আমেরিকান অর্থনীতি
আমেরিকার প্রতি অনেকের অগাধ বিশ্বাস এবং রীতিমত দিনরাত পুজো করেন। তবে বাস্তবতা হলো আমেরিকার বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা একেবারে শেষ পর্যায়ের দিকে এসে ঠেকেছে। বিশেষ করে ৯/১১ এর পরে, অর্থনৈতিক মন্দাসহ সব মিলিয়ে আমেরিকাকে একদম পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে এসে ঠেকিয়েছে৷
.
একটা দেশ মূলত দুইভাবে ঋণে পড়তে পারে। এক. রাষ্ট্রায়ত্ত যেসব প্রতিষ্ঠান আছে সেসব প্রতিষ্ঠান সচল রাখতে সরকারের নিজের পক্ষ থেকে ভর্তুকি দিয়ে, জনগণের কাছ থেকে ট্যাক্স একটু কম নিয়ে। দুই. যদি আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়ে যায়। যেমনঃ অলিম্পিক আয়োজন করে গ্রিস নিজের দেশে ইচ্ছেমত টাকা ব্যয় করেছিলো যার ফলে এই দেশও কয়েক বছর আগে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলো। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মধ্যে গ্রিসের অবস্থাই সবচেয়ে খারাপ।
.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগে ১৯৩৯ সালে আমেরিকার ঋণ ছিলো মাত্র ৪০ বিলিয়ন ডলার, যা যুদ্ধ শেষে ১৯৪৫ সালে ২৭১ বিলিয়ন ডলারে ঠেকে। আমেরিকার সৃষ্টির পর থেকে আজ পর্যন্ত সে শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি সময় কাটিয়েছে যুদ্ধে। বাকি শতকরা ১০ ভাগ শান্তিতে, মানে কারো সাথে যুদ্ধ না করে কাটিয়েছে। স্বঘোষিত মোড়ল হিসেবে পৃথিবীর সকল প্রান্তের ছোটো বড় যুদ্ধে ঠিকাদারীর দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছে আমেরিকা। সামরিক খাতে ব্যয় করতে গিয়ে আমেরিকা ঋণে পড়েছে, ঋণের পরিমাণ বেড়েছে।
.
তবে সব কিছু ছাপিয়ে ৯/১১ এর পরে তাদের সামরিক খাতে ব্যয় বহুগুণে বেড়েছে৷ ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান সব মিলিয়ে প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের মত ব্যয় হয়ে গিয়েছে (অনেকে অবশ্য ১.৯ ট্রিলিয়ন বলে থাকেন। তবে সংখ্যাটা যে মিলিয়ন, বিলিয়ন নয় বরং ট্রিলিয়ন ডলারের ঘরে তা সকলে একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছে)।
.
বর্তমানে প্রায় নিয়মিত ভিত্তিতে হারিকেন, অগ্ন্যুৎপাতের দেখা যাচ্ছে। সেখানেও বেশ ভালো পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে আমেরিকার। আগে থেকে লোকজন সরিয়ে মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব হলেও অবকাঠামোগত নানা ক্ষতি আছেই৷ এসব খাতে টাকা খরচ করতে গিয়ে আবার বেকার সমস্যা বাড়ছে। যেটা অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় আমেরিকাতে বেশি।
.
.
প্রশ্ন হল একটা দেশে ঋণের ফাঁদে পড়ার শুরু কিভাবে হয়?
.
মনে করুন, দেশের সরকার বিভিন্ন খাতে টাকা ব্যয় করছে নিজের পকেট থেকে। জনগণের কাছ থেকে যেই ট্যাক্স নিচ্ছে তাতে সব পুষিয়ে উঠতে পারে না। আবার বাংলাদেশের মতো গরিব দেশগুলোতে আছে দুর্নীতির কালো ছায়া। আবার যখন সরকার প্রতি অর্থবছরে ঘাটতি বাজেট পেশ করে তখন তাদের সেই টাকা আউটসোর্সিং করা লাগে বিভিন্ন খাত থেকে। এই যে, এখন থেকেই শুরু হলো "ঋণ নেওয়া" এর হিসাব।
.
অনেকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন, টাকা ঘাটতি থাকলে টাকা ছাপাও। যত ইচ্ছা তত ছাপাও। টাকা ছাপালে দুই ধরণের সমস্যা হয়। এক. গ্যালোপিং ইনফ্লেশান (Galloping inflation)। এর মাধ্যমে আপনার নিত্য প্রয়োজনীয় মালামালের উপর মাসিক ১০% করে দাম বাড়তে থাকবে। মানে মুদ্রাস্ফীতির সূচনা হবে। দুই. এটা হল হাইপারইনফ্লেশান (hyperinflation)। এই মুদ্রাস্ফীতি আরো ভয়ানক। এক্ষেত্রে জিনিস পত্রের দাম বেড়ে যাবে ৫০%। অর্থাৎ, ১০০ টাকা দিয়ে আগে যেই এক ডজন ডিম পেতেন এখন তা ১৫০ টাকা হয়ে যাবে। এভাবে প্রতিমাসে ৫০ টাকা করে বাড়তে থাকলে ভাবুন বছর শেষে এক ডজন ডিম কিনে খাওয়ার মতো কয়জন মিডল ক্লাস ফ্যামিলির মানুষ খুঁজে পাবেন? জিম্বাবুয়ের উদাহরণ তো চোখের সামনেই আছে।
.
সেজন্যে আমেরিকা এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে বাজারে অনেকগুলো বন্ড ছাড়লো। ধনী দেশগুলো টাকা দিয়ে এই বন্ডগুলো কিনতে থাকলো। আমেরিকা টাকা পেল আর ধনী দেশগুলো ভালো একটা সুদের হারে বন্ডগুলো কিনে নিলো। উল্লেখ্য, আমেরিকার বন্ডের বেশ বড়ো ক্রেতা হলো চায়না। তাই, কথায় কথায় চায়নাকে মেরে উড়িয়ে দেওয়ার যেসব হুমকি আমেরিকা দেয় ওগুলো ফাঁকা বুলি ছাড়া আর কিছু না। কারণ, আমেরিকার কাছে চায়না যদি বন্ডের টাকা ফেরত চেয়ে বসে আমেরিকার মাথায় বাজ পড়বে। কারণ, ঐ টাকা আমেরিকার কাছে এখন নেই। আর টাকা ছাপাতে গেলে কী হবে তা আগেই বলা হয়েছে। আমেরিকার সাধারণ জনগণ এই ইনফ্লেশান কখনই মেনে নিবে না। তখন আমেরিকাই উলটো গৃহযুদ্ধের কবলে পড়ে যাবে।
.
আমেরিকার বর্তমান ঋণ প্রায় ২১ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার। আর এসব বন্ডের অর্ধেকের মতো ক্রেতা আমেরিকার জনগণ। আর বাকি অর্ধেক কিনেছে বাহিরের দেশের লোকজন। তবে সময় যত বাড়ছে এই ঋণ তত বাড়ছে। আবার এই বন্ড যারা কিনেছে তাদের ঋণের টাকা সুদসমেত কিন্তু ফেরত দিতে হচ্ছে একটু একটু করে। এই টাকা আসছে আমেরিকার জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকেই। অথচ জনগণ ট্যাক্সের টাকা দেয় মূলত তাদের নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তির জন্যে৷ সেই সুবিধা তারা পাচ্ছে না, যেহেতু ট্যাক্সের বেশ ভালো একটা অংশ এই বন্ডের টাকার ঋণ শোধে যাচ্ছে। ঋণ তো প্রতিনিয়ত বাড়ছে সুদের কারণে। এখানে উল্লেখ্য যে, অনেকে বলে থাকেন সুদ মানেই তো লাভ। তাদের জন্যে এখানে শিক্ষা আছে। কিভাবে সুদের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে কল্যাপ্স নেমে আসছে৷
.
ঋণ দুইভাবে আবার কমানো যায়। এক. ঋণ যদি মাফ করে দেওয়া হয়। আমেরিকার কাছে টাকা পাবে আর সেই টাকা মাফ করে দেবে এমন উদার মানুষ এখন নেই৷ অতএব, এই অপশান বাদ। দুই. এইটাই আসল অপশান। টাকা যা নিয়েছে, তা ফেরত দিবে সুদসহ। খেয়ে না খেয়ে কোথা থেকে দিবে তা দেখার বিষয় ইনভেস্টরদের না। আমেরিকা কোথা থেকে দিবে সেটা সে জানে।
.
কিন্তু জনগণ তো আর ট্যাক্স বাড়াবে না৷ একই সাথে তারা স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সেবা থেকেও বঞ্চিত হতে চাইবে না। কারণ, ইতোমধ্যেই তারা অনেক ট্যাক্সের টাকা গুনছে৷
.
এখন ডেমোক্র্যাট থেকে রিপাবলিকান সরকারে পরিবর্তন বা ভাইস ভার্সা হলে জনগণ নির্বাচনের সময় কাজের প্রতিশ্রুতি শুনতে চায়। মৌলিক সুবিধাগুলোর ক্ষেত্রে কোন সরকার বেশি সুবিধা দেবে সেটা দেখে এবং সেভাবে ব্যালট বক্স সাজায়। এখন কোনো সরকার যদি জাতীয় ঋণ শোধ করার জন্যে জনগণের উপর ট্যাক্স বাড়ায়, মৌলিক সুবিধাদি কমিয়ে দেয় তবে সেই সরকার পরের ইলেকশানে আর আসছে না, এটা প্রায় নিশ্চিত। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে আবার রাজনৈতিক ইস্যু চলে আসছে। অবশ্য ইয়াহুদী লবিং ইলেকশানে ফান্ড রেইজিং এ বড়ো ভূমিকা রাখলেও অন্তত গরিব দেশগুলোর মতো ইলেকশান রিগ হয় না এখানে। যা হওয়ার আগেই হ্যাকিং ট্যাকিং করে কাজ সেরে ফেলা হয়। তারপরেও পাবলিক সেন্টিমেন্টের দাম থাকে।
.
কিন্তু বিশ্ব মানচিত্রে আমেরিকাকে টিকিয়ে রাখতে তো এই ঋণ শোধ করা লাগবেই। তাহলে এই টাকা আসতে পারে জনগণের ট্যাক্স থেকে, সাময়িকভাবে মুদ্রাস্ফীতির চাপ সহ্য করে অথবা বড়ো বড়ো কর্পোরেশন, প্রাইভেট অর্গানাইজেশনের সিইও এর ফান্ডিং এর টাকাতে। কিন্তু, যাদের টাকায় আমেরিকান সরকারের ইলেকশান ক্যাম্পেইন চলে সেসব লবিস্টদের কাছে সরকার টাকা চাইতে ভয় পায়, মোদ্দা কথা টাকা চাইবে না। আবার, রাজনীতিবিদরাও দিবেন না এই টাকা৷ তাহলে এই টাকা বাধ্য হয়েই সাধারণ জনগণকে শোধ করা লাগবে৷ এর ফলে আমেরিকাতে বেকার বাড়ছে, গৃহহীন মানুষও বাড়ছে, জীবনযাত্রার মান বাড়ার ফলে খুব ছোটো ঘরেই গুটিশুটি হয়ে অনেককে থাকা লাগছে।
.
আমেরিকা যদি এই ঋণ শোধ করেও ফেলে (যদিও এটা অসম্ভব) তারপরেও আবার কয়েক বছরের মধ্যে আমেরিকা আবার লোনে পড়ে যাবে৷ কারণ, আমেরিকা "ওয়ার অন টেরর" এ একদম জান প্রাণ দিয়েই নেমেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো লস প্রজেক্ট হলো আফগানে তালিবান হঠানোর ব্যাপারটা৷ সিআইর এর ওয়ার ভেটেরানরাও এক বাক্যে স্বীকার করেছেন আফগানিস্তানে হামলা ছিল তাদের সবচেয়ে বড় ভুল। নগদ টাকা তো গিয়েছেই, আবার সেখান থেকে যেসব সৈনিক বেদম মার খেয়ে ফিরে আসছে তারা ফিরে আসছে নানা মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে। এদের আবার দীর্ঘকালব্যাপি ক্যাম্পে রেখে চিকিৎসা করানোর একটা খরচ আছে৷ শারীরিক চিকিৎসার খরচ আছে।
.
তবে আমেরিকা এ থেকে মুক্ত হতে পারবে না। কারণ, আমেরিকা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ আর্মস রপ্তানিকারক দেশ। আবার, আর্মস তৈরি করে এমন ৫ টি বড়ো কোম্পানির মধ্যে ৪ টিই আমেরিকার। বাকিটা যুক্তরাজ্যের৷ তাই, এই আর্মস বিজনেস টিকিয়ে রাখতে হলেও সবসময় যুদ্ধ টিকিয়ে রাখা লাগবে।
.
.
এই যুদ্ধগুলো আবার দুই প্রকার। একটা হলো রাজনৈতিক স্বার্থের যুদ্ধ। যেমনঃ ডেমোক্রেসি ভার্সাস সোশ্যালিজম। সম্ভাব্য ক্ষেত্র আমেরিকা ভার্সাস রাশা ব্লক। তবে এই যুদ্ধ এখন তেমন দৃশ্যমান না। আরেকটা হলো, রিলিজিয়াস আইডিওলোজিক্যাল ওয়ার। যেটা মুসলিম দেশগুলোতে হচ্ছে। আমেরিকা নিজেও চাচ্ছে এই যুদ্ধ শেষ না হোক। কারণ, পোকামাকড়ের যখন মৃত্যু যখন ঘনিয়ে আসে তখন তা নিজ থেকেই আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার জন্যে উড়ে চলে আসে।
আমেরিকার প্রতি অনেকের অগাধ বিশ্বাস এবং রীতিমত দিনরাত পুজো করেন। তবে বাস্তবতা হলো আমেরিকার বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা একেবারে শেষ পর্যায়ের দিকে এসে ঠেকেছে। বিশেষ করে ৯/১১ এর পরে, অর্থনৈতিক মন্দাসহ সব মিলিয়ে আমেরিকাকে একদম পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে এসে ঠেকিয়েছে৷
.
একটা দেশ মূলত দুইভাবে ঋণে পড়তে পারে। এক. রাষ্ট্রায়ত্ত যেসব প্রতিষ্ঠান আছে সেসব প্রতিষ্ঠান সচল রাখতে সরকারের নিজের পক্ষ থেকে ভর্তুকি দিয়ে, জনগণের কাছ থেকে ট্যাক্স একটু কম নিয়ে। দুই. যদি আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়ে যায়। যেমনঃ অলিম্পিক আয়োজন করে গ্রিস নিজের দেশে ইচ্ছেমত টাকা ব্যয় করেছিলো যার ফলে এই দেশও কয়েক বছর আগে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলো। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মধ্যে গ্রিসের অবস্থাই সবচেয়ে খারাপ।
.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগে ১৯৩৯ সালে আমেরিকার ঋণ ছিলো মাত্র ৪০ বিলিয়ন ডলার, যা যুদ্ধ শেষে ১৯৪৫ সালে ২৭১ বিলিয়ন ডলারে ঠেকে। আমেরিকার সৃষ্টির পর থেকে আজ পর্যন্ত সে শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি সময় কাটিয়েছে যুদ্ধে। বাকি শতকরা ১০ ভাগ শান্তিতে, মানে কারো সাথে যুদ্ধ না করে কাটিয়েছে। স্বঘোষিত মোড়ল হিসেবে পৃথিবীর সকল প্রান্তের ছোটো বড় যুদ্ধে ঠিকাদারীর দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছে আমেরিকা। সামরিক খাতে ব্যয় করতে গিয়ে আমেরিকা ঋণে পড়েছে, ঋণের পরিমাণ বেড়েছে।
.
তবে সব কিছু ছাপিয়ে ৯/১১ এর পরে তাদের সামরিক খাতে ব্যয় বহুগুণে বেড়েছে৷ ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান সব মিলিয়ে প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের মত ব্যয় হয়ে গিয়েছে (অনেকে অবশ্য ১.৯ ট্রিলিয়ন বলে থাকেন। তবে সংখ্যাটা যে মিলিয়ন, বিলিয়ন নয় বরং ট্রিলিয়ন ডলারের ঘরে তা সকলে একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছে)।
.
বর্তমানে প্রায় নিয়মিত ভিত্তিতে হারিকেন, অগ্ন্যুৎপাতের দেখা যাচ্ছে। সেখানেও বেশ ভালো পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে আমেরিকার। আগে থেকে লোকজন সরিয়ে মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব হলেও অবকাঠামোগত নানা ক্ষতি আছেই৷ এসব খাতে টাকা খরচ করতে গিয়ে আবার বেকার সমস্যা বাড়ছে। যেটা অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় আমেরিকাতে বেশি।
.
.
প্রশ্ন হল একটা দেশে ঋণের ফাঁদে পড়ার শুরু কিভাবে হয়?
.
মনে করুন, দেশের সরকার বিভিন্ন খাতে টাকা ব্যয় করছে নিজের পকেট থেকে। জনগণের কাছ থেকে যেই ট্যাক্স নিচ্ছে তাতে সব পুষিয়ে উঠতে পারে না। আবার বাংলাদেশের মতো গরিব দেশগুলোতে আছে দুর্নীতির কালো ছায়া। আবার যখন সরকার প্রতি অর্থবছরে ঘাটতি বাজেট পেশ করে তখন তাদের সেই টাকা আউটসোর্সিং করা লাগে বিভিন্ন খাত থেকে। এই যে, এখন থেকেই শুরু হলো "ঋণ নেওয়া" এর হিসাব।
.
অনেকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন, টাকা ঘাটতি থাকলে টাকা ছাপাও। যত ইচ্ছা তত ছাপাও। টাকা ছাপালে দুই ধরণের সমস্যা হয়। এক. গ্যালোপিং ইনফ্লেশান (Galloping inflation)। এর মাধ্যমে আপনার নিত্য প্রয়োজনীয় মালামালের উপর মাসিক ১০% করে দাম বাড়তে থাকবে। মানে মুদ্রাস্ফীতির সূচনা হবে। দুই. এটা হল হাইপারইনফ্লেশান (hyperinflation)। এই মুদ্রাস্ফীতি আরো ভয়ানক। এক্ষেত্রে জিনিস পত্রের দাম বেড়ে যাবে ৫০%। অর্থাৎ, ১০০ টাকা দিয়ে আগে যেই এক ডজন ডিম পেতেন এখন তা ১৫০ টাকা হয়ে যাবে। এভাবে প্রতিমাসে ৫০ টাকা করে বাড়তে থাকলে ভাবুন বছর শেষে এক ডজন ডিম কিনে খাওয়ার মতো কয়জন মিডল ক্লাস ফ্যামিলির মানুষ খুঁজে পাবেন? জিম্বাবুয়ের উদাহরণ তো চোখের সামনেই আছে।
.
সেজন্যে আমেরিকা এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে বাজারে অনেকগুলো বন্ড ছাড়লো। ধনী দেশগুলো টাকা দিয়ে এই বন্ডগুলো কিনতে থাকলো। আমেরিকা টাকা পেল আর ধনী দেশগুলো ভালো একটা সুদের হারে বন্ডগুলো কিনে নিলো। উল্লেখ্য, আমেরিকার বন্ডের বেশ বড়ো ক্রেতা হলো চায়না। তাই, কথায় কথায় চায়নাকে মেরে উড়িয়ে দেওয়ার যেসব হুমকি আমেরিকা দেয় ওগুলো ফাঁকা বুলি ছাড়া আর কিছু না। কারণ, আমেরিকার কাছে চায়না যদি বন্ডের টাকা ফেরত চেয়ে বসে আমেরিকার মাথায় বাজ পড়বে। কারণ, ঐ টাকা আমেরিকার কাছে এখন নেই। আর টাকা ছাপাতে গেলে কী হবে তা আগেই বলা হয়েছে। আমেরিকার সাধারণ জনগণ এই ইনফ্লেশান কখনই মেনে নিবে না। তখন আমেরিকাই উলটো গৃহযুদ্ধের কবলে পড়ে যাবে।
.
আমেরিকার বর্তমান ঋণ প্রায় ২১ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার। আর এসব বন্ডের অর্ধেকের মতো ক্রেতা আমেরিকার জনগণ। আর বাকি অর্ধেক কিনেছে বাহিরের দেশের লোকজন। তবে সময় যত বাড়ছে এই ঋণ তত বাড়ছে। আবার এই বন্ড যারা কিনেছে তাদের ঋণের টাকা সুদসমেত কিন্তু ফেরত দিতে হচ্ছে একটু একটু করে। এই টাকা আসছে আমেরিকার জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকেই। অথচ জনগণ ট্যাক্সের টাকা দেয় মূলত তাদের নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তির জন্যে৷ সেই সুবিধা তারা পাচ্ছে না, যেহেতু ট্যাক্সের বেশ ভালো একটা অংশ এই বন্ডের টাকার ঋণ শোধে যাচ্ছে। ঋণ তো প্রতিনিয়ত বাড়ছে সুদের কারণে। এখানে উল্লেখ্য যে, অনেকে বলে থাকেন সুদ মানেই তো লাভ। তাদের জন্যে এখানে শিক্ষা আছে। কিভাবে সুদের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে কল্যাপ্স নেমে আসছে৷
.
ঋণ দুইভাবে আবার কমানো যায়। এক. ঋণ যদি মাফ করে দেওয়া হয়। আমেরিকার কাছে টাকা পাবে আর সেই টাকা মাফ করে দেবে এমন উদার মানুষ এখন নেই৷ অতএব, এই অপশান বাদ। দুই. এইটাই আসল অপশান। টাকা যা নিয়েছে, তা ফেরত দিবে সুদসহ। খেয়ে না খেয়ে কোথা থেকে দিবে তা দেখার বিষয় ইনভেস্টরদের না। আমেরিকা কোথা থেকে দিবে সেটা সে জানে।
.
কিন্তু জনগণ তো আর ট্যাক্স বাড়াবে না৷ একই সাথে তারা স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সেবা থেকেও বঞ্চিত হতে চাইবে না। কারণ, ইতোমধ্যেই তারা অনেক ট্যাক্সের টাকা গুনছে৷
.
এখন ডেমোক্র্যাট থেকে রিপাবলিকান সরকারে পরিবর্তন বা ভাইস ভার্সা হলে জনগণ নির্বাচনের সময় কাজের প্রতিশ্রুতি শুনতে চায়। মৌলিক সুবিধাগুলোর ক্ষেত্রে কোন সরকার বেশি সুবিধা দেবে সেটা দেখে এবং সেভাবে ব্যালট বক্স সাজায়। এখন কোনো সরকার যদি জাতীয় ঋণ শোধ করার জন্যে জনগণের উপর ট্যাক্স বাড়ায়, মৌলিক সুবিধাদি কমিয়ে দেয় তবে সেই সরকার পরের ইলেকশানে আর আসছে না, এটা প্রায় নিশ্চিত। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে আবার রাজনৈতিক ইস্যু চলে আসছে। অবশ্য ইয়াহুদী লবিং ইলেকশানে ফান্ড রেইজিং এ বড়ো ভূমিকা রাখলেও অন্তত গরিব দেশগুলোর মতো ইলেকশান রিগ হয় না এখানে। যা হওয়ার আগেই হ্যাকিং ট্যাকিং করে কাজ সেরে ফেলা হয়। তারপরেও পাবলিক সেন্টিমেন্টের দাম থাকে।
.
কিন্তু বিশ্ব মানচিত্রে আমেরিকাকে টিকিয়ে রাখতে তো এই ঋণ শোধ করা লাগবেই। তাহলে এই টাকা আসতে পারে জনগণের ট্যাক্স থেকে, সাময়িকভাবে মুদ্রাস্ফীতির চাপ সহ্য করে অথবা বড়ো বড়ো কর্পোরেশন, প্রাইভেট অর্গানাইজেশনের সিইও এর ফান্ডিং এর টাকাতে। কিন্তু, যাদের টাকায় আমেরিকান সরকারের ইলেকশান ক্যাম্পেইন চলে সেসব লবিস্টদের কাছে সরকার টাকা চাইতে ভয় পায়, মোদ্দা কথা টাকা চাইবে না। আবার, রাজনীতিবিদরাও দিবেন না এই টাকা৷ তাহলে এই টাকা বাধ্য হয়েই সাধারণ জনগণকে শোধ করা লাগবে৷ এর ফলে আমেরিকাতে বেকার বাড়ছে, গৃহহীন মানুষও বাড়ছে, জীবনযাত্রার মান বাড়ার ফলে খুব ছোটো ঘরেই গুটিশুটি হয়ে অনেককে থাকা লাগছে।
.
আমেরিকা যদি এই ঋণ শোধ করেও ফেলে (যদিও এটা অসম্ভব) তারপরেও আবার কয়েক বছরের মধ্যে আমেরিকা আবার লোনে পড়ে যাবে৷ কারণ, আমেরিকা "ওয়ার অন টেরর" এ একদম জান প্রাণ দিয়েই নেমেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো লস প্রজেক্ট হলো আফগানে তালিবান হঠানোর ব্যাপারটা৷ সিআইর এর ওয়ার ভেটেরানরাও এক বাক্যে স্বীকার করেছেন আফগানিস্তানে হামলা ছিল তাদের সবচেয়ে বড় ভুল। নগদ টাকা তো গিয়েছেই, আবার সেখান থেকে যেসব সৈনিক বেদম মার খেয়ে ফিরে আসছে তারা ফিরে আসছে নানা মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে। এদের আবার দীর্ঘকালব্যাপি ক্যাম্পে রেখে চিকিৎসা করানোর একটা খরচ আছে৷ শারীরিক চিকিৎসার খরচ আছে।
.
তবে আমেরিকা এ থেকে মুক্ত হতে পারবে না। কারণ, আমেরিকা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ আর্মস রপ্তানিকারক দেশ। আবার, আর্মস তৈরি করে এমন ৫ টি বড়ো কোম্পানির মধ্যে ৪ টিই আমেরিকার। বাকিটা যুক্তরাজ্যের৷ তাই, এই আর্মস বিজনেস টিকিয়ে রাখতে হলেও সবসময় যুদ্ধ টিকিয়ে রাখা লাগবে।
.
.
এই যুদ্ধগুলো আবার দুই প্রকার। একটা হলো রাজনৈতিক স্বার্থের যুদ্ধ। যেমনঃ ডেমোক্রেসি ভার্সাস সোশ্যালিজম। সম্ভাব্য ক্ষেত্র আমেরিকা ভার্সাস রাশা ব্লক। তবে এই যুদ্ধ এখন তেমন দৃশ্যমান না। আরেকটা হলো, রিলিজিয়াস আইডিওলোজিক্যাল ওয়ার। যেটা মুসলিম দেশগুলোতে হচ্ছে। আমেরিকা নিজেও চাচ্ছে এই যুদ্ধ শেষ না হোক। কারণ, পোকামাকড়ের যখন মৃত্যু যখন ঘনিয়ে আসে তখন তা নিজ থেকেই আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার জন্যে উড়ে চলে আসে।
No comments:
Post a Comment