটেশান। মহাপরাক্রমশালীর বেঁধে দেয়া নিয়মে বাঁধা পড়ে ঘুরতে থাকা। স্বেচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়। সমর্পিত।
অতএব, সিজদারত।
কিছু মানুষ স্বেচ্ছায় নিজেকে মালিকের দেয়া নিয়মে বেঁধে ফেলে। এ বাঁধন মুক্তির। অজস্র মালিকের দাসত্বকে পায়ে দলে, পিষে সত্য মালিকের সামনে নিজের মূল্যবান মাথা, কপাল, মুখমন্ডলকে লুটিয়ে দেয়। তথা (মাথার) চিন্তা, (ললাটের) ভাগ্য, (মুখের) ইমেইজসহ যাবতীয় ইন্দ্রিয়সমূহকে মহামহিমের ইচ্ছার কাছে সমর্পিত করে দেয়। রত হয় সিজদায়।
এই বাঁধনের ধারাবাহিকতায় সে নিজেকে সঁপে দিতে থাকে অবিরাম। অবিরত। সবকিছুতে। প্রতিটা নিঃশ্বাসে। বিশ্বাসে। মহাজাগতিক মহাযাত্রায় সে একই সমান্তরালে হাঁটতে থাকে।
হাঁটতে হাঁটতে একসময় ডাক আসে। মেহমান হবার ডাক। আল-খালিক, আল-ওয়াদুদের ভালবাসাময় মহানিমন্ত্রণ।
যাবতীয় ভ্রান্তিময় রংচঙা পরিচয়ের লিবাস ফেলে দিয়ে গায়ে তুলে নেয় সাদাকে। পরিচয়ের নানান রঙের বাহারী পোশাক-পরিচয় ছুঁড়ে ফেলে সে সব রঙের সামগ্রিকতাকে স্বীকার করে নেয়। সব রঙের সামষ্টিকতা, অখন্ডতার সাদাকে সে জড়িয়ে নেয় শরীরে। মননে। আত্মায়। অন্তরে। সব খন্ড খন্ড রঙের খন্ডিত পরিচয় মুছে যায়। এক সুবিশাল মহাজাগতিক সাগরের স্রোতে মিশে যায় সে। একটা ছোট্ট ফোঁটা হিসেবে। বিশাল দেহের কোষ হয়ে। উম্মাহর অংশ হয়ে। পরিচয়হীন।
নিজের ইচ্ছে, গতির সবটুকু বিলীন হয়ে যায়। মহাজাগতিক ঘূর্ণণের সাথে তার ঘূর্ণণ মিলে মিশে এক হয়ে যায়। হয়ে যায় অখন্ড। কসমিক সাদা স্রোতের অংশ হয়ে সেও ঘুরতে থাকে। এন্টিক্লকওয়াইজ। ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে। সৃষ্ট সব রঙের সমষ্টি সাদা হয়ে, রঙের অনুপস্থিতি কালোকে ঘিরে।
কন্ঠ চিরে কান্নাভেজা শব্দমালা আছড়ে পড়ে কৃষ্ণ ঘনকের চারপাশে। নিজের উপস্থিতি জানান দেয় বিনয়ে, গলে গলে। সব মিথ্যে পরিচয়ের অহং আর আমিত্বকে ছুঁড়ে ফেলে, উম্মাহ নামক পরিচয়বাহী দেহের প্রতিটা কোষ উপস্থিতির ঘোষণা দেয় এমন এক বাক্যে, যে বাক্যে "আমি" নামক শব্দটার উল্লেখ নেই, ফলে, "আমিত্ব" নেই।
"এসেছি, উপস্থিত হয়েছি আপনার কাছে"
"লাব্বাইক"





















শারীরিক শিক্ষা
শরীফ আল হুসাইন

২০১৪ সালে একটা প্রাইভেট স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছিলাম।
ইংলিশের ক্লাস টিচার ছিলাম। কিন্তু শিক্ষক স্বল্পতা আর শিক্ষকদের গাফলতির কারণে প্রায়ই অন্যান্য বিষয়ে প্রক্সি ক্লাস নিতে হতো।
.
সেই সুবাদে একদিন ৮ম আর ৯ম শ্রেণীর "শারীরিক শিক্ষা" ক্লাস নিতে বলা হলো। এই সাবজেক্ট সম্পর্কে আমার আগেই কিছুটা ধারণা হয়েছিলো অন্য টিচারদের থেকে।
কোনো এক কারণে কেউই এই ক্লাস নিতে চাইতেন না। সেটা পরে বুঝতে পরে বুঝতে পেরেছি।
.
তো টিফিনের পর ৯ম শ্রেণীর কক্ষে ঢুকলাম। ছেলে-মেয়ে কম্বাইন্ড ক্লাস।
ক্লাস নাইনের ছেলে মেয়ে। বুঝতেই তো পারছেন।
.
আমার ক্লাসে যথাসম্ভব চোখ নামিয়ে ক্লাস নেয়ার চেষ্টা করি।
তার উপর এখন যে 'সাবজেক্ট' নিতে আসলাম, তা দেখে কেউ কেউ নিজেরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে।
কেউ কেউ ভাবছিলো, হয়তো অন্য কোনো ক্লাস নেবো। কিন্তু যখন বই চাইলাম, অবাক হয়ে গেলো।
.
বই হাতে নিয়ে যে অধ্যায় পড়াতে হবে সেটাতে একটু চোখ বুলিয়ে নিলাম। দেখে ভয় ভয় লাগছিলো। এসব কিভাবে পড়াবো?
.
পড়াতে শুরু করলাম। একটু পড়াতেই সেক্সুয়াল বিষয়াদি চলে আসলো।
এমন এমন বিষয়, যেগুলো ছেলেদের পড়াতে গেলেই লজ্জা লাগবে।
আর রুমে তো ছেলেমেয়ে উভয়েই আছে। তাই ওই পর্যন্তই থেমে গেলাম।
.
চালাকি করে কথা ঘুরিয়ে নিয়ে, উদাহরণ দেয়ার বাহানায় একটা গল্প বলা শুরু করলাম। মাঝে মাঝে গল্প থেকে শিক্ষাগুলো তুলে ধরতে লাগলাম। যাতে গল্পটা লম্বা হয়। সময় শেষ হয়। গল্পটা ছিলো 'বারসিসার গল্প'
.
ঘণ্টা পরার সাথে সাথে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।
প্রিন্সিপালকে বললাম, "স্যার, আমার শরীরটা ভালো না। মাথা ধরেছে। ছুটি দিলে ভালো হয়।'
আসলেই শরীর ভালো ছিলো না, সকাল থেকেই মাথা ব্যাথা করছিলো।
আমি ছুটি কম নিতাম, তাই অসুস্থ হওয়ার স্যার ছুটি দিতে বাধ্য হলেন।
৮ম শ্রেণীর ক্লাস নিতে আর যাওয়া লাগলো না।
.
যাহোক, চোখের হেফাযত আর নানা কারণে সাড়ে চার মাস পর স্কুলটা ছাড়তে হয়েছিলো। রমজানের আগের দিন ইত্তফা দিয়েছিলাম।
------------------------------------
স্কুলে 'শারীরিক শিক্ষা' নামে যা পড়ানো হচ্ছে, তা মূলত সুক্ষ যৌন সুড়সুড়ি ছাড়া কিছুই না। ছেলে মেয়ে এক সাথে করে, তাদের মাঝে স্বাভাবিক 'লজ্জাবোধ' ভেঙ্গে দিয়ে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে দেয়াই এই সুড়সুড়ির মূল উদ্দেশ্য।
যৌন শিক্ষার প্রয়োজন হলে, পুরুষ শিক্ষকরা ছেলেদের আর মহিলা শিক্ষিকারা মেয়েদের দেবে। কিন্তু সবাইকে এক সাথে করে এসব করতে হবে কেন?
তাও এমন এমন বিষয়, যেগুলো পুরুষরা পুরুষদের সামনে আর মেয়েরা মেয়েদের সামনে বলতেও লজ্জাবোধ করে।
সহশিক্ষার কুফলের সাথে এরকম আরো কিছু যোগ করা হলো আগুনে ঘি ঢালার মত।
.
সাবজেক্টটা এখনো অমনই আছে কিনা জানিনা।
তো আপনার ছোট ছোট ভাই-বোন, সন্তানদের কোথায় পড়াবেন, ভেবেছেন কি?


















সাহাবাদের বিরোধিতা ইসলামের বিরোধিতার শামিল
ইবনু মাযহার

তোমার মধ্যে যদি সাহাবাদের ব্যাপারে কোনরূপ মন্দ ধারণা ঢুকিয়ে দেয়া যায়, তাহলে তুমি আর কখনোই হাদিসে বিশ্বাস করে উঠতে পারবে না। তুমি যদি ভাবতে থাকো, সাহাবারাও আমাদের মত ভালো-মন্দ মিশানো মানুষ, তুমি আর সুন্নাহ মানতে পারবে না। কারণ এই হাদিস, এই সুন্নাহ এগুলো সাহাবাদের মাধ্যমেই সংরক্ষিত হয়েছে।
.
.
তুমি যদি সাহাবাদের সমালোচনাকে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দাও, তবে তুমি কুরআনকেও আল্লাহর বানী হিসেবে অস্বীকার করার পথ খুলে দিলে। কারণ এখন আমরা যে কুরআনের মুসাহাফাটি দেখি, এটা সাহাবাদের মাধ্যমেই সংরক্ষণ করা হয়েছে। এই কুরআনের প্রতি বিশ্বাস উঠে যাবার পথ খুলে দিও না। ইসলাম কেবল অন্যান্য কুফরি ধর্মগুলোর মত নৃতাত্ত্বিক ধর্মে পরিণত হবে কতকের জন্য, যেমনটা ইহুদী-নাসারাদের ক্ষেত্রে হয়েছে, যদি এমন করো।
.
.
তখন সাহাবদের ইসলাম আর ভালো লাগবে না। তাদের খিলাফাহ 'আলা মিনহাজুন নবুয়াহ ভালো লাগবে না। বরং ভালো লাগবে গণতন্ত্র, খিলাফাহ কায়েম হলেও, সেখানে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা জারি থাকবে, এমন সব কথা মুখ থেকে বের হয়ে আসবে। তখন সাহাবাদের করা হুদুদ, যেমন রজম, মুরতাদের মৃত্যুদন্ড আর ভালোলাগবে না। কুফফারদের বিরুদ্ধে ক্বিতালকে ভালো লাগবে না, জিহাদ মনে হবে না। জিহাদ মনে হবে শুধু ইনা নামক রিবাহ-কে! তোমরা কি এর উদাহরণ দেখো না? কারা বলে বাদ্য হালাল? কারা বলে ইসলামে রজম নেই, মুরতাদের শাস্তি মৃত্যু দন্ড নেই, কারা বলে এসব, তোমরা কি দেখো না? তারা কি আল্লাহ, তাঁর রাসূল (সা) এবং তার সাহাবাদের দ্বীন ইসলামকে ভালোবাসে? নাকি তাদের কথিত রাবাঈ, ফাদারদের দ্বীন আদ-দুনিয়াকে ভালোবাসে?
.
.
একজন মু'মিন এসব সহ্য করতে পারে না। তার লাগে, খুব লাগে। তার অন্তরটা জ্বলে-পুঁড়ে ছাড়-খাড় হয়ে যায়। আর যারা এই ক্ষতে লবণ লাগাতে আসবে, তারাও জ্বলে-পুঁড়ে ছাড়-খাড় হয়ে যাবে, বি'ইযানিল্লাহ...


স্যেকুলাদের কথিত লিবারেলিসম ইসলামে ঢুকাইতে আইসেন না
ইবনু মাযহার

আমাদের উপকারী ইলমের জন্য দুয়া করতে বলা হয়েছে। অথচ আমরা এখন উপকারী ইলম বাদ দিয়ে মিথ্যাচারের ভরপুর ইতিহাসগুলো বইয়ে মলাটবদ্ধ করে আম জনতার হাতে তুলে দিচ্ছি, আর বলছি এটাই নাকি বইয়ের স্বার্থকতা! এখানে জাস্ট মতগুলো তুলে ধরা হয়েছে!
.
.
একটু ক্ষ্যেমা দেন প্লিস! স্যেকুলাদের কথিত লিবারেলিসম ইসলামে ঢুকাইতে আইসেন না। পশ্চিমা কুফফাররা কত্ত লিবারেলি ভিন্নমতের বই পড়ে, অসহণশীল হয় না, আর আমরা খুব অসহণশীল, এসব শুনাইতে আইসেন না। পারলে আপনার পশ্চিমাদের ইবনু তাইমিয়ার বই আগা গোড়া পারলে পড়াইতে পারেন কিনা দেখেন, দেখবেন কত ধানে কত চাল।
.
.
মুবতাদিরা সুস্পষ্ট বিদা’তী আক্বীদার প্রচলনকে ভালোভাবেই নিবে। ভিন্নমত বলে জায়িজ করা চেষ্টা করবে। বাট ইসলাম ইস নট লিবারেল সেকুলার ড্যেমক্রেসি'স ফ্রিডম অব স্পীচ। কুফফারদের সহণশীলতার তুলনা দিতে আইসেন না। আপনাদের নিজেদেরটা তুললে আপনারা যে কত অসহণশীল সেটার ফিরিস্তি লিখে শেষ করা যাবে না। তাই বলি একটু ক্ষ্যেমা দেন।
.
.
কার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কি, এটা মোটামুটি এখন ওপেন সিক্রেট। কারা এ যামানায় রজম অস্বীকার করে, মুরতাদের শাস্তি অস্বীকার করে, ইনা নামক রিবাহকে ইসলাম কায়েমের মূল হাতিয়াড় বলে প্রচার করে, আর ক্বিতাল মা' আল-কুফফারকে অপছন্দ করে, এগুলোও দিন দিন স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কারা মুশরিকদের ছেড়ে দেয়, আর আহলুল ইসলামদের হত্যা করে, সেগুলোও স্পষ্ট হচ্ছে। আর কারা কাফিরদের তৈরী করা এসব অটোনোমাস রাষ্ট্রগুলোর সো কল্ড শাসকদের স্বাধীন সুলতান উপাধি দিয়ে আনুগত্য ওয়াজিব করিয়ে নিচ্ছে, সেগুলোও স্পষ্ট হচ্ছে।



ডেসটিনি ডিজরাপ্টেড বইয়ের কিছু বিষয় পর্যালোচনা (পর্ব-২)
আব্দুল্লাহ আল মাসুদ

ইসলামের ইতিহাসের একটি বেদনাময় ঘটনা হলো বিদ্রোহীদের হাতে উসমান রা. এর নির্মম শাহাদাত। এটি তৎকালীন সকল সত্যিকারের মুসলিমদের ব্যাথিত করেছিলো। এই ঘটনার পরে খলীফা হন আলী রা.। ঘটনার ধারাবাহিতায় ডেসটিনির লেখক বলেন:
"ঠিক সেই মুহুর্তেই নতুন করে গুঞ্জন শুরু হয় যে, উসমান হত্যার সাথে আলী রা. সম্পৃক্ত ছিলেন। আলী রা. স্বীকারও করেন যে, তার কিছুটা হলেও দায় আছে। কারণ উসমান রা. যখন বিপদে পড়ে তার সহযোগিতা চেয়েছিলেন তখন তিনি তা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তিনি যদি সেদিন উসমানের রা. পাশে দাঁড়াতেন তাহলে হয়তো এভাবে উসমানকে রা. প্রাণ দিতে হতো না। এরকম একটি মনোযাতনা হযরত আলীর রা. মনেও ছিলো।" [১০৬ পৃষ্ঠা]
#পর্যালোচনা
উসমান রা. এর হত্যার ঘটনার সময় আলী রা. এর ভূমিকা কী ছিলো সে বিষয়ে পূর্ববর্তী আলেমগণ ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করেছেন। সেখানে আমরা দেখি যে, আলী রা. যখন জানতে পারলেন যে, বিদ্রোহীরা উসমান রা.কে হত্যার সুযোগ খুঁজছে তিনি তখন আপন দুই ছেলে হাসান-হুসাইন রা.কে পাঠিয়ে দিলেন উসমান রা. এর বাড়ি পাহারা দেবার জন্য। কাউকে বাড়িতে প্রবেশ করতে দিতে কঠোরভাবে নিষেধ করে দেন তিনি। সেই সাথে তালহা যুবায়ের প্রমুখ সাহাবিরাও তাদের সন্তানদের পাহারা দিতে পাঠিয়ে দেন।
এদিকে বিদ্রোহীরা দরজায় পাহারা দেখে ঘরের পেছন দিক দিয়ে দেয়াল বেয়ে ভেতরে প্রবেশ করে দরজায় পাহারারত হাসান-হুসাইন-ইবনে যুবায়েরদের অজান্তেই উসমান রা.কে হত্যা করে ফেলেন। তো যখন আলী, তালহা, যুবায়ের প্রমুখ সাহাবিদের কাছে উসমান রা.কে হত্যা করার সংবাদ পৌঁছলো তারা দৌঁড়ে ছুটে এলেন। তাদের তখনকার অবস্থা কেমন ছিলো সে চিত্র সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যাহাবি রাহ.। তিনি বলেছেন 'ওয়াক্বাদ যাহাবাত উকুলুহুম...' মানে তারা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে এলেন। এসে দেখলেন উসমান রা.কে শহীদ করে ফেলা হয়েছে। আলী রা. জানতে চাইলেন: তিনি কীভাবে নিহত হলেন অথচ তোমরা দরজায় পাহারা দিচ্ছো? তখন তিনি এতোটাই ক্ষুব্ধ ও রাগান্বিত ছিলেন যে আপন বড় ছেলে হাসানকে চড় মারেন এবং হুসাইনের বুকে আঘাত করেন। বাকি অন্যান্য যারা পাহারায় ছিলো তাদের শুধু বকাঝকা করেন। তারপর রাগত অবস্থাতেই নিজের ঘরে ফিরে যান। [আল্লামা যাহাবি, সিয়ারু আলামিন নুবালা: ২/৬১২]
আলী রা. যে তাঁর সন্তানদেরকে উসমান রা. এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পাহারা দিতে পাঠান এটা আরও বহু ইতিহাস গ্রন্থে পাবেন। আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতী রাহ.ও তার বিখ্যাত কিতাব 'তারীখুল খুলাফা' তে তা উল্লেখ করেছে। [তারীখুল খুলাফা: ১৫৯]
এমনকি যখন বিদ্রোহীরা উসমান রা. এর ঘরে পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয় তখন আলী রা. কৌশলে তিন মশক পানি পাঠান। যাতে পিপাসায় তাকে কষ্ট পেতে না হয়। [সিয়ারু আলামিন নুবালা: ২/৬২১]
এতো কিছুর পরে আলী রা. এর ব্যাপারে এমন কথা বলা যে, "উসমান রা. যখন বিপদে পড়ে তার সহযোগিতা চেয়েছিলেন তখন তিনি তা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।" স্পষ্টত অপবাদ বৈ কিছুই না। বরং তিনি তো সাহায্য চাওয়ার আগেই আপন সন্তানদের তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পাহারায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
★ উসমান রা. নিহত হবার পর কাকে খলীফা বানানো হবে সে বিষয়ে ডেসটিনির লেখক বলেন,
"এরপর সকলের ভাবনা ঘুরে একজনের দিকেই স্থির হয়, যাকে একবার নয়, দুবার নয় তিনবার খলীফার পদের জন্য ভাবা হলেও শেষ পর্যন্ত আর দায়িত্ব দেয়া হয় নি। কিন্তু যাকে বলা হতো হযরত মুহাম্মাদ সা.এর একমাত্র বৈধ উত্তরাধিকারী- তিনি আর কেউ নন, রাসূল সা. এর জামাতা হযরত আলী রা.।" [১০৩ পৃষ্ঠা]
#পর্যালোচনা
এই কথাগুলোতে দুইটি বিষয় লক্ষ্যণীয়:
{ক} প্রথম খলীফা নির্বাচনের সময় তো আলী রা. এর নাম প্রস্তাব দূরে থাক তিনি সেই মজলিসে উপস্থিতই ছিলেন না। আর দ্বিতীয় খলীফা উমর রা. কে প্রথম খলীফা আবু বকর রা. মৃত্যুর পূর্বেই খলীফা মনোনীত করে যান। তারপর শুধু তৃতীয় খলীফা মনোনয়ন করার সময় অন্য কয়েকজনের সাথে সর্বপ্রথম আলী রা. এর নাম প্রস্তাবে আসে। যদিও তখন তিনি খলীফা হতে পারেন নি। বরং উসমান রা. খলীফা হন। তাহলে লেখক যে বললেন, একবার নয়, দুবার নয় তিনবার... কথাটা কিভাবে বাস্তব হলো?
{খ} আলী রা. যদি রাসূল সা. এর একমাত্র বৈধ উত্তরাধিকারী হয়ে থাকেন তাহলে এর আগে যারা খলীফা হলেন তারা কি অবৈধ ছিলেন? এটা তো শিয়াদের বিশ্বাস। তাদের আকীদা হলো, রাসূলের মৃত্যুর পর শাসনভার পাওয়ার একমাত্র বৈধ হকদার হলেন আলী রা.। এই বিতর্কের সূত্র ধরেই তারা আবু বকর ও উমর রা.কে খেলাফত ছিনতাইকারী ও কাফের বলে থাকে। তাদের ব্যাপারে সর্বোচ্চ ঘৃণা পোষণ করে।
★হুসাইন রা. এর শাহাদাত ইসলামি ইতিহাসের একটি বড়ো ট্রাজেডি। শিয়াদের দ্বারা ইসলামের ইতিহাসে যেসব বিষয়ে বিকৃতি ঘটেছে তার মধ্যে অন্যতম হলো এই বিষয়ক ইতিহাস। ইংরেজি ভাষার ঐতিহাসিকরা শিয়াদের সেসক ইতিহাস নির্দ্বিধায় গ্রহণ করে নেয়ার ফলে তাদের বই-পুস্তকেও বিকৃত ইতিহাস ছড়িয়ে আছে। ডেসটিনির লেখকও এর থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। এই বিষয়ে পর্যালোচনা করার আগে চলুন একটা জায়গা থেকে লেখকের কলম থেকেই পড়ে নেই:
"ইয়াজিদ যখন জানতে পারলো যে নবি মুহাম্মাদ সা. এর ছোট নাতি তাকে মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে মদিনা থেকে বের হয়েছে তখন সে তাকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য সেনাবাহিনী প্রেরণ করলো। ইমাম হুসাইন ইয়াজিদের সাম্রাজ্যের জন্যে মোটেও হুমকি ছিলো না। তা সত্ত্বেও ইয়াজিদ তাকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করতে চাইলো। যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহস করতে না পারে। ইমাম হুসাইনের ছোট দলকে ধ্বংস করার জন্য এতো বড় সেনাবাহিনীর কোন প্রয়োজন ছিলো না।" [১১৫ পৃষ্ঠা]
#পর্যালোচনা
লেখকের বক্তব্য থেকে স্পষ্টতই বুঝে আসে যে, ইয়াজিদ হুসাইন রা.কে হত্যা করার জন্য বাহিনী পাঠায়। অথচ এটি সঠিক নয়। বরং সে কেবল তাকে ইরাকে প্রবেশ করতে বাধাদান করার নির্দেশ প্রদান করে গভর্নর ইবনে যিয়াদকে। পরে ইবনে যিয়াদ নিজে থেকে আগ বেড়ে হত্যাকাণ্ড ঘটায়। যাতে করে ইয়াজিদকে খুশি করতে পারে।
এই বিষয়ে ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেন,
"মুহাদ্দিসদের ঐক্যমতে ইয়াজিদ হুসাইন রা. এর হত্যার আদেশ দেয় নি। বরং তিনি ইবনে যিয়াদকে আদেশ করেছিলেন যাতে তাকে ইরাকের ক্ষমতা দখলে বাধা দান করে। [মিনহাজুস সুন্নাহ: ৪/৪৭২]
হুসাইন রা. এর ইরাক গমনের কথা শুনে ইয়াজিদ যে চিঠি লিখেছিলো কুফার গভর্নর ইবনে যিয়াদের কাছে সেখান থেকেও স্পষ্ট হয় যে, সে হত্যার আদেশ দেয় নি। শুধু হুসাইন রা.কে বাধা দিতে বলেছিলো। [মাজমাউয যাওয়াইদ: ৯/১৯৩]
★হুসাইন রা. শহীদ হবার পর কী ঘটেছিলো সেই বর্ণনা দিয়েছেন লেখক এভাবে:
"সেই দ্বিখণ্ডিত মস্তক যখন ইয়াজিদের দরবারে পৌঁছে তখন ইয়াজিদ বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের এক দূতের সাথে নৈশভোজে ব্যস্ত ছিলেন। ইমাম হুসাইনের কাটা মাথা সেখানে পৌঁছার পর গোটা আয়োজনটাই ভণ্ডুল হয়ে যায়। দ্বিখণ্ডিত মস্তক দেখে দূত বলেন, তোমরা মুসলমানরা সম্মানীত একজন ব্যক্তির লাশের সাথে এ রকম আচরণ করো? আমরা কখনও যিশুখ্রিস্টের বংশধরদের সাথে এরূপ আচরণ করতে পারতাম না। এই কট্টর সমালোচনা ইয়াজিদকে আরও উত্তেজিত করে তোলে। তিনি সেই দূতকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন।" (১১৫ পৃষ্ঠা)
#পর্যালোচনা
নির্ভরযোগ্য কোন ইতিহাস গ্রন্থে আমরা এরকম কোন বর্ণনা দেখতে পাই না। আমি অনেক তালাশ করেও পাই নি। পরে গুগলে খুঁজতে গিয়ে দেখি শিয়াদের বিভিন্ন সাইটে এই ঘটনাটি বর্ণনা করা আছে। তাও আবার সনদ বিহীন ও দুর্বলভাবে। কারণ কোথাও কোথাও বলা হয়েছে উপস্থিত ব্যক্তিটি ছিল একজন খৃস্টান পাদ্রি। সেই ঘটনা একটু অন্যরকম। আর এখানে যার কথা বলা হয়েছে সে ছিলো রোম সম্রাটের দূত।
যাইহোক, আমরা যদি নির্ভরযোগ্য ইতিহাস গ্রন্থের দিকে তাকাই তবে ভিন্ন চিত্র দেখতে পাই। এই ক্ষেত্রে আমি ইবনে কাসীর রা.এর আলবিদায়া ওয়ান নিহায়াহ থেকে বিষয়টি উল্লেখ করবো। উল্লেখ্য যে, তিনি তার গ্রন্থে এই ঘটনাগুলো উল্লেখ করার আগে শিরোনাম দিয়েছেন এভাবে- 'ইতিহাসবেত্তাদের বর্ণনা অনুসারে হুসাইন রা. এর হত্যার বর্ণনা। শিয়ারা যেসব মিথ্যা ধারণা রাখে সেরকম নয়।'
তারমানে হলো, এই বিষয়ে শিয়ারা যে বহু গালগল্প তৈরি করেছে সেদিকে ইঙ্গিত করে তিনি পাঠককে জানিয়ে দিলেন, আমার বর্ণনা করা বিষয়গুলো তাদের বানোয়াট জিনিস থেকে মুক্ত। তো সেখানে তিনি বর্ণনা করেন,
"হুসাইন রা. এর লাশ দেখে তার চক্ষু অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে। সে বলে: হুসাইনকে হত্যা করা ছাড়াই তোমাদের আনুগত্যে আমি সন্তুষ্ট ছিলাম।" [আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/১৯১]
আমি আগেই বলেছিলাম যে, ইবনে যিয়াদ এটা নিজ থেকে করেছিলো যাতে সে ইয়াজিদের সুদৃষ্টি আকর্ষণ ও তাকে খুশি করতে পারে। এখানে সেই দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, এর জন্য হুসাইনকে হত্যা করার প্রয়োজন ছিলো না। আমি তো তোমাদের আনুগত্যে এমনিতেই সন্তুষ্ট।
ষষ্ঠ শতকের আরেকজন মুহাদ্দিস ও ইতিহাসবেত্তা ইবনুল আসীর জাযারি রাহ. তার বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থেও এমনটা বলেছেন। সেখানে আরও আছে যে, ইয়াজিদ হুসাইন রা. এর খণ্ডিত মস্তক দেখে ইবনে যিয়াদের উপর লানত করেছিলো। [আলকামিল ফিত্তারীখ: ৩/৪৩৭]
তো এই বিশুদ্ধ বর্ণনাটিও লেখক এনেছেন। তবে এসব বানোয়াট কাহিনী বলার পর 'অন্য বর্ণনায় আছে' বলে। যাতে অনুমিত হয় যে আগেরটা বেশি সত্য। আর পরে এটা যেহেতু কোথাও কোথাও পাওয়া যায় তাই হালকাভাবে বলে দিলেন দুই লাইনে। অথচ হওয়া উচিত ছিলো এর উল্টো।
আগামী পর্বে আরও বিষয় উল্লেখ করবো ইনশাআল্লাহ। সময়ের অভাবে এই পর্বে শুধু এতোটুকুই আনলাম।


















হিপোক্রেইসি
মিসবাহ মাহিন
অধিকাংশ মানুষের মন Lesser evil অর্থাৎ তুলনামূলকভাবে কম খারাপটাকে বেছে নিতে পছন্দ করে। দেশে বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংঘটন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই নানা অনিয়মের কথা চলে আসছে। প্রায় সব ক্যাম্পাস থেকে শুরু করে যেকোনো অরাজনৈতিক আন্দোলনেও পুলিশের পাশাপাশি এরাও ব্যাকআপ পুলিশিং করছে। কাউকে রড, কাউকে হাতুড়ি, কাউকে রামদা, কাউকে পিস্তল - যাকে যেভাবে পারছে থামিয়ে রাখছে।
.
এই ছাত্রদের কাজকর্ম দেখে রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ দাবী করা সুশীলেরাও বেশ বিপাকে পড়ে যান মাঝে মধ্যে। এদের তো বলা যায় না এরা ইসলামী কোনো দল করে কিংবা উগ্রবাদী কোনো দল। কারণ, সুশীল অভিধান অনুযায়ী এরা সবদিকেই পার্ফেক্ট। মদ- গাঁজা - নারী এই তিন এদের সঙ্গী।
.
মানুষ অতিষ্ট হয়ে তখন Lesser evil খুঁজেন। এর আগে যে বা যারা ক্ষমতায় ছিলেন তাদের ভালো দিকগুলো দেখেন। এইটা হল দুইটা খারাপের মধ্যে একটা খারাপকে বেছে নেওয়া। মানুষ ধরেই নিয়েছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের কারাগারে আটকা পড়ে গিয়েছে। মরতে যখন হবেই একটা উপায়ে মরতেই হবে। বাঁচার কোনো রাস্তা নেই।
.
অপেক্ষাকৃত কম খারাপ বেছে নেওয়া হলো পরাজিত মানসিকতার উত্তম উদাহরণ। একজন সাধারণ মুসলিমও স্বীকার করে তাঁদের নেতা রাসুল (সা) দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে দুইটা বস্তু রেখে গিয়েছেন। কুর'আন এবং হাদিস। সাথে এও বলে গিয়েছিলেন যারা এই দুইটি আঁকড়ে ধরতে পারবে তাদের পথভ্রষ্ট হওয়ার কোনো সুযোগ কিছুতেই নেই।
.
রাসুল (সা) এর মৃত্যুর এত বছর পরে এসে কুর'আন - হাদিস আমাদের সমাজে ঠিকই আছে। তবে এই কুর'আন ব্যবহার হয় মানুষ মারা গেলে মৃতের উদ্দেশ্যে খতম দেওয়ার কাজে, এই কুর'আন কেবল কাজে লাগানো হয় তাবিজ- কবজের কাজে, এই হাদিস কেবল উদ্ধৃত করা হয় বিপরীত পক্ষের সাথে তর্কে জিতে আসতে। আমরা ভুলেই গিয়েছি মুসলিমদের কুর'আন - হাদিসের ব্যবহার জীবনের সবদিকেই করা যায়।
.
আমরা কেবল দুটি দলের মাঝে আটকা পড়ে গেছি। এর বাহিরেও ভালো কিছু থাকতে পারে- এই ধারণা না নিয়েই আমাদের দাদা, তার দাদা, তার দাদা এভাবেই অনেকে চলে গিয়েছে দুনিয়া ছেড়ে।
.
.
বৈশ্বিক পরিমন্ডলেও আমেরিকা আর রাশিয়া ব্লক ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না। অথচ দুইটা হল শয়তানের ফুফাতো - মামাতো ভাইয়ের মত।
.
ইসলামের যে সর্বব্যাপী মেসেজ পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আলেমদের ছিলো তাঁরা তা পারেন নি। সবাই পারেন নি বললে ভুল হবে। যাঁরা পেরেছেন তাঁদের কেউ হয়তো মাটির নীচে অথবা কারাগারে অথবা খুব কষ্টে জীবনযাপন করছেন পুরো সমাজে একঘরে হয়ে। এই আলেমদের সাথেই পড়ুয়া আরেকদল আলেম হয়তো শত্রুর সাথে রফা করে নিজের জীবনকে গুছিয়ে নিয়েছে।
.
একই ভূ- গোলকের এক পাশের মানুষ খেলা, বিনোদন নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে। আবার দিনশেষে স্বীকারও করছে এগুলো জাস্ট ফান ছিলো। সেই একই পৃথিবীর আরেক প্রান্তে সাগরে রিফিউজি শিশুর লাশ ভেসে আসে, এক প্রান্ত থেকে অসহায় মুসলিমদের তাড়িয়ে দিলে আরেক প্রান্তেরই মুসলিম ভাইয়েরা তাদের অজানা সমুদ্রের বুকে ফেরত পাঠায়। যেনো সমুদ্রের এপার ওপারে দুই দল পিং-পং খেলছে।
.
এগুলো হিপোক্রেইসি! শিয়ার হিপোক্রেইসি!!





















এক মাজলুম মাওলানা
আলি হাসান উসামা

আল্লাহর রাসুলের মধ্যে আমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ। রাসুল মিষ্টি খেয়েছেন, তাই আমরা মিষ্টি খাব। রাসুল তায়েফে গিয়ে নির্যাতিত হয়েছেন, তাই আমরা নির্যাতিত হব। এভাবেই শান্তিকামিতার মূলনীতিকে ঠিক রেখে আমরা প্রিয় রাসুলকে অনুসরণ করে যাব। যেখানে এই মূলনীতি ব্যাহত হবে, সেখানে রাসুলের জীবনের সে-সংক্রান্ত অধ্যায়কে স্রেফ বইয়ের পাতার মধ্যেই এঁটে রাখাব অথবা তার অপব্যাখ্যা করে ভিন্ন কোনো প্রয়োগক্ষেত্রে প্রয়োগ করব।
রাসুল সা. তখন হুদাইবিয়ায়। খবর পেলেন উসমান রা.-কে তাগুতের দোসররা বন্দী করে ফেলেছে; এমনকি তার রক্তে নিজেদের হাত রঞ্জিত করেছে। রাসুলুল্লাহ সা. তখন সাহাবিদের একত্রিত করে সকলের কাছ থেকে বাইয়াত নিলেন। আল্লাহ সে প্রসঙ্গে বলেছেন, যারা আপনার কাছে বাইয়াত দিচ্ছে, তারা তো আল্লাহর কাছে বাইয়াত দিচ্ছে। আল্লাহর হাত তাদের হাতের ওপর। যে এই বাইয়াতকে ভঙ্গ করবে, সে তার নিজেরই ক্ষতি করবে। আর যে আল্লাহকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবে, অবশ্যই তিনি তাকে মহা প্রতিদান দান করবেন।
এক মাওলানা ধৃত হয়েছেন। তার অপরাধ খুব বেশি কিছু নয়। তিনি নাকি উগ্রবাদ প্রচার করতেন। আচ্ছা, উগ্রবাদের সংজ্ঞা কী? আমরা তো দেখি, শাহবাগি নাস্তিকরা সেখান থেকে উগ্রবাদ প্রচার করছে। আওয়ামী লীগ সরকারের অনুসারী ছাত্ররা তো শুধু উগ্রবাদই নয়; বরং রীতিমতো সন্ত্রাসবাদের প্রচার করছে। আর দাদাদের দেশের হিন্দুগোষ্ঠী তো উগ্রতার চরম শিখর স্পর্শ করেছে।
উগ্রবাদ হলো তাত্ত্বিক ব্যাপার আর সন্ত্রাসবাদ হলো প্রায়োগিক ব্যাপার। ইসলাম উগ্রবাদী ধর্ম নয়। এ কথা তো সর্বজনস্বীকৃত। তাহলে যে বিষয়গুলো ইসলাম-সমর্থিত, তা কখনো উগ্রবাদ হতে পারে না। বরং নিঃসন্দেহে তা-ই ভারসাম্যের পথ। এবার দেখা যাক, এই মাওলানা যা কিছু প্রচার করতেন, তা ইসলাম-সমর্থিত কি না। যদি তা ইসলাম-সমর্থিত হয় তাহলে কখনোই তা উগ্রবাদ নয়। এ ধ্রুব সত্যকে অস্বীকার করার কোনো জো নেই।
এই মাওলানার আরেকটা অপরাধ হলো, তিনি গাজওয়ার হাদিসগুলোতে বিশ্বাস করতেন। আচ্ছা, তাহলে কি কোনো মুসলমানের জন্য কুরআন এবং সুন্নাহর কিছু অংশকে অবিশ্বাস করার সুযোগ রয়েছে! তিনি বিশ্বাস করতেন—এ জন্য তিনি অপরাধী। এর মানে হলো, অধিকাংশ মুসলিমই এসব হাদিসের প্রতি বিশ্বাস রাখে না। আর সেই কারণে তারা অপরাধী নয়। আচ্ছা, যারা কিছু হাদিসে বিশ্বাস রাখে না, তারা নিজেদের মুসলিম পরিচয় দিলেও কীভাবে তারা মুসলিম হতে পারে! আল্লাহ বলেন, ‘তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশের প্রতি ইমান রাখো আর কিছু অংশকে অস্বীকার করো! যে-কেউ এমনটা করবে, তার শাস্তি এ ছাড়া আর কিছু নয় যে, দুনিয়াতে তার জন্য থাকবে লাঞ্ছনা আর আখিরাতে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে ভয়াবহ শাস্তির দিকে। তোমরা যা কিছু করো, আল্লাহ সে সম্পর্কে বে-খবর নন।’
একজন আলিমকে মাজলুম হতে দেখেও আজ কেউ প্রতিবাদ করবে না। কারণ, মুখে স্বীকার না করলেও আমাদের দৃষ্টিতেও তিনি একধরনের অপরাধী। নাস্তিকদের সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই, যা ইসলামের দর্পণে দেখলে বর্তমান প্রেক্ষাপটে কতটুকু গুরুত্ব রাখে এবং সার্বিক ফলাফলের বিচারে তার উপকারিতাই কতটুকু, তা ভিন্ন প্রসঙ্গ। সেই লড়াই আমাদের চোখে বীরত্বের মাপকাঠি হলেও দীনের বার্তা প্রচার এবং বিশুদ্ধ ইলমের খেদমত আমাদের চোখে কোনো কিছুই নয়। বরং তা-ই আমাদের চোখে একধরনের অপরাধ, যে কারণে আজ এক মাজলুম আলিমের জন্য কেউ সমবেদনাটুকুও প্রকাশ করবে না।
তিনি কোনো গণতান্ত্রিক দলের সদস্য নন, তাই আজ তার জন্য মিছিল হবে না। কেউ তার জন্য র‍্যালি বের করবে না। তার জন্য কোনো মানববন্ধনও হবে না। কোনো প্রেস ব্রিফিং দিতেও কাউকে দেখা যাবে না। বিনাশ্রমের একটা জিনিস—ফেসবুকের পোস্ট, তা-ও কেউ করবে না। পাছে না এর জন্য নিজেকেই অপরাধী হতে হয়।
বস্তুত আমরা পাশ্চাত্যের ছকে আঁকা ইসলামেই সন্তুষ্ট হয়ে গিয়েছি। তাই এর বাইরের কিছু করা আমাদের জন্য বড় কঠিন। পরাজিত মানসিকতা আজ আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছেয়ে গেছে। জীবন তো একটাই। এ জীবন তো ভোগ-বিলাসের জন্য নয়। দুনিয়া তো মুমিনের জন্য কারাগার। পুরো জীবনটাই যেখানে কারাগার, সেখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কারাগারগুলো তো গৌণ ব্যাপার। আল্লাহ তাআলার কাছে পুরো দুনিয়ার মূল্য মাছির ডানা পরিমাণও নয়।
মুমিনদের জন্য সুখের দিন তো আগামীতে, মৃত্যুর পরে। সেখানে আল্লাহ মুমিনদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন এমন জান্নাত, যা কোনো চোখ দেখেনি, কোনো কান শোনেনি, এমনকি কোনো অন্তরেও যার কল্পনা আসেনি। ইউসুফ আ. বড় সুন্দর বলেছিলেন, ‘প্রভু হে, ওরা আমাকে যে দিকে ডাকছে (হালের প্রেক্ষাপটের আলোকে বললে, ওরা আমাকে যে মডারেট-পরিমার্জিত ইসলাম মানাতে চাচ্ছে) তারচে তো কারাগারই আমার কাছে বড় বেশি পছন্দনীয়।’
মনে রেখো হে শান্তিকামীরা, সর্বোত্তম জিহাদ হলো জালিম শাসকের সামনে সত্যের বাণী তুলে ধরা। তোমরা তো নিষ্ক্রিয়তাকেই মানহাজ বানিয়ে নিয়েছ, নীরবতাকেই মুক্তির উপায় হিসেবে গণ্য করেছে; কিন্তু আল্লাহর রাসুল সা. প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সত্যের বাণী তুলে ধরাকে কোনো অসতর্কতা নয়; বরং সর্বোত্তম জিহাদ বলে অভিহিত করে গিয়েছেন।
আজ যারা সত্যের বাণী প্রচারের কারণে এক মাজলুম ব্যক্তিকেই বরং অপরাধী হিসেবে মূল্যায়ন করছ, জেনে রেখো, সেদিন খুব দূরে নয়, যেদিন তোমার সঙ্গেও একই ঘটনা ঘটবে; আর তোমার সেই দুর্দিনে অন্যরাও মুখে কুলুপ এঁটে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে ঘটে যাওয়া পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করবে। তোমার সাহায্যে কেউই এগিয়ে আসবে না।
দীন না মানা সত্ত্বেও জাতিগতভাবে স্রেফ মুসলিম পরিচয়ধারী হওয়ার কারণে রোহিঙ্গাদের ভাগ্যে যে দুর্দিন নেমে এসেছে, পূর্ণাঙ্গ ইসলামে বিশ্বাস করার কারণে আজ যেমন বাঙালিদের ওপরও ভয়াল নির্যাতন নেমে আসছে, সেদিন খুব দূরে নয়, যেদিন শুধু ব্যক্তিগত ইসলাম তথা নামাজ-রোজার কারণেই তোমার বুককে বেয়নেটের খোঁচায় রক্তাক্ত করা হবে এবং তোমার খুন ঝরতে দেখে জালিমরা পৈশাচিক উল্লাসে মেতে উঠবে। তোমার আর্তনাদ দেখে গগনবিদারী হাসির হররা ছুটবে তাগুতের দোসরদের ঝলমলে প্রাসাদগুলোতে।
যে ব্যক্তি নিজের ভাইকে মাজলুম হতে দেখে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সাধ্যানুসারে তার সাহায্যে এগিয়ে আসে না, আল্লাহ তাকে লাঞ্ছিত করেন এবং তাকে এমন বিপদে ফেলেন, যে ক্ষেত্রে তার সাহায্যেও অন্য কেউ আর এগিয়ে আসে না।
নকল প্রভুর ক্ষমতা এতটুকুই!
ড. বিলাল ফিলিপ্স (স্রষ্টা ধর্ম ও জীবন)

ব্রাজিলের অ্যামাজন জঙ্গলের আদিম উপ-জাতিদের একদল মানুষ "স্কোয়াচ" নামক মূর্তির পূজা করে। তাদের বিশ্বাস সব সৃষ্টির সর্বোচ্চ স্রষ্টা এই "স্কোয়াচ"। একটি কুঁড়েঘরে স্কোয়াচের মানুষ রূপী মূর্তিটা বসানো ছিল।

একদিন স্রষ্টাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেওয়ার জন্য এক যুবক সেই ঘরে ঢোকে। তাকে শেখানো হয়েছিল এই মূর্তিই তার স্রষ্টা, তার পালনকর্তা। সে যখন মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে মূর্তির সামনে সিজদা করছিল, তখন কুঁড়েঘরের ভেতর একটি নেড়ি কুকুর চুপিসারে ঢুকে পড়ল। লোকটা সিজদা শেষ করে মাথা ওঠাতেই দেখল,

__সেই কুকুরটি মূর্তিটার উপর মূত্রত্যাগ করছে।

সেই যুবকটি এটা কোনোভাবেই সহ্য করতে পারল না। তাই সে কুকুরটাকে ধরার জন্য উঠে দাঁড়াল। এই ফাঁকে কুকুরটাও ঘরের বাইরে বেরিয়ে যায়। অপমানের জ্বালায় দগ্ধ সেই যুবক বহুদূর পর্যন্ত কুকুরটিকে তাড়া করে ফিরল।

ক্রোধ কিছুটা কমে আসার পর সে শান্ত হয়ে বসল। এবং হঠাৎ তার মনে এই বোধোদয় হলো যে, এই মূর্তি কখনোই মহাবিশ্বের প্রভু হতে পারে না। নিজের মনের সাথে ক্রমাগত যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত সে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাল যে, এই মূর্তি তার স্রষ্টা নয়; স্রষ্টা নিশ্চয়ই অন্য কেউ।

শুনতে যতই আশ্চর্য জনক মনে হোক না কেন, এই যুবকের জন্য এটাই ছিল স্রষ্টার পক্ষ থেকে নিদর্শন। জন্মের পর থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে স্রষ্টা মানুষকে তাঁর বিভিন্ন নিদর্শন দেখিয়ে থাকেন।

পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন সময়ে তিনি মানুষকে তাঁর নিদর্শন দেখান। বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে মানুষের অন্তরে তিনি এই ইঙ্গিত দেন যে, স্রষ্টার অস্তিত্ব রয়েছে, স্রষ্টা একজনই এবং তিনি এক ও অদ্বিতীয়।









তাসাউফ
মঞ্জুরুল করীম

তাসাউফ কেন চর্চা করা হয়? চর্চা এজন্য করা হয় যাতে এর মাধ্যমে মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক চরিত্রের উন্নয়ন ঘটে,রোগসমূহ নির্মূল হয়। এক্ষেত্রে শাইখের নিজস্ব আমল খুব গুরুত্বপূর্ণ, কেননা মুরিদরা তো শাইখকে দেখেই শেখে। যখন তারা দেখে যে শাইখ নির্লোভ, নির্ভেজাল, বিনম্র,আল্লাহভীরু, নেককার এক বান্দা তখন দেখাদেখি তারাও তেমনটা হতে চেষ্টা করে। কিন্তু খোদ পীরের ভেতর যখন বাহারি রোগের সমাহার ঘটে তখন মুরিদানরা আর কতটাই বা উন্নয়ন ঘটাবে?
.
সুলতান আলাউদ্দিনের সময়কালে ৩জন মাশাইখের নাম ঐতিহাসি কাযী জিয়াউদ্দীন বারানী উল্লেখ করেছেন,তাঁরা হচ্ছে- শাইখুল ইসলাম নিজামুদ্দীন,শাইখুল ইসলাম আলাউদ্দিন ও শাইখুল ইসলাম রুকনুদ্দীন(রাহ:)। তাঁদের আমল ও আখলাকের কিরকম প্রভাব মুরিদ ও অন্যান্য সাধারণ মানুষের ওপর পড়েছিল তার বর্ণনায় কাযী জিয়াউদ্দীন(রাহ:) লিখেছেন,
.
"পীর মাশাইখদের সচ্চরিত্র ও দুনিয়াবিমুখতা দেখে পার্থিব জগতের প্রলোভন ও আসক্তি তাদের অন্তর থেকে হ্রাস পেতে থাকে। বুযুর্গদের ইবাদাত ও পারস্পরিক সম্পর্কের বরকতে লোকদের মানসপটে স্থান পেয়েছে সততা ও অকৃত্রিমতা। তাদের মহৎ চারিত্রিক গুণাবলী ও চেষ্টাসাধনার প্রভাবে খোদাভীরুদের অন্তরে স্বভাবচরিত্র পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়"
.
এই আমলের প্রভাব ক্রিয়াশীল হয়েছিল মূলত সুলতান আলাউদ্দিনের (রাহ:) শরঈ শাসনের বরকতে। ফলে উভয়ের মিলনের ফল কেমন হয়েছিল তার বর্ণনা এমনটা পাওয়া যায়-
.
"আলাভী আমলের শেষের দিকে মদ,প্রেমপ্রণয়,পাপ-অনাচার,জুয়া,বেহায়াপনা ও অশ্লীলতার নামও অধিকাংশ মানুষের মুখে শোনাই যায়নি। বড় বড় পাপসমূহ মানুষের কাছে কুফর সদৃশ মনে হত। মুসলমানরা পরস্পর লজ্জারবশবর্তী হয়ে প্রকাশ্যে সুদের লেনদেন ও মালামাল মজুদ করতে সাহস করতো নাদোকানদারের মিথ্যাকথন,মাপে ও ওজনে কম দেয়া ও ভেজাল মিশ্রণের অবসান ঘটলো।"
.
এমনটা তো এমনি এমনি হয়নি, খাজা নিজামুদ্দীন(রাহ:) কে তাঁর শাইখ খাজা ফরিদুদ্দীন গাঞ্জেশকর (রাহ:) তাগিদ দিয়ে বলতেন,"প্রতিপক্ষকে খুশি করা ও পাওনাদারকে সন্তুষ্ট রাখতে বিন্দুমাত্র অবহেলা করও না". আর আজকালকার পীররা আছে প্রতিপক্ষকে দাঁতভাঙা জবাব দেবার তালে আর পরিচিত কয়েকজন পীর সাহেবের লেনদনে সম্পর্কে জানি বলে সে বিষয়ে আর না ই বা বলি।
.
আসলে আমল বৃক্ষে ফল অনুকূল পরিবেশ ছাড়া ধরেনা। যদি ধরেও তাহলে সেটা পরিপক্ব হয়না ।
.
যাইহোক, তবুও যদি মাশাইখদের নিজেদের মাঝে প্রকৃত যুহদ থাকে তাহলে মুরিদানদের কিছু না কিছু উন্নয়ন অবশ্যই ঘটবে। এটা তাসাউফের রূহ। কিন্তু বর্তমানে বাহ্যিকভাবে এর উপস্থিতি সেভাবে দৃশ্যমান নয়।
.
[ বজমে সূফিয়া:১৯৮-২০২ এর সূত্রে ভারতবর্ষে মুসলমানদের অবদান,আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী(রাহ:), অনুবাদক : অধ্যাপক আ.ফ.ম.খালিদ হোসেন,পৃ:৪১; সেন্টার ফর রিসার্চ অন দ্যা কুর'আন এন্ড সুন্নাহ,চট্টগ্রাম, ২০০৪]























ডেসটিনি ডিজরাপ্টেড বইয়ের কিছু বিষয় পর্যালোচনা (পর্ব-৩)
আব্দুল্লাহ আল মাসুদ

বিবাহিত ব্যক্তি যিনায় লিপ্ত হলে তার শাস্তি রজম বা পাথর নিক্ষেপে হত্যা। এটা যে রাসুল সা. বাস্তবায়ন করে গেছেন সে বিষয়ে পুরো মুসলিম উম্মাহ একমত। অথচ এই বিষয়ে ডেসটিনির লেখক লিখেছেন:
"যিনার সর্বনাশা প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে হযরত উমর রা. খুবই সচেতন ছিলেন। তাই তিনি ব্যভিচার ও পরকিয়ার বিরুদ্ধে খুবই কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি যিনার শাস্তি হিসেবে পাথর মারার প্রচলন করেন।" [৯১ পৃষ্ঠা]
#পর্যালোচনা
এখানে পাথর মারার প্রচলনকারী হিসেবে উমর রা. এর কথা বলা হলো। এই বিষয়ে আমি বেশি কিছু বলবো না। বলার প্রয়োজনও নাই। শুধু দুইটা হাদীস তুলে দিচ্ছি। যেখানে নবী-যুগে এই বিধান কার্যকর করার প্রমাণ আছে।
(১) আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) বলেন, মুসলিমদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট এলো। তখন তিনি মাসজিদে বসে ছিলেন। সে তখন উচ্চৈঃস্বরে বলল, হে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! আমি ব্যভিচার করেছি। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। সে লোকটি তাঁর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) -এর চেহারার দিকে গিয়ে বলল, হে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! আমি ব্যভিচার করেছি। এবারও তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এভাবে সে চারবার স্বীকারোক্তি প্রদান করল। এরপর সে যখন চারবার নিজের উপর সাক্ষ্য দিল, তখন রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে ডাকলেন এবং বললেন, তোমার মধ্যে কি পাগলামী আছে? সে বলল, না। তুমি কি বিবাহিত? সে বলল, হ্যাঁ। তখন রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তোমরা তাকে নিয়ে যাও এবং পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা কর।
ইবনু শিহাব (রহঃ) বলেন, জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে যিনি হাদীস শ্রবণ করেছেন তিনি আমার কাছে বলেন যে, জাবির (রাঃ) বলেছেন, পাথর নিক্ষেপকারীদের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম। আমারা তখন তাকে (ঈদের) সলাত পড়ার স্থানে পাথর নিক্ষেপ করলাম। যখন তার উপর পাথর পড়তে লাগল তখন সে পলায়ন করল। আমরা তাকে ‘হার্রা'’ নামক স্থানে ধরে ফেললাম এবং পাথর মেরে হত্যা করলাম। [সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৪৩১২]
(২) জুহাইনাহ্ গোত্রের এক মহিলা নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট আগমন করল। সে বলল, হে আল্লাহর নবী! আমি ‘হদ্দ’ (শারী’আত কর্তৃক নির্ধারিত ব্যভিচারের শাস্তি)-এর উপযোগী হয়েছি। অতএব আমার উপর তা কার্যকর করুন। তখন আল্লাহর নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার অভিভাবককে ডাকলেন এবং বললেন, তাকে ভালভাবে দেখাশোনা করো। তারপর সে যখন সন্তান প্রসব করবে তখন তাকে আমার কাছে নিয়ে আসবে। সে তাই করলো। এরপর আল্লাহর নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার প্রতি (শাস্তি প্রদানের নির্দেশ দিলেন। তখন মহিলার কাপড় শক্ত করে বাঁধা হলো। এরপর তিনি শাস্তি কার্যকর করার আদেশ দিলেন। তাকে পাথর মারা হলো। অতঃপর তিনি তার উপর জানাযার সলাত আদায় করলেন। তখন উমার (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর নবী! আপনি তার (জানাযার) সলাত আদায় করলেন অথচ সে তো ব্যভিচার করেছিল? তিনি বললেন, নিশ্চয়ই সে এমনভাবে তাওবাহ্ করেছে, যদি তা মাদীনার সত্তরজন লোকের মধ্যে বণ্টিত হতো, তবে তাদের জন্য তাই যথেষ্ট হতো। তুমি কি তার চেয়ে অধিক উত্তম তাওবাহ্কারী কখনও দেখেছ? সে-তো নিজের জীবন আল্লাহর জন্য দিয়ে দিয়েছে। [সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৪৩২৫]
যেই উমর রা. এর ব্যাপারে এমন কথা বলা হলো এই বিষয়ে খোদ তার নিজের বক্তব্যও হাদীসের পাতায় বিদ্যমান। চলুন দেখে আসি কী সেটা।
"আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘উমার ইবনু খাত্তাব (রাঃ) রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর মিম্বারের উপর বসা অবস্থায় বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে সত্য দ্বীনসহ পাঠিয়েছেন এবং তাঁর উপর কিতাব (কুরআন) অবতীর্ণ করেছেন। আল্লাহ্‌র নাযিলকৃত বিষয়ের মধ্যে (আরবী) (ব্যভিচারের জন্য পাথর নিক্ষেপের আয়াত) রয়েছে। তা আমরা পাঠ করেছি, স্মরণ রেখেছি এবং হৃদয়ঙ্গম করেছি। সুতরাং রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ব্যভিচারের জন্য রজম করার হুকুম বাস্তবায়ন করেছেন। তাঁর পরবর্তী সময়ে আমরাও (ব্যভিচারের জন্য) রজমের হুকুম বাস্তবায়িত করেছি। আমি ভয় করছি যে, দীর্ঘদিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর কেউ এ কথা হয়তো বলবে যে, আমারা আল্লাহর কিতাবে (ব্যভিচারের শাস্তি) রজমের নির্দেশ পাই না। তখন আল্লাহ কর্তৃক নাযিলকৃত এ ফরয কাজটি পরিত্যাগ করে তারা মানুষদেরকে পথভ্রষ্ট করে ফেলবে। নিশ্চয়ই আল্লাহর কিতাবে বিবাহিত নর-নারীর ব্যভিচারের শাস্তি (আরবী) (পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা)-এর হুকুম সাব্যস্ত। যখন সাক্ষ্য দ্বারা তা প্রমাণিত হয়, কিংবা গর্ভবতী হয়, অথবা সে নিজে স্বীকার করে। [সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৪৩১০ ]
উমর রা. যে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন এখানে তার বাস্তবতা আমরা ইতিমধ্যে দেখতে পেয়েছি। মুসলিমদের মধ্যেই কিছু পশ্চিমা-প্রভাবিত অতি আধুনিক ও প্রগতিশীল বলে খ্যাত লোকেরা যিনার শাস্তি হিসেবে এটা মানতে অস্বীকার করে। যেহেতু কুরআনে তা সরাসরি বলা হয় নি। বিশেষত আহলে কুরআন ও হাদীস অস্বীকারকারীরা এটা বেশি বলে থাকে।
এই বিধান উমর রা. প্রচলন করেছেন এমন তথ্য প্রতিষ্ঠা হলে ফায়দা কী? ফায়দা হলো, তখন এর আইনগত মর্যাদা কমে যায়। কারণ যে বিধান কুরআনে নাই এবং নবিজিও বলেন নাই সেটা কেন উমর রা. এর কথার ভিত্তিতে মানতে হবে? যখন কিনা বিধানটা মানুষের জীবন-মৃত্যুর সাথে সম্পৃক্ত মারাত্মক বিষয়। এমন জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা ছাড়া শুধু উমর রা. এর সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে মানা কতোটুকু গ্রহণযোগ্য? বেশির থেকে বেশি এতোটুকু বলা যাবে তখন যে, এটা হদ্দ নয় বরং তাযীর। মানে শাসকের পক্ষ থেকে নির্ধারণ করা একটা শাস্তি মাত্র। চূড়ান্ত কিছু নয়। অন্য শাসক ভালো মনে করলে তাতে পরিবর্তন ঘটাতে পারবেন। এসব কারণেই দেখা যায় এক শ্রেণির প্রচ্যাবিদরাও ব্যাপারটাকে এভাবে প্রচার করে থাকে। যাতে করে ইসলামের এই বিধানটা অকার্যকর করে ফেলা যায় এবং এর আইনগত মর্যাদা হ্রাস করা সম্ভব হয়।
★উমর রা. এর আলোচনা করতে গিয়ে ডেসটিনির লেখক লিখেছেন:
"কোন মুসলমান মালিক কোন অধীনস্থ দাসের সাথে শারিরীক সম্পর্ক করে এবং তার ফলে সে গর্ভবতী হয়ে যায় তাহলে উক্ত মালিককে সেই দাসের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। অর্থাৎ ঐ দাসের ঔরসে যে সন্তান জন্ম নিবে তা যেন মুসলমান হিসেবে জন্ম নিতে পারে এবং তার পরপরই সে মুক্ত হয়ে যায়।" [৯২ পৃষ্ঠা]
#পর্যালোচনা
{ক} অধীনস্থ দাস বলতে আমরা গোলাম বুঝি। বাঁদি নয়। কারণ তাকে বলা হয় দাসী। তো পুরুষ মালিক তার দাসীর সাথে শারিরীক সম্পর্ক করতে পারলেও মহিলা মালিক তার দাসের সাথে শারিরীক সম্পর্ক করতে পারে না। তো 'অধীনস্ত দাসের সাথে শারিরীক সম্পর্ক' কথা থেকে অনুমিত হয় যে মহিলা মালিক ও তার অধীনস্ত দাসের ব্যাপারে কথা বলা হচ্ছে যে, মালিক তার দাসের সাথে শারিরীক সম্পর্ক করে গর্ভবতী হলে তখন সেই দাসকে বিবাহ করতে হবে। দাসের জায়গায় দাসী বললে এমনটা বোঝার আর অবকাশ থাকতো না। আর এখানে আসলে লেখক দাসীর কথাই বলতে চেয়েছেন। হয়তো অনুবাদক অনুবাদে ভুলটা করায় জটিলতাটা তৈরি হয়েছে।
{খ} ধরে নিলাম মূল লেখক দাসীর কথাই বলেছেন। তবুও মাসআলাটি সঠিক নয়। কারণ দাসীর সাথে শারিরীক সম্পর্ক হবার পর সেই দাসী মনিব কর্তৃক গর্ভবতী হলে সেই দাসীকে বিবাহ করতে হবে এটা পুরোই ভুল কথা। বরং সঠিক মাসআলা হলো, মনিবের মৃত্যুর পর এমনিতেই ওই দাসী মুক্ত হয়ে যাবে। দাসীর পেট থেকে জন্ম নেওয়া মনিবের সন্তান এমনিতেই মুক্ত হয়ে যাবে। অন্য কিছু করতে হবে না। তারমানে সন্তান শুরু থেকেই মুক্ত হয়ে যাচ্ছে আর দাসী মুক্ত হচ্ছে মনিবের মৃত্যুর পর। এমন দাসীকে ফিকহের পরিভাষায় 'উম্মু ওয়ালাদ' বলা হয়। এই বিষয়ে ফিকহ ও হাদীসের কিতাবে নির্দেশনা দেওয়া আছে।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন , যে কোন দাসী তার মনিবের ঔরসজাত সন্তান প্রসব করবে সে তার মনিবের মৃত্যুর পর আযাদ হয়ে যাবে । [ইবনে মাজাহ: ২৫১৫ ]
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ কারো মালিকানায় কোন নিকটাত্মীয় ‘মুহাররাম’ দাস হয়ে আসলে সে আযাদ। [সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৩৯৪৯]
এই হাদীসকেও ফকীহগণ এই বিষয়ে দলীল হিসেবে পেশ করেন। কারণ আপন সন্তান হলো 'মুহাররাম'। ফলে সে জন্মের সময় আযাদ হয়ে যাবে। দাসীর পেট থেকে হয়েছে বলে দাস বলে গণ্য হবে না। দাস বিষয়ক মাসআলা যারা জানেন তাদের কাছে এটি কোন অস্পষ্ট বা নতুন বিষয় নয়। মোটকথা হলো, লেখক যে এখানে সন্তান মুক্ত হবার জন্য দাসীকে বিবাহ করার কথা বলেছেন তা সঠিক নয়।
রাসূল সা. এর সন্তান ইবরাহীমের জন্ম হয়েছিলো মারিয়া কিবতিয়া এর গর্ভে। তিনি ছিলেন দাসী। কই নবিজী তো গর্ভবতী হবার পর তাকে বিয়ে করেন নি! বরং যখন তার প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলো তখন নবি সা. বললেন, "তাঁর সন্তানই তাকে দাসত্বমুক্ত করেছে।" [সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ২৫১৬]
আগামী পর্বে আরও কিছু বিষয় তুলে ধরে এই পর্যালোচনার ইতি টানবো ইনশাআল্লাহ।




ডেসটিনি ডিজরাপ্টেড: সামগ্রিক মূল্যায়ন ও প্রাসঙ্গিক আরও কিছু কথা
আব্দুল্লাহ আল মাসুদ

'ডেসটিনি ডিজরাপ্টেড' বইটি নিয়ে ইতিমধ্যেই আমি তিন পর্বে পর্যালোচনা লিখেছি। আপাতত পর্বের সংখ্যা আর বাড়াচ্ছি না। কারণ একজন শ্রদ্ধেয় ভাইর দেওয়া সংশোধনী কপি প্রকাশনীর হাতে পৌঁছেছে এবং অফিসিয়ালি তারা গুরুত্ব সহকারে তা বিবেচনায় নিবেন বলে জানিয়েছেন। আশা করি ভুলগুলো সংশোধন করে নিবেন তারা।
পুরো বইটা আমি পড়েছি। লেখকের ইতিহাস বলার ঢংয়ের প্রশংসাই করতে হয়। গল্প করার স্টাইলে তিনি শতো শতো বছরের ইতিহাস বলে গিয়েছেন। যেহেতু গল্প করার সময় ঘটনার খুব ভেতরে যাওয়া হয় না এবং বিস্তারিত বিবরণও থাকে না এখানেও সেটাই হয়েছে। লেখক সংক্ষিপ্তভাবে আলোকপাত করে করে সামনে অগ্রসর হন। সেজন্যই চারশ পৃষ্ঠার একটা বইতে এতো শতো বছরকে আঁটানো সম্ভব হয়েছে। লেখক যদি আরও সচেতন হতেন এবং তার যেসব ভ্রান্তি ঘটেছে ভেতরে তা যদি না হতো তবে বইটা এর অনন্যতার কারণে অবশ্যই সর্বশ্রেণীর পাঠকের পাঠ্যতালিকায় স্থান করে নিতে পারার যোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারতো। লেখকের করা কিছু ভুল ছিলো এমন যা ইসলাম সম্পর্কে সামান্য পড়াশোনা করা একজনেরও জানা থাকার কথা। এটা আমাকে অবাক করেছে অনেক। যিনি শতো শতো বছরের ইতিহাস গড়গড় করে গল্পচ্ছলে বলে যাচ্ছেন এই সামান্য ও প্রসিদ্ধ ব্যাপার তার অজানা থেকে গেলো কেমনে আল্লাহই ভালো জানে। (যেমন যিনার শাস্তি স্বরূপ রজমের প্রচলন উমর রা. করেছেন বলে দাবি করা।)
বইটা যেহেতু অনূদিত তাই এতে কাঁচি চালানোর সুযোগ নাই বলে যদি ধারণা করা হয় তাহলে অন্ততপক্ষে টীকা-টিপ্পনি যুক্ত করতে তো সমস্যা হবার কথা ছিলো না। যেসব জায়গায় লেখকের ভ্রান্তি হয়েছে সেখানে টীকাতে সঠিক বিষয়টা বলে দিলেই হতো। যেমনটা আবু বকর রা. এর খলীফা হবার সময় আলী রা. এর মনোমালিন্য নিয়ে করা আলোচনাতে টীকা দিয়ে বাস্তব বিষয় পাঠকের সামনে ক্লিয়ার করে দেওয়া হয়েছিলো। (দেখুন ৭২ পৃষ্ঠায়।) সুতরাং এই একটা জায়গার মতো অন্যান্য জায়গাগুলোতেও তা করা উচিত ছিলো। কিন্তু তা করা হয় নি। ভ্রান্তিসহই বইটা বাজারে নিয়ে আসা হয়।
ব্যক্তিগতভাবে গার্ডিয়ান প্রকাশনীর সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই। পূর্ব-বিদ্ধেষ নেই। নেই কোন হিংসা। বরং বলা যায় সুসম্পর্ক আছে। তাদের 'বন্ধন' বইটা আমি শরঈ সম্পাদনাও করেছিলাম। তাদের কিছু বই আমাকে উপহার পাঠানোও হয়েছে। তো এই পর্যালোচনা হয়তো আমার ব্যাপারে তাদের মনে কষ্টের জন্ম দিবে। হয়তো আমি কারও কারও চক্ষুশূল হবো। এই পর্যালোচনা না লেখলে আগের সাধারণ সম্পর্ক বহাল থাকতো। হয়তো আগের মতো আমাকে তারা তাদের সদ্য প্রকাশিত কোন বই উপহার পাঠাতো। আমার এই পর্যালোচনা সেই সুবিধাগুলোকে হুমকির মুখে ফেলেছে। কথাগুলো বললাম এটা বোঝানোর জন্য যে, পর্যালোচনা লিখে আমার বিন্দুমাত্র লাভ তো হয়-ই নি উল্টো সম্ভাব্য লোকসানের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তবুও আমি দায়িত্ববোধ থেকে কথাগুলো লিখেছি। আমার মনে হয়েছে এগুলো অবশ্যই বলা দরকার। আমার অনেক বইপত্র পড়া হয়। কোন কোন বইতে সামান্য ত্রুটি ধরা পড়ে। সেসব দাগিয়ে রাখি। কয়টা নিয়েই বা এমন পর্যালোচনা লিখি? এটা লিখেছি কারণ এর ভুলগুলো এমন ও এতো যে এটা স্কীপ করে যাওয়া ছিলো অসম্ভব।
পর্যালোচনাটি লিখতে গিয়ে প্রথম পর্বের পর আমাকে ঘাটের টাকা খরচ করে বইটা কিনতে হয়েছে। সময় ব্যয় করে পুরো বইটা পড়তে হয়েছে। আগে থেকে জানা থাকার পরেও পর্যালোচনাকে দালিলিকভাবে উপস্থাপন করতে গিয়ে আরবী বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করার পেছনে প্রচুর সময় খরচ করতে হয়েছে। যাতে করে আমার তুলে ধরা বিষয়গুলো কেবলই মুখের বুলি না হয়ে রেফারেন্সসহই হয়। এতে আমার কতোটা কষ্ট হয়েছে সেটা আমি জানি। পুরো কাজটাতে আমার দুনিয়াবি কোন লাভ ছিলো না। এই সময়গুলো অনুবাদের পেছনে ব্যায় করলেও কিছু পয়সা আয়ের মাধ্যম হতো। কথাগুলো বলছি, কাজটা যে আমি নিরেট দ্বীনের দিকে তাকিয়ে করেছি সেটা বোঝানোর জন্য। এখানে ব্যাক্তিগত স্বার্থের লেশমাত্র ছিলো না।
প্রশ্ন হতে পারে প্রকাশককে কানে কানে বা ইনবক্সে না বলে প্রকাশ্যে কেন বললাম। বললাম এই কারণে যে, এর আগেও তাদের থেকে অসচেতনতার পরিচয় আমরা পেয়েছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে আশাবাদী ছিলাম তারা নিজেদের ঘাটতিটা দূর করে আরও কর্তব্যপরায়ণ হবেন। কিন্তু ডেসটিনি বইটা সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছে। আগামীতে যাতে তারা প্রতিটি বইয়ের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকেন সেই নিয়তেই আমি এটি লিখেছি প্রকাশ্যে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, ব্যক্তিগত ভুলত্রুটি অবশ্যই গোপনে ধরিয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু ভুলটা যখন ব্যক্তিগত গণ্ডি পার হয়ে জনসম্মুখে ছড়িয়ে পড়ে তখন তার সংশোধনও সবার সামনে দিয়ে হওয়া উচিত। যাতে সাধারণ পাঠক সচেতন হতে পারে যে, আমার সামনে যে বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে বইতে সেটা আসলে ঠিক নয়, ভুল। প্রকাশ্য পদ্ধতি অবলম্বন করা ছাড়া এর ভিন্ন কোন উপায় এখনও পর্যন্ত আমার নজরে পড়ে নি।
তাছাড়া এমন বিষয় গোপনে করার একটা ক্ষতিও আছে। সেটা হলো, এমন হলে দেখা যাবে অন্য প্রকাশনীও বই প্রকাশে অসচেতন থেকে যাবে। প্রথমে ভুলে ভরা বই প্রকাশ করবে। সেগুলো পাঠকদেন হাতে যাবে। পরে কেউ হয়তো গোপনে ভুলগুলো ধরিয়ে দিবে। তখন তারা সংশোধন করবে। (অনেক সময় ধরিয়ে দেবার পরও পাত্তা না দিয়ে ওভাবেই রেখে দেওয়া হয়। এর দৃষ্টান্তও আছে।) তারপর আবার আরেকটা ভুলে ভরা বই প্রকাশ করবে। আবার কেউ তা ধরিয়ে দেবার পর ঠিক করবে। মাঝখানে যারা প্রথমবার বইটা কিনলো তারা ঠিকই ভুলগুলোও বইয়ের সাথে নিজের ঘরে নিয়ে গেলো। এই সিলসিলা চালু থাকবে। পরিবর্তন ঘটবে না। যেহেতু তাদের ঝুঁকির মুখে পড়তে হচ্ছে না। কিন্তু যখন অন্যরা দেখবে যে, ভুল-ভ্রন্তিতে ভরপুর বই প্রকাশ করলে প্রকাশ্য সমালোচনার আগুনে পড়তে হবে এবং সেটা তাদের প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষতিকর হবে তখন প্রতিটি প্রকাশনীই শুরু থেকে সচেতন থাকতে বাধ্য হবে।
ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় গার্ডিয়ানের প্রকাশককে আমার নিষ্ঠাবান মনে হয়েছে। কিন্তু কোথায় যেন তাদের গ্যাপ রয়ে যাচ্ছে। একই ধরনের ভুল তারা করে ফেলছে। এটা তাদের কর্তব্যহেলা হতে পারে। কিন্তু অনেক আবেগী পাঠক প্রকাশককে ইহুদিদের দালাল, শিয়া, কাফেরসহ আরও এই সেই বলছেন। যার সাথে আমি জোরালো দ্বিমত পোষণ করি। এসব মন্তব্যের দায় কেবলই মন্তব্যদাতাদের। সেই সাথে গার্ডিয়ানের সেসব পাঠকের সাথেও জোরালো দ্বিমত পোষণ করি যারা মন্তব্য করে বলে- 'কে কী বললো কান দিবেন না', 'এসব মানুষ হিংসায় জ্বলেপুড়ে করছে সো বাদ দেন' ইত্যাদি। কারণ বইয়ের যে সমস্যা আছে সেটা তো অস্বীকার করার সুযোগ নেই। সুতরাং এগুলো কানে নিতেই হবে। নইলে তো পরিবর্তন আসবে না। আমি আশাবাদী গার্ডিয়ান পরিবার বইটি নিয়ে করা আমার পর্যালোচনাগুলোকে ইতিবাচকভাবে নিবেন।
একেক প্রকাশনী একেক ধরনের হবে সেটাই স্বাভাবিক। কেউ কেবলই পাক-ভারতের আলেমদের উর্দু বইর অনুবাদ করবে- যেমন: মাকতাবাতুল আশরাফ, কেউ আরবের জনপ্রিয় বক্তা বা লেখকদের বইর অনুবাদে জোর দিবে- যেমন: হুদহুদ প্রকাশনী, কেউ সালাফদের প্রাচীন বইগুলো বাংলায় আনার উপর জোর দিবে- যেমন: মাকতাবাতুল বায়ান ও মাকতাবাতুল আসলাফ ইত্যাদি। তো একেক জনের কর্মপন্থা ও ধরন একেক রকম হবে। সবাইকে যে কেবল সালাফদের প্রাচীন বই আনতে হবে তেমন কোন কথা নেই। বরং প্রকাশনা জগতে বৈচিত্রময় প্রকাশনী যতো বেশি থাকবে আমরা ততো লাভবান হবো। ততো সমৃদ্ধ হবো। কিন্তু তার মানে কখনোই এই নয় যে আমরা যাচাইবাছাই ছাড়াই যা তা জিনিস নিয়ে পাঠকদের সামনে হাজির হবো।
ইসলামী বইপত্রের প্রকাশনা আর সেক্যুলার বইপত্রের প্রকাশনা যে এক কাতারের না সেটা আমরা যতো দ্রুত বুঝবো ততোই মঙ্গল। কারণ ইসলামী বইপত্রের সাথে ঈমান-আকীদার প্রশ্ন জড়িয়ে থাকে।
















বিশ্বাস, ইবাদত, মুআমালা, দণ্ডবিধি এবং শিষ্টাচার
আলি হাসান উসামা

আমরা ইসলামকে পাঁচ ভাগে ভাগ করতে পারি :
১. বিশ্বাস; যাকে আমরা ইমান শব্দে অভিহিত করতে পারি।
২. ইবাদত।
৩. মুআমালা।
৪. দণ্ডবিধি।
৫. শিষ্টাচার।
ইমানের মূল বিষয়গুলো হলো :
১. আল্লাহর প্রতি ইমান।
২. রাসুলের প্রতি ইমান।
৩. কিতাবুল্লাহর প্রতি ইমান।
৪. ফেরেশতাদের প্রতি ইমান।
৫. পরকালের প্রতি ইমান।
৬. তাকদিরের প্রতি ইমান।
৭. মৃত্যু পরবর্তী পুনরুত্থানের প্রতি ইমান।
মৌলিক ইবাদত হলো :
১. সালাত।
২. জাকাত।
৩. সিয়াম।
৪. হজ।
৫. জিহাদ।
মুআমালার মৌলিক শাখাগুলো হলো :
১. বিবাহশাদি।
২. আর্থিক লেনদেন।
৩. পারস্পরিক বিবাদ-বিসংবাদ।
৪. আমানত।
৫. পরিত্যক্ত সম্পত্তি।
দণ্ডবিধির মূলনীতিগুলো হলো :
১. মানবহত্যার দণ্ড। অর্থাৎ কিসাস।
২. সম্পদ আত্মসাতের দণ্ড। অর্থাৎ চুরি-ডাকাতির হদ।
৩. সম্মান-সম্ভ্রমহানির দণ্ড। অর্থাৎ অপবাদের হদ।
৪. পর্দা লঙ্ঘনের দণ্ড। অর্থাৎ ব্যভিচারের হদ।
৫. ইসলামের রজ্জুকে ছিন্ন করার দণ্ড। অর্থাৎ রিদ্দাহর হদ।
শিষ্টাচারের মূলনীতিগুলো হলো :
১. আখলাক। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। নিজেকে উত্তম বৈশিষ্ট্যে সজ্জিত করা এবং অন্তরকে মন্দ বৈশিষ্ট্যগুলোর কলুষতা থেকে মুক্ত করা।
২. ভালো স্বভাব গড়ে তোলা।
৩. সিয়াসাত। অর্থাৎ সকল কাজ যথাযথ শৃঙ্খলা এবং পরিকল্পনার সঙ্গে সম্পাদন করা।
৪. মুআশারা। পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশ এবং নির্দেশনা অনুসরণ করা।















আফগানিস্তানে তালিবানের ইতিহাস
সালমান সাঈদ

ক্রমঃ১

#তালেবানসন্ত্রাসী এই হ্যাশটাগে লিখতে বসলাম। হ্যশট্যাগে ক্লিক করলে লেখা পাবেন।

এই সিরিজে বাংলাভাষায় ব্যবহৃত সম্মানসূচক আপনি, তিনি বা এই ধরণের সর্বনাম বা সম্মানসূচক ক্রিয়াপদ যেমন করেছিলেন গিয়েছিলেন ব্যবহার করা হবেনা। সে, করেছিল গিয়েছিল ব্যবহার করা হবে। এবং এখানে ইসলামিক টার্ম যথাসম্ভব এড়িয়ে গিয়ে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ বজায় রাখবার চেষ্টা করা হবে।

আমি আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা থেকে লিখবো। যদি কারও উপকার হয় আল'হামদুলিল্লাহ। আর যেকোন ভুল অথবা ক্ষতির দায়ভারের জন্য আল্লহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। - Salman Saeed

ক্রমঃ২

ইসলাম গ্রহণের পর থেকেই বিভিন্ন গ্রুপ নিয়ে একা একা পড়ালেখা করতাম। তালেবানদের নাম অতীতে অনেকের কাছে শুনলেও তালেবানদের সম্পর্কে প্রথম কোনো একাডেমিক স্কলারের কাছ থেকে বক্তব্য শুনেছিলাম ২০১৪ সালে, যতদূর মনে পড়ে। ইসলামিক অনলাইন ইউনিভার্সিটির কোর্সে ড.বিলাল ফিলিপস তালেবানদের মূর্তি ভাঙা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেন। সমালোচনা করেন এই বলে যে, ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র চার বছরের মাথায় দুর্ভিক্ষ, সন্ত্রাস দমন, কূটনৈতিক অগ্রগতির আগেই তালেবান লিডার মোল্লা ওমর মূর্তি ভাঙবার মাধ্যমে শত্রু বাড়িয়ে ফেলে এবং হিকমতহীনতার পরিচয় দেয়।

সম্ভবত উপত্যকার বাংলা নাম বামিয়ান। মধ্য আফগানিস্তানের হাজরাজাতের এই ব্যামিয়ান উপত্যকায় ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত গৌতম বুদ্ধের দুটো মূর্তি ছিল। মূর্তি দুটো প্রাচীন সভ্যতার ঐতিহ্য হিসেবে Unesco World Heritage Site এর মর্যাদা পায়। একটা মূর্তি প্রায় ২০ তলা উচ্চতার (১৭০+ ফুট) আরেকটি ১৩ তলার মত।

১৯৭১ এর ৯ মাসের যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাংলাদেশকে আগের পরিস্থিতিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল প্রায় ৫-৭ বছর পরঅন্যদিকে ১৯৮১ সাল বা তারও আগে থেকে যুদ্ধ-চলমান এমন একটা দেশের ক্ষমতা পায় মোল্লা ওমর ১৯৯৬ সালে।

বারবার আফগান কূটনৈতিক যোগাযোগের চেষ্টা করেও যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকা বা তার মিত্রপক্ষের কারও স্বীকৃতি আদায় করতে তালেবান ব্যর্থ হয়। এর কারণ ছিল মূলত এই আফগানিস্তানে আমেরিকার পছন্দের প্লেয়ার আহমেদ শাহ মাসুদ তখনও তালেবান সরকারের বিরুদ্ধে লড়ছে। অন্যদিকে আফগানিস্তানে খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসার অভাবে শিশুমৃত্যুর হার, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ের মোকাবেলায় তালেবান তখন ব্যস্ত মাসুদের পাশাপাশি। জাতিসংঘের সাহায্য আসতে চাচ্ছে, কিন্তু স্বভাবতই শর্তসাপেক্ষে।

এতদভিন্ন, মোল্লা ওমর ও তালেবান ছিল ইসলামের কট্টরপন্থী দেওবন্দি মাসলাকের অনুসারী। তারা ভীত হয় কয়েকটা ব্যাপারেঃ

১। সাহায্যের সাথে আসা বিপুল বিদেশী নাগরিকের আনাগোনা ও গোয়েন্দা তথ্যের আদানপ্রদান (যেহেতু আমেরিকা বা মেজর ইউরোপীয় দেশ থেকে সরকার হিসেবে তালেবান স্বীকৃতি পায়নি এবং গৃহযুদ্ধের শেষ প্লেয়ার মাসুদ তখনো জীবিত)

২। নারী ও শিশুর জন্য আসা সাহায্যে পর্দার ব্যাঘাত ঘটবে।

৩। অবশ্যই সাহায্য পাবার সাথে অন্যান্য কিছু শর্ত।

২০০১ সালের শুরুর দিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের দুই মূর্তিমান বুদ্ধের জন্য কিছু টাকাপয়সা স্যাংশন করা হয়। যেগুলো আফগান সরকারকে দেওয়া হবে এক্সক্লুসিভলি বুদ্ধের মেইনটেনেন্সের জন্য। জীবিত হাজার হাজার অর্ধমৃত আর দুর্ভিক্ষপীড়িত আদমসন্তান দেখা মোল্লা ওমর মূর্তির তেমন কোন মেইন্টেনেন্সের দরকার আছে বলে বুঝতে পারেনা। সে শুধু দেখেছিল যে এই মৃত বুদ্ধ দুইজন শুধু কিছুদিনের বৃষ্টির জন্য সামান্য স্যাঁতস্যাঁতে। মোল্লা ওমর মার্চ মাসে মূর্তি ভাঙার নির্দেশ দেয় ক্ষুব্ধ হয়ে। কেননা মূর্তির মেইন্টেনেন্সের টাকা আবার দুর্ভিক্ষপীড়িতদের জন্য ব্যবহার করা যাবে না। ডাইনামাইটে উড়ে যাওয়া মূর্তির ব্যাপারে তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের কট্টর ইসলামিক আইডিওলজির দোহাই দেয়। রেফারেন্স দেয় সম্ভবত এই বলে যে মক্কা বিজয়ের পর ইসলামের নবী মুহাম্মাদ (স) ও মক্কার কাছাকাছি বিভিন্ন জায়গায় মূর্তি ভাঙার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

তাতে কাজ হয়না। দেশে বিদেশে নিন্দার ঝড় ওঠে। মুসলিম, অমুসলিম, আলেম, গাফেল, সৌদি, বৌদি সব তরফ থেকে।

ক্রমঃ৩

প্রথম অপারেশন, গ্রুপ গঠন ও কীভাবে লাইমলাইটে এলো

১৯৯৪ সাল। রাশিয়া সমর্থিত সরকারের পতন হয়েছে এবং পেশোয়ার চুক্তির বাস্তবরুপে আহমাদ শাহ মাসুদ (লায়ন অব পাঞ্জেশির) ও বুরহানউদ্দিন রব্বানির সরকার ক্ষমতা দখল করেছে। সোভিয়েতের শেষ সোলজারও আফগান ছেড়ে পালিয়ে গেছে অনেক আগেই। এরা (বুরহান ও মাসুদ) ছিল রাশান যুদ্ধের বীর সেনাপতি। গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার (আরেক সোভিয়েত যুদ্ধের বীর) এর বিদ্রোহ এবং যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশে তখনও সেন্ট্রাল সরকার তথা মাসুদদের সেইভাবে কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠা হয়নি। তাই রাশান যুদ্ধের বিভিন্ন অস্ত্রধারী পাকিস্তানে ট্রেনিং প্রাপ্ত গ্রুপ নিজেদের এলাকাভিত্তিক রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে।

আইনের শাসন নেই, সরকারী কন্ট্রোল নেই, এক দশকের বেশি ধরে চলা সোভিয়েত যুদ্ধের পরে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধ সাধারণ মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দিয়েছে। মৌলিক চাহিদা পূরণ যেখানে কষ্ট, সেখানে অস্ত্রধারী তথাকথিত 'মুজাহিদিন' গ্রুপের লুটপাট আর নৈরাজ্য আফগানিস্তানের সারা শরীর জুড়ে ক্ষতের সৃষ্টি করেছে।

অনেকে মনে করেন তালেবান রাশিয়ান কম্যুনিজমের বিরুদ্ধে লড়াই করে আফগান স্বাধীন করে। এটা ভুল।

১৯৯৪ সালের আগে তালেবান নামের কোন গ্রুপের অস্তিত্ব ছিলনা। তবে এটা ঠিক তালেবানদের সবাই না হলেও প্রথম অপারেশনের প্রায় সবাই রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে আফগানের ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যেমন, মোল্লা ওমর মূলত আর্টিলারি চালিয়ে সোভিয়েত ট্যাংক ধ্বংস করত। এবং তালেবান ফর্মেশনের আগে আফগান কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে মোল্লা ওমর একজন নোবডির বেশি কিছু ছিলনা।।

সম্ভবত কান্দাহার প্রদেশের ঘটনা। কোন এক এলাকাভিত্তিক অস্ত্রধারী গ্রুপ এক গ্রামে লুটপাট চালায়। লুটের শেষে তারা দুটো মেয়েকে ধরে নিয়ে যায় নিজেদের ক্যাম্পে উপর্যুপরি ধর্ষণের জন্য। সোভিয়েত যুদ্ধে এক চোখ হারানো মোল্লা ওমর তখন মাদ্রাসার শিক্ষক। ওমর তারই মতো সোভিয়েতের বিরুদ্ধে অস্ত্রচালনার ট্রেনিং পাওয়া মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক বেছে নেয়। ২৫-৪৫ জনের একটা গ্রুপ যারা মূলত নিজেদের তলিবে ইলম তথা জ্ঞানের ছাত্র বলে পরিচয় দেয়, তারা তাদের পুরনো অস্ত্রে পুনরায় শান দেয়। মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে সেই লুটেরা গ্রুপের ক্যাম্পে হামলা হয়। মেয়ে দুটো গ্রামে ফিরে আসে। মোল্লা ওমর ও এই তলিবান (students of knowledge)দের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধবিদ্ধস্ত এক জাতির সাধারণ মানুষ এই গ্রুপকে তাদের ত্রাণকর্তা হিসেবে দেখে।

পরবর্তীতে উসামা বিন লাদেন এবং পাকিস্তানি ইন্টেলিজেন্সের থেকে প্রচুর সাহায্য পেলেও তালেবানদের গঠনের মূল ইতিহাস হল এই যে, তারা জনগণের সমর্থনে অনেক দূর যেতে সক্ষম হয়। আমার এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে পরবর্তী পর্বে আমি কিছু যুক্তি পেশ করবো। কেননা পাকিস্তানের আইএসাই এর তৈরি বা সিয়াইএ এর তৈরি বলে তালেবানদের ব্যাপারে দাবি করা হয়।

আফগানিস্তানের সোভিয়েত কিংবা সোভিয়েত উত্তর পর্বের এক কয়েকটা কী ফিগারের মধ্যে অবশ্যই সৌদি সালাফিজম, ওসামা বিন লাদেন, শাহ জিয়া থেকে নওয়াজ-পারভেজের পাকিস্তান ও উপমহাদেশের দেওবন্দিজমও আসবে ইন শা আল্লহ। আজ এ পর্যন্তই থাক। শেষ করবো তালেবানদের স্বচেষ্টায় লাইমলাইটে আসা দিয়ে।

১৯৯২ সালে সোভিয়েত সমর্থিত নাজিবুল্লাহ সরকারের পতন হবার পর, বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপগুলোকে পেশোয়ারে একত্রিত করা হয়। আসলে নাজিবুল্লার পতনের আগেই তখন কাবুল দখল শুধু সময়ের ব্যাপার ছিল। আমেরিকা এবং পাকিস্তান উভয়েই সোভিয়েতের বিরুদ্ধে এক হয়ে যুদ্ধ করলেও তাদের উদ্দেশ্য ভিন্ন ছিল। পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট শাহ জিয়াউলের নীতি অনুযায়ী অনেক ক্ষেত্রেই পাকিস্তান, আমেরিকা ও আফগান গ্রুপগুলোর মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ছিল। তাই সোভিয়েত চলে যাবার পর পাকিস্তানের পেশোয়ারে গ্রুপ লিডাররা একত্রিত হয়। ওসামা বিন লাদেন (যে এই যুদ্ধে বিপুল ফান্ডিং ও বিদেশী যোদ্ধা দিয়ে সাহায্য করেছিল) এই সম্মেলনকে সমর্থন করে। তবে 'মুজাহিদিন' গ্রুপগুলোর মধ্যে বড় একজন লিডার গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ না করে গৃহযুদ্ধের সূচনা করে। পেশোয়ার সম্মেলনের পর গুলবুদ্দিনকে গুরুত্বপূর্ণ পদে রেখেই বুরহানউদ্দিন রব্বানি ও মাসুদ সরকার গঠন করে। নানা ঘাত প্রতিঘাত পার হয়ে মাসুদ ও বুরহানের সরকার কাবুল দখল করলেও সমস্যা বাঁধে অন্যখানে। তা হল দুটোঃ

১। যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ গঠনের আগেই মাসুদ সরকারকে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়। এর ফলে রাজধানী থেকে দূরে তেমন কোন কন্ট্রোল কেন্দ্রের হাতে ছিলনা। ফলশ্রুতিতে সোভিয়েত যুদ্ধের অস্ত্রধারী গ্রুপগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠে দেশের আগে থেকেই ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে একবারেই ভেঙে ফেলে। গ্রুপগুলোর লুটপাট, খুন, ধর্ষন ও রাহাজানি সাধারণ আফগানদের মাসুদ সরকারের প্রতি বিতৃষ্ণ করে তোলে।

২। সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে সৌদি আরব ধর্মযুদ্ধ হিসেবে অফিশিয়াল ফতোয়া দেয়। দেওবন্দিরা ইন্দো-পাক-বাংলাদেশ থেকে লোক পাঠায় ধর্মযুদ্ধের নেকী হাসিলের উদ্দেশ্যে। তাই এই যুদ্ধের শেষে কেন্দ্রে দেওবন্দি কিংবা সালাফি কট্টর ইসলামপন্থি সরকার গঠিত হবে এমনটাই ছিল বহু আফগানি উলামা ও আম মানুষের চাওয়া। কিন্তু আমেরিকা মূলত এই যুদ্ধে সমর্থন করে সোভিয়েতকে মার খাইয়ে নিজে শক্তির স্বাদ নিতে।

মজার ব্যাপার হল আমেরিকা যতদিন পক্ষে ছিল, ততদিন সবকিছু ধর্মযুদ্ধ তথা জিহাদ ছিল। সোভিয়েত যতদিন ছিল ততদিন প্রথম প্রায়োরিটি ছিল রাশিয়া হটাও কিন্তু সোভিয়েত যাবার পর পাকিস্তান, সৌদি, এবং আমেরিকার আলাদা আলাদা স্বার্থ আবিষ্কৃত হয়।

আহমাদ শাহ মাসুদ আমেরিকার একনিষ্ঠ সমর্থন আদায় করে যা তালেবানদের উত্থানের সময় আরও পাকাপোক্ত হয়। মাসুদ ও বুরহানউদ্দিন মূলত কট্টরপন্থী ইসলামী সরকার গঠনের বদলে একধরণের জগাখিচুড়ি আইডিওলজিরনা ঘারকা না ঘাটকাটাইপ সরকার তৈরি করে যা ওয়াহাবি এবং দেওবন্দি উভয় ঘরানায় প্রত্যাখ্যাত হয়।

পাকিস্তান মাসুদকে দিয়ে স্বার্থ আদায়ে ব্যর্থ হয় কারণ মাসুদ ছিল আমেরিকার একান্ত অনুগত এবং মাসুদকে এই অনুগত হতে বাধ্য করেছিল চারিদিকের ক্রমহ্রাসমান মিত্রসংখ্যা। পাকিস্তান মাসুদের বিকল্প খুঁজতে থাকে।

সৌদি-আরব বিশেষ করে তাদের ওয়াহাবি উলামা মাসুদকে নিয়ে খুশি হবার কথা ছিলনা। কিন্তু আমেরিকা জুজুর ভয় দেখিয়ে সৌদিকে এই অঞ্চলে আর নাক না গলানোর নির্দেশ দেয়। সৌদি নাগরিক উসামা বিন লাদেন ও তার সহচর আদর্শগুরু আব্দুল্লাহ আযযাম ততদিনে আফগান ও হিন্দে জিহাদি জোশ ছড়িয়েছে এবং আফগানিস্তানে নেই ঈশ্বরবাদি কমিউনিজমের পতনের পর ইসলামি খিলাফতের স্বপ্ন দেখিয়েছে। স্বভাবতই উসামা সরকার গঠনের পর মাসুদের কর্মকাণ্ডে নাখোশ ছিল। পরবর্তীতে ওসামা, সৌদি সরকারের নির্দেশ উপেক্ষা করে, আফগান রাজনীতিতে নাক গলাতে আসলে সৌদিরাজ অনুগত উলামা তাকে ফতোয়াবানে জর্জরিত করে এবং আজও 'খারেজি' ও ইসলামি শাসকের বিদ্রোহি পাপী হিসেবে চিহ্নিত করে।

ঠিক এই অবস্থায় তালেবানের জনকল্যাণমুখী অপারেশনগুলো শুরু হয়েছিল। তালেবান একটা নির্দিষ্ট সীমানায় জনপ্রিয়তা ও টেরিটরি দখলে আনে। তারপর উসামা বিন লাদেন ও তার দল আল-কায়েদার সমর্থন ও পাকিস্তানের শক্তিশালী 'মাসুদ বিকল্প' হবার সুযোগ লাভ করে।

আফগান রাজনীতিতে মোল্লা ওমর হয়ে ওঠে এক নতুন কারিশমার নাম, যা পাঞ্জেশিরের সিংহ, সোভিয়েত ইউনিয়নের ত্রাস, আহমেদ শাহ মাসুদকেও হার মানিয়ে দেয়।

ক্রমঃ৪

বিংশ শতাব্দীর শুরুর পরাশক্তিগুলো দুটি বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে কী প্লেয়ার হিসেবে। ব্রিটেন বা ফ্রান্স তাদের ইকোনমিকে অনেকটা স্যাক্রিফাইস করেই এ যুদ্ধগুলো জয়ের আকাঙ্ক্ষায় মেতে ওঠে। পক্ষান্তরে আমেরিকা প্রথম যুদ্ধে কী প্লেয়ার ছিলনা। রাশানরা ১৯১৭ এর পর নেই আর আমেরিকা পরে জয়েন করে। ১ম বিশ্বযুদ্ধের ট্রেডিং এর পর, অস্ত্র ব্যাবসায়ীরা আমেরিকার সাধারণ জনগণের ভিতরে একটা ধারণা পুশ করে 'War is good for the economy'

২য় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়া ও আমেরিকা দেরিতে ডিসাইসিভ এন্ট্রি নেয় এবং ২য় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিক থেকেই ফ্রান্স ও ব্রিটেনের আধিপত্য কমে যায় এবং পৃথিবীতে দ্বিমেরু রাজনীতির সৃষ্টি হয়। এই দুই মেরু ছিল উদ্ভূত দুই পরাশক্তি। ওয়াশিংটন ডিসি ও মস্কো। মজার ব্যাপার হল, একই শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা রাশিয়া ও আমেরিকা ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর একে অপরের প্রধান শত্রুতে পরিণত হয়।

আমেরিকার রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল সেক্যুলার ডেমোক্রেসি আর রাশিয়ার ছিল কমিউনিজমের বিভিন্ন রাশান ভার্সন। রাশিয়া ও আমেরিকা উভয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের আঞ্চলিক রাজনীতিতে নাক গলাতে থাকে। এবং স্থানীয় সরকারগুলোও এই দ্বিমেরুর যেকোন একটা বেছে নেয় সুবিধামত। এর কারণগুলো ছিল সুপারপাওয়ারের জুজুর ভয়, আন্তর্জাতিক লবিং সুবিধা, বিপদের মুহূর্তে ইন্টেলিজেন্স ও অস্ত্র কিনতে পারবার ভরসা। দ্বিমেরুর এই পৃথিবীতে আমেরিকা মূলত উত্তর-পশ্চিম ইউরোপকে পাশে পায়। আবার দক্ষিণ আমেরিকায় ওয়াশিংটন বিরোধী মনোভাব প্রবল হয়।

ইন্ডিয়া রাশান ব্লকে যায়। মুসলমান নামধারী রাষ্ট্রগুলোর জন্যে চয়েজ এক্টাই ছিল, সেটা হল আমেরিকা।

মুসলিম নামধারী সরকারগুলোর জন্য কমিউনিস্ট ব্লকে ঢোকার প্রধান বাঁধা ছিল ধর্ম। কারণ, কমিউনিজম নেই ঈশ্বরবাদের (নাস্তিকতার) প্রকাশ্য স্লোগান দেয়। অপরদিকে আমেরিকার সেক্যুলারিজম কুফর হলেও তা একটু ঘুরানো কুফর। অশিক্ষিত মুসলিম জনগোষ্ঠী আজও সংবিধানকে সর্বোচ্চ আইন মানাকে কুফরি মনে করেনা। আর তাই পাকিস্তান, সৌদি আরব, মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশই রাশান ব্লকে যায়নি।

অবশ্য বাংলাদেশ তার জন্মলগ্ন থেকেই দুইদিক বজায় রাখে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর অনেক সরকারই এমন আচরণে বাধ্য হয়। তবে এই কোল্ড ওয়ার বা দ্বিমেরুর পৃথিবীতে ৪৪ বছরের ইতিহাসে নানা উত্থানপতন আছে যা আমাদের পরিসরের বাইরে।

২য় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা ও রাশিয়া একে অপরের বিরুদ্ধে পরোক্ষ যুদ্ধ বা কোল্ড ওয়ারে লিপ্ত হয়। এই যুদ্ধ ছিল প্রভাব বিস্তারের যুদ্ধ। বিভিন্ন এলাকায় নিজেদের পছন্দের সরকার তৈরি করা, প্রাকৃতিক সম্পদে নজরদারি করা, মনোপলি ইকোনোমিক সিস্টেম তৈরি করা (যা আজও আম্রিকা জিইয়ে রেখেছে) ইত্যাদির জন্য বিভিন্ন খুন, হাইজ্যাক, ইন্টেলিজেন্স পার্সোনেল হত্যা সবই চলত।।

আফগানিস্তান হলো একদিকে ভারত উপমহাদেশের প্রবেশ পথ, অন্যদিকে সোভিয়েতের বর্ডারের কাছে। তাঁর উপর মুসলিম শক্তি পাকিস্তান ও ইরানের সাথেও এর বর্ডার থাকায় কোল্ড ওয়ারেও এর গুরুত্ব ছিল অনেক। যুগে যুগে অন্য পরাশক্তির কাছে অপরাজেয় আফগানে প্রভাব বিস্তার নিয়ে দুই এই পরাশক্তির ভেতরে কোন্দল ছিল।

লম্বা গল্প অল্প কথায় বলতে গেলে, ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে রাজার শাসন চলত। রাজা জহির শাহের আমলে সোভিয়েত ও আমেরিকা উভয়ের সংগেই সুসম্পর্ক বজায় রাখে আফগানিস্তান। ১৯৭৩ সালে রাজা জহির শাহের পতন হয়। সম্ভবত ১৯৭৩-৭৮ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা দাউদ কিছুটা আমেরিকান ব্লকের সমর্থিত ছিল।

এরপর ১৯৭৮ সাল থেকে ৯২-৩ সালে আহমেদ শাহ মাসুদের ক্ষমতা দখল পর্যন্ত বিভিন্ন সোভিয়েত সমর্থিত বা সোভিয়েত পুতুল সরকার ক্ষমতায় ছিল। এদের লিডারশীপ বদল হয়েছে তারাকি, বাবরাক কার্মাল ও সর্বশেষ নাজিবুল্লার হাতে।

১৯৭৮ সালে তারাকি ক্ষমতায় আসবার পর থেকেই বিভিন্ন ইসলামিক গ্রুপ বিদ্রোহ শুরু করে কমিউনিজম-গণতন্ত্র আর বাইরে ইসলামের লেবাসধারী সোভিয়েত সমর্থিত খিচুড়ি সরকারের বিরুদ্ধে। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ।

এই গৃহযুদ্ধ পরবর্তীতে একবিংশ শতাব্দীর মুসলিম জাগরণ পর্যন্ত ভূমিকা রাখে। এই গৃহযুদ্ধ কোল্ড ওয়ারে সোভিয়েতের পরাজয়কে কেবল সময়ের ব্যাপার করে দেয়। এই গৃহযুদ্ধের বদৌলতে মুসলমানেরা বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি সোভিয়েতকে আফগান থেকে বিতাড়িত করে বিংশ শতাব্দীর ইলুশনারি কমিউনিজমকে অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়। এই যুদ্ধের ফলাফল বহুকাল ধরে মুসলমান সভ্যতাকে প্রেরণা যুগিয়ে যাবে, নিরন্তর আশার আলো দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে সন্নিকট সূর্যোদয়ের দিকে।

ক্রমঃ৫

সোভিয়েত আগমন এবং এর বিরুদ্ধে কোয়ালিশন, কাবায় হামলা, আব্দুল্লাহ আযযাম, ওসামা বিন লাদেন, সৌদি আরব, পাকিস্তান আমেরিকা ইত্যাদি

মূলত আমাদের বাংলার কমিউনিস্টদের মতই আফগান কমিউনিস্ট লিডারশীপ ছিল বহুধা বিভক্ত। এই বিভক্তি তাদের পতন ত্বরান্বিত করে এবং সোভিয়েতকে দুর্বল করে দেয়। অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে সামাল দিতে গিয়ে কমিউনিস্টরা তাদের মূল শত্রু ইসলামিস্ট এবং আমেরিকার কাছে পরাজিত হয়।

১৯৬৫ সালে কার্ল মার্ক্সের আদর্শে বিশ্বাসী কতক কমিউনিস্ট নেতা People's Democratic Party of Afghanistan গঠন করে। এই পার্টির মূল চারজন নেতার নাম উল্লেখ করব যারা পরবর্তীতে আফগানিস্তানের শাসনভার পাবে। এই সময় আফগানিস্তানে রাজতন্ত্র ছিল। গঠিত হবার মোটামুটি ৩-৪ বছরের মধ্যেই কমিউনিস্টরা তাদের স্বভাবগত ভাবে আদর্শিক দ্বন্দ্বের কারণে দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে; খালক ও পর্চম।

খালক দলের প্রধান নূর মোহাম্মাদ তারাকি বিশ্বাস করত আকষ্মিক বিপ্লবের মাধ্যমে লেনিনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তারাকির আদর্শ মূলত আফগান গ্রামগুলোতে জনপ্রিয় ছিল। তারাকির প্রধান সাপোর্টার ছিল হাফিজুল্লাহ আমীনআইরনি হল আমীন তারাকিকে হত্যা করে ১৯৭৯ সালে ক্ষমতা দখল করে।

অপর গ্রুপের নাম ছিল পর্চম। নেতা বাবরাক কার্মাল মূলত Gradual Revolution এ বিশ্বাসী ছিল। তার ধারণা ছিল আপাতত ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী আফগান জনগণকে কমিউনিজমের বিষ খাওয়াতে হবে আস্তে-ধীরে। নাহলে রিএকশনে খোদ কমিউনিজমই ধ্বংস হয়ে যাবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে শহুরে জনপ্রিয়তার অধিকারি কার্মালের দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক ছিল। কার্মালের আদর্শে বিশ্বাসী ড. নাজিবুল্লাহ। সেও কার্মালকে অভিশংসন করে কালের পরিক্রমায়।

দাউদ খানকে সরিয়ে প্রথম আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠা করে খালক গ্রুপের নূর মোহাম্মাদ তারাকি (১৯৭৮ সালে)। তারাকি কঠোর হস্তে সমস্ত রাইভাল গ্রুপকে দমন করে। এক্ষেত্রে তার সহকারী হিসেবে সে পায় হাফিযুল্লাহ আমীনকে। PDPA বা People's Democratic Party of Afghanistan এর খালক ফ্র‍্যাকশন, যা মূলত কঠোর দমন নীতি অবলম্বন করে প্রো-ইসলামিক আফগানিস্তানকে রাতারাতি নাস্তিক কমিউনিস্ট স্টেটে বানাতে চেয়েছিল, তারা ক্ষমতায় থাকে মাত্র ২ বছরের মত। কিন্তু এই দুই বছর আফগানিস্তানের ভবিষ্যতের অনেক ঘটনার কারণ হয়ে যায়।

তারাকি ও তার সহচর আমীন আফগানিস্তানে all-out দমন-পীড়ন চালায়। এই দুইয়ের হাত থেকে রেহাই পায়না দাউদ খানের সাপোর্টার ও গ্রাম্য প্রভাবশালী মৌলভির দল যারা কমিউনিজমকে ইসলামের এক নম্বর শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে। এমনকি তারাকি-আমীন গ্রুপ PDPA এর আরেক ফ্র‍্যাকশন পর্চমের বাবরাক কার্মাল ও তার অনুসারীদের হত্যা ও বন্দি করবার পরিকল্পনা নিয়ে আগাতে থাকে।

১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনীর নেতৃত্বে ইরানে তথাকথিত ইসলামিক রেভলুশন ঘটে। খোমেনি ইরানের শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে। শাহ ছিল আমেরিকার একনিষ্ঠ ভালবাসার মানুষ। শাহের পতন সোভিয়েতকে খুশি করে কিন্তু আমেরিকা মরিয়া হয়ে ওঠে ইরান-আফগান ব্লকে প্রভাব প্রতিষ্ঠায় নতুন প্লেয়ার খুঁজতে। আফগানিস্তানে তারাকি-আমীন সরকার সোভিয়েতের অনুগত ছিল কারণ তারা কমিউনিস্ট। কিন্তু তারাকি সরকার যখন আরেক সোভিয়েতপন্থী কমিউনিস্ট গ্রুপ PDPA এর বাবরাক কার্মালের পর্চমের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়, তখন তা সোভিয়েতের মাথাব্যাথার কারণ হয়। বিশেষ করে, ১৯৭৯ সালের মাঝামাঝি অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে আমীন তার প্রেসিডেন্ট তারাকিকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে। এই ঘটনায় সোভিয়েত সরাসরি ব্রিগেড দিয়ে কাবুল দখল করে এবং পর্চমের বারবাক কার্মালকে ক্ষমতায় বসায়।

ইরানের ইসলামিক বিপ্লবে আমেরিকা তার বন্ধু শাহকে হারিয়ে, পার্সিয়ান অঞ্চলে দিশেহারা অনুভব করে। অন্যদিকে ১৯৭৯ সালে জুহাইমান আল ওতাইবির নেতৃত্বে কাবাঘরে হামলা হয়। এই হামলা সৌদি আরবের ক্ষমতায় থাকা আহলে সৌদকে ক্ষমতার অনিশ্চয়তা নিয়ে ভাবতে শেখায় এবং পুরো আরবে তাদের জনপ্রিয়তা হ্রাসের স্পষ্ট নিদর্শন দেখায়। আহলে সৌদ এই অবস্থায় তাদের পুরনো বন্ধু আমেরিকার সাহায্যের কামনা করে। পক্ষান্তরে আমেরিকা, আফগানিস্তানে তাদের পছন্দের লোককে ক্ষমতায় বসানোর জন্য সৌদি পেট্রো ডলারের সাহায্য নেয়। কমিউনিস্ট-সোভিয়াত সমর্থিত তারাকি কিংবা কার্মাল সরকারকে হটানোর জন্য সৌদি ও আমেরিকা তাদের রাজনৈতিক জোট গঠন করে।

নূর মোহাম্মাদ তারাকির সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রকে আফগানিস্তানের জনগণ ভালোভাবে নেয়নি। কমিউনিজমের প্রকাশ্য নেই-ঈশ্বর স্লোগান যেকোন ধর্মপ্রাণ সমাজের মতই আফগানিস্তানেও প্রত্যাখ্যাত হয়। লোকাল মৌলভি ও ধর্মীয় নেতারা এর বিরুদ্ধে জনমত তৈরির চেষ্টা করলে তারাকি সরকার তা কঠোর হস্তে দমন করে।

এই দমন হিতে বিপরীত হয়। আঞ্চলিক রাজনীতির আরেক কী প্লেয়ার পাকিস্তানের প্রো-ইসলামিক প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক তখন ক্ষমতায়। তাছাড়া পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগের বহু অফিসার তখনো আফগানিস্তানে একটি ইসলামিক সরকার দেখবার স্বপ্নে বিভোর। এরূপ পরিস্থিতিতে আফগান কমিউনিস্ট-ডেমোক্রেসির বিরুদ্ধে মোল্লা-মৌলভিদের যেকোন সশস্ত্র বিপ্লব পাকিস্তানের সমর্থন পায়।

১৯৭৯ সালে সৌদি আরবে জোহাইমান আল ওতায়বির নেতৃত্বে কাবাঘরে হামলা হয়। এই হামলার পর জোহাইমান আল ওতায়বির মত বহু আরবই মনে করতে থাকে ইসলামিক বিশ্বে, কিংবা ইসলামের খেদমতে আহলে সৌদের তেমন কোন ভূমিকা নেই। নিজের টেরিটোরিতে যেকোন ধরণের ইসলামিক আদর্শভিত্তিক বিপ্লবের ভয় ধরে যায় আহলে সৌদ সরকারের ভিতর। সেই সময় সৌদি আরবও ইখওয়ানুল মুসলিমীন পন্থী আলেম-ওলামার উপর দমননীতি গ্রহণ করে। ইসলামিক জিহাদি ভাবধারার সাঈদ কুতুবের অনুসারীদের বিভিন্ন ধরণের শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। জুহাইমান ছিল সৌদি আরবেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত গ্রাজুয়েট। তাই এই ধরণের কট্টরপন্থী ইসলামী চিন্তাধারাকে দাবিয়ে রাখার নীতি গ্রহণ করা হয়। এরই ফলশ্রুতিতে সৌদি আরবে কর্মরত ফিলিস্তিনি প্রফেসর আব্দুল্লাহ আযযামকে সৌদি থেকে চলে যেতে বাধ্য করা হয়।

এই আব্দুল্লাহ আযযাম মূলত ওসামা বিন লাদেনের আদর্শিক ভাবগুরু। আব্দুল আযীয ইউনিভার্সিটিতে ছাত্র থাকা অবস্থায় সৌদি ধনকুবেরের ছেলে ওসামা বিন লাদেনের পরিচয় ঘটে শিক্ষক আব্দুল্লাহ আযযামের সংগে। তিনি সৌদি থেকে পাক-আফগান সীমান্তে চলে যান এবং সেখানে বিদেশি সৈন্য ট্রেনিং এর মাধ্যমে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আবদুল্লাহ আযযাম আফগান যুদ্ধের এক বিশাল কী ফিগার। তিনি ওসামা বিন লাদেনকে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন ও এই যুদ্ধকে রাশিয়ান কাফেরদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের ধর্মযুদ্ধজিহাদহিসেবে ফতোয়া দেন। লাদেন পরিবারের সম্পদসহ যুদ্ধে ব্যবহার করবার জন্য সম্পদ আহরণের জন্য তিনি উপমহাদেশে এবং আমেরিকান মুসলিমদের মধ্যে ক্যাম্পেইন চালান। আবদুল্লাহ আযযাম ছিলেন সর্বোপরি ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত আফগান যুদ্ধে মুসলমানদের একজন আদর্শিক ধর্মগুরু।

ইরানের ইসলামিক রেভলুশন আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারে সৌদিকে কিছুটা চাপে ফেলে। শিয়া ফ্রাকশনের খোমেনি গ্রুপ ক্ষমতা দখল করলে সৌদি আরব নিজেদের পৃথিবীব্যাপী ইসলামের রক্ষক হিসেবে প্রদর্শন করতে চায়। তাছাড়া সৌদি সরকারের উলামাদের প্রতি দমন নীতি অনেক উলামাকে অসন্তুষ্ট করে।

উল্লেখিত সমস্ত কারণের প্রেক্ষিতে, সৌদি আরব রাষ্ট্রীয়ভাবে আফগানযুদ্ধকে মুসলমানদের ধর্মযুদ্ধ হিসেবে ফতোয়া দেয়। আফগানিস্তানের যুদ্ধে জান ও মাল ব্যয় করবার জন্য ওসামা বিন লাদেনের সামনে আর কোন বাঁধা থাকেনা।

বিভিন্ন ফ্রন্টে ও বহুধা বিভক্ত আদর্শে সৌদি আরব, ইরান, পাকিস্তান এবং আরও অনেক কী প্রেশার গ্রুপের কোয়ালিশনের সমর্থনে আফগান জনগণ লড়তে থাকে সোভিয়েত আর্মির বিরুদ্ধে। তাদেরকে আফগানিস্তান থেকে তাড়াবার লক্ষ্যে। এই পুরো গ্রুপকেই, দল, মত, আদর্শ নির্বিশেষে 'মুজাহিদীন' নামে ডাকা হয়।

ক্রমঃ৬

২০০১ সালে আমেরিকা সরাসরি আক্রমণ করে আফগানিস্তানকে। তারপর প্রথমে বুরহানউদ্দিন রব্বানিকে ক্ষমতায় বসায় এবং অল্প কয়েকদিন পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান করে হামিদ কারজাইকে। এই কারজাই এক দশকেরও বেশি ক্ষমতায় থাকে। এগুলো পরবর্তী পর্বগুলোতে ডিটেইলস আলোচনা করবো ইন শা আল্লহ। আজ মূলত সংক্ষেপে বর্তমান আফগানিস্তানের কথা বলবো। - জুন ১, ২০১৮

২০০১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হবার পরে সম্ভবত এখনকার মত ভালো অবস্থানে তালেবান কখনই ছিলনা। এর পেছনে অবশ্যই তাদের ২য় নেতা, আমেরিকার ড্রোন হামলায় নিহত মোল্লা মন্সুরের অবদান অনস্বীকার্য। মোল্লা মন্সুরই তালেবানের অন্তর্কলহ দূর করবার জন্যে মোটামুটি নিরপেক্ষ একজন উত্তরসূরি নির্বাচন করে। হাইবাতুল্লাহ আকুন্দজাদা।

২০১৭ সালের নভেম্বারের হিসাবে আফগানিস্তানের শতকরা ৬০ ভাগ এলাকা রিপাবলিক আফগানিস্তানের অধীনে। যার প্রেসিডেন্ট আমেরিকা সমর্থিত আশ্রাফ গনি। অন্যদিকে শতকরা ১৩ ভাগ এলাকা তালেবান অধীনস্থ। আফগানিস্তানের ৪০% এলাকায় সরকারি কোন কন্ট্রোল নেই বা দুর্বল অথবা সেখানে সরকার ও তালেবানের মধ্য লড়াই চলছে।। এইসব তথ্যই আফগান সরকার সমর্থিত সূত্র থেকে নেওয়া। কাজেই বাস্তবে আশরাফ গনির সরকারের অবস্থা আরও নাজুক।

২০১৬ সালে মোল্লা মনসুরের মৃত্যুর পর থেকে তালেবান অত্যন্ত দ্রুতগতিতে আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের প্রভাব বাড়াচ্ছে। ২০১৮ সালে তালেবান অধ্যুষিত এলাকায় একটা মাদ্রাসার হাফেজ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আশ্রাফ গনির সরকার নৃশংস বিমান হামলা চালায় এবং এই হামলায় প্রায় অর্ধশতের বেশি মানুষ মারা যায় যাদের ৯৫% এর বেশি ছিল সিভিলিয়ান এবং অধিকাংশ সদ্য হাফেজ হওয়া শিশু-কিশোর। এ ঘটনাটি গনির সরকারের জন্য আত্মঘাতী হয় এবং তালেবান নেতা মৌলভী আকুন্দজাদা এর পরপরই হিংস্র এবং সহিংস হামলার ঘোষণা দেয়। 'আল খন্দক' নামের এই অপারেশনগুলোতে আফগানিস্তানের মানচিত্রে গত মাস দুয়েকেই অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। অন্তত এগারোটা ডিস্ট্রিক্ট বা জেলার পতন ঘটেছে। একটা গুরুত্বপূর্ণ হাইওয়ে তালেবান ব্লক করে রেখেছে এক মাস ধরে। ফারিয়াব প্রদেশের রাজধানী দখলের দ্বারপ্রান্তে এসে গেছে তালেবান।

আফগানিস্তানের সরকার এবং তালেবান দুই দলই একে অপরকে অন্যের প্রক্সি হিসেবে দোষারোপ করে। যেমন আমাদের দেশে আওয়ামীলীগ বিএনপিকে পাকিস্তানের বা আম্রিকার চর বলে আর আওয়ামীলীগকে বিএনপি বলে ভারতের দালাল।

আফগানিস্তানে কেউই কাওকে সাধারণভাবে কোন আফগানি রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়না। তবে সম্প্রতি রিপাব্লিক আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট গনি এই গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসেছে। আফগানিস্তানের শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে, গনি কোন শর্ত ছাড়াই ফেব্রুয়ারি মাসে তালেবানকে টেবিলে বসে আলোচনার প্রস্তাব দেয় এবং তাদেরকে আফগানিস্তানের রাজনীতিতে স্বক্রিয় অংশগ্রহণ করানো হবে এমন হিন্টস দেয়। এ প্রস্তাবনা ঐতিহাসিক, কেননা এরপর গনি তালেবানকে আর টেরোরিস্ট বলতে পারবে না। তাহলে লোকে বলবে সে সন্ত্রাসীদের আলোচনার টেবিলে ডাকে।

পুরো আফগানিস্তানে গনি সরকারের দৈন্যদশা বিশ্ববাসীর কাছে আরও স্পষ্ট হয় যখন এই প্রস্তাব তালেবান প্রত্যাখ্যান করে। এর বিপরীতে তালেবান গনিকে আমেরিকার পুতুল হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং তাদের আগের কথাই রিপিট করে যে, যতদিন আফগান মাটিতে বিদেশী সৈন্য থাকবে ততদিন আলোচনা হলে গনির বস আমেরিকা বা ন্যাটোর সাথে হতে পারে তবে পুতুল গনির সংগে নয়।
ফেব্রুয়ারির প্রস্তাবের বিপরীতে তালেবান মুখপাত্র জাবিহুল্লা মুজাহিদ আফগান সরকারের পুলিশ ও সরকারী কর্মকর্তাদের সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দেয় এবং তাদেরকে নতুন জীবন সহজ করে দেবার আশ্বাস দেয় যদি তারা আমেরিকা ও আফগান রিপাব্লিকের চাকরি ছেড়ে দেয়। এই সাধারণ ক্ষমা আফগান পুলিশ ও আর্মির জন্য সুখের কিছু ছিলনা বরং এটা ছিল পরোক্ষ প্রাণনাশের হুমকি। এরপর তালেবান ঘোষণা দিয়ে সরকারি এবং আমেরিকান নন সিভিলিয়ান ক্ষেত্রগুলোতে হামলা চালায় এবং তারা একটা উইং তৈরি করে যারা এই মিশনগুলোতে সিভিলিয়ান ক্যাজুয়ালটি কমানোর জন্যে স্বাধীনভাবে কাজ করবে।

তালেবান অগ্রগতিতে ট্রাম্পের ঘুম হারাম হয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আফগানে আরও আমেরিকান সৈন্য বাড়াতে চায় এবং আমেরিকার আন্তর্জাতিক মিত্রদের কাছে গনির সরকারকে 'সন্ত্রাসবিরোধী' কর্মকাণ্ডে সহায়তা করতে আবেদন করে। জবাবে ব্রিটেন আফগানে বৃটিশ সৈন্য বাড়াবার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।

সর্বশেষ কয়েকটা ঘটনা

ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় একদল উলামা আবারও তাদের পছন্দের সরকারের কথায় মিলিত হয়ে সম্ভবত ১১ মে ২০১৮ তে ইসলামের খেদমতে নিবেদিতপ্রাণ হয়েছে। এরা পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আশ্রাফ গনির দাওয়াতে জাকার্তায় একত্র হয়ে তালেবানকে যুদ্ধের পথ ছেড়ে শান্তি আলোচনার দাওয়াত দিয়েছে।

জাকার্তার সম্মেলনের পর আফগানিস্তানের আমেরিকান কমাণ্ডার নিকোলসন দাবি করছে যে শান্তি আলোচনা অগ্রসর হচ্ছে। অপরদিকে তালেবান বলেছে যে নিকোলসন আসলে আফগানিস্তানে নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে গুজব ছড়াচ্ছে।

গনির সরকার, ট্রাম্প ও তার বন্ধুরা এবং নিবেদিতপ্রাণ উলামাকে ফারিয়াবে তালেবানের অগ্রগতি আতংকিত করছে।

ক্রমঃ৭

সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ  (এটা মূলত ক্রম-৫ পটভূমির পরের অংশ)

১৯৭৯ সালের সোভিয়েতের আফগান আক্রমণ থেকে এই বর্ণনা শুরু করছি।

PDPA খালক গ্রুপের প্রেসিডেন্ট তারাকি সোভিয়েতের থেকে প্রাপ্ত সাহায্যে খুশি ছিলনা। সে সরাসরি সোভিয়েত আর্মিকে আসতে অনুরোধ করত। তার দমন নীতি তাকে কমিউনিস্ট, ইসলামিস্ট সবার শত্রু বানিয়েছিল। অন্যদিকে রাশিয়াও তার প্রতি কিছুটা অসন্তুষ্ট ছিল। কারণ, তারাকি অন্য কমিউনিস্ট পর্চমের কার্মাল নাজিবুল্লাহদেরও নানাভাবে অত্যাচার করত। সোভিয়েত প্রথমে সরাসরি যুদ্ধে আগ্রহী ছিলনা। কিন্তু তারাকি যখন তার নিজের দলের লোক হাফিয আমিনের নির্দেশে খুন হয়, তখন সোভিয়েত মনে করে যে এই ঘটনা আফগান কমিউনিস্টদের বহুধা বিভক্ত করে দুর্বল করে ফেলবে। ইরানের ইসলামিক রিফর্ম সৌদি বা US এর মত রাশিয়াকেও আতংকিত করে। তাই মুজাহিদিনদের এমন এডভান্টেজকে বাড়তে না দিয়ে রাশিয়া আফগানে প্রবেশ করে।

আবার প্রো-রাশিয়ান সরকারকে ফেলে দিতে আমেরিকা পাকিস্তানকে সাথে নিয়ে সরকার বিরোধি গ্রুপগুলোকে ইন্ধন দিতে থাকে। এতদভিন্ন, প্রেসিডেন্ট তারাকির হত্যাকারি আমিনকে রাশিয়া বিশ্বাস করতে পারেনা। যদিও রাশিয়া প্রথমেই বুঝতে পেরেছিল যে বিদেশি শক্তির সরাসরি যুদ্ধ করা আফগানিস্তানে উলটো ফল এনে দেবে এবং তা বিরোধিদের পক্ষে জনমত ঘুরিয়ে দেবে। বাস্তবেও তাই হয়েছিল।

প্রেসিডেন্ট তারাকির প্রধানমন্ত্রী এবং হত্যাকারি হাফিয আমীনকে সোভিয়েত প্রথমেই হত্যা করে। এরপর সোভিয়েত আমীন সরকারের বিরুদ্ধে লড়ে সহজেই শহর এলাকার কন্ট্রোল নিয়ে নিতে সক্ষম হয়। কিন্তু তাতে স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি হয়। Communist PDPA এর পর্চম গ্রুপের প্রধান বাবরাক কার্মালকে প্রেসিডেন্ট করা হয়। কিন্তু কার্মাল যখন দেখল, আফগানিস্তানের জনগণ সোভিয়েত আর্মিকে ভালভাবে নিচ্ছেনা, তখন সে যুদ্ধের সমস্ত অশান্তির দায়ভার সোভিয়েতের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। অন্যদিকে গ্রাম্য এলাকায় সরকার ও সোভিয়েত কন্ট্রোল ক্রমাগতভাবে হারাতে থাকে। মুজাহিদিন গ্রুপগুলো বিদেশি শক্তির বিরোধী জনগণকে একত্রিত করে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে তীব্র রেজিস্টেন্স তৈরি করে।

আমেরিকা জাতিসংঘের মাধ্যমে সোভিয়েতের আক্রমণকে অবৈধ ঘোষনা করে নানারকম স্যাংশন ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এদিকে তলে তলে CIA নানা রকম অপারেশন চালাতে থাকে। তারা ইসরায়েলের থেকে অস্ত্র কিনে এনে সাপ্লাই দেয়। অনেক দেশ যেমন, বৃটেন, তুরস্ক ইত্যাদি তাদের পুরোনো অস্ত্র মুজাহিদিনদের কাছে বিক্রি করে দেয়। পাকিস্তান ও সৌদিআরব এই যুদ্ধকে হলি ওয়ার তকমা লাগিয়ে মুসলিম যুবকদের অংশগ্রহণের পথ উন্মুক্ত করে দেয়।

আফগানিস্তান সরকারের আর্মি সোভিয়েতের আগমনের পর দুর্বল হয়ে পড়ে। সম্ভবত আফগান জাতীয়তাবাদ এর মূল কারণ ছিল। অন্যদিকে ছয়মাসের জন্য আসা রাশানরা বুঝতে পারে আফগানে তাদের প্রবেশের অল্প সময় পর প্রস্থান বাবরাক কার্মালকে বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে দেবেনা। কেননা বিরোধি গ্রুপ তখন অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। উভয় সংকটে পড়ে যাওয়া রাশানরা নানা নিষ্ঠুর কৌশলে বিরোধিদের সাপ্লাইয়ার সন্দেহে বহু আফগান গ্রাম (মূলত এয়ারস্ট্রাইকে) তছনছ করে দেয়। এটা বাবরাক ও সোভিয়েত উভয়ের জন্য কাল হয়ে দাড়ায়। মুজাহিদিনরা নিয়মিত ভলান্টিয়ার যোদ্ধা পেতে থাকে গ্রামের পরিবার হারানোদের মধ্যে থেকে। আবার আব্দুল্লাহ আযযাম, ওসামা বিন লাদেন এবং পাকিস্তানে ট্রেনিংপ্রাপ্ত বিদেশি যোদ্ধাদের দ্বারাও।

বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এবং আরব থেকে বহু মুসলিম যুবক এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যদিও লোকাল ফাইটারদের তুলনায় এরা সংখ্যায় অনেক কম ছিল। আব্দুল্লাহ আযযাম ট্রেনিং ক্যাম্পগুলোতে তার ফিলিস্তিন যুদ্ধের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে দেশি-বিদেশি তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন।
সৌদি বিলিয়নিয়ার ওসামা বিন লাদেন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে অস্ত্র খরিদ বাবদ এই যুদ্ধে যোগ দেয়। সে খুব দ্রুতই তার ক্যারিশমাটিক ব্যক্তিত্ব দিয়ে মুজাহিদিনদের মন জয় করে ফেলে। এর সাথে ধর্মযুদ্ধের খাতিরে জান ও মাল ব্যয় করে সে দল-মত নির্বিশেষে আফগান মুজাহিদিনদের মনে স্থান গড়ে নেয়, যা নাইন ইলেভেনের পর তার ভাগ্যকে নির্ধারণ করে।

বিদ্রোহি যোদ্ধারা অনেকটা এখনকার সিরিয়ার মত বহুধা বিভক্ত ছিল। অবশ্য শুরুতে তারা নিজেদের মধ্যে বিরোধে জড়াত না। কিন্তু পরে রাশিয়া আফগান সরকারের ইন্টেলিজেন্স উইংকে কাজে লাগিয়ে এদের মধ্যে বিরোধ লাগিয়ে দিতে সক্ষম হয়।

সমস্ত গ্রুপগুলোর মধ্যে সবচাইতে বড়টা ছিল জমিয়াত-এ-ইসলামির কমান্ডার আহমেদ শাহ মাসুদের। পানশিরের এই সিংহ পুরুষ আফগান যুদ্ধে সাহসিকতার জন্যে সাধারণ আফগানদের মনে জায়গা করে নেয়। সে ছিল জমিয়াতের নেতা বুরহানউদ্দিন রব্বানির অনুসারী। বুরহানউদ্দিন তার আদর্শগত দিক থেকে ভারতের ইসলামি চিন্তাবিদ আবুল আলা মওদুদি দ্বারা প্রভাবিত ছিল।
আরেকটা বড় গ্রুপ ছিল গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের হিযব-ই-ইসলামী। গুলবুদ্দিন মূলত প্রাথমিক জীবনে জমিয়াতের সাথে থাকলেও পরে বেরিয়ে আসে। আমরা পরবর্তী আলোচনায় দেখব যে হেকমতিয়ারের দল এবং মত পরিবর্তনের ইতিহাস তাকে কীভাবে আজ পর্যন্ত রহস্যময় করে রেখেছে। হেকমতিয়ারের সাথে সন্ধি করেনি এমন গ্রুপ আফগানিস্তানে কম ছিল। আবার প্রভাব বিস্তারের জন্য মুজাহিদিন গ্রুপকে আক্রমণেও হেকমতিয়ার ছিল সরেস।

আরেক প্রভাবশালী মুজাহিদিন মোহাম্মাদ নবী মোহাম্মাদি আরেকটা মাঝারি সাইজের গ্রুপের নেতা। সে মূলত সোভিয়েতের বিরুদ্ধে লড়াইকে ফোকাস করে এবং নিজেদের লড়াইকে বন্ধ করবার চেষ্টা করে। বহু তালেবান তার ছাত্র এবং তার আন্ডারে যুদ্ধও করেছে।

আরেকটা গ্রুপের কথা উল্লেখ না করলেই নয়তা হল জালালউদ্দিন হক্কানির হক্কানি নেটওয়ার্ক। জালালউদ্দিন হক্কানির ছেলে সিরাজউদ্দিন বর্তমান তালেবানের ২য় বা ৩য় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। হাইবাতুল্লাহ আকুন্দজাদার পর মোল্লা ওমরের ছেলের ও সিরাজের পজিশন বা র‍্যাংক প্রায় একই। যদিও অফিশিয়ালি সিরাজ ২য়।

সোভিয়েত খুব দ্রুতই আফগান গ্রামে ভিলেইন হিসেবে আবির্ভূত হয়। লোকাল ওয়ারলর্ডদের আক্রমণ পরিচালনার কেন্দ্র ছিল বিভিন্ন গ্রাম। সত্য-মিথ্যা নির্বিশেষে সোভিয়েত এইসব গ্রামে এয়ারস্ট্রাইক চালাতো, ফসল পুড়িয়ে দিত, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে গ্রামবাসীকে বন্দি করে গোয়েন্দা তথ্যের জন্য সাধারণ মানুষকে নির্যাতন করত, যা বাবরাক কার্মালের সরকার বিরোধি আফগানের সংখ্যা দিন কে দিন বাড়িয়েই চলেছিল।
যদিও সৈন্য মৃত্যুর সংখ্যা ছিল মুজাহিদিনদের অনেক বেশি, প্রায় চার থেকে পাঁচগুণ। যদিও রাশান ও আফগান সরকারের মোট সৈন্য সংখ্যাও মুজাহিদিনদের তিনগুণ ছিল। সোভিয়েত এবং তাদের পুতুল কার্মাল আফগানিস্তানে শান্তি বা কন্ট্রোল কোনটাই আনতে পারেনি।

রাশিয়া অচিরেই বুঝতে পারে যে, আফগানিস্তানে নিজেদের সরকার বসিয়ে troops সরিয়ে নেওয়া প্রায় অসম্ভব। ক্রমাগত গ্রাম ধ্বংসের স্ট্রাটেজি, গোয়েন্দা লেলিয়ে বিরোধিদের আপোসে লড়িয়েও সরকারি কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছেনা। বরং দখলকৃত টেরিটরিতে সৈন্য কমিয়ে দিলেই বেদখল হয়ে যাচ্ছে। যদিও মোট ১০ বছর সেখানে অবস্থান করে, কিন্তু রাশিয়া এর মাঝামাঝি পিরিয়ড থেকেই আফগান হতে সম্মানজনক এক্সিট খুঁজতে থাকে এই ভেবে যে পরাজয়কে কূটনৈতিক চাল চেলে ধামাচাপা দেওয়া যায় কিনা। বারবাক কার্মাল মূলত রাশিয়ানদের পুতুল বলা যায়। রাশিয়ান এক্সিটের শুরুর দিকেই নিজ দলের নাজিবুল্লাহ তাকে সরিয়ে ১৯৮৭ সালে ক্ষমতা দখল করে।

ক্রমঃ৮

১৯৯৬ সালে মাসুদ ও বোরহান রব্বানির জমিয়াত সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে তালেবান। আফগানিস্তান Islamic state of Afghanistan থেকে পরিবর্তিত হয় ইসলামি ইমারত আফগানিস্তানে। তালেবানের অবিসংবাদিত নেতা মোল্লা ওমর দেশের নেতৃত্বে আসে।

মাসুদ কিংবা বোরহানের সরকার কি পুতুল সরকার ছিল? না। বরং মাসুদের জমিয়াত সরকার ছিল আমেরিকা সমর্থিত, আমেরিকার পুতুল নয়। পরবর্তীতে আমরা পুতুল সরকার বলতে কী মনে করি সেই আলোচনা করবো ইন শা আল্লহ।

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে মোল্লা ওমর ও তার তালেবান প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু আফগান যুদ্ধ থেকে শুরু করে ক্ষমতার শেষ দিন পর্যন্ত মাসুদ ছিল আমেরিকার বিশ্বাসভাজন। মুজাহিদিন যোদ্ধা হিসেবে মাসুদ ছিল এক নম্বর কী প্লেয়ার আর সরকার হিসেবে মাসুদের সরকার আমেরিকা ও তার কলিগদের কাছে ছিল স্বস্তির।

মাসুদ কমিউনিস্ট ছিলনা। বরং কমিউনিস্ট হটিয়ে সে ক্ষমতা দখল করে। মাসুদ ইসলামী সিম্প্যাথাইজার ছিল, কিন্ত মৌলিক ইসলাম প্রতিষ্ঠায় মাসুদ সরকারের তেমন ভূমিকা না থাকায় আফগান যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতিতে মাসুদ আমেরিকার প্রিয়পাত্র হয়।

আমেরিকা জানতো যে, যুদ্ধ করা অসংখ্য যোদ্ধা গ্রুপ তখন আফগানিস্তানে বিদ্যমান। এই গ্রুপগুলো ওসামা বিন লাদেন ও তার গুরু আব্দুল্লাহ ইউসুফ আযযামের ছড়ানো জিহাদী অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত। তাছাড়া উপমহাদেশীয় উলামাদের ব্যাপক চাপ ছিল কমিউনিস্ট হটিয়ে ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবার। তাই সরাসরি সেক্যুলার ডেমোক্রেসি ও প্রকৃত ইসলামিক সরকারের মাঝামাঝি আহমেদ শাহ মাসুদের সরকার আমেরিকার ছিল প্রথম পছন্দ।

পানশিরের সিংহ, ব্যক্তিত্ববান সুপুরুষ আহমেদ শাহ মাসুদের সরকার ৪ বছরের মত ক্ষমতায় ছিল। এরপর আসে অপেক্ষাকৃত ইসলামপন্থী তালেবান। তালেবান ২০০১ সালের শেষের দিকে সরাসরি আমেরিকার সৈন্য ও জেনারেলদের কাছে রাজধানী ছেড়ে দিয়ে insurgent হয়ে যায় এবং গেরিলা অপারেশনের মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করতে থাকে। তাদের এই প্রচেষ্টায় তারা একে একে অনেক বন্ধু হারাতে থাকে। কেননা ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা বা রাশিয়ার বন্ধু নয়, এমন কাওকে সাহায্য করার অর্থসন্ত্রাস

তালেবান সরকারের উচ্চপদস্থরা ছিল সোভিয়েতের ত্রাস, আর আমেরিকার বন্ধু মাসুদের শত্রু। তাদের মূলমন্ত্র ছিল স্থানীয় উলামাদের স্বপ্নের ইসলামিক ইমারত প্রতিষ্ঠা। বন্ধুহীন বছরগুলো আফগানিস্তানের পাহাড়ে কাটিয়ে, ১৫ বছরের দীর্ঘ স্ট্রাগলের পর ২০১৬ সাল থেকে মৌলভি হাইবাতুল্লাহ আকুন্দজাদার নেতৃত্বে তালেবান ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে, যা আঘাত হানে বহু রাষ্ট্রের স্বার্থে।

২০০১ সালে আমেরিকা যখন আফগান আক্রমণ করে, তখন বাইরের ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোর তেমন কোন এক্টিভিটি ছিলনা। আফগানিস্তানে তখন আমেরিকা তার পুতুল সরকার (প্রথমে বোরহানউদ্দিন) হামিদ কারজাইয়ের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক এবং অনৈসলামিক সরকার গঠন করে। এই হামিদ কারজাইকে সিলেক্ট করা হয় জার্মানিতে বসে। কারজাইয়ের সরকারকে কার্যত ইন্সটল করে আমেরিকা। বিগত ১৭ বছর ধরে কারজাই ও আশ্রাফ গনির সরকারকে কার্যত প্রোটেকশান দিয়ে আসছে আমেরিকার জেনারেলরা। এরা আফগানিস্তানের মানুষের রক্ত ও ঐতিহ্যের বিনিময়ে ও পরাধীনতার গ্লানিতে চূর্ণ করে আশ্রাফ গনিদের পুতুল সরকারকে টিকিয়ে রাখছে।

এই উপমহাদেশ থেকে শুরু করে সৌদি আরবের উলামারা অনেকে আফগানিস্তানে আমেরিকান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লেখালেখি করেছেন। তবে তারা সংখ্যায় অনেক নন। কোন এক অজ্ঞাত কারণে সৌদি ও পাকিস্তানে ধীরে ধীরে তালেবান নিয়ে আলোচনা ট্যাবুতে পরিণত হয়। পাকিস্তান তাদের অযোগ্য সামরিক শাসক পারভেজের আমলে তালেবান সরকারের সঙ্গে শেষ সূতোটি ছিড়ে ফেলে লাল মসজিদ হামলার মাধ্যমে। পাকিস্তানের সেনাশাসক পারভেজ তার পূর্বসুরি জিয়াউল হকের মত সাহসী ছিলনা, সে ছিল কাপুরুষ।

সৌদি আরবও আফগানিস্তান নিয়ে আর কোনদিন মাথা ঘামায়নি। বস্তুত এই সরকারগুলো তাদের দেশীয় বিরোধীদের নিয়ে চিন্তিত ছিল। সৌদি তার রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে আমেরিকার নুন খায় ও তাদের ইন্টেলিজেন্স পয়সা দিয়ে কেনে।

ক্রমঃ৯

আফগানিস্তান। দুর্গম পাহাড়ি এলাকা আর উপত্যকায় ভরা এই দেশ। বহু সুপারপাওয়ারের কাছে অপরাজেয় আফগানদের গর্ব এই দেশ।

১৯৭৯ সালের ডিসেম্বর মাসে এই অপরাজেয় দেশের রাজধানী কাবুল, সোভিয়েত রাশিয়ার অধীনস্থ হয়ে যায়। হাফিযুল্লাহ আমীনকে হত্যা করে রাশিয়া ইন্সটল করে পুতুল বাবরাক কার্মালকে।

১০ বছর ধরে মূলত ইসলামপন্থি Warlord দের হাতে মার খেয়ে পড়িমরি করে আফগান থেকে পালিয়ে বাঁচে রাশিয়া। আফগান পুনরায় স্বাধীন হয়। রাশিয়ার ছেড়ে যাওয়া নাজিবুল্লাহ সরকারের খুব তাড়াতাড়িই পতন হয়। কাবুলের মসনদে আসে জেনারেল আহমেদ শাহ মাসুদ ও বোরহানউদ্দিন রব্বানির সরকার। মোটামুটি ১৯৯২ সাল থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত তালেবান দ্বারা হটানোর আগ পর্যন্ত এরাই ছিল কাবুলের হর্তাকর্তা।

১৯৯৬ সালে তালেবান আমেরিকাকে অসন্তুষ্ট করে ও মাসুদকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসে। ক্ষমতায় আসবার পর তারা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির আশায় বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চালাতে থাকে। কিন্তু আমেরিকা বা তার দোসরেরা তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি।

সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের জিহাদকে সৌদি ও স্থানীয় দেওবন্দি সমস্ত উলামা ইসলামিক ধর্মযুদ্ধ বা জিহাদ বলে আখ্যায়িত করেন। সৌদি বিলিয়নিয়ার ওসামা বিন লাদেন এই যুদ্ধে তার নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দেয়।

সৌদির সুখের জীবন ছেড়ে জান ও মাল ব্যয় করা ক্যারিশমাটিক ফিগার ওসামা খুব সহজেই আফগান যোদ্ধাদের মন জয় করে নিতে সমর্থ হয়। আফগান নেতাদের অনেকে তাকে অন্য আফগান গ্রুপের নেতার চাইতেও বেশী ভালোবাসত, গুরু মানত। ওসামা এই যুদ্ধ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এবং মিলিটারি ধারণা লাভ করে তার গ্লোবাল ধর্মযোদ্ধাদের গ্রুপ আল কায়িদাতুল জিহাদ গঠন করে।

ওসামা আফগানিস্তানে কত সম্পদ ব্যয় করে তার একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে এই ঘটনায়; হেরাতে একটা ট্রেনিং ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার জন্য ওসামা আবু মুসাব যারকাউইকে বাংলাদেশি মূল্যে প্রায় ২ কোটি টাকা দেয়। অথচ আমার জানামতে ওসামা এর আগে যারকাউইর সাথে দেখাও করেনি।

ওসামার আল কায়েদার ধর্মীয় বায়াত ছিল তালেবান নেতা মোল্লা ওমরের কাছে। এদিকে আমেরিকা বরাবরই তার প্রিয়পাত্র মাসুদ ও বোরহানকে ক্ষমতায় দেখতে চাইত। ২০০১ সালের ৯ সেপ্টেম্বার ছদ্মবেশী আত্মঘাতী বোমা হামলায় মাসুদ মারা যায় এবং ১১ সেপ্টেম্বার টুইন টাওয়ারে হামলার ঘটনা ঘটে। দুটো ঘটনাতেই আমেরিকা ওসামা বিন লাদেন ও আল কায়েদাকে দায়ী করে এবং মোল্লা ওমরকে নির্দেশ দেয় বিন লাদেনকে ধরে দেবার জন্য।

নাইন ইলেভেন নিয়ে আমার ব্যক্তিগত ভাবনা অন্য আরেকদিন লিখবো যদি আল্লাহ চান। আমার জানামতে নাইন ইলেভেনের পর নিচের ঘটনাগুলো ঘটে।

মোল্লা ওমর আমেরিকাকে বিন লাদেনের বিচার করবার আশ্বাস দেয়। তালেবান সরকারের অধীনে আফগানিস্তানে ইসলামিক আইনে ওসামার বিচার করবার কথা আসে। তবে তার আগে তদন্তে প্রমাণ করবার বিষয় আসে ওসামা আসলেই এই ঘটনায় জড়িত ছিল কিনা। কিন্তু মোল্লা ওমরের তদন্তে আল কায়েদা কিংবা বিন লাদেন টুইন টাওয়ারে হামলা অস্বীকার করে।

আমেরিকা তার জনগণের উপর হামলার কারণে এক ধরণের অহংকার নিয়ে মোল্লা ওমরের সমস্ত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। সর্বশেষ মোল্লা ওমর আমেরিকার কাছে এই হামলার প্রমাণ চায়। আমেরিকা সেটাও দিতে অস্বীকার করে এবং ওসামাকে নিঃশর্তভাবে তাদের হাতে তুলে দিতে বলে।

স্বল্পভাষী মোল্লা ওমরের এটা বুঝতে বাকি ছিল না যে আমেরিকার নির্দেশ অমান্য করার ফলাফল আফগানিস্তানে সরাসরি আমেরিকার আক্রমণের নামান্তর। সাথে এটাও কারো অজানা ছিল না যে ওসামা বিন লাদেনকে আমেরিকার হাতে তুলে দেওয়া তার জীবননাশের সমান।

ওমর তার উচ্চপদস্থ তালেবান অফিশিয়ালদের সাথে পরামর্শ করে। এই অফিশিয়ালগন বিন লাদেনকে সোভিয়েত যুদ্ধ থেকে চেনে। তাদের অধিকাংশের বক্তব্য ছিল ধর্মীয় আবেগ দিয়ে ভরাঃ "ওসামা আমাদের মুসলিম ভাই। আমরা তার সংগে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সোভিয়েত তাড়িয়েছি। এখন কাফের আমেরিকার হাতে তাকে তুলে দেওয়া কী করে মিল্লাতে মুহাম্মাদি অংশ হতে পারে? আমরা প্রয়োজনে যে কোন ফলাফলের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু নিজের ভাইয়ের জীবন বিপন্ন হতে দেবোনা।" মোল্লা ওমরও তার কমান্ডারদের সাথে একমত ছিল।

নাইন ইলেভেনের পর যে এত তাড়াতাড়ি আমেরিকা আফগানিস্তান আক্রমণ করেছিল, তা সত্যিই বিষ্ময়কর। আমেরিকার মিলটারি মাইটের কাছে আফগানিস্তানের কারিশমা ম্লান হয়ে গিয়েছিল। মোল্লা ওমর তার স্বপ্নের পরিসমাপ্তি দেখছিল এবং সেই যে আফগানিস্তানের প্রাণ, কাবুলের মসনদ ছেড়ে গিয়েছিল, জীবদ্দশায় সে তা আর দেখে যেতে পারেনি।

আফগানিস্তানে মোল্লা ওমররা সোভিয়েত যুগের পতন ঘটিয়েছিল। কিন্তু আমেরিকান Invader দের হাতে স্বাধীনতার সূর্যকে পুনরায় অস্তমিত হয়ে থাকতেই এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল ওমরকে। সেটা অবশ্য আরও ১৪ বছর ধরে আমেরিকার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে স্ট্রাগলের পরে।

ক্রমঃ১০

২০০১ সালে তালেবান সরকারকে উৎখাত করার পর আমেরিকা প্রথমে বোরহানুদ্দিন এবং পরে জার্মানিতে অনুষ্ঠিত একটা কনফারেন্সের মাধ্যমে হামিদ কারজাইকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে। কারজাইয়ের সরকার ছিল মূলত পুতুল মীর জাফরের সরকার। এই গণতান্ত্রিক সরকার ছিল রাশিয়ার ইন্সটল করা বাবরাক কার্মালের অনুরূপ সরকার। সেই কারজাই বা তার পরের পরাধীন সরকারগুলোকে আজও আমেরিকা তার সৈন্যসামন্ত দিয়ে প্রটেকশন দিয়ে যাচ্ছে, আর তারা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে আমেরিকার এজেন্ডা।

আপনি যদি একজন সাধারণ মুসল্লি হয়ে থাকেন বাংলাদেশের, তাহলে আপনি জানেন এদেশে একটা তথাকথিত ওলামাগোষ্ঠী বিদ্যমান যারা সৌদি আরবকে আদর্শ ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণ করতে চায়। এরা কখনই আপনাকে বর্তমানে আশরাফ গনির সরকার কী করছে তা বলবেনা। এরা এও বলবেনা লাল মসজিদের হিরো গাজী কেন পাকিস্তানি আর্মির সাথে যুদ্ধ করে মরেছিল। বলবে না কী করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জিহাদ কিছুদিন পর আমেরিকার বিরুদ্ধেসন্ত্রাসেপরিণত হয়েছিল। কিন্তু এরা আপনাকে সুযোগ পেলেই মোল্লা ওমর বা তালেবানের ব্যাপারে দুটো কটু কথা শুনিয়ে দিতে পিছপা হবে না। আমেরিকার আফগান ছাড়া নিয়েও এদের তেমন কোন মাথাব্যাথা নেই, কারণ তারা হলো আহলে সৌদ পন্থি।

সৌদিআরব রাজনৈতিকভাবে অনেক আগে থেকেই আমেরিকাপন্থি। সেই আলোচনা আগের তালেবান সিরিজে করা হয়েছে। আহলে সৌদ যেকোন ইসলামিক পলিটিকাল মুভমেন্টকেই তাদের লাভ ক্ষতির হিসাবে দেখতে চায় নিজেদের মসনদ টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে। ১৯৭৯ সালে জুহাইমান আল ওতায়বির দ্বারা কাবা আক্রান্ত হবার পর সৌদি উলামা ফিল্টার করা শুরু করে। আরব বসন্তের ছোঁয়া থেকে বাঁচতে এই দশকে আরও মরিয়া হয়ে আমেরিকার প্রতি নির্ভরশীলতা বাড়ায়।

২০০১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হবার পর তালেবানদের জন্য আজকের মত সুসময় আর কখনও আসেনি। মোল্লা ওমরের মৃত্যুর পর তালেবানদের অভ্যন্তরে নেতৃত্ব নিয়ে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। ২০১৫ সালে মোল্লা মনসুর অফিশিয়াল নেতৃত্বে আসলেও মোল্লা ওমরের মত কারিশমা তার ছিলনা। কিন্তু মনসুর উত্তরসূরি নির্বাচনে অসাধারণ দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। আমার বিচারে সেটাই তালেবানকে আজকের জায়গায় নিয়ে গেছে।

মোল্লা আখতার মনসুর তার মৃত্যুর পর অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ এবং ঠাণ্ডা মাথার মৌলভি হাইবাতুল্লাহ আকুন্দজাদাকে নেতা নির্বাচন করতে নির্দেশ দেয়। সাথে ২য় ও ৩য় প্রধান দলনেতা বানায় জালালউদ্দিন হক্কানির ছেলে সিরাজ ও মোল্লা ওমরের ছেলে ইয়াকুবকে। এতে তালেবান তার অভ্যন্তরীণ ঝামেলাগুলো কাটিয়ে উঠে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে।

২০১৮ সালে যুদ্ধরত নয় এমন সিভিলিয়ান মৃত্যু কমানোর জন্য তালেবান নিজস্ব কমিশন বানায়। এবং বিশেষ করে এই বসন্তে আল খন্দক নামে তারা বহু ডিসাইসিভ অপারেশন চালায়। এতে কাবুল সরকারের ভিত নড়ে যায়।

সৌদি বা পাকিস্তান কখনই আমেরিকার আফগান আক্রমণ নিয়ে সোচ্চার ছিলনা। উলামাদের একত্রিত করে আমেরিকার বিরুদ্ধচারণ করা তাদের পক্ষে অসম্ভব ছিল। পাকিস্তানি আর্মির তেহরিকের বিরোধ পাকিস্তানে তালেবান বিরোধি মনোভাব প্রবল করে তোলে। ২০০২ বা তার পরের কিছু সময় আড়ালে আবডালে কিছু মানুষ এবং উলামা আফগানিস্তান বিষয়ে কথা বললেও পরবর্তী সময়ে তালেবান কেন্দ্রিক যে কোন বিষয় একরকম ট্যাবু হয়ে যায়।

মিলিটারি মাইটের হাতে তালেবানের পরাজয় অনিবার্য - এমন ধারণা ছিল অনেক উলামা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকের। এরই ফলশ্রুতি হিসেবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ওবামা তার ২য় টার্মে ক্ষমতায় আসবার পর ২০১৪ সালের ভিতর আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার সকল সৈন্য প্রত্যাহারের কথা বলে। প্রকৃতপক্ষে দেশের বাইরে সেনা পাঠানো যেকোন সরকারের জন্যই প্রচুর খরচের ব্যাপার। কিন্তু আফগানিস্তানের সেই সময়কার পরিস্থিতি (২০১৪) ততটা অনুকূলে ছিলনা আমেরিকার যতটা ছিল আশা।

ওবামা সেনা প্রত্যাহার না করলেও ট্রাম্পের নির্বাচনী ইশতেহারে দেশের বাইরে আমেরিকার খরচ কমাবার একটা বিষয় খুব কড়াভাবে উল্লেখ ছিল। ট্রাম্প তাই চাইবেই ২০২০ সালের US নির্বাচনের আগে আফগানিস্তান বিষয়ে ক্লিয়ার কোন উত্তর।

গনির উপর প্রেশার ছিল আমেরিকান সৈন্যের উপর নির্ভরতা কমানোর। কিন্তু আল খন্দক অপারেশনে অসহায় গনি এখন আরও কিছু বৃটিশ সৈন্যের সহায়তা চাচ্ছে তার পরাধীন মসনদ টিকিয়ে রাখার জন্য।

কাবুলে আমেরিকার পুতুল সরকার যখনই খারাপ অবস্থায় গেছে তখনই তারা তালেবানকে আলোচনার টেবিলে ডেকেছে এবং আলোচনার শর্ত শিথিল করেছে। সর্বশেষ আশরাফ গনি নিঃশর্ত আলোচনার প্রস্তাব পেশ করে যেটা তালেবান প্রত্যাখ্যান করে দেয়। তাদের কথা হল গনির সরকার পুতুল, ন্যাটো বা আমেরিকার প্রক্সি। আলোচনা হলে আমেরিকার সাথে হবে, প্রক্সির সাথে নয়।

এদিকে আমেরিকা তালেবানকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে আখ্যায়িত করে এসেছে। যেহেতু সন্ত্রাসীদের সাথে কোন সভ্য মানুষ আলোচনায় বসতে পারেনা আর বসলেও পরে তাকে আর সন্ত্রাসী বলতে পারবেনা; এই উভয় সংকটে আফগানিস্তানে আলোচনা হবার পথ রুদ্ধ হয়ে আটকে আছে। আর ওদিকে তালেবান তো প্রতিদিন অগ্রসর হচ্ছেই।

আলোচনা হলে সবচাইতে লাভ গনির সরকারের। কেননা বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে গনির সরকার বেশিদিন টিকবেনা। আমেরিকার ট্রাম্প বড় কোন যুদ্ধের খরচ নেবেনা, তাই সৈন্য প্রত্যাহার করে নিলে গনিদের জীবন বাঁচবে কিনা সন্দেহ আছে। তাই তড়িঘড়ি করে শান্তি আলোচনার জন্য আমেরিকা ও গনি সরকার উভয়ই বেছে নিয়েছে আফগানিস্তানের পুরনো প্লেয়ার সৌদি আরবের মধ্যস্থতাকে।

সৌদি উলামার (এমনকি সরকারপন্থি হলেও) একটা গ্রহণযোগ্য নেটওয়ার্ক আছে সারাবিশ্বে। এটা হল পেট্রো-ইসলাম। আমেরিকা এবং গনি চাইছে, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তালেবানকে প্রেসার দিয়ে আলোচনার টেবিলে বসাতে। তারা সারাবিশ্ব থেকে ফরিদ উদ্দিন মাসুদের মত বিতর্কিত লোক দিয়ে কিছু মুখস্থ সরকারি বুলি আওড়ানোর জন্য গত ১০ ও ১১ জুলাই এক সম্মেলনের আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করে বিশ্ববরেণ্য ক্বারী আব্দুর রহমান সুদাইস। বাংলাদেশ থেকে অংশ নেয় দেওবন্দি-কওমি ঘরানার ফরিদউদ্দিন মাসউদ। এই ধরণের আরেকটা সম্মেলন এর আগে জাকার্তায় হয়েছিল।

আসলে এইসব সম্মেলনের আসলেই তেমন কোন ধর্মীয় গুরুত্ব নেই, কেননা এগুলো রাজনৈতিক। তুরস্কের এফেন্দি, উমাইয়াদের পোষা টিয়া কিংবা আব্বাসীয় খলিফা মামুনের অধীনস্থরা ঠিক এরকম ভাষায়ই শাসকের কর্মকাণ্ডকে কুরআন আর হাদিস দিয়ে সাব্যস্ত করত, এ আর নতুন কিছু নয়।

ইমাম আবু হানিফা, ইমাম আহমদেরা এইসব শাসকের আনুগত্যকে অস্বীকার করে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। আপনি কি একটা আলেমের নাম জানেন, যে ইমাম আহমদের মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর করেছিল?

রহিমাহুমুল্লহ। হাদা-নাল্লহ।





দান সাদাকার বিনিময় নিন আল্লাহর থেকে
আল মুজাহিদ আরমান

আমরা অনেক সময় ভিক্ষুক বা কোন অভাবগ্রস্তকে কিছু দিলে বলি, "আমাদের জন্য দু'আ করবেন।" এটি বললে এক দিক থেকে লস হতে পারে। কারণ তখন ব্যাপারটা এমন হয় যে, আপনি দানের বিনিময়ে তার থেকে দু'আ ক্রয় করলেন! তাহলে দানের প্রতিদান তো ভিক্ষুক থেকেই নিয়ে নিলেন, আল্লাহর কাছ থেকে কীভাবে নিবেন?
.
আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল সা.-কে একটি ভেড়া উপহার দেয়া হলে, তিনি বলেন, "এটি বণ্টন করে দাও।" খাদেম ফিরে এলে আয়িশা রা. জিজ্ঞেস করেন, 'তারা কী বলল?' খাদেম জানান, 'তারা বলেছে - বারাকাল্লাহু ফিকুম (আল্লাহ আপনাদের বরকত দিন)
তখন আয়িশা রা. বলেন, 'ওয়া ফিহিম বারাকাল্লাহ' (আল্লাহ তাদের বরকত দিন)
আয়িশা রা. আরো বলেন, তারা যা বলেছে আমরাও তাদের অনুরূপ বলে দিচ্ছি। আর আমাদের সওয়াব তো আমাদের থাকছেই!'[১]
ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহ. বলেন, "আমাদের কাছে এ মর্মে সংবাদ পৌঁছেছে যে, দান-সাদাকার ক্ষেত্রেও তিনি অনুরূপ বলতেন।"[২]
.
হাদিসটিতে লক্ষ করুন, আয়িশা রা. বা তাঁর খাদেম কিন্তু ভিক্ষুককে এটি বলেননি যে, "তুমি আমাদের জন্য বরকতের দু'আ করো", বরং ভিক্ষুক স্বেচ্ছায় দু'আ করেছে। তবুও আয়িশা রা. তাঁর দু'আ তাকেই ফেরত দিয়ে দিয়েছেন, যাতে আখিরাতে দানের প্রতিদানে কোন কমতি না আসে! আর আমরা কী করি? ৫০/১০০ টাকা দিলেই ভিখারীর কাছে দু'আ চেয়ে বসি! আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।
----------------
(১) ইবনুস সুন্নি, ২৭৩, হাদিসটির মান জাইয়িদ তথা উত্তম।
(২) "আপনার প্রয়োজন আল্লাহকে বলুন" - লেখক : ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ, পৃষ্ঠা ১৭৬)








মিস ওয়ার্ল্ড বনাম মিস আখিরাহ
আরিফুল ইসলাম

মিস ওয়ার্ল্ড/মিস ইউনিভার্সের অনেক গল্প শুনেছি, এবার একজন মিস আখিরাহ'র গল্প শুনি। সত্য গল্প...
ক.
বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী মহিলা কে?
প্রশ্নটা যদি হতো, বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী কে? তাহলে চোখের সামনে ভেসে উঠতো বিল গেটস, ওয়ারেন বাফেট, জেফ বেযস, মার্ক জুকারবার্গ এই নামগুলো।
.
বিলিয়নিয়ারদের লিস্টে যেহেতু মহিলাদের নাম পেছনে, সেজন্যে মহিলা বিলিয়নিয়ারদের নামগুলো খুব একটা পরিচিত নয়।
বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী মহিলা হলেন এলিস ওয়াল্টন [১], ওয়ালমার্ট এর প্রতিষ্ঠাতা স্যাম ওয়াল্টনের একমাত্র মেয়ে। বাবার মৃত্যুর পর সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হন এলিস ওয়াল্টন। বৈবাহিক অবস্থা ডিভোর্সি। বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী মহিলা তালাকপ্রাপ্তা!
.
আয়ের দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কোম্পানি হলো ওয়ালমার্ট। আর আমেরিকার খুচরা বিক্রেতার দিক থেকেও সবচেয়ে বড় ওয়ালমার্ট।
খ.
বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরী, 'মিস ওয়ার্ল্ড' এর ক্রাউন মাথায় থাকা সত্ত্বেও অনেকেই পারিবারিক জীবনে সুখী ছিলেন না। 'সুন্দরী হলেই সুখী হওয়া যায়না' কথাটা তাদের সাথে অনেক ক্ষেত্রে মিলে যায়।
.
Yukta Mookhey নামের ভারতের মিস ওয়ার্ল্ড ছিলেন তালাকপ্রাপ্তা। তবে তারচেয়েও খারাপ পরিণতি হয়েছে মারিয়ানা কলোভোবা ফিদারস্টোন আর নাফিসা জোসেফের।
.
মারিয়ানা কলোভোবা ফিদারস্টোন ছিলেন যুক্তরাজ্যের সেরা সুন্দরী। তার ব্যাংকার স্বামী তাদের বিবাহ বিচ্ছেদের কথা বললে মারিয়ানা এমনভাবে মদপান করেন যে, মদপানের বিষক্রিয়ায় মারা যান।
.
নাফিসা জোসেফ ছিলেন মিস ইন্ডিয়া (১৯৯৭)। তার স্বামী তাদের বিবাহ বিচ্ছেদের কথা বললে তিনি গলায় দড়ি লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন [২]।
গ.
যে মিস আখিরাহ'র গল্প বলতে যাচ্ছি তাঁর উপাধি ছিলো তাহিরা। তাহিরা অর্থ পবিত্র। তিনি এমন এক সময়ে জন্মগ্রহণ করেছেন, বেড়ে উঠেছেন যেই সময়টা ইতিহাসে Age of Darkness নামে পরিচিত। এরকম অজ্ঞতার যুগে পূতপবিত্র থাকার জন্য তিনি এই উপাধী লাভ করেন।
.
তিনি ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। তার বাবার নাম খুওয়াইলিদ ইবন আসাদ। বাবার মৃত্যুর পর তিনি বাবার সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হন। তিনি তাঁর সময়ের অন্যতম সম্পদশালী ছিলেন। তাঁর একার পণ্য তাঁর বংশের বাকি সবার সম্পদের সমান ছিলো।
.
দুই বারের বিধবা হওয়া সত্ত্বেও তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন তার দেশের অনেক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ। তিনি সবগুলো প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর চেয়ে বয়সে ছোট এক যুবকের সততা এবং আমানতদারিতা তাকে মুগ্ধ করে। তিনি সেই যুবককে বিয়ের প্রস্তাব দেন। তাদের বিয়ে হয়।
.
তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে সম্পদশালী মহিলা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর স্বামী যখন একটা গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকতেন তখন তিনি সেই পাহাড়ে উঠে স্বামীর জন্য খাবার নিয়ে যেতেন।
একবার তিনি তাঁর স্বামীর জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন ওহী বাহক ফেরেশতা জিবরাঈল আলাইহিসালাম তাঁর স্বামীকে এসে বললেন, "যখন তিনি আপনার কাছে পৌছবেন তখন আপনি আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং আমার (জিবরাঈল আ.) পক্ষ থেকে তাকে সালাম জানাবেন।"
.
সুবহানআল্লাহ, তাকে কে সালাম জানাচ্ছেন? স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওতা'আলা এবং বার্তাবাহক ফেরেশতা জিবরাঈল আলাইহিসালাম।
শুধু সালাম জানিয়েই শেষ নয় জিবরাঈল আলাইহিসালাম তাকে জান্নাতের একটা প্রসাদের সুসংবাদ দেন [৩]।
সেই প্রসাদের নাম কাসাব। সেখানে থাকবেনা কোনো ধরণের কোলাহল, থাকবেনা কোনো ধরণের দুঃখ-ক্লেশ। যার অভ্যন্তর ভাগ ফাঁকা-মোতি (Pearls) দ্বারা তৈরি করা হয়েছে।
.
তাঁর স্বামী যখন সত্য প্রচার করা শুরু করলেন, স্বামীর গোত্র যখন তাঁর এই ধরণের প্রচারণার বিরোধীতা করেন, তখন তিনিই প্রথম তাঁর স্বামীকে সত্যায়ন করেন, তাঁর স্বামীর প্রচারিত দ্বীনকে সত্য বলে স্বীকৃতি দেন।
স্বামীর সাথে ২৫ বছর সাংসারিক জীবন অতিবাহিত করার পর তিনি মারা যান। তিনি মারা যাবার পর তাঁর স্বামী আরো বিয়ে করেন। স্বভাবতই এক সতীন আরেক সতীনকে ঈর্ষা করে।
তাঁর এক সতীন তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেন, আমি আমার স্বামীর অন্য কোনো স্ত্রীকে নিয়ে এতোটা ঈর্ষা করিনা, যতোটা তাকে নিয়ে করি। যদিও আমার স্বামীর সাথে আমার বিয়ের ৩ বছর আগে তিনি মারা যান, কিন্তু আমার স্বামী তাঁর কথা অনেক বেশি স্মরণ করতেন [৪]।
.
শুধু তাই নয়। তাঁর স্বামী তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেন,
"সমগ্র নারীদের মধ্যে ইমরানের কন্যা মারইয়াম হলেন সর্বোত্তম আর নারীদের সেরা হলেন তিনি।" [৫]
.
তাঁর সময়কার সবচেয়ে সম্পদশালী হওয়া সত্ত্বেও বিয়ে করেছিলেন আর্থিক সামর্থ্যের দিক থেকে তাঁর চেয়ে কম সামর্থ্যবান একজন যুবককে। যে যুবক মেষ চড়াতেন [৬]। সেই মেষ চড়ানো যুবককে বিয়ে করার জন্যই তিনি পরিচয় লাভ করেন 'Mother of the Believers' নামে।
ঘ.
যে মিস আখিরাহ'র কথা বলা হচ্ছে, তিনি হলেন হযরত খাদিজা বিনত খুওয়াইলিদ রাদিয়াল্লাহু আনহা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয়তমা স্ত্রী, মু'মিনদের মা।
তাঁর প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভালোবাসা ছিলো এরকম যে, তাঁর মৃত্যুর পর কখনো কোনো ছাগল জবাই করা হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার গোশত উপহারস্বরূপ খুঁজে খুঁজে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার বান্ধবীদেরকে দিতেন [৭]।
.
নবুওয়াতের তৃতীয় বছরে কুরাইশরা যখন তাদেরকে বয়কট করে তখন তাঁরা 'শিয়াবে আবু তালিবে' আশ্রয় গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহাও সেখানে অবস্থান করেন। প্রায় তিনটি বছর দুর্ভিক্ষের মধ্যে সেখানে অতিবাহিত হয়। এই সময়ে গাছের পাতা খাওয়া ছাড়া জীবনধারণের আর কোনো উপায় তাদের কাছে ছিলো না। ছোটবেলা থেকে ধনী পরিবারে বড় হওয়া সত্ত্বেও খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা হাসিমুখে ঐ সংকটপূর্ণ অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে থেকে কাটান।
.
বিয়ের পর তিনি তার সমস্ত সম্পত্তি রাসূলুল্লাহর হাতে তুলে দেন এমনকি তার প্রিয় দাস যায়েদ ইবনে হারেসাকেও (রাদিয়াল্লাহু আনহু)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ভালোবেসে যায়েদকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে দেন।
ঙ.
গত বছর ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী মহিলা ছিলেন ফ্রান্সের লিলিয়ান বেট্টেনকোর্ট। ২০১৭ সালের ২১ শে সেপ্টেম্বর লিলিয়ান বেট্টেনকোর্টের মৃত্যুর পর বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী মহিলার মুকুট পরে আছেন এলিস ওয়াল্টন। তার মৃত্যুর পর হয়তো আরেকজন এসে Wealthiest Women in The World এর মুকুটটা পরবেন।
.
ঠিক তেমনি মিস ওয়ার্ল্ড/মিস ইউনিভার্স এর মুকুট বছর ঘুরে একজনের পর আরেকজনের মাথায় উঠে। মিস ওয়ার্ল্ড যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের বয়স বিশ্লেষণ করে দেখলাম ১৭ থেকে ২৬ বছরের মধ্যেই সবাই বিশ্ব সুন্দরীর খেতাব পেয়েছেন।
.
বয়স বাড়ার সাথে সাথে সবার সৌন্দর্য হারিয়ে যায়। বিশ্ব সুন্দরী কিংবা দেশ সেরা সুন্দরী হয়েও পারিবারিক জীবনে অনেকেই সুখী হতে পারেন নি। কেউ পেয়েছেন ডিভোর্স, আর কেউবা ডিভোর্সের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে করেছেন আত্মহত্যা।
.
সময়ের সাথে বিশ্বসেরা সুন্দরী যখন বৃদ্ধা হন তখন তার দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী যখন দেউলিয়া হন তখন তার নিজ ঘরেও তার আশ্রয় হয়না।
.
আর খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা তার সমস্ত সম্পদ ব্যয় করেছেন রাসূলুল্লাহর খিদমতে। আর আল্লাহ তাকে দিয়েছেন জান্নাতের মণিমুক্তা খচিত প্রসাদ। মু'মিনরা শ্রদ্ধাভরে তাকে স্মরণ করে। তাঁর নাম শুনে পড়ে রাদিয়াল্লাহু আনহা / আল্লাহ তাঁর উপর সন্তুষ্ট হন। জান্নাতে তিনি পাবেন কাসাব নামক প্রসাদ আর পৃথিবীতে মু'মিনরা তাকে 'মা' বলে সম্ভোধন করে।
রেফারেন্স:
১। বিবিসি, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭। লিংক কমেন্টে।
২। লিংক কমেন্টে।
৩। সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩৮২০।
৪। সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩৮১৭।
৫। সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩৪৩২।
৬। সহিহ বুখারী, হাদিস নং ২২৬২।
৭। জামে' আত-তিরমিজি, হাদিস নং ২০১৭।

















প্রতিটা মুহূর্ত অতিবাহিত হোক ইবাদতে
মাহিন মাহমুদ

ভালো কাজের জন্য ইচ্ছেটাই যথেষ্ট। কিছু কিছু ভালো কাজ আছে, যেগুলোর জন্য দোয়া-কালাম মুখস্থ করারও প্রয়োজন হয় না।
যেমন,
খাবার তো প্রতিদিনই খাই। কম পক্ষে তিনবেলা। খাওয়ার সময় দস্তরটা বিছিয়ে নিতে পারি একটু সচেতন হলেই। একটা সুন্নাত আদায় হয়ে গেল!
ঘরে বা মসজিদে প্রবেশ করব? ডান পা'টা আগে প্রবেশ করাই! বের হবার সময় একটু সচেতন হলেই বাম পা'কে বের করা সম্ভব।
টয়লেটে যাব? বাম পা আগে দিই!
বের হতে ডান পা!
রাস্তায় চলছি? ডান দিক দিয়ে হাঁটি!
দৃষ্টিটা একটু হেফাজত করার চেষ্টা, আমাকে অনেক বিপদ থেকে বাঁচাতে পারে।
পকেটে খুচরা টাকা রাখা কোনো ব্যপারই না। বাদাম, চিপস অথবা চায়ের সঙ্গে 'টা' খেতে গিয়ে কত টাকাই তো খরচ করি। একটু চেষ্টা আর সদিচ্ছা থাকলেই হলো। রাস্তাঘাটে কত অসহায় মানুষ আছে। পকেটের খুচরা অংশটা দিয়ে অনায়াসেই তাদের অসহায়ত্ব ঘুচাতে পারি!
ব্যবসায়ীরা একটা কাজ নিয়মিত করেই দেখুন না! বরকত হবেই হবে, ইনশাআল্লাহ।
কাজটা হলো, প্রতিদিন দোকান খুলে নির্দিষ্ট কিছু টাকা আলাদা করুন। এই টাকাটা ভিক্ষুকদের জন্য বরাদ্দ রাখুন। এতে হাত দিবেন না। ভিক্ষুক না পেলেও জমিয়ে রাখুন। পরদিন আবার নির্দিষ্ট একটা অংশ। অপেক্ষাকৃত দ্বীনদার, গরীব যারা আছেন, এই অংশটা তাদের হাতে তুলে দিন।






পশ্চিমা সভ্যতার কদর্য চেহারা
এম মাহবুবুর রহমান

উন্নত কাফির দেশগুলোর সামাজিক সংস্কৃতি, সুবিধা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ভাল। সোশ্যাল জাস্টিস অ্যাপারেন্টলি আছে কিছু একসেপশন ছাড়া। এগুলো দেখে প্রভাবিত না হওয়ার কিছু নেই। কে চায় এত সুযোগ-সুবিধা ছেড়ে-ছুড়ে নোংরা দেশে থাকতে ?
তবে লক্ষ্য করলে দেখবেন কাফির দেশগুলো এবং তাদের বাসিন্দারা সুযোগের অভাবে ভাল। সুযোগমতো এদের আসল চেহারা বের হয়ে আসে। যেমন ক্রোয়েশীয়রা ইংল্যান্ড এর বিপক্ষে জয় এর পর স্রেব্রেনিৎসার গণহত্যা নিয়েও উল্লাস করতে দেখা গেছে। বসনিয়ান সার্বরা তো অনেকে বিশ্বাস-ই করে না স্রেব্রেনিৎসায় ৮০০০+ পুরুষদের গণহত্যা করা হয়েছিল। সার্বিয়ানদের অনেকেই সেই কসাই জেনারেল মিলাদিচ এবং প্রেসিডেন্ট রাদোভান কারাদিচকে হিরো-ই মনে করে, অনেক সাক্ষাৎকারে দেখা গেছে তারা তাদের প্রটেক্ট করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
সাদা আমেরিকানদের দেখুন, এদের চেহারাও বের হয়ে আসে আদিবাসী আমেরিকানদের বেলায়, ব্ল্যাকদের বেলায়। ফ্রেঞ্চ, ব্রিটিশ, বেলজিয়ান - এদের সবারই কালো ইতিহাস আছে এবং একটা সিগনিফিক্যান্ট জনগণ তাদের সেই ইতিহাসকে অন্ধকারের বদলে তাকে গৌরব হিসেবেই দেখে। চাইনিজদের মনে হয় এরা সাতে-পাঁচে নেই, কিন্তু উইঘুর মুসলিমদের প্রতি এদের আচরণ দেখুন, সমীকরণ ভিন্ন।
কিছু মানুষ আছে তারা ফিতরাতগত ভাবেই ভাল, মুসলিম বা অমুসলিম হোক, কিন্তু এদের সংখ্যা নগণ্য। বাকি ভাস্ট মেজরিটির অন্তরে আছে ঘুমিয়ে থাকা দানব, বিদ্বেষের আগুন। কিন্তু আমরা তাদের বাইরেরটা দেখেই গলে যাই, তাদের গুণগান গাইতে গাইতে ফেনা তুলে ফেলি।

আসিফ আদনানঃ পশ্চিমা সোশ্যাল জাস্টিস অ্যাবসোলিউট অর্থে সোশ্যাল জাস্টিস না। এটার উল্টো পিঠও আছে। ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে যৌন বিকৃতি, লিঙ্গ বিকৃতিকে অনুমোদন দেয়া। নারী অধিকারের নামে গর্ভপাতের মাধ্যমে কোটি কোটি শিশু হত্যা করা, বাক স্বাধীনতার নামে আল্লাহর ও তাঁর রাসূল (আলাইহিমুস সালাতু ওয়াস সালাম) -দের ও তাঁর দ্বীনকে আক্রমণ করার স্বাধীনতা, অশ্লীলতা ও ফাহিশাতকে অনুমোদন দেয়া, নফসের উপাসনাকে স্বাধীনতা বলা - এগুলোও এই "সোশ্যাল জাস্টিসের" অংশ।
এদের একটা ভালো গভর্নিং সিস্টেম আছে (রেলেটিভ টু থার্ড অ্যান্ড সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রিস) নইলে এক-দেড়শো বছর আগেই এরা মাসে পর মাস গোসল না করে থাকতো। নিজেরা রাস্তায় কামড়াকামড়ি করতো। কয়েক দশক আগে রাস্তায় পাবলিকলি মানুষকে লিঞ্চ করা হতো। গুড এনাফ সিস্টেম হলে কুকুরকেও ডিসিপ্লিন করা যায়। মানুষ পশুই - অনলি অ্যায গুড অর অ্যায সফিস্টিকেইটেড অ্যায দা সিস্টেম।

বাঙালি সিস্টেমের কিছু সুফল দেখে জাতের ওপর, দেশের ওপর মাহাত্ম্য অর্পন করতে চায়।





ইসলামিস্টদের গণতান্ত্রিক পরিণতি
মিফতাহ আয যামান

গণতন্ত্রিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ কারী ইসলামপন্থীদের (লং টার্মে) মোটা দাগে দুইরকম পরিণতি হতে পারে, এবং এই দুইরকম পরিণতিই হয়ে আসছে।
.
১। তারা ধৈর্য হারিয়ে গণতন্ত্রকে ছেড়ে অস্ত্রের দিকে ঝুঁকবে, এবং লং টার্মে অস্ত্র ব্যবহারের যুতঃসই পরিকল্পনা না থাকার দরূণ ব্যর্থ হবে।
.
২। তারা আরো বেশি গণতান্ত্রিক হবে। তারা ইসলামী গণতন্ত্রের কথা বললেও, তারা একচুয়ালি পালন করবে গণতান্ত্রিক ইসলাম। সেটা হলে গণতন্ত্রের প্রতি নিজের মূল্যবোধ নিয়ে আত্মসমর্পণের হার উপর্যুপোরী বাড়তে থাকবে। এবং তারা ব্যর্থ হবে।
.
কারণ গণতন্ত্রিক পদ্ধতি একটি সেকুলার সিস্টেমকে ইস্টাবলিশ করার জন্যই ডিসাইন করা হয়েছে। আপনি যদি গণতন্ত্রকে শূরার মতও মনে করেন, দেখবেন দিন শেষে আপনার শূরায় কোন মুজাহিদ নেই, কোন রাব্বানি 'আলিম নেই। পাশে পাবেন কেবল, পেটি বুর্জোয়া 'আলিম, মূর্খ কমিউনিস্ট, যায়ানিস্ট স্কুল হতে গ্রাজুয়েশন করা সেকুলার, আর শান্তিনিকেতনের বাণী শোনানো আরএসএস সদস্যদের।
.
আপনি তো গণতন্ত্র করতে গিয়ে কোন মুজাহিদ বাহিনীর জন্য অস্ত্র-সস্ত্র সংগ্র করেন নি। অস্ত্র, প্রশিক্ষণ সব কিছু আল্লাহ তা'আলা ফরয করার পরও আপনি সেগুলোকে হারাম ভেবে এসেছেন। কিন্তু তারা ঠিকই ক্রুসেড বাহিনী তৈরী করে রেখেছে। আপনার হাতে অপশন দুইটা, হয় তাদের হয় বিনা যুদ্ধে মারা পড়বেন। অথবা তাদের একজন হয়ে মনে মনে ইসলাম কায়েম করতে থাকবেন। আর অধিকাংশ সময়েই এই মনে মনে ইসলাম আর বাহিরে বাহিরে অভিনয় করতে থাকার পরিণতি এমন হয় যে, কোনটা অভিনয় আর কোনটা আসল সেটাই ভুলে যাওয়া।

No comments:

Post a Comment